আরেক রকম ● দশম বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২২ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

‘ফাদার সের্গিয়ুস ’ পাঠ

অমিয় দেব


তলস্তয়ের এই আখ্যান (প্রকাশ ১৮৯৮) আমি পড়েছি ইংরেজি অনুবাদে। ১৯৮৮-তে মস্কোর 'রাদুগা' প্রকাশিত এক তলস্তয় সংকলনে যাতে আমি ‘ইভান ইলিয়িচের মৃত্যু’-র অনুবাদও পড়েছিলাম। এর অনুবাদক হেলেন আল্টশুলার। এর কথা প্রথম শুনি সুবীর রায়চৌধুরীর কাছে। তিনি পড়েছিলেন ‘চতুরঙ্গ’ সকাশে, নারীর মোহে প্রলোভন সাপেক্ষ তপস্বীকে কেন্দ্রে রেখে। আমি আপাতত এর কাহিনি একবার পুরো মেলে দেখতে চাইছি মাত্র। গল্পটি সুদর্শন যুবক প্রিন্স স্তেপান কাসাৎস্কি-কে নিয়ে। সম্রাটের এক বাহিনীর সে অধিনায়ক; জার প্রথম নিকোলাস তার দয়িতপ্রতিম আদর্শ এবং সেও সম্রাটের প্রিয়পাত্র। সম্রাট সান্নিধ্যে যে - উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তার নিশ্চিত ছিল, এবং যে - বিবাহে তার আভিজাত্যের স্তরও উন্নীত হতে যাচ্ছিল, দুইই জলাঞ্জলি দিয়ে যে সে হঠাৎ - পিটার্সবুর্গ সমাজকে চমকে দিয়ে - সন্ন্যাসব্রত নিয়ে এক মঠে প্রবেশ করে বসল, তা-ই বস্তুত এই আখ্যানের প্রথম বাক্য।

কারণ ছিল। কাসাৎস্কি গুণী, কিন্তু অহংকারীও। এবং রাগী। তাছাড়া যে-সময়কার কথা তলস্তয় বলছেন, তখন উচ্চবর্গীয় রুশ পুরুষ তার নিজের একাধিক নারীতে আসক্তি অনৈতিক মনে না করলেও, নারীর একাধিক পুরুষে আসক্তি অনৈতিক মনে করত। যে-নারীকে পুরুষ ভালোবাসবে তাকে হতে হবে পবিত্র। এবার, সমাজের সবচেয়ে উঁচু মহলে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবার জন্য যে-সুলক্ষণাকে বেছে নিয়ে কাসাৎস্কি তার প্রেমে পড়েছিল, সেই কাউন্টেস মারী করৎকোভা গোড়ায় নিরুত্তাপ থাকলেও অচিরেই তাকে ভালোবেসে ফেলল। বাগ্‌দানও হল। কিন্তু মারীর অতীত? সে যে স্বয়ং জারের কামনার পাত্রী ছিল - কাসাৎস্কির নিকোলাই পাভলোভিচের। এক দুর্বল মুহূর্তে মারীর মুখে একথা শুনে সে রাগে ফেটে পড়ল। অতীত ধামাচাপা দিতে বুঝি তাকে ব্যবহার করা হচ্ছিল? জার না হলে তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে সে হয়তো খুনই করে ফেলত! অপার হতাশায় সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে তার শৈশবের ভগবানেই সে আশ্রয় নিল। পিটার্সবুর্গ গোল্লায় যাক, তার বাকি জীবন কাটুক মঠেই।

প্রথম যে-মঠে সে গেল, তার অধ্যক্ষই হয়ে উঠলেন তার সবসময়ের ‘গুরু’, তার ভালোমন্দের নিয়ন্তা। তিনি যে-বিধান দেবেন তাই তাকে মানতে হবে। প্রার্থনাই তার পূজা। আর সেই পূজাই তাকে করে যেতে হবে দিনের পর দিন, দিনের পর দিন, ক্লান্তি বা নির্বেদের কোনও ছিঁটেফোঁটাও তাতে প্রশ্রয় পাবে না। যে-জীবন সে ছেড়ে এসেছে তার কোনও ছায়াও আর পড়বে না তার উপর - তা মা-র মৃত্যুই হোক বা মারীর বিবাহই হোক। এমনি করে তিন বছর কাটিয়ে মঠবাসী কাসাৎস্কি যাজকপদে বৃত হল। এক নতুন নামও সে পেল, সের্গিয়ুস। আরো চার বছর কাটল এই প্রথম মঠেই। এর পর পদোন্নতি হলঃ বিশপ তাকে রাজধানীর কাছে এক মঠে পাঠিয়ে দিলেন। এখানে জাঁকজমক বেশি। এখানকার অধ্যক্ষও যেন রাজন্যসমাগম পছন্দ করেন। এক জেনারেলের সঙ্গে পরিচয়ের জন্য তাকে একদিন ডেকে পাঠালেন। এতে তার ক্ষোভ সের্গিয়ুস চেপে রাখতে পারলে না। তার ‘গুরু’ তথা প্রথম মঠের অধ্যক্ষ কিন্তু তার ক্ষোভে তারই আত্মাভিমান দেখতে পেলেন। ঈশ্বরে মনোনিবেশ নিয়েও এ তার আত্মতুষ্টি। তবে আরো পরীক্ষার সুযোগ এলঃ এক তৃতীয় মঠ সন্নিকটে নির্জন গুহাবাস। কৃচ্ছ্রসাধনও। তাতে ন্যূনতম ইন্দ্রিয়সুখের বালাই ছিল না।

এই নির্জনবাসের ষষ্ঠ বছরে এক পুরাণপ্রভব ঘটনা ঘটল। এক বিবাহবিচ্ছিন্ন স্বাধিকারচেতন সুন্দরী রমণী বন্ধুদের সঙ্গে বাজি রেখে সের্গিয়ুসের সঙ্গে রাত কাটাবে বলে তার গুহাদ্বারে এল। বাজি, কেননা ততদিনে যে এই সন্ন্যাসী প্রলোভনের অতীত তা প্রায় স্বতঃসিদ্ধ। অথচ প্রলোভন তো সাধনারই এক পরোক্ষ উপচার, কারণ তাতেই তার প্রমার সোপান। সন্ত আন্তনির কথা কি জানে না সের্গিয়ুস?সের্গিয়ুসেরও তো এক শয়তানকাম। (আরেক শয়তান তার আছে যা সন্ত আন্তনিদের ছিল না - হয়তো দুইই তার আসলে এক - তা ঈশ্বরেরই অস্তিত্ব বিষয়ক এক সংশয়।) সে এক গভীর রাত, বাইরে ভয়ানক ঠান্ডা, বরফ পড়ছে। বারবার দরজায় করাঘাত করে রমণী আশ্রয় চাইছে। উত্তর না পেয়ে এসে জানলায় দাঁড়াল যাতে সের্গিয়ুস তাকে দেখতে পায়। তার ‘কাতরতা’ দেখে তাকে অবশেষে ঢুকতে দিল সের্গিয়ুস, কিন্তু অচিরেই তার মিথ্যা ধরে ফেলল। প্রার্থনার পর প্রার্থনা সে করেই যাচ্ছে, আপন মনে, বিড়বিড় করে, কিন্তু নিষ্কৃতি কোথায়? এদিকে রমণী তার জাল বিছোচ্ছে। শেষ পর্যন্ত যে-কুড়ুলে সে জ্বালানি কাঠ চেরে তা দিয়ে তার বাঁ-হাতের তর্জনী কেটে টুকরো করে ফেলল। এবং তা যখন আবিষ্কার করল রমণী তখন তার চৈতন্য হল। অনুশোচনায় শুধু যে কাতর স্বরে বারবার ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিল তা নয়, তার জীবনটাই পাল্টে গেল - এক বছর পর সেও সন্ন্যাসিনী হয়ে এক মঠে ঢুকল।

আরো সাত বছর চলল ফাদার সের্গিয়ুসের নির্জনবাস। কিন্তু এই ঘটনার কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়াতে তা আর খুব নির্জন রইল না। লোকে তাঁর কাছে আসতে শুরু করল। দূরদূরান্ত থেকেও। গোড়ায় কেবল তাঁকে দেখতে, তাঁর আশীর্বাদ চাইতে। পরে প্রয়োজনেও, তাঁর প্রার্থনা থেকে সম্ভাব্য সিদ্ধিলাভ করতে। তাঁর স্পর্শে যদি রোগ সারে, অন্ধের দৃষ্টি ফোটে? কে জানে হয়তো তা কাকতাল, কিন্তু অলৌকিকে বিশ্বাস করতে তো পা বাড়িয়েই আছে মানুষজন। এদিকে, সংলগ্ন মঠ তাঁর এই খ্যাতির সদ্ব্যবহার শুরু করল। বেশি চাঁদা আসতে লাগল তাদের। ফাদার সের্গিয়ুসকে প্রতিষ্ঠান করে তুলতে কিছু আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাও করে দিল তারা। সেই কৃচ্ছ্রসাধন আর নেই। আর, ক্লান্তিকর হলেও এই খ্যাতির চাপ তাঁর ভালোই লাগছিল। তবে ঈশ্বর কি আড়ালে চলে যাচ্ছিলেন না? এবং শেষ পর্যন্ত প্রায় নির্দ্বিধায়, তাঁর কাছে সুস্থতাবিধানে আনীত এক ‘আতুর’ মেয়ের কামে সাড়া দিয়ে, শয়তানের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন ফাদার সের্গিয়ুস। করেই বুঝতে পারলেন আর সময় নেই, এবার ঋষির বেশে এই ‘সন্ত’ ‘সন্ত’ খেলা থেকে পালিয়ে গিয়ে তাঁর নির্দ্বিধ নিরীশ্বতার শাস্তি নিতে হবে মাথা পেতে। অর্থাৎ আত্মহনন। তার উপায় ভাবতে ভাবতে তিনি, চাষীর বেশে, সের্গিয়ুসত্ব পরিহার করে যে-নদীতীরে পৌঁচেছেন সেখানে শুয়ে তাঁর ছোটোবেলার স্মৃতি মেলে ধরলেন। বিশেষ করে মনে পড়ল সেই বোকাসোকা মেয়ে পাশেঙ্কাকে যে তাঁদের খেলার সঙ্গী হতে এসেছিল। বড়ো হয়েও সে হতবুদ্ধি-মতোই থেকে গেল। যার সঙ্গে বিয়ে হল সে তার জমিজমা সব উড়িয়ে দিল। এক ছেলে এক মেয়ে হল তার। ছেলেটি অল্পবয়সে মারাও গেল। বিধবা হয়ে তার মেয়ে ও ভাবী জামাতাকে নিয়ে একবার এসেওছিল সের্গিয়ুসের মঠে। কোন এক ছোটো শহরে যেন এখন থাকে, হতদরিদ্র।

কেন যে আত্মহত্যা না সমাধা করে পাশেঙ্কার কথা ভাবতে লাগলেন, কে জানে! ভাবতে ভাবতে শেষে ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্ন দেখলেন, এক দেবদূত এসে তাঁকে বলল, তুমি পাশেঙ্কার কাছে যাও। সে বলে দেবে কী করতে হবে তোমাকে। কী পাপ করেছ আর তা থেকে মুক্তির উপায় কী। - তাঁর ঈশ্বর তাঁকে ছেড়ে যাননি তাহলে। সেই ছোটো শহরের পথে তিনি পা বাড়ালেন। অনেকটা রাস্তা, তবু লোকেদের জিজ্ঞেস করে করে একসময় পৌঁছেও গেলেন। তবে তাঁকে দেখাচ্ছে এক বুড়ো ভিক্ষাজীবী তীর্থযাত্রীর মতো, চেনাও দুষ্কর।

পাশেঙ্কা এখন প্রাস্কোভিয়া মিখাইলোভ্‌না, প্রৌঢ়া। মেয়ে আর মেয়ের স্নায়ুরোগী বর ও পাঁচ নাতি-নাতনিকে নিয়ে থাকেন। তাদের ভরণপোষণও তিনি করেন, কয়েক বাড়িতে মেয়েদের গানবাজনা শিখিয়ে। সুখ খুব নেই সংসারে। তবু তিনি নালিশ না করে উদয়াস্ত খাটেন। সকলের সব দাবি পূরণ করেন। আর জামাতার একটা চাকরির জন্য এঁকে ওঁকে লিখতে থাকেন। আজকের এই আগন্তুককে যখন শেষ পর্যন্ত চেনা গেল, তখন পাশেঙ্কা তথা প্রাস্কোভিয়া মিখাইলোভ্‌নার সে কী উৎসাহ, সের্গিয়ুস, ফাদার সের্গিয়ুস তাঁদের অতিথি। অতিথি জানালেন তিনি আর ফাদার সের্গিয়ুস নন, তিনি পাপী, তার পাপ ক্ষালনের উপায় জানতেই পাশেঙ্কার কাছে এসেছেন। জানাও হল। ‘আমার ঠিক পাশেঙ্কার মতো হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু আমি তা হইনি। আমি ভগবদ্‌ সেবার ভান করে মানুষের প্রয়োজন মিটিয়ে গেছি; আর ও ভগবানেরই সেবা করেছে, যদিও ভাবছে ও মানুষের প্রয়োজন মিটিয়ে যাচ্ছে।’ বিবেকানন্দের কর্মযোগ থেকে কি খুব দূরে আছি আমরা?‘ হ্যাঁ, একটা ভালো কাজ, কোনও প্রত্যুপকারের আশা না করে এক পাত্র জল এগিয়ে দেওয়াও, মানুষের প্রশংসা পাব বলে আমি যত প্রয়োজন তাদের মিটিয়ে গেছি, তার চাইতে বেশি দামি।’

গোড়ায় কি সত্যকার ভগবদ্‌ সেবার এক কণাও তাঁর মধ্যে ছিল না? ছিল। কিন্তু ‘ফাদার সের্গিয়ুস’ হয়ে উঠতে উঠতে তা উচ্ছন্নে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছেন তিনি। এবার তিনি ঈশ্বরের খোঁজে যাত্রা করবেন। করলেনও। এক অনামা পথিক, গ্রাম থেকে গ্রামে হেঁটে চলেছেন, কখনও কখনও অন্য তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে, খ্রিস্টের নামে আশ্রয় ও খাদ্য চেয়ে চেয়ে। কারো কাছে পাচ্ছেন। কারো কাছে পাচ্ছেন না। পাচ্ছেন না বলে খেদ নেই। অহংকার সম্পূর্ণ তিরোহিত। নম্রতার সঙ্গে এর ওর নানা সেবাও করছেন। কেউ পরিচয় চাইলে বলছেন, তাঁর প্রভু ঈশ্বর। কারোর অবহেলার দানও সাদরে নিয়ে নিচ্ছেন; হয়তো পরে কোনও দীনদুঃখীকে তা দিয়ে দেবেন। অবশেষে, এক প্রদেশে যখন পুলিশ তাঁর সেখানে অবস্থানের অনুমতিপত্র না পেয়ে তাঁকে ধরে নিয়ে গেল, আর বিচারে তাঁর সাইবেরিয়া নির্বাসন হল, তিনি নিঃশঙ্কচিত্তে তা মেনে নিলেন। এবং সাইবেরিয়া গিয়েও তিনি নানাভাবে লোকের সেবা করতে থাকলেন। প্রভু ঈশ্বরই যাঁর ঠিকানা, তাঁর কি এইই নয় পুনরুজ্জীবন?

তাঁর ‘পুনরুজ্জীবন’ উপন্যাসে কি তলস্তয় এরই এক অন্য রূপ দেখেননি?