আরেক রকম ● দশম বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২২ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

আবার হিন্দি আগ্রাসন

রজত রায়


সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আবারও হিন্দি ভাষাকে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তুলেছেন। তাঁর যুক্তি, হিন্দি ভাষার মাধ্যমেই গোটা দেশকে একসূত্রে বাঁধা সম্ভব। ইতিমধ্যেই প্রত্যাশিতভাবে দক্ষিণ ভারত থেকে তার প্রতিবাদ উঠতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংগীতজ্ঞ ও সুরকার এ আর রহমান, কর্নাটকের বিশিষ্ট চলচ্চিত্রাভিনেতা প্রকাশ রাজ প্রমুখ প্রকাশ্যেই এই সরকারি চেষ্টার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এবং ডিএমকে নেতা এম কে স্ট্যালিন কড়া ভাষায় অমিত শাহের মন্তব্যের নিন্দা করেছেন। একই মঞ্চ থেকে কেরালার সিপিআই(এম) মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নও প্রতিবাদ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহল থেকেও প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ সৌগত রায়, সুখেন্দুশেখর রায়েরা প্রকাশ্যেই এর বিরোধিতা করেছেন। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ও সাংসদ অধীররঞ্জন চৌধুরীও স্পষ্টই মনে করেন, এটা দেশকে বিভাজনের চক্রান্ত। এআইসিসি থেকেও প্রতিবাদ করা হয়েছে।

আসলে অমিত শাহ জল মাপছেন। তিনি এবং তাঁর দল ভালোভাবেই অবগত আছেন যে সংবিধানের অষ্টম তফসিল অনুযায়ী দেশের ২২টি ভাষা স্বীকৃত। তা সত্ত্বেও ২০১৫ সাল থেকেই কেন্দ্রের বিজেপি নেতারা বার বার হিন্দিকে সরকারি ভাষা থেকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় উন্নত করার কথা বলছেন। প্রতিবারই জোরালো প্রতিবাদের মুখে সুর নরম করে পিছু হঠছেন। এআইসিসি সহ বিরোধী শিবিরের অনেকেরই বক্তব্য, হিন্দিকে কেন্দ্র করে দেশের মধ্যে বিভেদের সুর চড়া করার পিছনে বর্তমানের চড়া মূল্যবৃদ্ধি, লাগামহীন বেকার সমস্যা থেকে মানুষের নজর অন্যত্র ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টাটাও কাজ করছে।

দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই অ-হিন্দিভাষী। তবুও তাদের উপর জোর করে হিন্দিকে চাপিয়ে দেওয়ার এই অপচেষ্টা এই প্রথম নয়, স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকেই হিন্দিভাষীরা এই চেষ্টা শুরু করে। তখন কংগ্রেস স্বাধীনতার আন্দোলনের পুরোভাগে থাকার কারণে সংসদীয় রাজনীতিতেও ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। আর এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে দেশের রাজনীতিতে কংগ্রেসের আধিপত্য (hegemony) প্রতিষ্ঠিত ছিল। শুরু হয়েছিল আধিপত্যবাদী রাজনীতি। যে কারণে, কংগ্রেসের ওই আধিপত্যের প্রাতিষ্ঠিনিক কাঠামোর মধ্যে থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দিভাষীরা রাষ্ট্রভাষা বা সরকারি কাজেকর্মে কোন ভাষা ব্যবহৃত হবে সেই প্রশ্নে জোর করে হিন্দিকে চাপিয়ে দেয়। অথচ, গান্ধীজির নেতৃত্বে কংগ্রেসের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকেই ঠিক হয়েছিল যে ইংরেজির পাশাপাশি গোটা দেশের মধ্যে যোগাযোগের সেতু হিসাবে 'হিন্দুস্তানী' ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করা হবে। এই হিন্দুস্তানী ভাষা দীর্ঘদিন ধরে হিন্দি ও উর্দু ভাষার মিশেলে তৈরি। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুও হিন্দুস্তানী ভাষার সমর্থক ছিলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজের সরকারি ভাষা ছিল হিন্দুস্তানী। কিন্তু স্বাধীন ভারতের ভাষানীতির খসড়া তৈরির জন্য যে কমিটি তৈরি হয়, সেখানে আলোচনার প্রথম বৈঠকেই অন্যতম সদস্য মৌলানা আবুল কালাম আজাদ লক্ষ্য করেন যে হিন্দিভাষীরা (নেতৃত্বে পুরুষোত্তম দাস ট্যাণ্ডন) হিন্দিকেই জাতীয় ভাষা হিসাবে গ্রহণ করতে চাপ সৃষ্টি করছেন। তখন তিনি সেখান থেকে ইস্তফা দেন এবং কিছুদিন পরেই সাংবিধানিক পরিষদের (Constituent Assembly) বিশেষ অধিবেশনে (সেপ্টেম্বর, ১৯৪৯) এই প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, গান্ধীজির নেতৃত্বে অনেক আগেই কংগ্রেস দেশের জাতীয় ভাষা নিয়ে নীতিগত অবস্থান নিয়ে বলেছিল, হিন্দি নয়, হিন্দুস্তানীই হবে দেশের জাতীয় ভাষা। হিন্দি ও উর্দুর মিশ্রণে তৈরি এই হিন্দুস্থানী ভাষা আমাদের মতো বহুভাষী দেশে বিভিন্ন ভাষার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গণ্ডী ছাড়িয়ে অনেক বেশি মানুষকে কাছে টানতে সক্ষম। তিনি এটাও মনে করিয়ে দেন যে, গোটা দেশ ঘুরে দেখে গান্ধীজির এই ধারণা জন্মানোর কারণেই তিনি হিন্দি ভাষা প্রসার সমিতির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে হিন্দুস্তানী ভাষা প্রসার সমিতির সঙ্গে যুক্ত হন। আজাদ এটাও উল্লেখ করেন যে হিন্দুস্তানী ভাষাকে গ্রহণ করলে উর্দুকেও তার মধ্যে জায়গা করে দেওয়া যাবে, তাকে বঞ্চিত করা হবে না।

সাংবিধানিক পরিষদের ওই বিতর্কে তখনকার মাদ্রাজের প্রতিনিধি শ্রীমতী জি দুর্গাবাঈয়ের বক্তব্যও প্রণিধানযোগ্য। দুর্গাবাঈ নিজে দীর্ঘদিন তামিলভাষীদের মধ্যে হিন্দি ভাষা প্রচারের কাজ করেছেন। তাঁর ধারণা ছিল, ঠিকমতো চেষ্টা চালালে অ-হিন্দিভাষী মানুষেরাও স্বেচ্ছায় ধীরে ধীরে হিন্দিকে গ্রহণ করবেন। কিন্তু সরকারিভাবে জোর করে উপর থেকে হিন্দি এভাবে সবার উপরে চাপিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ দেখে তিনি রুখে দাঁড়ান এবং সতর্ক করে বলেন, এতে দেশের বেশিরভাগ মানুষই সায় দেবে না। তাঁরও বক্তব্য, হিন্দি নয়, জাতীয় ভাষা করা দরকার হিন্দুস্তানীকেই।

সদস্যদের একটা বড় অংশই হিন্দিভাষী, এবং তাঁরা কংগ্রেসের এবং সাংবিধানিক পরিষদের সদস্য হওয়ার কারণে দাবি করছিলেন হিন্দিকেই জাতীয় ভাষা হিসাবে সংবিধানে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। হিন্দিভাষীদের সমতুল্য সংখ্যায় অন্য কোনও ভাষাগোষ্ঠী না থাকায় তাঁরা মনে করছিলেন, তাঁদের দাবি যুক্তিযুক্ত। আর দেশের একটাই জাতীয় ভাষা দরকার, যা দিয়ে গোটা দেশকে একসূত্রে গাঁথা যাবে, এটাও তাঁদের যুক্তি। এই ঐক্যের যুক্তির বিরুদ্ধে অন্যভাষীদের বক্তব্য ছিল, এতে দেশের অন্য ভাষাভাষী মানুষ তাঁদের মাতৃভাষা হারাবেন। দেশের বৈচিত্র্য নষ্ট হবে। সর্দার হুকুম সিংও তাতে সায় দেন। মনে রাখতে হবে, একক ভাষাগোষ্ঠী হিসাবে হিন্দি প্রথম হলেও দেশের মোট জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ কখনই হিন্দিভাষীরা নয়। তাই সংখ্যার যে মাপকাঠি সংসদীয় গণতন্ত্রে ব্যবহৃত হয়, তাতেও তাদের যুক্তি ধোপে টেকে না।

কিন্তু উত্তরপ্রদেশের (তখন ইউনাইটেড প্রভিন্স) স্বাধীনতা সংগ্রামী আর ভি ধুলেকারের বক্তব্য স্পষ্ট, হিন্দি ইতিমধ্যেই দেশের অন্য সব ভাষাকে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দিয়েছে। সরকারি ভাষা নয়, হিন্দিকে 'জাতীয় ভাষা'র স্বীকৃতিই দিতে হবে। আর হিন্দুস্তানী ও উর্দু প্রসঙ্গে তাঁর দাবি, দেশভাগের পরে মাত্র কয়েক হাজার মুসলমান ভারতে রয়ে গেছে। তাদের জন্য বড়জোর পৃথক নির্বাচনী এলাকা করা যায়, হিন্দুস্তানী ভাষা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই।

পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্রের কথাই শোনা যাক। তাঁর যুক্তি ছিল, হিন্দি নয়, সংস্কৃত হোক গোটা দেশের ভাষা। অ-হিন্দিভাষীদের হিন্দি শেখানোর বদলে সবাইকেই সংস্কৃত শেখানো হোক। পাশাপাশি ইংরেজি থাকুক দেশ-বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য। কাশীকান্ত মৈত্রের বাবা লক্ষ্মীকান্ত সাংবিধানিক পরিষদের বিতর্কে হিন্দিওয়ালাদের সতর্ক করে দিতে পূর্ব পাকিস্তানের কথা মনে করিয়ে দেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানে ক্ষমতাসীনরা গোটা দেশের জন্য উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা করার পরে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবল বিক্ষোভ শুরু হয়। সেখানকার মানুষ তাঁদের মাতৃভাষা বাংলাকে ছাড়তে রাজি হন না। এমনকি ঢাকাতে জিন্নার কণ্ঠস্বরকে ডুবিয়ে দিয়ে উর্দুর বদলে বাংলার দাবিই সোচ্চার হয়। গোড়ায় পাক সরকার এসব বিক্ষোভকে 'হিন্দু'দের চক্রান্ত বলার চেষ্টা করে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ জোর গলায় তা উড়িয়ে দিয়ে বলেন, এই ভাষা রবীন্দ্রনাথের, এই ভাষা তাদেরও। তার অবমাননা তাঁরা সইবেন না। শেষে পাক সরকার বাধ্য হয়ে ঘোষণা করে যে পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষাই ব্যবহৃত হবে।

ভাষা যে নিছক আবেগের ব্যাপার নয়, মানুষের পরিচিতির একটা আবশ্যিক অঙ্গ তো বটেই, সর্বোপরি তার জীবনযাপনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার, এটা সাধারণ মানুষও বোঝে। তাই দক্ষিণ ভারতে তামিল, তেলুগু ও কন্নর ভাষীরা ব্রিটিশ আমল থেকেই বার বার নিজেদের ভাষা রক্ষার দাবিতে আন্দোলন করেছেন। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ দিয়েছেন। বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার জন্যও ভারতে বার বার আন্দোলন হয়েছে। ১৯৬১ সালের মে মাসে অসমের কাছাড়ে বাংলাভাষীদের উপর সরকার থেকে জোর করে অহমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশ গুলি চালালে ১১ জন শহীদ হন। তার পর বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা ব্যবহারে সরকারি স্বীকৃতি মেলে। ১৯৩৭ সালে কংগ্রেস মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে নির্বাচন জেতার পরে রাজাজী মুখ্যমন্ত্রী হন। তখন তিনি সেখানে হিন্দি ভাষা চাপাতে চেষ্টা করলে তামিলরা প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করে। তারপরে দফায় দফায় তামিলনাড়ুতে হিন্দিবিরোধী আন্দোলন চলছে।

আরও সাম্প্রতিক ইতিহাস হল বাংলা ভাষার দাবিকে ঘিরে শুরু হয়ে বাঙালি জাতীয়তাবোধের আন্দোলন কীভাবে পাকিস্তানকে দুভাগ করে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিল।

হিন্দি কি ভারতের জাতীয় ভাষা (national language)? নাকি, সরকারি ভাষা (official language)? ভারতীয় সংবিধানে কোথাও এটা বলা নেই যে, হিন্দি আমাদের জাতীয় ভাষা। তা সত্ত্বেও হিন্দিওয়ালারা হিন্দিকেই জাতীয় ভাষা করতে উপর থেকে চাপাতে সচেষ্ট। এ ব্যাপারে কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই।

ইংরেজ আমলে ভারতের যাবতীয় সরকারি কাজকর্ম, আদালতের কাজে ইংরাজি ভাষা ব্যবহৃত হত। স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, হিন্দিকে সেই মর্যাদা দিয়ে ইংরেজিকে পুরোপুরি বিদায় দেওয়া হবে, নাকি, অন্য কোনও পন্থা বার করা হবে, এ নিয়ে সাংবিধানিক পরিষদে (Constituent Assembly) চার বছর ধরে আলোচনা ও বিতর্ক চলে। উত্তর ভারতের হিন্দিভাষী সদস্যরা ইংরেজি বিসর্জন দিয়ে হিন্দিকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে অটল থাকেন। তাঁদের যুক্তি (এখন অমিত শাহরা যা বলছেন), এটা হলে গোটা দেশকে একটা ঐক্যসূত্রে বাঁধা যাবে। অন্যদিকে, বিরোধীদের যুক্তি (প্রধানত দক্ষিণ ভারতীয়দের) ছিল, এটা হলে বহুভাষী ও বহু সংস্কৃতির যে বৈচিত্র্য তা নষ্ট হবে। শেষে গোপালাস্বামী আয়েঙ্গার এবং কে এম মুনশির মধ্যস্থতায় একটা রফাসূত্র তৈরি হয়। তাতে ঠিক হয়, আপাতত হিন্দি ও ইংরেজি, দুটো ভাষাকেই সরকারি কাজের ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হবে। ১৫ বছর পরে ইংরেজিকে সরিয়ে শুধুই হিন্দিকে সরকারি ভাষা বলে গণ্য করা হবে। মনে করা হয়, ততদিনে হিন্দি যথেষ্ট শক্তিশালী ভাষা হয়ে উঠবে। কিন্তু ১৫ বছর পরে যখন ইংরেজিকে বিসর্জন দেওয়ার চেষ্ট হল, তখন প্রবল বাধা এল দাক্ষিণাত্য থেকে। তখন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু সংসদে প্রতিশ্রুতি দেন যে, হিন্দি কখনই জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হবে না। ইংরেজি আগের মতোই থেকে যায়। কিন্তু বার বার কেন্দ্রীয় সরকার ইংরেজিকে সরকারি ভাষা থেকে সরিয়ে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করে দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে। প্রতিবারই প্রবল বিরোধিতার মুখে পিছিয়ে গেছে।

ভাষা নিয়ে আরও একটি সমঝোতা সূত্র সরকারিভাবে গৃহীত হয়েছিল। ত্রি-ভাষা সূত্র। অর্থাৎ, প্রতিটি রাজ্যের মানুষকেই মাতৃভাষা ও ইংরেজির সঙ্গে অন্য যে কোনও অঞ্চলের একটা ভাষা শিখতে হবে। অর্থাৎ, হিন্দিভাষীরা যে চাইছিলেন হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করে দিয়ে সহজেই ভারত শাসন করবেন, তা হবে না। একটা সাম্য বজায় রাখতে তাঁদেরও হিন্দি, ইংরেজির সঙ্গে বাংলা, ওড়িয়া, তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালয়ালাম ইত্যাদি আঞ্চলিক ভাষার যে কোনও একটি শিখতে হবে। এতে কোনও একটি ভাষাই (হিন্দি) অন্য ভাষাভাষীর উপর সরকারি ফতোয়ার জোরে আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবে তা কার্যে রূপান্তর করা হয়নি। মনে রাখতে হবে, হিন্দির জোর এখানেই যে দেশের অন্য কোনও ভাষাগোষ্ঠীর জনসংখ্যা একক ভাবে হিন্দির সমান নয়। কিন্তু হিন্দির এই বড়সড় চেহারাটাও কৃত্রিম। হিন্দির মধ্যে মৈথিলী, ভোজপুরি, বুন্দেলখণ্ডি, রাজস্থানী, ছত্তিশগঢ়ী, হরিয়ানভি প্রভৃতি অনেক ভাষা লুকিয়ে রয়েছে। এমনকি উত্তরাখণ্ডের নিজস্ব ভাষা ও ব্যাকরণ থাকলেও শুধুই দেবনাগরী লিপি ব্যবহারের কারণেই তাদেরও হিন্দির ছত্রচ্ছায়ার তলায় নিয়ে আসা হয়েছে। এই সব ভিন্ন ভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর মানুষেরা বহুদিন ধরেই তারা নিজেদের ভাষা পরিচয়ের পৃথক স্বীকৃতি চেয়ে আন্দোলন করে আসছেন। কিন্তু কী কংগ্রেস, কী বিজেপি, কেন্দ্রের কোনও সরকারই এ নিয়ে গা করে না। কারণ, একবার রাজি হলে হিন্দি জনগোষ্ঠীর সংখ্যাটা অনেকটাই নিচে নেমে যাবে। আধিপত্য থাকবে না।

বুন্দেলখণ্ডের ভাষা নিয়ে একটা তথ্য ১৯৯১ সালের জনগণণার রিপোর্টের মধ্যে লুকিয়ে আছে। ১৯৬১ সালের পর ৩০ বছরের ব্যবধানে ১৯৯১ সালে জনগণণার সময় ভাষাগোষ্ঠীগুলির তথ্য সংক্রান্ত রিপোর্ট বার করা হয়। তখন দেখা যায়, বুন্দেলখণ্ডিভাষীদের সংখ্যা লাফ দিয়ে অনেকটাই বেড়ে গেছে। প্রতি দশ বছরে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার দিয়ে মাপা হলে দেখা যাচ্ছে হিসাব মিলছে না। অর্থাৎ, জনসংখ্যার জাতীয় স্তরে বৃদ্ধির হার বা ওই অঞ্চলে সাম্প্রতিক অতীতে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের চাইতে অনেক বেশি মানুষ নিজেদের পরিচয় বুন্দেলখণ্ডি বলে নথিভুক্ত করেছেন। এর কারণ কী? জনগণণা দফতরের ভাষাবিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা, বুন্দেলখণ্ডিদের জনসংখ্যার কোনও হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটেনি। তাঁদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার স্বাভাবিকই রয়েছে। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তাঁরা দেখলেন যে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হিন্দিভাষী, অন্য হিন্দিভাষী নেতারাও ক্ষমতার বিভিন্ন চূড়ায় অবস্থান করছেন। চারদিকে হিন্দিরই দাপট। এই অবস্থায় অনুন্নত বুন্দেলখণ্ডের বেশিরভাগ মানুষ মনে করলেন যে তাঁরা যদি হিন্দির পতাকা হাতে নেন, তা হলে সম্ভবত উন্নয়নের কর্মযজ্ঞের ছিঁটেফোঁটা তাঁদের ভাগ্যেও জুটবে। তাই ১৯৬১ সালে তাঁরা নিজেদের বুন্দেলখণ্ডি ভাষার পরিচয় লুকিয়ে রেখে নিজেদের হিন্দিভাষী বলে নথিভুক্ত করেছিলেন। তারপর ৩০ বছর কেটে গেলেও বুন্দেলখণ্ডের মানুষের কপালে উন্নয়নের ভাগ বিশেষ কিছু জুটল না। বুন্দেলখণ্ডের চম্বল বেহড়ে ডাকাত তৈরি ছাড়া আর কিছু হয় না, এমনই তকমা জুটল তাদের। ফলে, ক্ষুব্ধ ও হতাশ বুন্দেলখণ্ডিদের মধ্যে ক্রোধ ধূমায়িত হতে লাগল। তারই প্রকাশ ঘটল ১৯৯১ সালের জনগণণা রিপোর্টে। যাঁরা এতদিন নিজেদের হিন্দিভাষী বলে এসেছিলেন, তাঁরা এবার ফিরে গেলেন নিজেদের বুন্দেলখণ্ডি পরিচয়ে। জনগণণা দফতরের ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, এটাকে roll back effect বলা হয়। তাঁরা মনে করিয়ে দেন যে এরকম আরও নজির আছে। যেমন, অহমিয়া ভাষার ছায়া থেকে ককবরক ভাষাগোষ্ঠীর বেরিয়ে আসা। এখন যে ভাষাগুলি হিন্দির ছত্রচ্ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার জন্য লড়াই চালাচ্ছে, বুন্দেলখণ্ডি তাদের অন্যতম।

ভারতীয় সংবিধান যেহেতু দেশের জাতীয় ভাষা কী হবে সে প্রশ্নে নীরব, সুপ্রিম কোর্টও তাই, ফলে, এ নিয়ে একাধিক হাইকোর্টে দুই ভিন্নধর্মী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন দেখা যায়। একদিকে হিন্দিকে জাতীয় ভাষা হিসাবে দেখার পক্ষে দেশের ঐক্য সুদৃঢ় করার যুক্তি, বিপরীতে দেশের বৈচিত্র্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং হিন্দি চাপিয়ে দিলে অ-হিন্দিভাষীদের যে বাড়তি সমস্যা তৈরি হবে সেই যুক্তির সমর্থনে বলা হচ্ছিল। বোম্বাই হাইকোর্ট (Bombay Education Society v. State, 1954), কলকাতা হাইকোর্ট (West Bengal Board of Secondary Education v. Siliguri High School, 2003) এবং মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্ট (R Prasad v. Union Bank of India, 1998) এ ব্যাপারে দেশের ঐক্য ও সংহতির কথায় জোর দিয়েছিল। অন্যদিকে, গুজরাত হাইকোর্ট (Amritlal Poptlal v. Chief Secretary, 2013), কর্ণাটক হাইকোর্ট (General Sewcretary, Linguistic Minority v. State of Karnataka, 1989) এবং পটনা হাইকোর্ট (Jayakant Misra v. State of Bihar, 2002) এর কড়া বিরোধিতা করে বৈচিত্রের পক্ষে সায় দেয়।

অন্যরা রায়ে নির্দিষ্ট করে এ নিয়ে না বললেও পটনা হাইকোর্ট বলে। তাই তার একটু বিস্তারিত উল্লেখ করা দরকার। জয়কান্ত মিশ্র নিজে মৈথিলি এবং মৈথিলি ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে লড়ছেন। তাঁর করা মামলার রায়ে পটনা হাইকোর্টের বিচারপতি রবি এস ধাওয়ান তাঁর রায়ে এক জায়গায় বলেনঃ
'...Government of Bihar has misunderstood the difference between official language, national language and mother tongue - Raj Bhasa, Rastra Bhasa and Matri Bhasa. The Hindi speaking States in their administration at times act as if the other languages are in juxtaposition to Hindi as rival. This is not so. Asserting the hegemony of Hindi and being belligerently pushing it under a misconception that it is a national language (Rastra Bhasa) so ordained by the Constitution of India is the biggest misunderstanding and one solitary factor which contributes to discord with people of the nation where Hindi is not spoken. A person does not speak Hindi is no less a nationalist than any other citizen who comes from a Hindi speaking State...'।

অর্থ পরিষ্কার, হিন্দিওয়ালারা (অমিত শাহ সহ) যতই বলুন যে, একমাত্র হিন্দি ভাষাই গোটা দেশকে একসূত্রে গাঁথতে সক্ষম, কার্যত এই জোরজবরদস্তির নীতির কারণে তা দেশের ভিতর ক্ষোভের সঞ্চার করে ঐক্য ও সংহতিকেই বিনষ্ট করছে।

বহুদিন ধরেই হিন্দিওয়ালারা সরকারিভাবে হিন্দিকে তোল্লাই দিতে নানা ধরণের কাজ করে চলেছে। দেশের সর্বত্র রেলস্টেশনের গায়ে হিন্দিতে ফলক লাগানো, কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে হিন্দির ব্যবহার ও হিন্দি পড়ানো বাধ্যতামূলক করা, কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসে অ-হিন্দিভাষী কর্মীদের হিন্দি শেখার জন্য বাড়তি উৎসাহভাতা ও ইনক্রিমেন্ট দেওয়া, সংসদের হিন্দিভাষা প্রসার সমিতিকে বিদেশভ্রমণের জন্যও অর্থবরাদ্দ করা, হিন্দি প্রকাশনায় বিপুল অর্থ বরাদ্দ করা তারই কিছু নজির। পূর্ব ভারতে তেমন প্রতিরোধ না হলেও দক্ষিণ ভারতে কিন্তু তা যথেষ্ট প্রতিরোধের মুখে পড়ে চলেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও হিন্দিওয়ালারা আধিপত্য বিস্তারে উদগ্রীব। তবে ২০১৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর (হিন্দি ভাষা দিবস) উপলক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের 'প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো' একটি লেখা প্রকাশ করে। সেই লেখাতে ১৯১৭ সালে দক্ষিণ ভারত থেকে ভারতে ফেরার পরে গান্ধীজির আগ্রহে হিন্দি ভাষা প্রসারের কর্মকাণ্ড শুরু হয় বলে উল্লেখ করা হয়। মাদ্রাজের জি দুর্গাবাঈ সেই ডাকে সাড়া দিয়ে মাদ্রাজে তামিলভাষীদের মধ্যে হিন্দি শেখানোর কাজ শুরু করেন (১৯২১-২৩)। কিন্তু পরে ১৯৪৯ সালে সাংবিধানিক পরিষদে তিনি খেদের সঙ্গে বলেন যে, হিন্দিওয়ালাদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য আগ্রাসী মনোভাবের কারণে মানুষ এর বিরোধিতা করতে বাধ্য হচ্ছে। এখানে যেটা বলা হয়নি তা হল, গান্ধীজি তার কয়েক বছরের মধ্যেই হিন্দি থেকে হিন্দুস্তানীতে সরে এসেছিলেন, যেটা মৌলানা আজাদ তখনই স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন।

ভাষাকে নিয়ে এত আবেগ কেন? কেনই বা ১৯৫২ সালে পত্তি শ্রীরামালুর মতো মানুষ টানা ৫৮ দিন অনশন করে প্রাণ দেন নিজেদের তেলুগু ভাষাভিত্তিক রাজ্য অন্ধ্রের দাবি আদায়ের জন্য? কেন তার পরে শুধুই পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশই নয়, কেন্দ্রীয় সরকার ভাষার ভিত্তিতে বিভিন্ন রাজ্যের পুনর্গঠন করতে বাধ্য হয়? বাংলাদেশের ইতিহাস তো রয়েছেই। আসলে ভাষা যেহেতু মানুষের নিজের মনের ভাব প্রকাশের প্রধান অবলম্বন, তাই এই আবেগ থাকা অনিবার্য। তা ছাড়া আর্থিক কর্মকাণ্ডের দিকটাও গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দি সরকারি ভাষা হওয়ার সুবাদে দেশ জুড়ে হিন্দিভাষীদের জন্য অসংখ্য কাজ সৃষ্টি হয়ে চলেছে, সরকারি ও বেসরকারি মহলে। যদিও ইংরেজি এখনও সরকারি ভাষার স্বীকৃতি হারায়নি, এবং বিশ্বায়নের সুবাদে তার প্রভাব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের আমলেও একবার নমো নমো করে বাংলা ভাষায় সরকারি কাজ শুরু করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং রাজনৈতিক দিক থেকে ইংরেজি বনাম বাংলার লড়াইয়ে কোনঠাসা হয়ে বাংলাকে অবহেলা করাটাই রীতি হয়ে গেল। ইংরেজি মাধ্যমে স্কুলের বাড়বাড়ন্তের সঙ্গে তাল রেখেই কলকাতা ও জেলায় জেলায় যেসব উৎকৃষ্ট মানের বাংলা মাধ্যমের স্কুল ছিল, সেগুলি চরম অবহেলার শিকার হল। ফলে, ইংরেজি মাধ্যম ও বাংলা মাধ্যমের স্কুলের মধ্যে উঁচু ও নিচুর শ্রেণীবিভাজন তৈরি হয়ে গেল। প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ যেভাবে মাতৃভাষার সমাদর করতে পেরেছে তা দেখেও পশ্চিমবঙ্গের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত বাঙালি নির্বিশেষে মাতৃভাষাকে নিয়ে হীনমন্যতা এখন স্পষ্টতই দৃশ্যমান। দক্ষিণ ভারতে কিন্তু হিন্দিকে সরিয়ে রেখে আঞ্চলিক ভাষাগুলি ইংরেজির পাশেই সসম্মানে অবস্থান করছে। যদি পশ্চিমবঙ্গে সরকারি কাজে দক্ষিণ ভারতের মতো বাংলা ব্যবহার বাধ্যতামূলক হত, তা হলে বাংলা ভাষা এতটা অবহেলিত হত না। হিন্দির সপক্ষে একটা কথা বলা অবশ্যই যায় যে, সরকারি উদ্যোগে নয়, বলিউডের সৌজন্যে হিন্দি গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের (কংগ্রেস ও বিজেপি উভয়েরই) আগ্রাসী মনোভাবে অ-হিন্দি রাজ্যগুলির মানুষের বিরূপ প্রতিক্রিয়া থামছে না। যদি বিজেপি ও কংগ্রেস নির্বিশেষে কেন্দ্রের সরকার হিন্দিভাষীদের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে গোটা দেশের উপর হিন্দিকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা পরিত্যাগ করে ত্রি-ভাষার সূত্র অনুযায়ী স্কুলস্তর থেকেই মাতৃভাষা, ইংরেজি এবং অন্য একটি ভাষা শেখানোর উপর জোর না দেয়, তা হলে হিন্দির, এবং তার জেরে হিন্দিভাষীদের সঙ্গে অ-হিন্দি রাজ্যগুলির মানুষের বিরোধ বাড়বে বই কমবে না। অমিত শাহ বলছেন, হিন্দি ভাষা দেশকে ঐক্যসূত্রে বাঁধতে পারবে। তাই হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করা চাই। কিন্তু বাস্তবে এর পরিণতি হবে ঠিক উল্টো। পাকিস্তান বাংলাভাষীর উপর জোর করে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার পরিণতি কী হয়েছিল, তা আমরা দেখেছি। অমিত শাহদের হিন্দি নিয়ে জোরাজুরি দেশকে এক করার বদলে টুকরো টুকরো করার পথে ঠেলে দিতে পারে। তাই এখনই এই বিপদ সম্পর্কে সচেতন হওয়ার সময় এসেছে।