আরেক রকম ● দশম বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২২ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

বামপন্থার পুনরুজ্জীবন

সৌরীন ভট্টাচার্য


কলকাতায় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল পিডিএস-এর সপ্তম রাজ্য সম্মেলন। তার উদ্বোধন অনুষ্ঠান ছিল ১২ মার্চ। সেখানে ‘বামপন্থা রক্ষায় আজকের ভাবনা’ শীর্ষক একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে কিছু বলার জন্যে আমন্ত্রিত হয়েও আমি ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে উপস্থিত থাকতে পারিনি। আলোচ্য বিষয়ে আমার দু-একটি ভাবনা আমি সেখানে লিখিত আকারে পেশ করি। খুবই সংক্ষেপে সামান্য দু-একটি কথা তুলেছিলাম। মূলত সেই কথাগুলি একটু বিশদে এখন বলার চেষ্টা করছি।

রাজনৈতিক কর্মীদের সামনে এই ধরনের বিষয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই যে-সংকোচ আমাকে ঘিরে ধরে তা এই যে, আমি কখনো হাতেকলমে রাজনীতির ক্ষেত্রে কোনো কাজ করিনি। তাই মনে হয় এসব ফাঁকা কথা বলে কী হবে। যে ধরনের রাজনীতিতে থিয়োরি ও প্র্যাক্টিসের ঐক্যসূত্রের উপরে জোর দেওয়া হয় সেখানে আরো বেশি করে মনে হয় আমাদের মতো বাইরের লোকের কথার ভূমিকা কতটুকু। আবার অন্য একটা কথাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মের ফললাভে বা ফলভোগে অবশ্যই রাজনীতির বাইরের মানুষের অংশ আছে। তা যদি না থাকত তবে ওই রাজনীতির ভিতর আর বাইরে বলে যা বলা হচ্ছে তা দুই অংশে আলাদা হয়েই থাকত। এক অংশের ভালোমন্দ অন্য অংশের কিছু গায়ে লাগত না। কিন্তু ব্যাপারটা কখনোই তা নয়। তাই ভিতর ও বাইরেকে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে হয়।

আমরা সবাই জানি বর্তমানে বামপন্থার পুনরুজ্জীবন নিয়ে চারিদিকে কথাবার্তা হচ্ছে। হবারই কথা। আমাদের পরিচিত ছোটো গণ্ডির মধ্যেই দেখেছি যাঁরা ভাবনা চিন্তায় ঠিক কোনো অর্থে বামপন্থী নন তাঁরাও অনেকে ভারতে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে বামেদের আর একটু স্বাস্থ্যকর সদর্থক ভূমিকার দিকে খুব তাকিয়ে আছেন। যতটা বুঝতে পারি তাঁদের মন কাজ করছে এইভাবে। দেশে বর্তমানে চরম দক্ষিণপন্থী অসহিষ্ণু মন যেরকম উৎকট নগ্নতায় সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ প্রতিষ্ঠায় তৎপর হয়ে উঠেছে এবং রাষ্ট্রীয় স্তরে তাতে যেভাবে প্রায় প্রকাশ্যে আনুকূল্য দেখানো হচ্ছে, তাতে নাগরিক সমাজের এই এক অংশের মন হতাশ বোধ করছে। আবার অন্যদিকে এ রাজ্যে শাসকদলের ছোটো বড়ো মাঝারি নেতা-নেত্রী ও কর্মীবৃন্দের নীতিহীন বিশৃঙ্খল আচরণ ও আর্থিক অনাসৃষ্টি দেখে দেখে সাধারণ মানুষ খানিকটা বীতশ্রদ্ধ হচ্ছেন। এই মনোভাব কতটা ব্যাপক বা এর কোনো প্রতিফলন নির্বাচনের ইভিএম যন্ত্রে দেখা যাবে কিনা তা বলার সময় এখনো আসেনি। কিন্তু এই মানসিক মুহূর্তের খানিকটা পরিচয় মেলে ওই ধরনের কথাবার্তায়। এঁরা বড়ো কোনো মতাদর্শের বিচারে আদৌ বাম শিবিরের মানুষ হয়তো নন, তবুও আপাতত বামেদের কাছ থেকেই তাঁদের কিছুটা প্রত্যাশা পূরণের ভাবনা মাথায় কাজ করছে। এটুকু কথাও যদি সত্যি হয় তাহলেও বাম শিবিরের উৎসাহী হয়ে ওঠার কারণ আছে বই কি। এইরকম প্রসঙ্গেই উঠছে বামপন্থার পুনরুজ্জীবনের কথা। অথচ বামপন্থী কর্মীর দিক থেকে এই রাজ্যে, এই দেশে, এই দুনিয়ায় প্রায় অধিকাংশ দেশে আজ বড়ো দুর্দিন। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আজ সোভিয়েত সমাজতন্ত্র বিলুপ্ত। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মতিগতি নিয়ে কমিউনিস্টদের মধ্যেই প্রশ্ন ও সংশয়ের অন্ত নেই। এরকম অবস্থায় কমিউনিস্ট মতাদর্শের পক্ষে কোনো আন্তর্জাতিক সংহতির তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। আজ তাই জাতীয় স্তরের কমিউনিজম চর্চার দিন। এর বিপদ সকলেরই জানা। তাতে জাতীয়তার ধাক্কায় কমিউনিজম কতটা টিঁকবে বলা শক্ত। আজকের চীনের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রের বিশ্ববিজয়ের আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা দেখে কোনোরকম আন্তর্জাতিকতার কথা তুলতে গলা শুকিয়ে যাবার দশা হবে।

কাজ আর তত্ত্বকে মেলাবার কথায় আমি কর্মতত্ত্বৈক্য কথাটা ব্যবহার করে থাকি। শব্দটা প্রথমে শুনতে একটু খটোমটো লাগে। কিন্তু এমন কিছু না। কর্ম, তত্ত্ব, ঐক্য, এই তিনটে কথা জুড়ে দাঁড়িয়েছে শব্দটা। আমার অভিপ্রায় এই, কাজ হিসেবে কর্ম আর তত্ত্বকে খুব আলাদা না রাখা। ভাবলে দেখা যাবে কাজ হিসেবে এ দুটো খুব আলাদা না। যিনি কাজ করছেন কাজ হিসেবে কিছু একটা ভাবনা তাঁর মাথায় আছে। কোন কাজে কোন ফল প্রত্যাশিত সে বিষয়েও কিছু না কিছু একটা আন্দাজ কাজ করে। এইসব ভাবনাচিন্তা নিয়েই তাঁর তত্ত্বজগৎ। আবার যিনি হয়তো মূলত ভাবনাচিন্তাই করেন, তিনি, যে কাজই করুন না কেন, তার মধ্যে সেসব ভাবনাচিন্তারই তো প্রতিফলন ঘটাবেন। কাজেই কর্ম আর তত্ত্ব মিলেমিশেই আছে আসলে। আনুষ্ঠানিকভাবে এই মিলে থাকাটাকে স্বীকৃতি দিই আর না দিই। এবং এ কাজ দুটো যত আলাদা রাখা হবে তত এক ধরনের জাতিভেদপ্রথা আমাদের পেয়ে বসবে। উঁচুনীচু, এ কাজ আমার, সে কাজ তার, এই ধরনের চিন্তা, তার থেকে এই ধাঁচের মানসিকতা আমাদের গ্রাস করবেই। সব কাজই সবার। শিক্ষা, অনুশীলন, দক্ষতা এ সবের দরকার নেই তা নয়। অবশ্যই আছে। কিন্তু তার সঙ্গে ওই থাকে থাকে সাজানো ব্যবস্থার যোগ ভাঙতে হবে। না হলে যা দাঁড়াবে তাতে এবাড়ির ছেলেমেয়ে স্কুলে যাবে, ওবাড়ির ছেলেমেয়ে না যেতে পারলে আর কী করা যাবে। এ বছর তো আমাদের স্বাধীনতার বয়স পঁচাত্তর হল। আমরা বড়ো করে জয়ন্তী পালন করছি। এখনো কি আমাদের সব ছেলেমেয়ে মিড-ডে মিলে রোজ একটা করে ডিম পায়। যদি এমন হতে পারত, তা যতদিন ব্যবস্থা করা না যাচ্ছে, ততদিন আমাদের অনেকের অনেক কাজ বন্ধ থাকত। প্রশ্ন তো শেষমেশ অগ্রাধিকারের। এই যে কারুর কারুর ডিম না পাওয়ার জন্য অন্য কারুর অন্য অনেক কিছু আটকে যায় না, এর মধ্যে তো আছে সেই সামাজিক উঁচুনীচুর সমস্যা। কাজেই দেখা যাবে যে, কর্মতত্ত্বৈক্যের মতো গালভারী শব্দের সমস্যার সঙ্গেও আসলে জড়িয়ে আছে ডিম পাওয়া না-পাওয়ার সমস্যা। তাই যেসব জিনিস আমরা এতদিন আলাদা আলাদা ভাবতে অভ্যস্ত, তার অনেক কিছুই আজ হয়তো একসঙ্গে ভেবে দেখার সময় এসেছে।

কিন্তু একটা কথা। এই একসঙ্গে ভেবে দেখার ব্যাপারটা হয়তো এমনিতে খুব সামান্য কথা। কিন্তু এইটুকু কাজেও দেখা যাবে যে আমাদের অভ্যস্ত রাজনৈতিক সংস্কারে এমন ঘা লাগবে তা হয়তো আমরা খুব সহজে সামলাতে পারব না। যেমন উঁচুনীচুর ব্যাপারে বেশিদূর এগোতে গেলে এমন কাজে আমাদের হাত লাগাতে হবে যা আমরা কোনোদিন করিনি। একটা ছোটো উদাহরণ। কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের গোপন সেলের মিটিং হচ্ছে। দলের কোনো ছেলে কষ্টেসৃষ্টে কিছু খাবারদাবার জোগাড় করে এনেছে। তার পরে, এখনো পর্যন্ত আমার ধারণা এটাই স্বাভাবিক দৃশ্য, দেখা যাবে যে, দলের মেয়েরা সেই খাবার গুছিয়ে গাছিয়ে সবার জন্য প্লেটে সাজিয়ে দিচ্ছেন। এমনিতে একেবারে ঠিক আছে। কিন্তু সবাই বুঝবেন যে, এর মধ্যে আমাদের সমাজে প্রচলিত কাজকর্মের লিঙ্গভাগাভাগির একটা ভূমিকা অকথিতভাবে, অসমালোচিতভাবে প্রায় নিঃশব্দে বয়ে চলেছে। এই চেনা স্টিরিওটাইপের বেলায় মনে হতেই পারে এতে কী এমন এসে যাচ্ছে। বিস্তারে ব্যাখ্যা করতে গেলে তো সময় লাগবে। তবে এসে যে যাচ্ছে কিছু তার পরিচয় একেবারে বড়ো বড়ো পার্টি সংগঠন থেকে আরম্ভ করে নাটকের দল, এমনকি ছেলেমেয়ে মেশানো আড্ডার দলেও পাওয়া যাবে।

এই উদাহরণটা নিয়ে ভাবতে গেলে দেখা যাবে আমরা এসে পড়ছি একেবারে আমাদের গার্হস্থ্যের আঙিনায়। আমরা আমাদের ঘরের বাইরের কাজের সঙ্গে ঘরের কাজকে মিলিয়ে দেখার কথা এখনো তেমন করে চিন্তা ভাবনার মধ্যে নিতেই পারিনি। পারিনি বলেই আমাদের সংসদে এখনো প্রশ্ন ওঠে ঘরের মেয়েরা সাংসদ হলে চাপাটি বানাবে কে। আমাদের সংসদ নারী সংরক্ষণ বিলের সামনে আজও থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ পঞ্চায়েত স্তরে এ ব্যাপারে বেশ খানিকটা বদল এসেছে। অন্তত আমাদের রাজ্যে। এখানেও গোড়ার দিকে হাসিঠাট্টা ছিল যে, মেয়েরা পঞ্চায়েতের সদস্য হলেও কার্যত চলবে পরিবারের পুরুষের কথাতেই। একেবারে প্রথম দিকে তা যদি খানিকটা সত্যি হয়েও থাকে, আজ আর নিশ্চয় কেউ তা বলবেন না। কিন্তু এটুকু পরিবর্তনের জন্যেও গার্হস্থ্য সমস্যার দিকে আমাদের যে মনোযোগ দেবার দরকার ছিল তা আজও দেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। আসলে গার্হস্থ্য এখনো তেমন করে জন পরিসরের আলোচ্য বিষয় হয়েই উঠতে পারেনি।

এসব কথার দিকে নজর দেবার কথা বললে এমন কথা উঠবেই যে এসব তো সমাজ সংস্কারের কথা। এ কি রাজনীতির কথা। ঠিক। কিন্তু সমাজের কথা বাদ দিয়ে রাজনীতির কথায় খুব বেশিদূর এগোনো যাচ্ছে কি? লিঙ্গ প্রশ্ন, উঁচু পদ, নীচু পদ, দুর্নীতি ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে বিব্রত নয় কোন রাজনৈতিক দল। লোকসভা, বিধানসভা, পুরসভা, পঞ্চায়েতের টিকিট নিয়ে মাথার চুল ছিঁড়তে হয় না এমন কোন রাজনৈতিক দল আছে। এবং এই প্রসঙ্গে আজ আরো বেশি করে খেয়াল করা দরকার যে, এক অর্থে রাজনীতি আজ রাজনীতির হাত ছেড়েই বেরিয়ে যেতে চাইছে। রাজনীতি পৌঁছে যাচ্ছে লবি, কনসালটেন্সি ইত্যাদি নামের নানারকমের পেশা বৃত্তির বিশেষজ্ঞের দোরগোড়ায়। ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এইরকম। সাধারণভাবে নাগরিকেরা সরকারের বা রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক সেবা পরিষেবার সুব্যবস্থার উপরে নির্ভর করেন। অনেকে হয়তো এই ধরনের সেবা-পরিষেবার উপরে খুব নির্ভর করেন না। যাঁরা করেন না, তাঁরা করেন না। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকেই করেন, করতে হয়। এখন এই পরিষেবা ঠিকঠাক পরিচালনার ভার প্রশাসনের উপরে ন্যস্ত। প্রশাসন ব্যর্থ না হলে নাগরিকের কাজ ঠিকমতো চলে যায়। এইবার, রাষ্ট্রের চরিত্র, সেই রাষ্ট্র পরিচালনার ভার যে সরকারের, সেই সরকারের চরিত্র, এসব প্রশ্নে সাধারণভাবে নাগরিকের যদি তেমন আগ্রহ না থাকে, তাহলে নাগরিকের প্রয়োজন মেটাবার জন্যে সুষ্ঠু প্রশাসন ব্যবস্থাই যথেষ্ট। ভালো প্রশাসন, বিশেষজ্ঞ বিদ্যাক্ষেত্র হিসেবে ম্যানেজমেন্ট বিদ্যার অন্তর্গত। এই বিদ্যা মূলত করপোরেট ক্ষেত্রের করায়ত্ত। অতএব, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন আর করপোরেট প্রশাসনের আরো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কাম্য। তাহলে নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক যদি প্রধানত প্রশাসন কেন্দ্রিক হয়, তাহলে রাজনীতির প্রশ্ন ক্রমে অবান্তর হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে আমরা ম্যানেজড্ ডেমোক্রেসি, ম্যানেজড্ স্টেট, এই জাতীয় কিছু একটা পেতে পারি। তাহলে আজ নতুন করে রাজনীতির ভূমিকা আবিষ্কার করার দরকার আছে। এবং সে ভূমিকায় নাগরিকের স্থান নির্ণয় করা জরুরি। একদিকে নাগরিক যত বেশি অ-রাজনৈতিক হবে, অন্যদিকে রাষ্ট্র তত বেশি প্রশাসনমুখী হবে। তাকে দেখতে লাগবে জনকল্যাণমুখী। ততই রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে, সমাজজীবন থেকে হারিয়ে যাবে রাজনীতি। ঘিরে ধরবে লবি ও কন্সালটেন্সির আবর্ত। অর্থনীতি ইতিমধ্যেই অনেকটা রেটিং এজেন্সির আবর্তে আটকে পড়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্ষুধা, স্বাধীনতা ইত্যাদি নানা মানবিক ধারণাও আজ সূচক ও রেটিং নির্ভর। আজ আমাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় নাক-এর রেটিং নির্ভর। গোটা অর্থনীতি বিশ্বব্যাংক ধরনের প্রতিষ্ঠানের রেটিং নির্ভর। এ ছাড়া আছে রীতিমতো আন্তর্জাতিক প্রভাব সম্পন্ন রেটিং এজেন্সি। আমাদের সমস্ত কাজকর্মের লক্ষ্য দাঁড়িয়ে যাচ্ছে ভালো রেটিং পাওয়া। কারণ এসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আর্থিক অনুদানের প্রশ্ন। ফলে আমাদের জীবনে জ্যান্ত মানুষের তাপ উত্তাপ হারিয়ে যাচ্ছে। কাজের সঙ্গে আনন্দের যোগ, এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্নটাই কেমন অবান্তর শোনাবে। জ্যান্ত মানুষের তাপ উত্তাপ আবার ফিরে আসতে পারে রাজনীতির হাত ধরে। কিন্তু তার জন্যে চাই রাজনীতির অন্য চেহারা। রাজনীতি বলতেই দলীয় রাজনীতির যে আজব চেহারা আমাদের ঘিরে ফেলেছে তার থেকে বেরিয়ে আসার পথ চাই। রাজনীতি থেকেই বেরিয়ে আসা সে পথ নয়।

আমাদের রাজনীতি এখনো পর্যন্ত মোটামুটি রাষ্ট্রমুখী। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা তার প্রধান লক্ষ্য। বড়ো মাপের সমাজ বিপ্লব, সে আবার এক অন্য বড়ো গল্প। এখন থাক। এদিকে আজ প্রায় সর্বত্র রাষ্ট্র বৃহৎ পুঁজির দ্বারা গ্রস্ত। আজ তিরিশ বছর ধরে বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া বলবান গতিতে এগিয়ে চলেছে। পুঁজির তরফে সমস্যা নেই বলছি না। অবশ্যই আছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রের মধ্যে তার যেটুকু প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবকাশ ছিল আজ আর তাও নেই। আজ দুর্বলতা সত্ত্বেও পুঁজির প্রতিপত্তি বস্তুত একচ্ছত্র। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়েই দেখা গিয়েছিল মার্কিন অর্থনীতির দুর্বলতার সঙ্গে তার কূটনৈতিক ও সামরিক সাফল্যের এক অভূতপূর্ব মিশেল। ঠিক এই মুহূর্তে ইউক্রেনে যা চলছে তার ফল কী দাঁড়াবে তা কে জানে। শুরুতে অনেকেই হয়তো ভাবেননি যুদ্ধ এতদিন স্থায়ী হবে। ইতিমধ্যেই অনেকের ভাঁড়ারে টান পড়েছে। রাষ্ট্রের কূটনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে পুঁজির চাহিদা ও চাপ অবশ্যই মিশে থাকে। আজকের বিশ্বায়ন পর্বের পৃথিবীতে তা হয়তো আরো ঘনিষ্ঠভাবেই মিশে থাকে। রাষ্ট্র এইভাবে ক্রমে ক্রমে পুঁজির হাতে ধরা পড়ে। সেই রাষ্ট্রক্ষমতায় পৌঁছোবার লক্ষ্যই যদি আজকের রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে, তাহলে আখেরে আমার হাতে থাকছে কী।

এদিকে বিশ্ব পরিস্থিতির দিকে তাকালে মনে হয় সুস্থ রাজনীতির পরিসর পাবার জন্য সমাজ আজ ব্যগ্র অপেক্ষায় রয়েছে। গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নানা কিসিমের উগ্র দক্ষিণপন্থা আজ দেশে দেশে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। আমাদের দেশে, আমাদের রাজ্যেও সেসব লক্ষণ বেশ প্রকট। এখানে ওখানে একটু আধটু অন্য রাজনীতির যা সন্ধান পাওয়া যায় তা যৎসামান্য। রাজনীতির অন্যমনস্কতায় রাজনৈতিক পরিসরটাই ক্রমে সরে যাচ্ছে পুঁজি-পেশা-বৃত্তির এক জটিল আবর্তের দিকে। একালের নতুন প্রযুক্তি তার সহায়। আর প্রযুক্তির টানে সমাজের চেহারা যে উলটে পালটে যায় এ আর নতুন কথা কি। কাজেই সেই প্রযুক্তির অঙ্ক মিলিয়ে নিয়েই আজকের রাজনীতির ভাবনা সাজাতে হবে। তাই মনে হয় নাগরিকের সজাগ মন ও বিবেচনা ছাড়া রাজনীতির পুনরুদ্ধারের পথ কোথায়। শুধু আঁটোসাঁটো দলীয় সংগঠনই সম্ভবত আজকের রাজনীতির জন্য যথেষ্ট নয়।

আজকের রাজনীতিতে তাই সমাজের পুনর্বিন্যাসের প্রশ্ন যেমন উপেক্ষা করা চলে না, তেমনি সবল নাগরিক সমাজের দায়-দায়িত্বের কথাও আর পাশ কাটিয়ে গেলে চলবে না। নাগরিক সমাজ বলতে আমি নাগরিকদের কোনো সংঘ বা সংগঠনের কথা ভাবছি না। অনেকের মাথায় এই ভাবনা আছে তা আমি জানি। তাঁরা মনে করেন যে এরকম একটা কোনো সংঘ বা সংগঠন থাকলে রাষ্ট্রের ভুলভ্রান্তি বা বড়ো মাপের কোনো বিচ্যুতির সময়ে এই ধরনের সংগঠনের পক্ষে রাজনৈতিকভাবে তা মোকাবিলা করার একটা অবকাশ থাকে। খানিকটা যেন রাষ্ট্রের কাজকর্মের উপরে পরিদর্শকের ভূমিকা পালনের চিন্তা। এই চিন্তা অন্তত দুটো কারণে আমার খুব সুবিধাজনক মনে হয় না। এরকম পরিদর্শকের ভূমিকা পালন করতে গেলে দলীয় অর্থে অরাজনৈতিক এবং সামাজিক অর্থে মান্যগণ্য মানুষদের দরকার পড়ে। সেরকম মানুষ আমাদের চারপাশে পাওয়া কি আজকের দিনে খুব সোজা। আর পেলেও তাঁদের কাজের ধারা যদি আলগা সুপরামর্শের চেয়ে বেশি কিছু হতে হয় তাহলে সংবিধান টপকে যাবার বিপদ দেখা দিতে পারে। আর সত্যিই সেরকম গুণী মানুষ যদি বেশি না মেলে তাহলে যাঁদের নিয়ে কাজ চালাতে হবে সেটা অচিরেই আর একটা আমাদের চেনা সংগঠনগুলোর মতো কিছু দাঁড়িয়ে যাবে। তাহলে আর খুব বেশি কি এগোবে।

আমি নাগরিক সমাজের দায়িত্বের কথা যখন ভাবছি তখন এরকম কোনো সাংগঠনিক কথা আমি ভাবছি না। আমি ভাবছি শক্ত সমর্থ নাগরিকেরই কথা। যে নাগরিক রাষ্ট্রের জনকল্যাণমুখী কাজকে শুধুমাত্র তাঁর নিজের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসেবে দেখবেন না। যে নাগরিক নিজের বোধবুদ্ধিকে বিসর্জন দিয়ে সমস্ত ব্যাপারে রাজনৈতিক দলের নির্দেশের অপেক্ষা করে থাকবেন না। যে নাগরিক নিজেকে অকাতরে রাজনৈতিক গড্ডলিকা স্রোতে শামিল করবেন না। যে নাগরিক নিজের বিচার বিবেচনার উপরে আস্থা রেখে সমাজের যে-কোনো সংগঠিত অংশের চোখে চোখ রেখে কথা বলার ভরসা পাবেন। আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠা ভার যাঁদের হাতে আছে তাঁদেরও দেখতে হবে নাগরিকের এই জাতীয় অধিকার যেন কোথাও ক্ষুণ্ণ না হয়। সমাজটাকে দুমড়ে মুচড়ে বলীয়ানদের হাতে কাগজের গোল্লা পাকিয়ে ফেলার দুর্মতি থেকে সরে আসতে হবে।

সব শেষে বাজারে শোনা একটা কথা গল্পের ছলে বলে কথা শেষ করি। সময়টা ছিল সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসির দিন। আমি যার কাছে আনাজপত্র কিনি তার মুখে সেদিন শুনেছিলাম এই নিভৃত সংলাপ। স্বগতোক্তির ধরনে সে জিনিস ওজন করতে করতে বলেছিল, ‘বুঝলাম আমি না হয় খুব খারাপ, তুমি কি এমন ভালো’। এই রাজনীতির বোধকে বাঁচিয়ে রাখা চাই।