আরেক রকম ● দশম বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২২ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪২৯
প্রবন্ধ
সরকার টিকলে উন্নয়ন হবে?
অশোক সরকার
দেশের রাজ্য রাজনীতিতে দুটি সুস্পষ্ট পরস্পর বিরোধী ধারা গত ৩০ বছর ধরে পাশাপাশি বয়ে চলেছে। বেশ কিছু রাজ্য আছে, যেখানে একেবারে নিয়ম করে পাঁচ বছর অন্তর সরকার বদলায়। পাশাপাশি বেশ কিছু রাজ্য আছে, যেখানে বিভিন্ন সময়ে একটানা ১৫-২০ বা তারও বেশি রাজত্ব করেছে এমন সরকারও আছে। রাজ্য রাজনীতির এমন কি বিশেষত্ব আছে যা কোনো কোনো রাজ্যে সরকারকে টিকতে দেয় না, আর কিছু রাজ্যে টিকতে দেয়? আর তার সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্কটা কী? এই প্রশ্ন দুটোর উত্তর খুঁজতে এই লেখা।
শুরুতে এই দুটি ধারার একটা প্রাথমিক পরিচয় দরকার। প্রথমটি, অর্থাৎ প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সরকার পালটে যাবার ধারাটি প্রথম লক্ষিত হয়েছিল কেরালা ও তামিলনাড়ুতে। ৮০-র দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই এই কেরালায় কংগ্রেস ও বাম শক্তি এবং তামিলনাড়ুতে ডিএমকে ও এআইডিএমকে-র মধ্যে এই পালাবদল শুরু হয়ে যায়। দু'জায়গাতেই মাঝে একবারই ব্যতিক্রম ঘটেছে, তাছাড়া এই ধারা অব্যাহত থেকেছে। এই ধরনের পালাবদল আমেরিকা-ইংলন্ডে এক সময় নিয়মমাফিক ছিল, আমেরিকায় তা এখনো অব্যাহত, ইংল্যান্ডে অবশ্য অবস্থা বদলে গেছে। পশ্চিমে দুই পার্টি ব্যবস্থা পরিণত গণতন্ত্রের সাক্ষ্য বহন করত। মনে করা হত সমাজের সব শ্রেণির আশা আকাঙ্ক্ষা কল্যাণ ও উন্নয়ন কমবেশি দুটি দলই বহন করতে পারছে, যার মানে হল সমাজের বহু গোষ্ঠীর নিজস্ব আলাদা রাজনৈতিক সমাবেশ ও কণ্ঠের এবং প্রোগ্রামের দরকার হচ্ছে না। ভাষা, সংস্কৃতি, শ্রেণি, জাতি ইত্যাদি রাজনীতির নানা অক্ষপথগুলি পার করে এসে, মানুষ একটা স্বতন্ত্র রাজনৈতিক স্বত্তা খুঁজে পেয়েছে এই দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে।
কেরালা তামিলনাড়ুর ক্ষেত্রে লক্ষ করার মত ঘটনা এই যে, ব্যাপক জনকল্যাণ, মহিলা ক্ষমতায়ন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য জাতীয় দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটা সামাজিক সহমত তৈরি হয়েছিল। তার পরিচয় পাওয়া যায়, সরকার যারই হোক না কেন, এই কর্মসূচিগুলিতে কোনো ছেদ পড়েনি। কেরালায় গ্রামীণ বিকেন্দ্রীকরণ, মহিলা ক্ষমতায়ন, তামিলনাড়ুতে মিডডে মিল, মহিলা ক্ষমতায়ন, অঙ্গনয়াড়ি, স্কুলশিক্ষা, ইত্যাদি বিষয়ে দল নির্বিশেষে সহমত বর্তমান থেকেছে। তার ফলে এই বিষয় সংক্রান্ত কর্মসূচিগুলি সরকারের নীতি প্রণয়নের কেন্দ্রে থেকেছে, সীমানায় সরে যায়নি। দ্বিতীয় একটি ব্যাখ্যা বলে যে শুধু সহমত নয়, এই সব বিষয়গুলিতে একটা প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছিল। নানা গবেষণার মধ্যে দিয়ে এই রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে Competitive Development Politics আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। এই তত্ত্ব বলে যে, দুটি দল যখন সামাজিক উন্নয়ন ও জনকল্যাণ কর্মসূচিতে একে অপরকে ছাপিয়ে যেতে চায়, তখন মানুষ দুটি দলকেই একাধারে সুযোগ দিতে থাকে। রাজনীতির কথোপকথনটাই (discourse) বদলে যায়। এমনকি এও বলা হয়েছিল যে, এই দুটি রাজ্য গণতান্ত্রিক কল্যাণকারী শাসনের এক পরিণত অবস্থার দিকে এগিয়ে চলেছে। তামিলনাড়ু ও কেরালার সামাজিক উন্নয়ন যে বিপথে যায়নি, থমকেও পড়েনি, তার পিছনে এই সামাজিক সহমতের বা প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির বড় ভূমিকা আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এই প্রশ্ন তোলা যায় যে তাহলে দুটি দল আলাদা কেন? তাদের মধ্যে তফাত কি? তফাত মূলত দুটি দলের সমর্থক বলয়ের। সব ধরনের সামাজিক, পেশাগত, জাতিগত, স্বার্থগত গোষ্ঠীর মধ্যেই দুটি দলের উপস্থিতি আছে, কোনোটায় বেশি, কোনোটায় কম। তামিলনাড়ুতে দুই দলের মধ্যে আদর্শগত তফাতও নেই বলেই চলে, কেরালায় কংগ্রেস ও বামশক্তির মধ্যে আদর্শগত কিছু তফাত আছেই, তবে সেটা যতটা ঠোঁটে, কাজে ততটা নয়।
কেরালা তামিলনাড়ু ছেড়ে অন্য রাজ্যগুলির দিকে তাকালে আশ্চর্য হবেন যে, উত্তর পশ্চিম ভারতের বেশ কিছু রাজ্যেও পাঁচ বছর অন্তর পালাবদলের ধারা ৯০-এর দশক থেকেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, আসাম, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচলেও ছবিটা একই চেহারা নেয়। রাজস্থানে কংগ্রেস-বিজেপি, পাঞ্জাবে অকালি-কংগ্রেস, উত্তর প্রদেশে এসপি-বিএসপি-বিজেপি, অন্ধ্রে তেলেগু দেশম-কংগ্রেস-ওয়াইএসআর, হিমাচলে কংগ্রেস-বিজেপি। প্রায় প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ক্ষমতার পালাবদল। দু'একবার ব্যতিক্রম ঘটেছে ঠিকই, তাতে সামগ্রিক চিত্র পালটায় না। যখন যে দলটা মুখ্য বিরোধী দল হয়ে উঠছে তাদের সঙ্গেই ক্ষমতার বিনিময় হচ্ছে। রাজস্থান, পাঞ্জাব, আর হিমাচল ছাড়া অন্য রাজ্যগুলিতে দুই দলের পরিবর্তে তিন দলের মধ্যে পালাবদল ঘটছে।
ঘটনা একরকম হলেই যে তার ব্যাখ্যা একরকম হবে, এমন কোন কথা নেই। কেরালা, তামিলনাড়ুতে যে ব্যাখ্যা দেওয়া চলে তা রাজস্থানে, হিমাচলে, পাঞ্জাবে দেওয়া চলে কি? বা অন্ধ্র-তেলেঙ্গানায়, আসাম, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশে? কেরালা তামিলনাড়ু সামাজিক, পরিকাঠামোগত, এমনকি অর্থনৈতিক সূচকগুলিতে পরস্পরকে পাল্লা দেয়। সামাজিক প্রগতির সূচক তালিকা মানলে, পাঞ্জাব উপর থেকে আসে আট নম্বরে, হরিয়ানা নয় নম্বরে, অন্ধ্র দশে, রাজস্থান বিশে, উত্তরপ্রদেশ ২১শে, আসাম ২২শ নম্বর স্থানে আছে। কিন্তু হিমাচল আছে ২ নম্বরে তামিলনাড়ুর গা ঘেঁষে! কাজেই সহজেই আমরা হিমাচলকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দেখতে পারি।
অন্যদের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পালাবদলের ছবিতে মিল থাকলেও সামাজিক সূচকের স্তরের কোন মিল পাওয়া যাবে না। অর্থনৈতিক সূচকগুলিতেও একই রকম ফারাক দেখতে পাওয়া যাবে। তার মানে হিমাচলকে বাদ দিলে অন্য রাজ্যগুলিতে রাজনৈতিক পালাবদলের পিছনে সামাজিক সহমত বা Competitive Development Politics-এর তত্ত্ব খাটবে না। হিমাচলে ফেরত আসব, কিন্তু অন্য রাজ্যের ক্ষেত্রে তাহলে এক ভিন্ন ব্যাখ্যা খাড়া করতে হবে। একটা ব্যাপারে কিন্তু ওই সব রাজ্যের রাজনীতির চেহারার মধ্যে যথেষ্ট মিল দেখতে পাওয়া যায়। তা হল জাতি-সমীকরণ। পাশাপাশি অন্ধ্র-তেলেঙ্গানা, আসামের ক্ষেত্রে ভাষা ও আঞ্চলিকতার রাজনীতিও আনতে হবে। এই রাজ্যগুলির রাজনীতির কথোপকথন মানে বিভিন্ন জাতির রাজনৈতিক অবস্থানের চর্চা। রাজস্থানে রাজপুত, ব্রাহ্মণ, মিনা, জাঠ, গুজ্জর, খটিক জাতির মানুষ কোন নির্বাচনে কোন দিকে ঝুঁকছেন, তা পালাবদলের রূপ নির্ধারণ করে। ব্রাহ্মণ, জাঠ, রাজপুত, মুসলমান, যাদব, জাঠভ, মৌর্য, কুশয়াহা, নিশাদ ইত্যাদিরা কি করছেন তার আলোচনা উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনী আলোচনার মুল বিষয়। জাঠ, যাদব, রাজপুত, সাইনি, মুসলমান, গুজ্জর, ব্রাহ্মণ ইত্যাদিদের কথা বলছি মানে হরিয়ানার নির্বাচন আলোচনা করছি। এই তালিকা বাড়াচ্ছি না।
জাতি-সমীকরণ এর অদলবদল এই সব রাজ্যের নির্বাচনের একটা বড় বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আমাদের প্রশ্নটা থেকেই যায়, জাতি-সমীকরণ প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নড়েচড়ে যাবে কেন? উত্তর দেওয়া সহজ নয়। একটা চেষ্টা করা যেতে পারে। প্রথমত মনে রাখতে হবে জাতি সমীকরণগুলি কখনওই খুব দৃঢ় হয়না। যে সব জাতির মধ্যে সমীকরণগুলি তৈরি হচ্ছে তাদের মধ্যে সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে নানা অসমতা আছে, স্থানীয় স্তরে বৈরিতা আছে, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আছে। নির্বাচনী সমীকরণ নিতান্তই একটা অস্থায়ী সমঝোতা, যার মধ্যে কোন অন্তর্নিহিত বিশ্বাস নেই, বৃহত্তর স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার নেই, কোন বৃহত্তর সংগ্রামের জন্য পাশে দাঁড়ানো নেই, আছে মূলত জাতিস্বার্থ রক্ষা, ক্ষমতা ও সরকারি সুযোগের ভাগ নেবার জন্য একসাথে আসার মৌখিক চুক্তি। এছাড়া মনে রাখতে হবে, বিভিন্ন জাতি-সম্প্রদায়ের মধ্যে এই সমীকরণগুলি কষা হয়, দলীয় নেতাদের স্তরে, তার মানে এই নয় যে স্থানীয় স্তরে সেই সমীকরণ সমানভাবে দানা বাঁধে। এর ফলে, এই সমীকরণগুলি প্রতি পাঁচ বছর অন্তর রিনিউ করতে হয়। যেহেতু জাতি সমীকরণগুলি নিতান্তই ভঙ্গুর, তাই পাঁচ বছর পার করে তাকে টিকিয়ে রাখা খুবই কঠিন। পাঁচ বছর আসলে একটা কৃত্রিমতা; নির্বাচন পাঁচ বছর বাদে হয় বলে, সমীকরণের রাজ্যস্তরে স্থিতিটা জনসমক্ষে চলে আসে, কিন্তু স্থানীয় স্তরে ভাঙ্গা-গড়ার কাজ পুরো সময় জুড়েই চলতে থাকে।
বিভিন্ন জাতির মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাপ্রাপ্ত রাজনৈতিক দল বা কোয়ালিশন, চেষ্টা করে এই সমঝোতাটিকে টিকিয়ে রাখতে, যার ফলে সরকারি সুযোগ (চাকরি, লাইসেন্স, সরকারি কন্ট্রাক্ট, ব্যাঙ্ক ঋণ, স্কলারশিপ, পোস্টিং ইত্যাদি), আর সরকারি সহায়তা - দুইয়েতেই তার প্রতিফলন দেখা যায়, এবং তা করতে গিয়ে অর্থনীতি আর রাজনীতির মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হতে থাকে। নিও-লিবারাল শাসনে রাজ্য সরকারগুলির পক্ষে ব্যাপকভাবে সুযোগ ও সহায়তার প্রসারের ক্ষেত্রটি সংকুচিত হয়ে পড়েছে। আগে প্রতি বছর যত শিক্ষক, কনস্টেবল, পিওন, নিয়োগ করা হত, গত তিরিশ বছরে ক্রমান্বয়ে তা কমেছে, গত দশ বছরে তো নগণ্য হয়ে গেছে। সহায়তার ক্ষেত্রে ১০০ দিনের কাজ, মিডডে মিল, অঙ্গনবাড়ির খাবার, রেশনে চাল গম ইত্যাদি, আইন সুরক্ষিত কল্যাণকারী প্রকল্পগুলিতে অর্থ নিয়োগের পরে সরকারের হাতে ব্যাপকভাবে আরও কিছু করার সুযোগ যথেষ্টই কম। তাছাড়া এই প্রকল্পগুলি থেকে প্রাপ্ত সহায়তা, নিরন্তর মূল্যবৃদ্ধির প্রকোপ থেকে কিছুটা সুরাহা দিতে পারে, তার বেশি কিছু নয়।
এই ধরনের সমীকরণ নির্ভর রাজনীতি সামাজিক-আর্থিক উন্নয়নের কোনো বৃহত্তর সামাজিক সহমত বা প্রতিযোগিতা তৈরিতে আপারগ, কারণ সমীকরণগুলি গঠনের মধ্যেই তার কোনও স্থান নেই। নির্বাচনী সমীকরণ থেকে যে আশা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়, তা সুবিধা বণ্টনের প্রোগ্রাম দিয়ে সন্তুষ্ট করা কঠিন। এছাড়া ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলে বেশি প্রভাবশালী জাতিটি বা জাতিগুলি এই বণ্টনের মধ্যেও নিজেদের কোলে বেশি টানার চেষ্টা করে, যা অসন্তোষ তৈরি করতে শুরু করে। নির্বাচনের সময় এলে জাতি সমীকরণগুলি রিনিউ করার সময় আসে, এবং তখনই সমস্যা দেখা দেয়, এবং সমঝোতাগুলি ভেঙ্গে যায়।
সামাজিক বা আর্থিক সূচকে তাই বিশেষ কোন উন্নতি দেখা যায় না, বরং কিছু ক্ষেত্রে অবনতিই ঘটে। রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, আসাম, অন্ধ্র ইত্যাদিতে এই কাহিনির পুনরাবৃত্তি হতে দেখা যায়। আসাম, অন্ধ্রে অবশ্য এর সঙ্গে আঞ্চলিকতার রাজনীতির কথাও আনতে হবে। অন্ধ্রে (তেলেঙ্গানায়), তামিলনাড়ুর মতই আঞ্চলিকতার রাজনীতি একটা পরিণতিতে পৌঁছেছে; লড়াইটা এখন মূলত দুই কি তিন আঞ্চলিক দলের মধ্যে। কাজেই আঞ্চলিকতা এখন আর রাজ্য সরকার ভাঙ্গা গড়ায় খুব প্রাসঙ্গিক নয়।
হিমাচলের কথায় ফিরতেই হয়। হিমাচল নানা দিক থেকেই কেরালা, তামিলনাড়ুর সহযাত্রী বলা চলে। নারী সাক্ষরতা, বিপিএল-এর হার, কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের যোগদান, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ইত্যাদি অনেকগুলি বিষয়েই হিমাচল তামিলনাড়ুর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, এবং নিরন্তর এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ হিমাচল নিয়ে গবেষণা ও সামাজিক চর্চা খুবই কম, পত্রপত্রিকাতেও লেখা খুঁজতে দিন কাবার হয়ে যায়। হিমাচলের সামাজিক প্রগতির তথ্য দিয়ে লেখা ভারাক্রান্ত না করে, চলুন খুঁজে দেখি কংগ্রেস-বিজেপির মধ্যে নিরন্তর ক্ষমতা বদলের মধ্যেও কেন হিমাচল এতটা সামাজিক প্রগতি করতে পারল। উৎসাহী পাঠকের জন্য কিছু তথ্য পরিশিষ্টে দেওয়া থাকল।
হিমাচলের তিনটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমাদের শুরু করতে হবে। এ এক এমন রাজ্য যেখানে রাজপুতরা ৩৭%, আর ব্রাহ্মণরা ১৮%, তার পরে আসে দলিতরা যারা সবাই মিলে ২৬% আর ওবিসি-রা ১৩%। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল, হিমাচল এমন রাজ্য যেখানে সরকারি কর্মচারী-র সংখ্যা, আর তার মধ্যে মিলিটারিতে কর্মরত মানুষের সংখ্যা রাজ্যের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার মধ্যে দেশের মধ্যে শতকরা হিসেবে সর্বাধিক। আর তৃতীয়, হিমাচলের বিস্তৃত অংশ চম্বা, কাঙরা, মান্ডি, বিলাসপুর নামক অঞ্চলগুলি ব্রিটিশ আমলে অঙ্গরাজ্যের শাসনে শাসিত ছিল। হিমাচলে তিনটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। ১) সরকারি-মিলিটারি চাকরিরত মানুষের সংখ্যা এত বেশি বলে, গ্রামাঞ্চলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পরিকাঠামোর চাহিদা অনেক আগেই থেকে জোরালো ছিল এবং তা নিয়ে সমাজে একটা বৃহত্তর সহমত ছিল। এই সামাজিক সহমত তৈরির পিছনে অঙ্গরাজ্যগুলির শাসকদেরও কিছুটা ভূমিকা ছিল। ফলে শিক্ষা, রাস্তা, ঘর, জ্বালানি, বিদ্যুৎ জাতীয় পরিকাঠামো ব্যবস্থা একটানা উন্নতি হয়েছে। হিমাচলের মত দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে, যেখানে গ্রামগুলি একে অপরের থেকে অনেক দূরে, সেখানেও প্রতি বাড়িতে বিদ্যুৎ আছে, গ্যাস আছে। ২) রাজাদের শাসনের দৌলতে রাজপুত ও ব্রাহ্মণদের মধ্যে একটা দীর্ঘকালীন আস্থা ও সমঝোতা ছিল, এবং যেহেতু এই রাজপুত - ব্রাহ্মণদের হাত ধরেই হিমাচলের গ্রামে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিকাঠামোর বিস্তার ঘটেছিল, তাই সমাজে তাদের প্রতিপত্তি বিশেষ কোন বিরোধিতার সম্মুখীন হয়নি। অর্থাৎ সমাজ এগোনোর পথ নিয়ে হিমাচলে একটা বৃহত্তর সামাজিক সহমত তৈরি হয়েছিল। ৩) রাজাদের শাসন চলে যাবার পর, বিস্তীর্ণ জমি ভূমি সংস্কার হয়েছিল, ফলে হিমাচলে ৮০ ভাগের বেশি মানুষের নিজস্ব চাষের জমি আছে। এটা কম কথা নয়। ফলে ৯০-এর দশক থেকে কংগ্রেস আর বিজেপির মধ্যে নিয়মিত ক্ষমতা বদল হলেও হিমাচলের অগ্রগতিতে বিশেষ বাধা আসেনি। দুই পার্টিরই সামাজিক ভিত্তি রাজপুত ও ব্রাহ্মণদের ঘিরে, তার সঙ্গে অন্যান্য জাতিগুলির নির্বাচনী সমীকরণ যখন যেমন তৈরি হয়, সেই অনুযায়ী ক্ষমতার অদলবদল হতে দেখা যায়। সব মিলিয়ে রাজনীতির ধারা এবং সমাজ উন্নয়নের ভিত্তি - দুই ক্ষেত্রেই হিমাচল উত্তর ভারতে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম, এবং কেরালা তামিলনাড়ুর সমগোত্রীয়।
* * * * * *
রাজ্য রাজনীতিতে ক্ষমতার পালাবদলের এই নিয়মিত ধারার মধ্যেই আবার বিপরীত ধারাটিও বর্তমান। ছত্তিসগড়ে বিজেপি, পশ্চিমবঙ্গে প্রথমে বামফ্রন্ট পরে তৃণমূল, ওড়িশায় বিজেডি, বিহারে রাজেডি, জেডিইউ, গুজরাটে বিজেপি কোনও কোনও সময় ১৫ থেকে ২৫ বছর একটানা রাজত্ব করেছে। এটা কি করে সম্ভব হল? একদিকে কিছু রাজ্যে নিরন্তর সরকার বদল হচ্ছে, অন্যদিকে কিছু রাজ্যে এক এক সময় একটা দলের সরকার দিব্যি লম্বা সময় ধরে রাজত্ব করছে। তাহলে প্রশ্ন ওঠে ওই রাজ্যগুলির রাজনীতিতে এমন কি আছে, যার জন্য এটা সম্ভব হচ্ছে?
উপরের আলোচনার রেশ ধরে বলা যায় যে, এই সব রাজ্যে জাতি-সমীকরণ কোন কারণে অনেক বেশি স্থিতিশীল, তাই এ ঘটনা ঘটছে। কিন্তু ওড়িশা বা বাংলার ক্ষেত্রে এ ধরণের জাতি-সমীকরণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আর বিহারে, ছত্তিসগড়ে, এমনকি গুজরাতে জাতি-সমীকরণের ছবি নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে, কিন্তু তার স্থিতিশীলতা এবং জাতি-সমীকরণের প্রভাবে সরকারের টিকে থাকা ব্যাখ্যা করা যাবে কি? নাকি অন্য কোন বিষয়ের অবতারণা করতে হবে?
টিকে থাকার কাহিনির শুরু বামফ্রন্ট থেকে। ভূমি সংস্কার আর পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার মাধ্যমে, গ্রাম-মফস্বলের গরিবকে পাশে পেয়েছিল বামফ্রন্ট। এই গরিব প্রান্তিক চাষি হতে পারে, খেত মজুর হতে পারে, ভাগ চাষি হতে পারে, ছোট ব্যবসায়ী হতে পারে, ছোট কলকারখানার শ্রমিক হতে পারে। গরিব নিশ্চয়ই জীবনের অনেক সিদ্ধান্তের বেলায় জাতের কথা ভাবত, কিন্তু ভোট দেবার বেলায় ভাবত না। তাত্ত্বিকেরা এর নাম দিয়েছিলেন শ্রেণি-সমীকরণ। এই শ্রেণি-সমীকরণ এক দীর্ঘ সময়ের আন্দোলন থেকে উদ্ভূত। ভূমি সংস্কার ও পঞ্চায়েত গরীবের মনে সরকারের প্রতি গভীর ভরসা তৈরি করেছিল।
সরকার গড়তে ভাঙতে গেলে জাতি-সমীকরণ কাজে লাগে, কিন্তু সরকার টিকতে গেলে, সমাজের একটা বিস্তৃত অংশের সরকারের প্রতি ভরসা তৈরি করতে হয়। ছত্তিসগড়ে রমণ সিং এই একই কাজ করেছিলেন রেশন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এনে। রেশন ব্যবস্থা গ্রামীণ ও মফঃস্বলের গরীবের লাইফ লাইন, এটা সবাই জানে। সেই ব্যবস্থাই বহু দশক যাবৎ গরীবকে ঠকিয়ে এসেছে। রমণ সিং বুঝেছিলেন গরীবের ভরসা অর্জন করতে গেলে এ একটা সহজ উপায়। কিন্তু রেশন ব্যবস্থা একটা মারাত্মক দুর্নীতিগ্রস্থ পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ ব্যবসা, যার এক প্রান্তে আছে, নানা স্তরের সরকারি আধিকারিকেরা, আর অন্যদিকে আছে ডিস্ট্রিবিউটর ডিলার-রা। রমণ সিং এক ধাক্কায় সমস্ত লাইসেন্স বাতিল করে, ডিলারশিপ পুরোপুরি মহিলা দল আর গ্রাম পঞ্চায়েতের হাতে তুলে দিলেন। সমস্ত তথ্য বলে এতে দুর্নীতি বহুলাংশে কমল, সাপ্লাই আরও তৎপর হল, সাধারণ মানুষের কাছে জবাবদিহি বাড়ল। গরীব ভরসা পেল এই ভেবে, যে এই সরকার আমাদের কথা ভেবেছে। পাশাপাশি রমণ সিং-এর সরকার মাওবাদী আন্দোলন দমনে কঠোর ভূমিকা নিলেন। পূর্ব ও দক্ষিণ ছত্তিসগড়ের কয়েকটা জেলা ছাড়া মাওবাদীদের সত্যি কোন প্রভাব ছিল না, কিন্তু আপামর মানুষের মনে আতঙ্ক ছিল। রমন সিং সেই আতঙ্ক দূর করতে অনেকটাই সক্ষম হলেন।
ভরসা তৈরি-র রাজনীতিতে শুধু রমণ সিং নন, নিতীশ, নবীন, মমতাও একই পথে হেঁটেছেন। নিতীশ সরকারের সুস্পষ্ট দৃষ্টি ছিল আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি, পরিকাঠামোর উন্নতি আর মেয়েদের স্কুলে পাঠানোয়। নবীনের দৃষ্টি ছিল রেশন ব্যবস্থার উন্নতি ও দুর্যোগ মোকাবিলা ব্যবস্থার উন্নতির দিকে। মমতারও পরিকাঠামো উন্নতি, আর মেয়েদের কিছু সহায়তা পৌঁছে দেবার দিকে আগ্রহ ছিল। এগুলির কোনটাই খুব কঠিন কাজ নয়। ভূমি সংস্কার, গ্রামীণ বিকেন্দ্রীকরণ, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদি উন্নতি তুলনায় অনেক কঠিন কাজ। কিন্তু এই কাজগুলি মানুষের ভরসা তৈরি করতে পারে, স্বস্তি দিতে পারে। সমাজে এই বার্তা যায় যে সরকার সাধারণ মানুষের পাশে আছে। এই বার্তাটি টিকে থাকার রাজনীতিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এই প্রসঙ্গে আরেকটা বিষয় উল্লেখ করা দরকার। রেশন, আইন-শৃঙ্খলা, মেয়েদের স্কুলে পাঠানো বা ঘরে কিছু পৌঁছে দেওয়া সবটাই রাজ্য সরকারের বিষয়। এসবের সাফল্যে কেন্দ্র ভাগ বসাতে পারে না, নাম যশ সবটাই রাজ্য সরকারের ঝুলিতে। এটা কেন্দ্রীয় সরকারের যোজনা রূপায়নের দক্ষতা নয় - ১০০ দিনের কাজ দেওয়ার সঙ্গে এই কাজগুলিকে এক পংক্তিতে ফেলা যাবে না। রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি তৈরিতে ১০০ দিনের কাজের চেয়ে এই কাজগুলি অনেক বেশি কাজে লাগে, যদিও ১০০ দিন কাজ পেলে ঘরে প্রায় ২২,০০০ টাকা আসে। সরকারের অন্য কোনও সহায়তায় তা আসে না।
একটু তলিয়ে দেখলে আরও দুটি বিষয় নজরে আসে। এক, টিকে থাকার জন্য একটি কি দুটি জনকল্যাণকারী কাজ বিস্তৃতভাবে করলেই হয়, ব্যাপক সমাজ সংস্কার, অর্থনৈতিক সংস্কারের দরকার হচ্ছে না। ভূমি সংস্কার, গ্রামীণ বিকেন্দ্রীকরণ, শিক্ষা স্বাস্থ্যের প্রসার, বা কূদুম্বশ্রি-র মত কর্মসূচি টিকে থাকার জন্য ছিল না। এখন বিভিন্ন সরকার যা করছে, তা টিকে থাকার জন্যই করছে। দ্বিতীয়টি বোধহয় এই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। রাজ্যের রাজনীতি বহুকাল যাবত জাতি, ভাষা, অঞ্চল ও শ্রেণির অক্ষ পথে যাতায়াত করেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল হয় জাতি, নয় ভাষা, অঞ্চল বা শ্রেণি একতার মধ্যে রাজনৈতিক সংহতি তৈরির উপাদান খুঁজে পেয়েছে, সেই অনুযায়ী সংগঠন, সংগঠক, শ্লোগান, সমাবেশ, কর্মসূচি তৈরি করেছে। জাতি, ভাষা, শ্রেণি বা অঞ্চল - এগুলির ভিত সমষ্টি বা গোষ্ঠীতে, ব্যক্তিতে নয়। কংগ্রেসের একদলীয় শাসনের ছাতার থেকে বেরিয়ে দেশ জুড়ে বহু দলীয় শাসনের সুদীর্ঘ ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায় জাতি, ভাষা, অঞ্চল বা শ্রেণিগত সমষ্টির জোরেই বহু দলীয় গণতান্ত্রিকতার প্রসার ঘটেছে। সাম্প্রতিক কালে যা ঘটছে তাতে একটা নতুন দিশার ইঙ্গিত মিলছে বলে মনে হয়। টিকে থাকার রাজনীতি চিরাচরিত অক্ষপথগুলিতে চালিত হচ্ছে কি? সন্দেহ হয়। নিরাপত্তা, সাইকেল, রেশন, ব্যাঙ্কে টাকা, দুর্যোগে রক্ষা ও ত্রাণ, (আরও সাম্প্রতিক কালে রান্নার গ্যাস), এক নতুন অক্ষপথ তৈরি করেছে বলে আমি মনে করি, সেই অক্ষপথের ভিত রচিত হচ্ছে মহিলাদের মনে। এর ভিত সমষ্টিতে নেই, আছে ব্যক্তিতে।
গত ১৫-২০ বছরে ভোটের রাজনীতিতে যে সব ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে বোধহয় সবচেয়ে নতুন ঘটনা হল মহিলাদের ভোট। সমস্ত তথ্য বলে মহিলাদের ভোট দেবার প্রবণতা বেড়েছে, এবং নিজেদের ভাল মন্দ বিচার অনুযায়ী ভোট দেওয়া বেড়েছে। এর পিছনে যে সামাজিক উত্থান আছে তা নিয়ে এখানে বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ নেই, শুধু এইটুকু বলে ক্ষান্ত হব যে ৯০-এর দশক থেকেই সরকারি বেসরকারি নানা উদ্যোগে মহিলা ক্ষমতায়নের কাজ শুরু হয়েছিল। অন্ধ্রের আরক বিরোধী আন্দোলন, ৮টি রাজ্যে মহিলা-সমাখ্যা প্রকল্প থেকে শুরু হয়ে স্বনির্ভর দলের প্রসার, কুদুম্বশ্রি, ভেলেগু-জন্মভূমি, নানা রাজ্যে জমি আন্দোলন ইত্যাদি নানা উপায়ে দেশে এমন একটা সামাজিক উত্থানের প্রক্রিয়া দানা বেঁধেছে, যার ফলে মহিলারা বাড়ির বাইরে একলা বেরোচ্ছেন, দলবদ্ধ হয়ে নানা কাজ করছেন, তাঁদের হাতে কিছু টাকা আসছে, নিজেদের নামে ব্যাঙ্কে খাতা হচ্ছে, সরকারি অফিসে তাঁদের আনাগোনা বেড়েছে, সব মিলিয়ে তাঁদের স্বাধীন চেতনা বাড়ছে। ভোটের জগতে এর মূল পরিণাম হল মহিলারা নিজেদের মন-মরজি মত ভোট দিচ্ছেন। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের কাছে মহিলারা একটা আলাদা ভোট-গোষ্ঠী বলে পরিচিত হচ্ছেন।
এই ভোট-গোষ্ঠী-র কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমত, এই মহিলা ভোট-গোষ্ঠী-র ভিত সমষ্টিতে নয়, ব্যক্তিতে। যে অর্থে স্থান কাল সংস্কৃতি ইতিহাসের অর্থে জাতি, ভাষা, শ্রেণি বা আঞ্চলিকতার চেতনার উৎস সমষ্টিতে, ঠিক সেই অর্থে মহিলা চেতনার উৎস সমষ্টিতে নয়, মহিলা চেতনার উৎস ব্যক্তি কেন্দ্রিক। এটা ভাল মন্দের বিষয় নয় - সমষ্টি চেতনা, আর ব্যক্তি চেতনার মধ্যে বেছে নেবার কথা উঠছে না, উঠছে চিহ্নিতকরণের কথা। দ্বিতীয়ত জাতি, ভাষা, শ্রেণি বা আঞ্চলিকতা কেন্দ্রিক ভোট চেতনা সমষ্টির প্রকাশ্য assertion-এর চেতনা - আত্মমর্যাদা, গরিমার চেতনা। মহিলাদের ভোট চেতনা ব্যক্তির নীরব assertion-এর চেতনা। আজকে গ্রাম মফঃস্বলের মহিলারা স্পষ্ট বুঝতে পারছেন, জাতি-ভাষা-শ্রেণি-আঞ্চলিকতার চেতনায় মেয়েদের মুক্তি নেই, মেয়েদের মুক্তি আছে স্কুল কলেজে যেতে পারলে, পকেটে নিজস্ব কিছু টাকা থাকলে, রোজগারি কাজ করতে পারলে, সংসারের যন্ত্রণা থেকে কিছুটা অবসর পেলে, অন্য মেয়েদের সঙ্গে এক সঙ্গে মিশে বাইরের জগতকে অনুভব করতে পারলে। নিয়মিত সঠিক পরিমাণ ও গুণমানের রেশন, রান্নার গ্যাস, পাইপের জল, নিজের অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে কিছু টাকা, বাড়িতে একটা লেডিস সাইকেল ইত্যাদি সেই ভরসা যোগায়। তৃতীয়ত, এই নীরব assertion-এর চেতনা কিছুটা পরিমাণে হলেও, জাতি ভিত্তিক রাজনীতির উপরে উঠতে পেরেছে। পুরুষদের ভোট নানা জাতির মধ্যে যেভাবে ভাগ হয়, মহিলাদের ক্ষেত্রে ততটা দেখা যাচ্ছে না। স্পষ্টতই সরকারি যোজনার প্রত্যক্ষ এবং অনেক ক্ষেত্রে অপ্রত্যক্ষ টার্গেট মহিলারা। রমন-নবীন-নিতীশ-মমতা - এঁদের সবারই নীরব সমর্থক মহিলারা। এমনকি একই ছবি দেখতে পাচ্ছি উত্তরপ্রদেশের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে।
সব ব্যাখ্যারই ব্যতিক্রম থাকে, এই ব্যাখ্যার উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হল গুজরাত। গুজরাতে ১৯৯৩ সাল থেকে বিজেপির শাসন একটানা চলছে। মুখ্যমন্ত্রী বদলেছে ঠিকই - সুরেশ মেহতা, কেশুভাই প্যাটেল, নরেন্দ্র মোদী, আনন্দি প্যাটেল, বিজয় রুপানি, ভুপেন্দ্র প্যাটেল - কিন্তু শাসক দল বদলায়নি। সে অর্থে পশ্চিমবঙ্গে বামদের রেকর্ড ছুঁতে চলেছে গুজরাতের বিজেপি। এর সামাজিক ব্যাখ্যা কি? সবাই জানে গুজরাতে এমন কিছু সমাজ সংস্কার বা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বা অর্থনৈতিক সংস্কার কোনটাই হয়নি। গুজরাটে অর্থনৈতিক প্রগতি হয়েছে ঠিকই কিন্তু ওই ধরনের অর্থনৈতিক প্রগতি অন্য রাজ্যেও হয়েছে, সে ব্যাপারে গুজরাত ব্যতিক্রম কিছু নয়। সামাজিক প্রগতির সূচকে গুজরাত আসে উপর থেকে ১৩ নম্বরে। সেটাও এমন কিছু বলার মত নয়।
গুজরাতে যা ঘটেছে, তাকে রাজনীতির গুজরাত মডেল বলা যেতে পারে। কাহিনির মূলে কংগ্রেসের একটি রাডিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট। মাধব সিং সোলাঙ্কি ক্ষত্রিয়-হরিজন-আদিবাসী-মুসলিম এই চার সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা নির্বাচনী ঐক্য তৈরি করেছিলেন, যার সুফলে ১৯৮৫ সালে তিনি ক্ষমতায় আসেন। এই উত্থানের দৌলতে সংরক্ষণের দাবীটি আবার জোরদার হয়ে ওঠে। বিপরীতে ছিল ব্রাহ্মণ, বানিয়া, এবং প্যাটেল-রা। সোলাঙ্কির শাসনকালে গুজরাতে সংরক্ষণ বিরোধী একটা মহা আন্দোলন হয়েছিল। আসলে সেটা ছিল ওই সামাজিক পিছিয়ে পড়া অংশের সেকুলার ঐক্যের বিরুদ্ধে এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে সরকারি তন্ত্রে এদের কব্জার সম্ভাবনায় উদ্বিগ্ন এই প্রতিপত্তিশালী সম্প্রদায়গুলির প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদের প্রভাবে সোলাঙ্কিকে পদত্যাগ করতে হয়। ৯০-এর দশকে লালকৃষ্ণ আদভানির নেতৃত্বে যে হিন্দুত্বের অভিযান চলেছিল, সেই অভিযানের গুজরাটি ভার্সনটি ছিল, যে মুসলমান ও হরিজন তথা আদিবাসীদের শাস্তি দিতে হবে, আর ওবিসি জাতিগুলিকে হিন্দু দলে টানতে হবে। ওবিসি জাতিগুলিও হরিজন আদিবাসী ও মুসলমানদের সঙ্গে কংগ্রেসের বোঝাপড়াকে অনভিপ্রেত বলে ভাবতে শুরু করে। ফলে বিজেপি-র পক্ষে একটা হিন্দু ঐক্য গড়ে তুলতে সুবিধা হয়। ২০০২-এর দাঙ্গা এই ঐক্যকে আরও জোরদার করে। মুসলমানদের শাস্তি দেওয়া গেছে, ক্ষত্রিয়-হরিজন-মুসলিম-আদিবাসী ঐক্য ভেঙ্গে দেওয়া গেছে। বিশেষ করে মুসলিমদের মধ্যে যে অগ্রণী অংশটি তৈরি হয়েছিল, সেই অংশটিকে একবারে খতম করে দেওয়া গেছে।
এই কাহিনির সঙ্গে পাশাপাশি আরও একটা কাহিনি আছে। হরিজন, আদিবাসী, মুসলমান এই তিনটি শব্দ গুজরাটের শ্রমিকের সমার্থক। গ্রামীণ শ্রমিক, শহুরে শ্রমিক - দুই ক্ষেত্রেই এই তিনটি সামাজিক গ্রুপের প্রাধান্য। অন্যদিকে গ্রাম স্তরে দুটি ক্ষমতাশীল সামাজিক গ্রুপ, প্যাটেল ও ক্ষত্রিয়রা চিরকাল বিপরীত মেরুতে থেকেছে। শহরে মফস্বলে, বানিয়া, জৈন, প্যাটেল ও ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য, কারণ এরাই ছোট বড় ব্যবসায়ী, কলকারখানার মালিক, এমনকি শিল্পপতি। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এক হওয়া মানে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের বিরুদ্ধে সমাজের অগ্রণী অংশের এক হওয়া। এটা নির্বাচনী একতা নয়, এটা সমাজের ও অর্থনীতির চালিকাশক্তির নিয়ন্ত্রণের জন্য এক হওয়া, যা হরিজন-আদিবাসী-মুসলিম-ক্ষত্রিয় একতাকে রুখতে পারে, তাদের একতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পারে। এই ধরনের জাতি-ঐক্য তৈরি করতে গেলে তার অনুকূল একটা মতাদর্শ লাগে। বিজেপি সেই মতাদর্শ জুগিয়েছে। এই ধরণের জাতি ঐক্যের মধ্যে নিরন্তর যে সব আর্থিক, সামাজিক সংঘাত লেগে থাকে তা প্রশমিত করতে পার্টি ও তার সহযোগী সমাজের সংস্থা - সংগঠনগুলি (এক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী এসোসিয়েশন, আরএসএসের শাখা) প্রয়োজনমত আইন, পুলিশ, সরকারি আমলাতন্ত্রকে ব্যবহার করে সেই কাজটি সম্পন্ন করছে। পশ্চিমবঙ্গে বাম আমলে একসময় যেমন পার্টি আর সরকারকে আলাদা করে চেনা কঠিন হয়ে পড়েছিল, গুজরাতে বিজেপি প্রায় সেই পর্যায়ে রাজ্যটিকে নিয়ে গেছে।
গুজরাট মডেল এটাই যে, সমাজের ক্ষমতাশীল জাতিগুলির মধ্যে মতাদর্শগত ঐক্য তৈরি করতে সক্ষম হওয়া, অন্য ধর্মালম্বী মানুষদের সামাজিক অর্থনৈতিকভাবে এমন কোণঠাসা করে দেওয়া যাতে তারা নিজেরাই সমাজে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে নিজেদের মেনে নেয়, সরকারি তন্ত্রকে একেবারে এই মতাদর্শের কব্জায় নিয়ে নেওয়া, সাংবিধানিক নৈতিকতা, বাঁধন, বিধান ও প্রতিষ্ঠানগুলিকে পঙ্গু করে দিয়ে সনাতন ব্রাহ্মণ্য সমাজে ক্ষমতার বিন্যাস, সংস্কৃতির আঁচল, ও অনুরূপ নৈতিকতা তৈরিতে সক্ষম হওয়া। সরকার টেকার পিছনে এই মতাদর্শগত ঐক্য এবং তার সুগন্ধে ওবিসিদের একটা অংশকে সামিল করতে পারাটাই প্রধান কারণ। অর্থনৈতিক-সামাজিক প্রগতি-র গল্পটি একেবারেই অসার।
বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ফেডারাল রাষ্ট্রে সরকার টেকে বা টেকে না কেন, এবং কিছু রাজ্য কেন সামাজিক আর্থিক ভাবে এগিয়ে যায়, আবার অনেকেই পারে না, এই দুই প্রশ্নকে এক সঙ্গে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি এই নিবন্ধে। সরকার টিকলে কি উন্নয়ন হবে, সরকার না টিকলেও উন্নয়ন হচ্ছে কি করে, বারবার সরকার পালটালে কি উন্নয়ন হবে, না হবে না, এইসব প্রশ্নগুলো সবাইকেই ভাবায়, সেই ভাবনায় আমি একটু রসদ জোগানোর চেষ্টা করেছি। এইসব প্রশ্ন নিয়ে আরও বিস্তৃত আর গভীর আলোচনা দরকার। আশা করি সেই যাত্রায় অনেকেই সামিল হবেন।
পরিশিষ্ট (হিমাচল প্রদেশের সামাজিক প্রগতি)
১. মাধ্যমিক স্তরে পেরনো স্কুল পড়ুয়াদের সংখ্যা ৪৭% (রাঙ্ক উপর থেকে ৫ম)
২. স্কুল পড়ুয়াদের শিক্ষাগত ক্ষমতা (learning outcome) - ৭৫% (রাঙ্ক প্রথম)
৩. টয়লেট ব্যবহার করে এমন পরিবারের সংখ্যা ৭৮% (রাঙ্ক উপর থেকে ৮ম)
৪. তপশিলি জাতিদের মধ্যে বিপিএল মাত্র ১৬% (নীচ থেকে ৫ম)
৫. মেয়েদের শ্রমশক্তিতে যোগদান ৬৩% (রাঙ্ক প্রথম)
৬. মাধ্যমিক পেরনো মেয়েদের সংখ্যা ৪১% (রাঙ্ক উপর থেকে ৫ম)
৭. বিদ্যুতায়িত ঘরের সংখ্যা ৯৮% (রাঙ্ক উপর থেকে ৩য়)
৮. পাবলিক সেক্টরে কর্মরত মানুষের সংখ্যা ২৮% (রাঙ্ক প্রথম)
৯. আদিবাসীদের মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক পেরনোদের সংখ্যা ৬০% (রাঙ্ক প্রথম)
১০. ছোটখাটো স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার জন্য সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে/হাসপাতালে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ৫৮% (রাঙ্ক প্রথম)
১১. টোটাল ফারটিলিটি রেট ১.৯% (রাঙ্ক ৩য়)।