আরেক রকম ● দশম বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২২ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪২৯
সমসাময়িক
আফস্পা প্রত্যাহার?
মার্চ মাসের শেষ দিনের ভরদুপুরে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অকস্মাৎ এক টুইট বার্তা মারফত দেশবাসীকে জানালেন, - ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীজির নেতৃত্বে ভারত সরকার কয়েক দশক পরে নাগাল্যান্ড, মণিপুর এবং আসামে আফস্পার অধীনে অশান্ত এলাকা কমানোর বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করেছে। কেন্দ্রের এই পদক্ষেপ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে শান্তি, সমৃদ্ধি এবং উন্নয়নের একটি নতুন যুগের সূচনা করবে।'
চতুর্দিকে বেজে উঠল কাড়া-নাকাড়া। উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলির দীর্ঘদিনের দাবি মেনে নেওয়ায় সকলে ধন্য ধন্য করতে শুরু করে দিল। শুরু হয়ে গেল লাগামহীন প্রচার। অথচ কেউ প্রশ্ন করলেন না সংসদের অধিবেশন চলাকালীন সংসদে বিবৃতি না দিয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে বার্তা কেন দেওয়া হল? অবিশ্যি বর্তমান শাসকদল কবেই বা সংসদীয় রীতিনীতি মেনে চলে!
বাস্তবের সঙ্গে প্রচারের বিরাট ফারাক। ৩১শে মার্চের টুইট বার্তার পর যে সরকারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় তাতে দেখা যাচ্ছে আসামের ২৩টি জেলা থেকে আফস্পা পুরোপুরি প্রত্যাহৃত হয়েছে। ৯টি জেলায় কিন্তু আফস্পা জারি থাকবে। আর একটি জেলা আংশিকভাবে আফস্পার আওতায় থাকবে। সবমিলিয়ে আসামের ৬০ শতাংশ এলাকা আফস্পা মুক্ত হয়েছে।
সরকারের বিজ্ঞপ্তি অনুসারে নাগাল্যান্ডের ৩টি জেলায় আফস্পা আর প্রযুক্ত হবে না। তবে ৪টি জেলা আংশিকভাবে আফস্পার আওতায় থাকবে। সবমিলিয়ে নাগাল্যান্ডের ২৫ শতাংশ এলাকা আফস্পা মুক্ত হয়েছে। মণিপুরের ৬টি জেলা আংশিকভাবে আফস্পার আওতায় থাকলেও নাগা অধ্যুষিত ৩টি পার্বত্য জেলায় আফস্পা আগের মতোই জারি থাকবে।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, উত্তর পূর্ব ভারতের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে ১৯৫৮-য় সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন (আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট বা আফস্পা) প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে আরও দাবি করা হয়েছে, সেই সময় উত্তর পূর্ব ভারতের অশান্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজ্য সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসন অক্ষম হওয়ার কারণেই আফস্পা কার্যকর করা হয়।
১৯৫৮-র মে মাসে প্রথমে অর্ডিন্যান্স হিসেবে জারি হলেও কিছুদিনের মধ্যেই সংসদের দুই কক্ষে আলোচনার পর আফস্পা সংসদীয় অনুমোদন পায়। কিছুদিনের মধ্যেই রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পাওয়ার পর আফস্পা পুরোদস্তুর আইনের স্বীকৃতি পায়। প্রাথমিক ভাবে উত্তর পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে আফস্পা কার্যকর করা হয়। যদিও এরপর এই আইনে একাধিক সংশোধন করা হয়েছে এবং বেশ কয়েকটি রাজ্য এবং এলাকাকে আফস্পা-র পরিধি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
'হিউম্যান রাইটস ওয়াচ' সহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের মতে, ১৯৪২-এ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে ব্রিটিশদের জারি করা একটি অর্ডিন্যান্সের অনুকরণেই আফস্পা প্রণয়ন করা হয়। প্রাথমিক ভাবে নাগা জঙ্গিদের সশস্ত্র আন্দোলনকে দমন করতেই আফস্পা-কে কার্যকর করা হলেও ১৯৭২-এ একটি সংশোধনী নিয়ে এসে আফস্পাকে উত্তর পূর্বের সাতটি রাজ্যেই কার্যকর করা হয়। একই ভাবে ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৪-র মধ্যে পঞ্জাবের নাশকতামূলক কার্যকলাপ দমন করতে আফস্পা-র মতো কয়েকটি আইন কার্যকর করা হয়। ১৯৯০-এ কাশ্মীরের জন্যও একই ধরনের আইন নিয়ে আসে কেন্দ্র।
আফস্পা-র ব্যাখ্যা অনুযায়ী বায়ু সেনা থেকে শুরু করে স্থলভূমিতে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা যে কোনও সামরিক বাহিনীকেই সশস্ত্র বাহিনী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার এই আইন অনুযায়ী, কোনও রাজ্য বা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের রাজ্যপাল যদি মনে করেন যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সশস্ত্র বাহিনীর ব্যবহার প্রয়োজন, তাহলেই সেই এলাকাকে উপদ্রুত হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে। আফস্পা-র তিন নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, উপদ্রুত এলাকায় সশস্ত্র বাহিনীর যে কোনও কমিশনড অফিসার, ওয়ারেন্ট অফিসার, নন-কমিশনড অফিসার অথবা সমপদমর্যাদার যে কোনো ব্যক্তি আইনভঙ্গকারী কারও বিরুদ্ধে অন্যান্য পন্থার সঙ্গে গুলি চালানো বা বলপ্রয়োগ করতে পারেন যাতে কারও প্রাণহানিও হতে পারে।
একই ভাবে আফস্পা-র ক্ষমতাবলে সশস্ত্র বাহিনীর যে কোনও অফিসার ওয়ারেন্ট ছাড়াই এমন কাউকে গ্রেফতার পারেন, যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কোনও অপরাধ করে থাকেন অথবা করতে পারেন বলে সন্দেহ করা হয়।
এখানেই শেষ নয়, সূত্র মারফত পাওয়া কোনো খবরের ভিত্তিতে যে কোনো বাড়ি বা আস্তানা থেকে সশস্ত্র আক্রমণের আশঙ্কা আছে মনে হলে সেই নির্মাণ বা আস্তানা ধ্বংস করার অধিকার আফস্পা অনুযায়ী নিরাপত্তা বাহিনীর রয়েছে। পাশাপাশি, উপদ্রুত এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনী কোনও পদক্ষেপ করলে তার বিরুদ্ধে যাতে কোনও আইনি পদক্ষেপ না করা হয়, আফস্পা-য় সেই রক্ষাকবচও দেওয়া হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীকে। আইনে বলা রয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠলে একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি সাপেক্ষেই নিরাপত্তা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করা যাবে।
আফস্পা-র বিরুদ্ধে বরাবরের অভিযোগ ক্ষমতার অপব্যবহার করে অত্যাচার, ধর্ষণ, সাধারণ মানুষকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটায় সশস্ত্র বাহিনী। আইনি পদক্ষেপের ভয় না থাকাতেই এই ধরনের ঘটনা বাড়ছে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলির বরাবরের অভিযোগ।
স্থানীয় জনজাতি সংঠনগুলিও বহুদিন ধরে একই অভিযোগ করে চলেছে। রাজনৈতিক দলগুলোও আফস্পা প্রত্যাহারের দাবিতে মুখর। বিশেষতঃ নির্বাচনের আগে প্রচারিত ইশতেহারে আফস্পা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি প্রায় সব রাজনৈতিক দলই দিয়ে থাকে। এখনও পর্যন্ত একমাত্র ত্রিপুরার বামফ্রন্ট সরকার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পেরেছিল। ১৯৯৭-এর ১৬ই ফেব্রুয়ারি জারি করা আফস্পা ২০১৫-র ২৮শে মে ত্রিপুরা থেকে প্রত্যাহৃত হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে ধারাবাহিক ভাবে বিস্তর বিতর্কের পর ত্রিপুরার তখনকার বামফ্রন্ট সরকার রাজ্য থেকে আফস্পা প্রত্যাহারের প্রস্তাব বাস্তবায়িত করে।
অন্য রাজ্যগুলির মধ্যে একমাত্র নাগাল্যান্ড সাম্প্রতিক অতীতে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছে। ২০২১-এর ডিসেম্বরে নাগাল্যান্ডের মন জেলার ওটিং গ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ১৪ জন নিরীহ নাগরিকের মৃত্যুর পরই ফের চর্চায় আসে আর্মড ফোর্সেস স্পেশ্যাল পাওয়ারস অ্যাক্ট বা আফস্পা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের একটা অংশ রাজ্য থেকে এই বিশেষ আইন প্রত্যাহারের দাবিতে সরব হয়। রাজ্য বিধানসভায় সর্বসম্মতিক্রমে আফস্পা প্রত্যাহারের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ৩১শে মার্চের বার্তা অনুসারে কিন্তু সমগ্র নাগাল্যান্ড নয়, মাত্র ২৫ শতাংশ এলাকাকে আফস্পা মুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
উত্তর পূর্ব ভারতে দীর্ঘদিন ধরেই সক্রিয় বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধের অন্যতম মূল কারণ আফস্পা। বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে শান্তি আলোচনাতে সবসময়ই আফস্পা প্রত্যাহারের দাবিই প্রাধান্য পায়। তবুও আলোচনা হয়। সেটাই তো স্বাভাবিক। জঙ্গী সন্ত্রাসী বিচ্ছিন্নতাবাদী দমন যে কোনো প্রশাসনের প্রাথমিক কর্তব্য। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে আংশিক ভাবে হলেও আফস্পা প্রত্যাহারের ঘোষণা যথেষ্ট সদর্থক।
তবুও প্রশ্ন ওঠে। সরকারি বিবৃতি অনুযায়ী নিরাপত্তা ফিরে আসার জন্য আফস্পা প্রত্যাহার করা হলে পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হল না কেন? বিজ্ঞাপন মারফত নিয়মিত প্রচার হচ্ছে যে দুই কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল জম্মু ও কাশ্মীর এখন আর অশান্ত নয়। তাহলে সেই দুই কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে কেন আফস্পা এখনও বলবৎ রয়েছে?
এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে গেলে প্রথমেই আরেকটি প্রশ্ন করতে হয়। ঠিক এই সময়েই হঠাৎ করে কেন এই ঘোষণা করা হল? ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে যে এটাই আদর্শ সময়। গত কয়েক বছর ধরে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে প্রশাসন আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। যেভাবে এই গোষ্ঠীগুলির নেতাদের আপ্যায়ন করা হচ্ছে তা রীতিমতো নজর কাড়া। বিদেশে পলাতক কোনো নেতার সঙ্গে নিয়মিত অনলাইনে যোগাযোগ করা হচ্ছে। কখনও আবার কোনো নেতার আলোচনার আমন্ত্রণ রক্ষা করতে কোনও এক প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছে যাচ্ছেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অর্থাৎ বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর নেতৃত্ব প্রশাসনের কাছে গুরুত্ব আদায় করে চলেছে। অথচ এইসব নেতারা এবং তাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বাহিনী এখন বাস্তবে জনবিচ্ছিন্ন। সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদের আর তেমন কোনো প্রভাব নেই। তবুও তাদের ধারাবাহিক ভাবে কেন প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে?
উত্তর পূর্ব রাজ্যগুলিতে বসবাসরত অসংখ্য স্থানীয় জনজাতির মানুষ নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারছেন যে উগ্র জঙ্গী আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁদের প্রতিদিনের সমস্যার সমাধান হবে না। তাঁরা নিজেদের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানের জন্য সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছেন। প্রতিটি জনজাতির নিজস্ব জীবনযাপন পদ্ধতি পোশাক সংস্কৃতি আজও প্রচলিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভাষাও ভিন্ন। এবং প্রতিটি গোষ্ঠীর দাবিদাওয়াও স্বতন্ত্র। সর্বোপরি জনজাতি গোষ্ঠীগুলির লোকবল তেমন একটা বেশি নয়। এহেন বিভেদ শাসকের জন্য সবসময়ই সুবিধাজনক। কিন্তু সকলের একটা সম্মিলিত সাধারণ চাহিদা রয়েছে। যতদিন জঙ্গী বিচ্ছিন্নতাবাদ রাজ্যগুলিতে দাপিয়ে বেড়াত ততদিন এইসব ছোটো ছোটো জনগোষ্ঠীর মানুষ প্রাণভয়ে নিজেদের দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য কোনো আন্দোলনের কথা ভাবতেই পারেননি। সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আতঙ্কে মানুষ তখন দিশাহারা। কোনোরকমে মুখ বুজে বেঁচে থাকা ছাড়া অন্য কিছু ভাবার অবকাশ ছিল না। জঙ্গী বিচ্ছিন্নতাবাদ ক্রমশঃ সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশান্তরী হয়ে যাওয়ার পর ছোটো ছোটো জনজাতি গোষ্ঠীগুলি নিজের নিজের দাবি আদায়ের জন্য একত্রিত হয়ে আন্দোলন শুরু করেছে। আবার সাধারণ দাবি যেমন স্বায়তশাসনের অধিকার, স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে জনজাতি গোষ্ঠীগুলি এখন মুখর। সাম্প্রতিক অতীতে অরুণাচল প্রদেশ ও নাগাল্যান্ডে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে প্রশাসন পুরোপুরি বিপর্যস্ত। শাসকের বিভেদের নিদানপত্র খুব একটা কাজে আসছে না।
এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠে সেই কারণেই কি নাম কা ওয়াস্তে আফস্পা প্রত্যাহার? যতটুকু এলাকা আফস্পা মুক্ত হয়েছে তার থেকে শত গুণ বেশি হচ্ছে প্রচার। পাশাপাশি চলছে জঙ্গী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে সমঝোতার প্রচেষ্টা। কারণ, জঙ্গী বিচ্ছিন্নতাবাদ আবার মাথা চাড়া দিলে আতঙ্কে হারিয়ে যাবে প্রান্তিক জনজাতির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গোষ্ঠীসমূহের দাবিদাওয়া আদায়ের আন্দোলন। এখন প্রচারে বিভ্রান্ত হওয়ার সময় নয়, সতর্কতা জারি থাক।