আরেক রকম ● দশম বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২২ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪২৯

সমসাময়িক

লঙ্কা কাণ্ড


শ্রীলঙ্কার রাজপথে আপামর দেশবাসী নেমে এসে ডাক দিয়েছে 'গো গোতা গো'। সেখানকার জনতা রাস্তায় নেমে রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষের অপসারণ দাবি করছে। রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষে ও প্রধানমন্ত্রী তথা রাষ্ট্রপতির দাদা মাহিন্দা রাজাপক্ষে মানুষের এবং রাজনৈতিক সাথীদের আস্থা হারিয়েছেন। জাতি নির্বিশেষে শ্রীলঙ্কাবাসীরা এদের অপসারণের দাবীতে বিক্ষোভ দেখিয়ে চলেছে। জাতীদ্বেষে জীর্ণ সিংহলিরা আজ সব বিভেদ ভুলে দেশব্যাপী এক প্রতিবাদে সামিল। এটা হয়ত এত খারাপের ভেতরেও এক আলোর রেখা।

ভারতের দক্ষিণে অবস্থিত ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা আজ এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন। গোটা দেশটাই আজ দেউলিয়া ঘোষণা হওয়ার মুখে। যদিও এই অবস্থা একদিনে ঘটেনি। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে এক ভ্রান্ত রাজনীতির অনুশীলন দেশটিকে আজ এই অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে। গোটা দেশটার অর্থব্যবস্থা আজ ভেঙে পড়ার মুখে। মূল্যবৃদ্ধি আকাশছোঁয়া। বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার আজ তলানিতে। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চের ভেতর এই ভাণ্ডার কমেছে প্রায় ৭০%। এমনিতেই করোনা কালে পর্যটন নির্ভর দেশীয় অর্থনীতি ধাক্কা খেয়েছিল। বর্তমান রাশিয়া ও ইউক্রেনের ভেতর যুদ্ধ সেই পরিস্থিতিকে আরও সঙ্গীন করে তুলেছে দেশটির ভেতর। মুদ্রাস্ফীতি আজ লাগামছাড়া। ১ ডলার আজ সিংহলি মুদ্রায় ৩০০ টাকার ওপর। মুলত বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভর করে থাকা দেশীয় অর্থনীতি এই পরিস্থিতিতে এসে আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। পর্যটন কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমেছে। অন্যদিকে ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় তহবিলের ভাঁড়ে মা ভবানী অবস্থা হয়ে গিয়েছে। একদিকে কমতে থাকা আয় এবং অন্যদিকে ক্রমাগত বৈদেশিক ঋণের চাপ আজ শ্রীলঙ্কার অর্থব্যবস্থার মেরুদন্ডটাই ভেঙে দিয়েছে।

গোটা দেশে জ্বালানির অভাব। মানুষ টাকা খরচ করেও পাম্প থেকে জ্বালানি তেল পাচ্ছে না। দেশজুড়ে ১২ ঘন্টারও বেশী সময়জুড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকছে। হাসপাতালে জীবনদায়ী ওষুধের আকাল। খাদ্য, দুধ, রান্নার গ্যাসের তীব্র অভাব। যদিও এই পরিণতি খুব আশ্চর্যের নয়। বর্তমান শাসকদের কিছু অপরিণামদর্শী চটকদার সিদ্ধান্তের ফলস্বরূপ আজকের এই পরিস্থিতি। করোনা মহামারীর দাপটে যখন সব বন্ধ হয়ে যায় তখন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার ধরে রাখতে হঠাৎ করেই সে দেশের সরকার রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপায়। চাষিদের বাধ্য করা হয় জৈব চাষ করতে। সমস্ত সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে এই সিদ্ধান্ত বলবৎ করা হয় যার ফলস্বরূপ ফসলের উৎপাদন মার খায়। যদিও সরকার তার এই সিদ্ধান্তের কারণে হিসাবে জৈব চাষের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা বলে, কিন্তু প্রকৃত কারণ ছিল বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার মজুত রাখা। এই খাদ্যসঙ্কট গোটা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তোলে। ঠিক একই সময় শ্রীলঙ্কার সরকার আয়কর কমিয়ে দেয়, পরোক্ষ করও কমিয়ে দেয়। ফলে আয়ের পথ আরও সঙ্কুচিত হয় এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার আরও বেশী টাকা ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেয়। যা মুদ্রাস্ফীতিকে বেলাগাম করে তোলে। একই সময় শ্রীলঙ্কার সরকার তার বিদেশনীতিতে পরিবর্তন এনে অতিরিক্ত চীন নির্ভর হয়ে ওঠে। আগে ভারত ও চীনের সাথে যে সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক দেশটি রেখে চলত সেখান থেকে সরে যাওয়ায় অন্য দেশে থেকে আর্থিক ত্রাণ পাওয়াও আজ দেশটির কাছে কঠিন হয়ে উঠেছে। একমাত্র উপায় রয়েছে আইএমএফ-এর কাছে কড়া শর্তে ধার নেওয়া। ফলে সব মিলিয়ে দেশটির ভবিষ্যৎ আজ সঙ্কটে।

কিন্তু দেশটির এই অবস্থা কেবল অতিমারীর ফল নয়। বরং এর শিকড় অনেক গভীরে। ১৯৭২ সালে শ্রীলঙ্কা পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। তার আগে এটি ছিল ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন। ১৯৪৭-৭২ এই গোটা সময় জুড়েই শ্রীলঙ্কার ইতিহাস এক শ্রীবৃদ্ধির ইতিহাস। কিন্তু ১৯৭২ সালে এসে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে এক মৌলিক পরিবর্তন ঘটে যায়। এর আগে অবধি শ্রীলঙ্কায় বসবাসকারী সমস্ত জাতি তাদের নিজস্ব অধিকারগুলি নিয়ে এক সহাবস্থানে ছিল। কিন্তু ৭২ সালে শ্রীলঙ্কার রাজনীতি এক ধরনের আধিপত্যবাদের দিকে মোড় নেয়। সিংহলি বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী ও শ্রীলঙ্কার তামিল জনগোষ্ঠীর ভেতর গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয় যা পরবর্তী ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে চলে। এর মূল কারণ ৭২-এ নবগঠিত রাষ্ট্রের সংবিধানে বৌদ্ধ ধর্মকে সবার আগে রাখা হয় এবং সেখানকার মানুষের ওপর রাষ্ট্রের এই ধৰ্মীয় পরিচয়কে আরোপ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর পরবর্তী সময়ে তামিল জনগোষ্ঠীর সাথে গৃহযুদ্ধকে ব্যবহার করা হতে থাকে সিংহলি জনগোষ্ঠীকে একটি যুযুধান বৌদ্ধ আধিপত্যবাদী জাতিতে পরিণত করতে। এই সময় এলটিটিই-কে বিনাশ করতে গোটা দেশ জুড়েই এক উগ্র সিংহলি বৌদ্ধ জাতিবাদের আমদানি করা হয়। জাফনায় তামিলদের নির্বিচারে হত্যা করা হয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের নেতৃত্বে। এই সময় দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন আজকের রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষে। এই গণহত্যার পূর্ণ ফায়দা তুলতে রাজাপক্ষেরা জাতিবাদী জিগির আরও বাড়িয়ে তুলতে থাকে। আসলে এই পরিবারটি শ্রীলঙ্কায় এক ধরণের ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের আমদানি ঘটায়। ক্রমাগত জাগিয়ে তোলা জাতিবিদ্বেষের ফলে এক ধরণের সমর্থন এদের প্রতি গড়ে উঠতে থাকে। কিন্তু তামিল বিদ্রোহীদের নিধনের পর এদের দরকার পড়ে নতুন এক প্রতিপক্ষ যাদের বিরুদ্ধে জনতাকে আবার ক্ষেপিয়ে তোলা যায়। ২০১৯-এ মুসলিম সন্ত্রাসবাদীরা যখন সে দেশে হামলা চালায় তখন পরিস্থিতি এই রাজাপক্ষেদের জন্য অনুকূল হয়ে ওঠে। নতুন প্রতিপক্ষ, আরও বেশি ধর্মীয় আধিপত্যবাদের রাস্তা সুগম করে দেয়। কিন্তু এই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের আড়ালে শাসকদের অপদার্থতা ঢাকা পড়ে গেলেও বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। এই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ নির্বাচনে জেতার জন্য উপযোগী হলেও দেশের মানুষের যে কোনো কাজে লাগে না তা আজকে শ্রীলঙ্কার দিকে তাকালেই বোঝা যায়।

এই প্রবণতা কেবল রাজাপক্ষেদের একার নয়। গোটা দুনিয়া জুড়েই এই প্রবণতা আজ স্পষ্ট। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের একের পর এক চটকদার সিদ্ধান্ত যেমন মেক্সিকো সীমানায় দেয়াল বানানো বা অভিবাসীদের খেদানো, ব্রাজিলে বলসেরানোর আমাজন অববাহিকায় অপরিকল্পিত নির্মাণ অথবা ঘুরে ফিরে ভারতে নরেন্দ্র মোদীর নোট বাতিল, জিএসটি চালু ইত্যাদি সেই একই রাজনৈতিক প্রবণতার উদাহরণ। ক্রমাগত বিদ্বেষের রাজনীতির মাধ্যমে জনমতকে প্রভাবিত করা এবং সুস্থ গঠনমূলক পরিকল্পনার বদলে কিছু চটকদার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেদের সেই জনমোহিনী রাজনীতিকে রক্ষা করা এই ফ্যাসিবাদীদের বৈশিষ্ট্য। ভারত, আমেরিকা বা ব্রাজিল বৃহৎ অর্থনীতি তাই এখনো খুঁড়িয়ে হলেও গতিশীল, আর শ্রীলঙ্কার মত ছোট দেশের পক্ষে এই ধাক্কা সহন করার ক্ষমতা কম, তাই দেশটি আজ গভীর সঙ্কটে। শ্রীলঙ্কার এই অবস্থা থেকে ভারতবর্ষের মানুষের যথেষ্ট শিক্ষা নেওয়ার আছে। এই দেশের মানুষকে এখনই রাস্তায় নামতে হবে বর্তমান শাসকের এই বিদ্বেষের রাজনীতির দুষ্টচক্রকে ভেঙে, দেশের আপামর মেহনতি জনতার স্বার্থকে সামনে রেখে এক বৃহৎ গণআন্দোলন গড়ে তুলতে, নয়ত অচিরেই এই দেশের অবস্থা আমাদের পড়শীর মত হয়ে উঠবে।

জাতিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদে পেট ভরে না, নেতাদের পকেট ভরে। জনগণ যতদিনে বোঝে যে তাদের ঠকিয়েছে এই বিদ্বেষকামী রাজনীতি ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যায় বা বলা যায় লঙ্কা কাণ্ড হয়ে যায়। অতএব সাধু সাবধান!