আরেক রকম ● দশম বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২২ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪২৯

সম্পাদকীয়

দুর্বিষহ পরিস্থিতি


রাজ্যের দৈনিক সংবাদপত্রগুলি পড়লে আপাতত বিবমিষা এবং তীব্র ঘৃণা বাদ দিয়ে আর কোনো অনুভূতি উৎপন্ন হওয়ার কথা নয়। একটি ১৪ বছরের মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করে তার লাশ জ্বালিয়ে দেওয়া হল। ধর্ষণ এবং খুনে অভিযুক্ত একজন তৃণমূল নেতার পুত্র। এই অবধি পড়লেই সাধারণ মানুষের গা ঘিনঘিন করা উচিত। কিন্তু রাজ্যের শাসক দল এবং তার মুখ্যমন্ত্রী অন্য ধাতুতে গড়া। তাই তিনি এই ঘটনায় দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি হবে এহেন স্তোকবাক্য দেননি। সরাসরি তিনি বালিকাটিকে অপমান করেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন ‘লাভ আ্যাফ্যায়ার’ ছিল কি না দেখতে হবে, ইত্যাদি। অর্থাৎ কোনো ধর্ষকের নাম যদি তৃণমূলের সঙ্গে কোনোভাবে জড়িয়ে যায়, তাহলে মুখ্যমন্ত্রী নানান কায়দায় দলীয় বৃত্তটিকে অক্ষত রাখার চেষ্টা করবেন। এই ঘটনা যে হাঁসখালি ধর্ষণ কাণ্ডে প্রথম ঘটল এমন কিন্তু নয়। আমরা ভুলে যাইনি যে পার্ক স্ট্রীট, কামদুনি-র মতন ধর্ষণ কান্ডেও মুখ্যমন্ত্রী ধর্ষকের বিরুদ্ধে নয়, প্রশ্ন তুলেছিলেন ধর্ষিতার চরিত্র নিয়ে অথবা প্রতিবাদীদের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে। রাজ্যে একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রী থাকার পরেও ধর্ষণের মতন কদর্য অপরাধের প্রশ্নে মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি দোষীদের শাস্তির দাবিকে নিজের সরকারের অবস্থান হিসেবে ঘোষণা করছেন না। এর থেকেই বোঝা যায় যে আসলে তৃণমূল দলটি কাদের পক্ষে।

আপাতত সংবাদপত্রের পাতা ভরে রয়েছে একদিকে যেমন বাড়তে থাকা ধর্ষণের খবরে, অন্যদিকে রয়েছে লাগামহীন দুর্নীতি। রাজ্যে স্কুল শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির অভিযোগ তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রয়েছে। এইবার সেই দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায় সরাসরি প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীকে সিবিআই-এর সামনে হাজিরা দিতে নির্দেশ দিলেন কলকাতা হাইকোর্টের একজন বিচারপতি। সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন করা মাত্রই আগের রায়ের উপরে স্থগিতাদেশ জারি হল। এখানে মনে রাখতে হবে যে ইতিমধ্যেই কলকাতা হাইকোর্টের একজন বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় মুখ্য বিচারপতিকে চিঠি লিখে অভিযোগ জানিয়েছেন যে, তাঁর রায়গুলি ডিভিশন বেঞ্চ বারংবার পালটে দিয়েছে। চিঠিতে প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক প্রভাবের ইঙ্গিত রয়েছে। কলকাতা হাইকোর্টের ইতিহাসে এহেন ঘটনা নজিরবিহীন। যদি সত্যিই একজন বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ সম্পর্কে এহেন অভিযোগ থেকে থাকে তাহলে সুপ্রিম কোর্টের উচিত এই ঘটনার সত্যকে উদ্ঘাটন করা। তা না হলে বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

কিন্তু ঘটনা পরম্পরা এখানেই শেষ হয় না। যেই বিচারপতি প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে রায় দিলেন, তাঁর এজলাশ বয়কট করার দাবি তোলে তৃণমূল সমর্থক উকিলরা। সেই দাবি নিয়ে বচসায় হাইকোর্টের বার এসোসিয়েশনের সভাপতির উপর শারীরিক হামলা হয়। অন্যদিকে বিচারপতির এজলাশের সামনে ধরনায় বসে তৃণমূল। অর্থাৎ সরাসরি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিচারপতি তথা বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে রাজ্যের শাসকদল।

গোটা রাজ্যের পরিস্থিতি এক ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে। ধর্ষণ, খুন, রাজনৈতিক হানাহানি এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পর্যবসিত। প্রত্যেকটি ঘটনায় দেখা যাচ্ছে যে পুলিশ সরাসরি দুষ্কৃতিদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে তারা যদি শাসক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকে। অন্যদিকে, দুর্নীতির সমস্ত রেকর্ড ভেঙে গিয়েছে। নেতা-মন্ত্রীদের সিবিআই-ইডি তলব করছে। আর তা হলেই নেতারা আশ্রয় নিচ্ছে সরকারী হাসপাতালে। সিবিআই-ইডি বিজেপি-র অঙ্গুলিহেলনে চলে বলে মুখ্যমন্ত্রী যে অভিযোগ করছেন তার সারবত্তা রয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তার দলের নেতারা দুর্নীতিগ্রস্ত নন। ভুলে গেলে চলবে না এদের অনেককেই টিভির পর্দায় ঘুষ নিতে দেখা গেছে।

এহেন পরিস্থিতিতে রাজ্যের মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সেই ক্ষোভ বাম দিকে পরিচালিত করার দায়িত্ব বামপন্থীদের নিতে হবে। তৃণমূলের উপর রাগ করে বিজেপিকে রাজ্যে শক্তিশালী করা আত্মহত্যা করার সামিল। কিন্তু মানুষের সামনে যদি বিকল্প না থাকে, তবে তারা কিছুটা হয়ত বাধ্য হয়েই বিজেপিকে সমর্থন করছেন, যেমন তারা ২০২১ সালেও করেছিলেন। আবার একদল ভাবছিলেন বিজেপি নয়, তৃণমূলকেই সমর্থন করা দরকার। কিন্তু একের পর এক বিজেপি নেতার তৃণমূলে গমন, বিশেষ করে বালিগঞ্জ এবং আসানসোলে তাদের প্রার্থী করা প্রমাণ করে যে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নেও তৃণমূলের কোনো আদর্শগত বিজেপি বিরোধী অবস্থান নেই, সবটাই ভোটের খেলা। এই দ্বিমেরু-র রাজনীতি ভাঙতে হলে বামপন্থীদের শক্তিশালী হওয়া ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই। আনিস খান, বগটুই, বা হাঁসখালির ঘটনায় বামপন্থীরা রাস্তায় নেমেছেন। কিন্তু আরো বড়ো জনসমাবেশ করতে বামপন্থীদের উদ্যোগী হতে হবে। তৃণমূল ও বিজেপি বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রাম গড়ে তোলাই বর্তমান সময়ে বামপন্থীদের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ।