আরেক রকম ● দশম বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২২ ● ১৬-৩০ চৈত্র, ১৪২৮

প্রবন্ধ

পল ফারমার নেই

স্থবির দাশগুপ্ত




লোকস্বাস্থ্য চর্চার সঙ্গে যাঁর ছিল নাড়ির টান সেই পল ফারমার সদ্য প্রয়াত। তাঁর আকস্মিক, অকালপ্রয়াণে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা পরিচিতজন, সহকর্মী, ছাত্র-ছাত্রী এবং স্বাস্থ্য গবেষকরা মর্মাহত। একই সঙ্গে, চরাচরের যেখানে যেখানে তাঁর পদচারণা ঘটেছে সেখানকার প্রান্তিক, নিঃসহায় মানুষগুলো যেন বটবৃক্ষের শান্ত ছায়ার আশ্রয় থেকে বঞ্চিত হলেন।

পল ফারমার ছিলেন চিকিৎসক এবং নৃবিজ্ঞানী। আমাদের ধারণা, লোকস্বাস্থ্যের চর্চায় চিকিৎসাশাস্ত্র অথবা নৃবিজ্ঞান, যেকোনও একটি বিষয়ে বুৎপত্তিই যথেষ্ট ছিল; কিন্তু পল ফারমারের মনোভূমিতে ‘যথেষ্ট’ শব্দটি বোধহয় অনুপস্থিত। তাই নৃবিজ্ঞানের অধীত ধারণাগুলো মানবজমিনে সঞ্চারিত না-হলে যেন তাঁর স্বস্তি নেই। হয়তো বিচিত্র মানব সম্প্রদায়ের অন্তর্লীন বিভঙ্গ তাঁকে এমনভাবে মোহিত করেছিল যে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের কর্মস্থল থেকে বেরিয়ে বারবার হাইতি, রোয়ান্ডা, নিকারাগুয়ার রোগপীড়িত, স্বাস্থ্যবঞ্চিত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানই হয়ে উঠল তাঁর বৃত্তি। বৃত্তিই বটে, তবে এই বৃত্ত কখনও সম্পূর্ণ হয় না; তাই আরামকেদারার কেতাদুরস্ত স্বাস্থ্যচর্চা ছেড়ে বারবার মানুষের কাছে যাওয়া - একই মানুষের কাছে - যে যেখানে ক্রন্দনরত সেখানে পল ফারমারের বুকের পাঁজরই মোচড় দিয়ে ওঠে, যেন।

মানবিকতার এ এক অপরূপ মূর্তি। নিছক চিকিৎসাবিদ্যা না, নৃতত্ত্বও না, মানবিকতাই ছিল তাঁর বৃত্তি, সেখানেই তিনি ভাস্বর।

পল ফারমার মার্টিন লুথার কিং নন, কোটনিস নন, নর্মান বেথুন নন, নেলসন ম্যান্ডেলাও নন; এই স্মরণীয় চরিত্রগুলোর যাবতীয় অন্তর্গত গুণ আত্মসাৎ করে তিনি নিজেই স্বয়ম্ভু, অনুপম। তাঁর কর্মকাণ্ডে এঁরা সকলেই চিরজীবী হয়ে থাকেন। তাই তিনি বটবৃক্ষ, যা পথহারা শ্রান্ত পথিককে আশ্রয় দেয়, স্বাস্থ্যপথের হদিশ জানায়। তিনি জানাতেন, সংক্রামক ব্যাধিগুলোর সূতিকাগার আমাদের সামাজিক পরিবেশে, স্বাস্থ্য পরিচর্যার অসাম্যে। জানাতেন, স্বাস্থ্য পরিচর্যায় ডাক্তারির ব্যাকরণ অপরিহার্য, কিন্তু পর্যাপ্ত না। পরিবেশের বিমূর্ত ব্যঞ্জনা অগ্রাহ্য করে আমাদের গতিবিধি, মতিগতি আর বৈভবের অসভ্য সঞ্চলনই যে আধুনিক মানুষের শ্রেষ্ঠতম, জঘন্যতম নষ্টকীর্তি, সেই সুযোগেই যে জীবাণুর রূপ-চরিত্রের পরিবর্তন একথাটি না-বুঝলে লোকস্বাস্থ্য অধরাই থেকে যাবে। অথচ এই কর্কশ সত্য উচ্চারণকালেও তাঁর মুখে লেগে থাকে এক অমলিন, সংক্রামক হাসি, তাতে কেউ খুঁজে পেত বরাভয়, কেউ অনন্ত বন্ধুতা।

তাঁর সব কথার কেন্দ্রীয় উপাদান ছিল মাত্র তিনটি - সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়। কেউ ভাবতে পারেন, এ আর নতুন কথা কী? অন্য দেশের কথা বাদ দিয়ে শুধু নিজেদের দেশের দিকে তাকালেই আমরা এর হরেক নমুনা খুঁজে পাব। সাম্য নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধ আজও আমাদের স্মরণে আছে, মানবিক মর্য্যাদা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কুন্ঠা আর লজ্জাবোধও সুবিদিত, আর আছে ন্যায়বিচার নিয়ে বিদ্যাসাগরের দৃষ্টান্ত - সেই বিদ্যাসাগর যাঁকে বলা হত, মানবতার বাতিঘর। তাহলে আর নতুন কী? নতুন হল, বায়বীয় ধারণায় ভাসমান না-থেকে লোকস্বাস্থ্যের অঙ্গনে এই এই শতাব্দীপ্রাচীন ধারণাগুলোকে প্রয়োগ করা, যথাযোগ্য আসনে বসিয়ে দেওয়া। সেই আসনে ‘নকশি কাঁথার মাঠ’ আঁকা থাকে, সেই অংকনশিল্পই ফারমারের যুগোত্তীর্ণ অবদান। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সাম্য চাই। তাঁর এই অবিরল সমাজমনস্কতা অনন্তর জারিত হয়েছে নৃবিদ্যা আর আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার মিলনপ্রাঙ্গণে।

আধুনিক কীর্তিনাশী যুগে এই কীর্তি নতুন; কিন্তু আধুনিক, বিজ্ঞ মানুষের কাছে তার চেয়েও লজ্জার কথা এই যে, পুরনো কথাগুলো বারবার নতুন করে বলতে হয়!

স্বাস্থ্যের সাম্য নিয়ে আমাদের দেশে বামপন্থী আন্দোলনও কম হয়নি। তাতে অঙ্গীকার সুপ্রচুর, কিন্তু অগ্রগতি নেই; বিশ্লেষণ আছে, উপযুক্ত নকশা নেই। সেই পাঠ নিতে গেলে ফারমারই হয়তো আমাদের গন্তব্য। এমনকী, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সুচারু রূপায়ন ঘটাতে গেলে বামপন্থী আন্দোলনই হয়তো আমাদের ভবিষ্যৎ। কিন্তু বামপন্থার ভবিষ্যৎ যে কী তা নিয়ে যে সংশয় মেটে না। তখন মনে হয়, পল ফারমার কি বামপন্থী ছিলেন? ছিলেনই তো, অসাম্য যদি দক্ষিণপন্থার অবদান হয় তাহলে তিনি আলবৎ বামপন্থী। ‘লিবারেশন থিয়োলজি’র প্রবক্তা, গুস্তাভো গুটিয়েরেজ-এর চিরসখা, মন্ত্রশিষ্য ফারমার নিশ্চয়ই বামপন্থী; কিন্তু মার্ক্সবাদী নন। মার্ক্সবাদের প্রতি অনুরক্ত; সামাজিক অসাম্যের কারণ যে উদ্বৃত্ত পুঁজির ভাঁড়ার ঘরে, পুঁজিবাদ যে অসম বণ্টনের লীলাভূমি এসব কথা কে আর অস্বীকার করবে? তিনিও করেননি।

কিন্তু তার পরেও তিনি মার্ক্সবাদী নন, অন্তত আধুনিক রূপতরিকায়। কারণ, তিনি বুঝেছিলেন, হাইতির মানুষগুলো কেন নিপীড়িত, সর্বস্বান্ত তার উত্তর আধুনিক মার্ক্সবাদীদের কলহপ্রিয়তা, ঔদ্ধত্য আর গোঁড়ামির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। খুঁজতে হবে ওই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে, তাদেরকেই স্বাস্থ্যের সম্পদ রচনা করতে হবে, সেই সম্পদের সমবণ্টন ঘটাতে হবে। আধুনিক মার্ক্সবাদীরা সামাজিক সম্পদের ব্যবহার কীভাবে হবে তা নিয়ে চিন্তিত, আর ফারমারের চিন্তা, স্বাস্থ্যের দারিদ্র থেকে পরিত্রাণ ঘটবে কীভাবে তা নিয়ে। গোঁড়ামি তাঁর অসহ্য; তাই ‘পার্টনার্স ইন হেলথ’-এর মতো একটি প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি।এখানে তৈরি হবে লোকস্বাস্থ্যে ন্যায্যতার বয়ান। সমাজতন্ত্রের ত্রুটিগুলোর চেয়ে পুঁজিবাদের সর্বনাশী প্রত্যয়গুলোর বিরুদ্ধে তাঁর চিন্তার অভিমুখ। সেই চিন্তার পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে অক্ষয়, অব্যয় মানবিকতা।

কিন্তু সেই ন্যায্যতার বয়ান রচনা কি সম্ভব? দার্শনিক প্লেটো বলতেন, ন্যায্যতা মানে বর্গক্ষেত্র; একটি বাহু এদিক-ওদিক হলেই অন্যায্য। আজকের কর্পোরেট অধ্যুষিত তুমুল বৈষম্যের জন্মভূমিতে কি সেই ন্যায্যতার বিধান আদৌ বাস্তবিক?আমরা সভ্যতার গর্বে উচ্ছল; কিন্তু প্রশ্ন জাগে, আমরা কি আগের চেয়ে সদয় হয়েছি, না নির্দয়? আগে আমরা পাথর ছুঁড়ে মানুষ মারতাম, আজ আমাদের হাতে আণবিক বোমা। তাতে প্রমাণ হয় যে, আমাদের সংহারশক্তি বেড়েছে, পরিমাণে এবং তীব্রতায়। আমাদের সঞ্চয় ক্ষমতাও আকাশচুম্বী হয়েছে, সঞ্চয়ের গতিবেগও দর্শনীয়। আর এসবের অমোঘ পরিণামে মানবিক মর্যাদা কমেছে। সেই মর্যাদা নতুন করে আদায় করব কীভাবে? আমাদের কি নতুন কোনও সভ্যতার পাঠ নিতে হবে, নতুন বিশ্বব্যবস্থা? মনে হয়, ফারমার নিশ্চিত।

বুনিয়াদি চিকিৎসাই লোকস্বাস্থ্যের মেরুদণ্ড। একথা প্রমাণ করতে গিয়ে তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, বুনিয়াদি চিকিৎসার প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন - সেকেলে বুনিয়াদি চিকিৎসা না, অতি আধুনিক চিকিৎসার প্রতিষ্ঠান। তাঁর ‘ফিভারস, ফিউডস এন্ড ডায়ামন্ডস’ গ্রন্থে তিনি তথ্য দেখিয়ে বলেন, ইবোলা সংক্রমণে লক্ষ মানুষের মৃত্যু অভিপ্রেত ছিল না, অবশ্যম্ভাবীও না; কেবল উন্নত, বুনিয়াদি চিকিৎসার সম্ভার মজুত থাকলেই অসংখ্য মৃত্যু পরিহার করা যেত। সেই কথার প্রতিধ্বনি আমাদের পোড়া দেশেও ভেসে এসেছে, সাম্প্রতিক কোভিডকালে, হাতেনাতে প্রমাণও পাওয়া গেছে; কিন্তু আমরা ছিলাম বধির, তাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আজও আমরা বিশেষজ্ঞ, অতি-বিশেষজ্ঞ হাসপাতাল দেখে মূর্ছা যাই, লোকস্বাস্থ্য নিয়ে রচনা লিখি, তার বনিয়াদ রচনায় হাত দিই না। আমাদের নষ্টচরিত্রের অমনই নিয়তি।

তিনি বলেন, কর্পোরেট স্বাস্থ্য পরিষেবার উপর নির্ভরতা আজকের যুগের মারাত্মক ব্যাধি। কর্পোরেট বলে, তার পরিষেবা নাকি রত্নগর্ভা, তাই এত মুনাফা; কিন্তু সেই মুনাফাটা আসে কোত্থেকে? কোন পারদর্শিতা থেকে? অনেকটাই তো আসে সেই পরিষেবা থেকে যা কখনো দেওয়াই হয়নি। স্বাস্থ্যবঞ্চনাই তার একমাত্র মন্ত্র। এই পরিষেবা চাই না। স্বাস্থ্য পরিষেবায় সরকারি রাশ যত আলগা হয়েছে কর্পোরেট পরিষেবা ততই উজ্জ্বলতর হয়েছে। এ এক ফাঁদ। নিজের তৈরি করা ফাঁদে সরকার নিজেই জড়িয়ে পড়ে, বেরবার পথ নেই। তাহলে কী করা? ফারমার বলেননি; কিন্তু মনে হয়, আমাদের আজকের পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য পরিষেবার জাতীয়করণ একটা বিকল্প হতে পারে। ভাববার কথা, তবে একথা ঠিক যে, শুধু কাগুজে আইন দেখিয়ে কর্পোরেটদের বাগে আনা যাবে না।

তাঁর ‘প্যাথোলজিস অফ পাওয়ার’ গ্রন্থের একটি পরিচ্ছেদ শুরুই হচ্ছে এইকথা বলে যে, হাইতির লোকেরা বলে, ‘আইন তৈরি হয় কাগজে, আর বেয়নেট তৈরি হয় ইস্পাত দিয়ে’। অতএব, এই নৃবিজ্ঞানীর দৃষ্টিভঙ্গি অতি স্বচ্ছ, অল্প কথায় অনেক কথা বলে ফেলেন। তাই পল ফারমার আজকের দিনে বড় বেশি অধ্যয়নযোগ্য। কিন্তু তাঁকে অধ্যয়ন করতে গেলে যা বলছেন তার চেয়েও যা বলছেন না তার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে বেশি। কারণ মনে হয়, তাঁর রচনাগুলোর দুয়ার ধরে দাঁড়িয়ে আছে কোনও এক রহস্যনয়না, তার অবগুণ্ঠনের অন্তরালে, আরক্ত ওষ্ঠাধরে ফুটে আছে এক অব্যাখ্যাত হাসি। সেই হাসির অর্থ না-বুঝলে বৃথাই হবে আমাদের ফারমারচর্চা।তিনি বলছেন, পীড়িত মানুষ তোমার সামনে দাঁড়িয়ে। পীড়া থেকে পরিত্রাণের উপায় তোমার জানা। আর কতকাল নিশ্চেষ্ট থাকবে?

অর্থাৎ আমাদের বহচর্চিত অভ্যাসগুলো বর্জন করে নতুন অভ্যাস রপ্ত করতে হবে। যেমন, স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে এই দাবি ঘোষণা করতে গিয়ে আমরা একথা ভুলে যাই যে, স্বাস্থ্য আমাদের বুনিয়াদি, মানবিক অধিকার। প্রয়োজনে সেই অধিকারের বনিয়াদ আমরাই নির্মাণ করে নেব। লোকস্বাস্থ্যকে বাণিজ্যসংস্কৃতির হাতে ফেলে রাখা যাবে না।

তাহলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এক অন্য সংস্কৃতির বীজ রোপণ করা দরকার। কাজটা অতি কঠিন, সত্যি। অবশ্য তার বিকল্প আছে। তা হল, পল ফারমারকে মহাপুরুষ আখ্যা দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে থাকা, তাতে আমরা নিস্তার পাই। কর্পোরেটরাও এভাবেই নিস্তার চায়। মনে রাখতে হবে, ফারমারের অন্তিমযাত্রার পর মুহ্যমান কর্পোরেট বাণিজ্যপ্রবর বিল গেটস ‘দি আটলান্টিক’ পত্রিকায় জানিয়েছে, ‘দেয়ার উইল নেভার বি এনাদার পল ফারমার’! যা জানায়নি তা হল, আরেকজন পল ফারমার যাতে না-হয় সেদিকে তার সতর্ক দৃষ্টি। অতএব, এখন আমাদের সতর্কতা আরও বেশি জরুরি। বরং সুকান্তকে আমরা একটু অন্যভাবে আবৃত্তি করব, ‘…নৃতত্ত্ববিদ মুছবে কপাল তার, কর্পোরেট ও মানুষের হাড়ে মিল খুঁজে পাওয়া ভার’।