আরেক রকম ● দশম বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২২ ● ১৬-৩০ চৈত্র, ১৪২৮

প্রবন্ধ

জমি জীবন জীবিকা পরিবেশ ও দেউচা

সমীরণ সেনগুপ্ত


দেউচা-পাচাঁমি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিনশিঙা কয়লাখনি প্রকল্প ঘিরে রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কথায় এবং কাজে বিস্তর ব্যবধান লক্ষণীয়। এলাকায় বসবাসকারী জনসমষ্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই প্রস্তাবিত কয়লাখনি প্রকল্পের বিরোধী। কয়লাখনি প্রকল্পটিকে কেন্দ্র করে জীবন-জীবিকা এবং পরিবেশ সংক্রান্ত যে ন্যায্য প্রশ্নগুলি ঐ এলাকার মানুষ উত্থাপন করেছেন রাজ্য প্রশাসনের কাছে তার কোনো উত্তর নেই। নিজেদের জীবন-জীবিকা এবং পরিবেশ রক্ষায় স্থানীয় সাঁওতাল এবং বাঙালী গ্রামবাসীরা গড়ে তুলেছেন 'বীরভূম জমি, জীবন, জীবিকা ও প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভা'।

ওয়েস্ট বেঙ্গল পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেশের কয়লা মন্ত্রক দেউচা-পাচাঁমি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিনশিঙা কয়লা ব্লকের বরাত রাজ্য সরকারকে দেয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে, যদিও এর আগেই এই কয়লা ব্লক নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সহ বেশ কয়েকটি রাজ্য আগ্রহ দেখিয়েছিল। কয়লা ব্লকটি আনুমানিক ১২.২৮ বর্গ কিলোমিটার এবং ৩,৪০০ একর জমিতে। ১০টি মৌজা, ১৯টি গ্রাম মিলিয়ে আনুমানিক ৩,০১০টি পরিবারের বসতি যার মধ্যে ১,০১৩টি আদিবাসী পরিবার। খনি অঞ্চলে বনভূমি ৩০৭ একর। প্রায় ২.১ বিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন সম্ভব।

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ২০২০ সালের জুলাই মাসে বলেন (অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে) রাজ্য এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মহম্মদ বাজার ব্লকের অন্তর্ভুক্ত দেউচা বাসীর সাথে প্রস্তাবিত কয়লাখনি প্রকল্পকে কেন্দ্র করে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এলাকাবাসীর পূর্ণ সমর্থন নিয়ে এই প্রকল্প হবে এবং এই ধরণের বড়ো প্রকল্পগুলি সুস্থভাবে বাস্তবায়নের নিদর্শন হিসাবে গোটা দেশের কাছেই নজির হয়ে থাকবে দেউচা-পাচাঁমি। জেলা প্রশাসনের সাথে তাঁর সাম্প্রতিকতম সভার পরে মুখ্যমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ১০০ বছর কোনও চিন্তা থাকবে না, এক লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। বিভিন্ন সময়ে মুখ্যমন্ত্রী এ কথাও উল্লেখ করেছেন যে দেউচা পাচাঁমি সিঙ্গুর হবে না।

মুখে ভালো কথা বললেও প্রকল্প কেন্দ্র করে যে প্রশ্নগুলি উঠছে সরকার তার কোনও জবাবই দিচ্ছে না। প্রথমত, ২০১৩ সালের জমি অধিগ্রহণ আইন অনুযায়ী প্রকল্পের সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট আ্যসেসমেন্ট করার কথা। সেই কাজ কি করা হয়েছে? রিপোর্ট কোথায়? দ্বিতীয়ত, এই রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রকল্পের অন্তর্গত এলাকাবাসীকে তিন সপ্তাহ আগে থেকে জানিয়ে গ্রাম-সভার মাধ্যমে গণ-শুনানি করার কথা। এই কাজ যে হয়নি তা বোঝাই যাচ্ছে। তৃতীয়ত, ২০১৩ সালের জমি অধিগ্রহণ আইন অনুযায়ী প্রকল্পে যারা জমিহারা হতে চলেছেন তাদের আশি শতাংশের সম্মতি প্রয়োজন। লিখিত সম্মতি ছাড়া জমি নেওয়া যাবে না। লিখিত সম্মতি আদায়ে কোনও ধরণের জোর জবরদস্তি, ভয়ভীতির প্রদর্শন যাতে না করা হয় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে তা সুনিশ্চিত করতে হবে। সম্মতি গ্রহণের এই কাজ কি হয়েছে? অথচ এসবের আগেই মুখ্যমন্ত্রী ১০,০০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণের প্যাকেজ ঘোষণা করে দিয়েছেন। এই প্যাকেজ ঘিরেও যে প্রশ্ন উঠেছে তার কোনও সদুত্তর প্রশাসন দিতে পারছেনা। 'আরেক রকম' পত্রিকার এই সংখ্যায় অর্থনীতিবিদ প্রসেনজিৎ বসু 'কাঠগড়ায় কয়লাখনি' শীর্ষক নিবন্ধে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। বিশিষ্ট সাংবাদিক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য এবং শুভ্রজিত সেন 'স্ক্রোল' পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন যে, জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে অতি পুরু কঠিন ব্যসল্টের স্তর ভেদ করে কয়লা উত্তোলনের প্রযুক্তি ভারতে নেই। 'লাইভ মিন্ট' পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে কোল ইন্ডিয়ার প্রাত্তন চেয়ারম্যান পার্থ ভট্টাচার্য বলেছেন, দেউচা-পাচাঁমি কয়লা ব্লক থেকে কয়লা উত্তোলন অত্যন্ত কঠিন, সাধারণভাবে কয়লা উত্তোলনে যে সময় লাগে এক্ষেত্রে তার থেকে অনেক বেশী সময় লাগবে। বিনিয়োগের পরিমাণ হতে হবে অনেক বেশী এবং যে প্রযুক্তি লাগবে তা দেশে নেই, বিদেশ থেকে আনতে হবে। বিষয়গুলো বিবেচনা করে অর্থনৈতিক ভাবে প্রকল্পটি লাভজনক হবে না বুঝেই কি উল্লেখিত রাজ্যগুলি কিম্বা কোল ইন্ডিয়া হাত গুটিয়ে নেয়? পঞ্চমত, 'ইকনমিক টাইমস' পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী পোল্যান্ডের বেশ কয়েকটি সংস্থা এই প্রকল্পে আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রাসঙ্গিক, পোল্যান্ড খনিজ শিল্পে দুনিয়ায় এগিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যে প্রধান। আধুনিক প্রযুক্তি পোলিশ কোম্পানিগুলোর করায়ত্ত। ১৩০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত কয়লা উত্তোলনের অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা এদের আছে। বেঙ্গল বিজনেস সামিট ২০১৯-এ এই ধরণের বেশ কয়েকটি পোলিশ কোম্পানির সাথে ওয়েস্ট বেঙ্গল পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কর্তাদের বৈঠকও হয়। তবে কি দেউচা-পাচাঁমির কয়লা উত্তোলন যৌথ প্রক্রিয়ায় হবে? সেক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণ আইন ২০১৩-র নিয়মাবলী কিন্তু ভিন্ন। প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নতমানের যে ব্যাসল্ট পাওয়া যাবে, যা এই রাজ্যের সম্পদ তার মালিকানা কার থাকবে? সংশ্লিষ্ট বিদেশি কোম্পানির? রাজ্যবাসীর কাছে সবই তো ধোঁয়াশা। ষষ্ঠত, মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন এই প্রকল্পের মাধ্যমে এক লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। কোন তথ্যের ভিত্তিতে তিনি এই কথা বলছেন তা পরিষ্কার নয়। বরং কয়লাখনি শিল্পে কর্মসংস্থানের নিম্নগামী প্রবণতার তথ্যই সামনে আসছে। এই প্রকল্পে যদি এক লক্ষ মানুষেরই কর্মসংস্থান হয় তবে জমিহারা বাস্তুহারা পরিবারের সকলের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে  না কেন অথবা রাজ্য পুলিশের কনস্টেবল পদের চাকরীর কথাই বা বলা হচ্ছে কেন তাও বোধগম্য নয়। কয়লাখনিতে পুলিশ কনস্টেবলের প্রয়োজন কোথায়?

প্রস্তাবিত কয়লা প্রকল্পকে কেন্দ্র করে এলাকার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমষ্টির মনে জীবন-জীবিকা পরিবেশ সংক্রান্ত যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যে সব প্রশ্ন তাদের মননে দানা বেঁধেছে তার কোনও সদুত্তর না পেয়ে তারা প্রকল্পের বিরোধিতায় সংগঠিত হতে শুরু করেছেন। রাজ্য প্রশাসন মুখে সংবেদনশীল হওয়ার কথা বললেও কার্য ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই নানা ধরণের ছল চাতুরি প্রলোভন জবরদস্তি দমন পীড়ন চালিয়ে জোর করে এই প্রকল্প চাপিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর হয়েছে। এলাকার মানুষের উদ্যোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে দেওয়ানগঞ্জের মাঠে সভা সংগঠিত হয়। এই সভার পরে শাসকদল এবং পুলিশ একসাথে গ্রামবাসীদের উপর আক্রমণ করে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় পুলিশের প্রহারে অন্তঃসত্ত্বা আদিবাসী মহিলার বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাওয়ার সংবাদ। নির্লজ্জ প্রশাসন প্রাথমিকভাবে দোষ চাপায় গ্রামবাসীদের উপরেই। অভিযোগ করে আদিবাসী মহিলারা নাকি মদ্যপান করে পুলিশের উপরে চড়াও হয়েছিল! নতুন বছরের শুরুতে বেশ কয়েকটি সামাজিক সংগঠন গণসংগঠনের উদ্যোগে প্রকল্পের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়ে বীরভূমের জেলা শাসকের কাছে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। একই দিনে মিছিল করে সভা সংগঠিত হয় সিউরির জেলাশাসকের দপ্তরে সামনে। ৬ই জানুয়ারি তারিখে অর্থনীতিবিদ প্রসেনজিৎ বসু তথ্যের অধিকার আইনে আবেদন করেন প্রস্তাবিত কয়লাখনি বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানতে চেয়ে। দেড় মাস বাদে আবেদনটিকেই খারিজ করে ফেরত পাঠানো হয়েছে। অথচ আবেদনকারী একজন রেজিস্টার্ড আরটিআই আ্যাকটিভিস্ট, অতীতে বহু তথ্য জনসমক্ষে নিয়ে এসেছেন তথ্যের অধিকার আইন প্রয়োগ করে।

লড়াই থেমে থাকেনি। কয়লাখনি প্রকল্প এবং জোর করে জমি দখলের বিরুদ্ধে এলাকার মানুষ গড়ে তুলেছেন 'বীরভূম জমি, জীবন, জীবিকা ও প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভা'। মহাসভার পক্ষ থেকে ৮ই ফেব্রুয়ারি তারিখে কলকাতা প্রেস ক্লাবে প্রথম সাংবাদিক সম্মেলন সংগঠিত করা হয়। সাংবাদিক সম্মেলনে মহাসভার কয়লাখনি বাতিল সহ চারটি নির্দিষ্ট দাবি উত্থাপন করে ২০শে ফেব্রুয়ারি তারিখে দেওয়ানগঞ্জ ফুটবল মাঠে জনসভার আহ্বান করে এবং এই জনসভায় দাবির পক্ষে দাঁড়ানো সমস্ত প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি ও ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। দাবির স্বপক্ষে গ্রামে গ্রামে প্রচার শুরু হয়। সভা বানচাল করতে শাসকদলের নির্দেশে পুলিশ-প্রশাসন মাঠে নামে। চাহিদা অনুযায়ী সব কাগজপত্র জমা দেওয়ার পরেও ১৯ তারিখ রাত্রিবেলা পুলিশ সভার অনুমতি দিতে অস্বীকার করে। অনুমতি ছাড়াই ২০ তারিখ সভা হয়। শান্তিপূর্ণ এই সভায় ময়দান সংলগ্ন গ্রামগুলির মানুষ ভালো সংখ্যায় উপস্থিত হন। কলকাতা থেকেও বেশ কয়েকজন সমাজকর্মী মহাসভার কথা শুনতে উপস্থিত হয়েছিলেন। ভাঙরের বিধায়ক নৌসাদ সিদ্দিকি সিউড়ি স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে সভার উদ্দেশ্য রওনা দিলেও সভাস্থল থেকে বেশ খানিকটা দূরে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়ে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের অবস্থান চলতে থাকায় রাস্তায় আটকা পড়ে সভায় উপস্থিত হতে পারেননি। জনসভায় উপস্থিত মানুষের পক্ষ থেকে মহাসভার নেতৃত্ব সরকারের কাছে চারটি সুনির্দিষ্ট দাবি উত্থাপন করেন -
১) বলপূর্বক, বেআইনি জমি অধিগ্রহণ এবং পুলিশ-প্রশাসনের নিপীড়ন অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
২) আদিবাসী, সংখ্যালঘু, দলিত, অনগ্রসর বহুজনদের জমি-জীবিকার অধিকার হরণ করা চলবে না।
৩) পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু সংকট নিরসনে নতুন কয়লাখনি, কয়লিচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র খোলা চলবে না।
৪) ১০ হাজার কোটি টাকায় গ্রামবাসীদের উচ্ছেদ-ক্ষতিপূরণের পরিবর্তে পরিবেশ-বান্ধব বিকল্প প্রযুক্তির বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারি বিনিয়োগ চাই।

শান্তিপূর্ণভাবে জনসভা শেষ হয়। কলকাতা থেকে যে কয়েকজন সমাজকর্মী সভায় উপস্থিত ছিলেন কলকাতায় ফেরার পথে সভাস্থল থেকে দুই কিলোমিটার দূরে তাদের গাড়ি আটকায় তৃণমূলের নেতৃত্বে ১৫-২০ জনের একটি দল। খবর পেয়ে গ্রামবাসীরা সেই স্থানে উপস্থিত হলে শাসকদলের লোকেরা পালিয়ে যায়। দেউচা ব্যারেজের কাছে একটি বাজার সংলগ্ন অঞ্চলে সমাজকর্মীদের একটি গাড়ি আবার আটকায় শাসকদল তৃণমূলের লোকেরা।

"সংখ্যায় প্রায় ১০০ জন, বড় রাস্তার মাঝপথে গাড়ি দাঁড় করিয়ে গাড়ির কাচ ভাঙতে উদ্যত হয় তারা। শুরু হয় অকথ্য গালিগালাজ।" ঘটনার বিবরণ দিচ্ছিলেন সেই গাড়িতে উপস্থিত সমাজকর্মী নিউরো সায়েন্টিস্ট ডঃ সুমিত নন্দ। ডঃ নন্দ আরও বলেন "শাসকদলের জমায়েতের সংখ্যা বাড়তে থাকে, গাড়ির কাঁচ ঠেলে সরিয়ে দিয়ে গাড়িতে উপস্থিত সমাজকর্মীদের জামাকাপড় টেনে ধরে গাড়ি থেকে তাদের বের করতে উদ্যত হয় শাসকদলের কর্মীরা। সংখ্যায় বেড়ে ২৫০-৩০০ জনের দলটি একসময় গাড়িটি উল্টে দেওয়ার চেষ্টা করে, খুন করে ফেলার হুমকি দেয়। সমাজকর্মীরা বীরভূম জেলার এসপির সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন, এসপি তাদের বলেন বাইরে থেকে এলাকায় এসে তারাই নাকি গণ্ডগোল করছেন। প্রায় এক ঘণ্টা পর পুলিশ এসে সমাজকর্মীদের শাসকদল আশ্রিত সমাজ বিরোধীদের থেকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। কেড়ে নেওয়া হয় মোবাইল। প্রায় ৫-৬ ঘণ্টা ধরে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ তাদের জানায় শাসকদলের আক্রমণে জীবনহানির সম্ভাবনা রয়েছে এই কারণে পুলিশ প্রহরায় তাদের কলকাতায় পৌঁছে দেওয়া হবে। পুলিশের দুটি পৃথক গাড়িতে সমাজকর্মীদের বসিয়ে মহম্মদ বাজার থানা থেকে রওনা দেয় পুলিশ। ময়ূরাক্ষী ব্রিজের কাছে এসে গাড়ি দাঁড়িয়ে যায়, প্রায় এক দেড় ঘণ্টা বাদে সিউড়ি থানায় নিয়ে এসে জানানো হয় তাদের এরেস্ট করা হয়েছে। ঘড়িতে তখন রাত তিনটে। ভোরবেলায় তাদের আবার নিয়ে যাওয়া হয় মহম্মদ বাজার থানায়। একটি ফোন করার সুযোগ দেওয়া হয়নি, যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি উকিলের সাথে। বেলা ১০টা নাগাদ সিউরি কোর্টে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়, কোর্টে তাদের জেল হেফাজতের নির্দেশ হয়।" এইভাবে কলকাতার ৭ জন সমাজকর্মীসহ ২ জন স্থানীয় আদিবাসীকেও শাসকদলের নির্দেশে পুলিশ গ্রেফতার করে খুনের চেষ্টার অভিযোগ সহ ২৮টি ধারা দিয়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসায়। জামিন হয় ৯ দিনের মাথায়। মহম্মদ বাজার থানায় মোট ২৭ জনের বিরুদ্ধে দাঙ্গা, অপহরণ, খুনের চেষ্টার মতো একগাদা মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে কেস সাজানো হয়েছে।

শাসকদল এবং পুলিশ-প্রশাসনের ধারণা হয়েছিল এই ঘটনায় দমে গিয়ে গ্রামবাসীরা আন্দোলন থেকে পিছিয়ে যাবে। ৯ জনের গ্রেফতারের খবর গ্রামবাসীদের কাছে পৌছাতে 'বীরভূম জমি, জীবন, জীবিকা ও প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভা'র নেতৃত্বে আন্দোলনের তাপ আরও বাড়তে থাকে। শাসকদল এবং পুলিশ প্রশাসনের ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণিত করে আন্দোলনে প্রতিদিন বেশি বেশি সংখ্যক গ্রামবাসী অংশ নিতে শুরু করেন। গ্রামে গ্রামে মিছিল সভা সংগঠিত হতে শুরু করে। শ্রমিকরা কয়লাখনির বিরোধিতায়, ধৃত সমাজকর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে পাথর খাদানে ধর্মঘট শুরু করেন। রাজ্য এবং দেশের সংবাদমাধ্যমে দেউচা-পাচাঁমির সংবাদ প্রকাশ হতে শুরু করে। দিল্লির 'টিচার্স এগেন্সট ক্লাইমেট চেঞ্জ' সংগঠন আন্দোলনকারীদের সমর্থনে বিবৃতি দেয়। ডিএসএফ, এসএফআই-এর নেতৃত্বে জেএনইউ-এর ছাত্রছাত্রীরা দিল্লির বঙ্গ ভবনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সংযুক্ত কিষান মোর্চার পক্ষ থেকে আন্দোলনের সমর্থনে বিবৃতি জারি করা হয়। রাজ্যের এবং দেশের বহু বিশিষ্ট নাগরিক রাজ্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করে আন্দোলনের পক্ষে মত প্রদান করেন। ২৫শে ফেব্রুয়ারি থেকে মহাসভার উদ্যোগে শুরু হয় ধর্না অবস্থান। শাসকদলের সাথে সমঝোতা করে গ্রামের মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে যারা কয়লাখনি প্রকল্পের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছেন সেই তৃণমূল নেতা সুনীল সরেন, রবিন সরেনের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়।

রামপুরহাটের বগটুই গ্রামে যে নারকীয় হত্যালীলা সংগঠিত হয়েছে শাসকদলের সাথে পুলিশ প্রশাসনের একাংশের যোগসাজশে, তাকে ধামাচাপা দিতে মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন দেউচা-পাচাঁমি কয়লাখনি প্রকল্পের মাধ্যমে রাজ্যজুড়ে যে 'উন্নয়ন' হতে চলেছে তা ব্যাহত করতেই নাকি এই নৃশংস ঘটনা ঘটানো হয়েছে। দেউচা-পাচাঁমির ন্যায্য আন্দোলনের সাথে এই ঘটনাকে যুক্ত করার জন্য মহাসভার পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রতিবাদ করা হয়। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে জানানো হয়েছে মহাসভার পক্ষ থেকে।

দেউচা-পাঁচামি কয়লাখনি প্রকল্পে রাজ্যের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির অবস্থান কেমন? ভারতীয় রাজনীতিতে আরএসএস পরিচালিত বিজেপি এক বিরলতম রাজনৈতিক দল। কোনও বিষয়েই সুস্থ চিন্তা তাদের কাছে প্রত্যাশিত নয়, এরা শুধুমাত্র দ্বিচারিতা করে ঘোলা জলে মাছ ধরতে চায়। ভারত সরকার যখন একদিকে গ্লাসগো সম্মেলনের চুক্তিতে সই করছে বিজেপি নেতা মোহিত চট্টোপাধ্যায় ১০ই ডিসেম্বর তারিখে 'আনন্দবাজার পত্রিকা'য় নিবন্ধ লিখে দেউচা-পাচাঁমি প্রকল্পের পক্ষে মত সংগঠিত করেছেন। প্রদেশ কংগ্রেসের নেতা আব্দুল মান্নান তাদের হাই কম্যান্ডের কাছে চিঠি লিখে রাহুল গান্ধীকে দেউচা-পাচাঁমি এলাকায় আসার অনুরোধ জানিয়েছেন। বামফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত দলগুলো কয়লাখনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সবচেয়ে বড় বাম দল সিপিআই(এম) তাদের মুখপত্রে এলাকার মানুষের সংগ্রামের কথা তুলে ধরেছে। ভাঙরের বিধায়ক নওসাদ সিদ্দিকী আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। সিপিআই(এমএল) প্রকল্পের বিরোধিতায় সক্রিয়।

দেউচা-পাচাঁমি এলাকার সিংহভাগ মানুষ এই কয়লাখনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে। চারটি সুনির্দিষ্ট যুক্তিসম্মত দাবি তারা উত্থাপন করেছেন। রাজ্যের বাকি জনগণ কি করবেন? জীবন-জীবিকা, প্রকৃতির কথা বিবেচনায় রাখলে প্রস্তাবিত কয়লা প্রকল্পকে রাজ্যের স্বার্থ-বাহী বলা যায় না। শাসকদলের ছত্রছায়ায় রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে যে মাফিয়াতন্ত্র কায়েম হয়েছে বীরভূম জেলা হল তার পীঠস্থান। এলাকার মানুষের মতামত গ্রহণের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এরা আস্থাশীল নয় তা দেখাই যাছে। স্থানীয় মানুষ বারংবার এই আলাপ আলোচনার কথাই উল্লেখ করছেন। গ্রামসভা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথে জোর দিচ্ছেন। এই কারণেই দেউচার লড়াই একই সাথে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার লড়াই। 'বীরভূম জমি, জীবন, জীবিকা ও প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভা' সমগ্র রাজ্যবাসীর সমর্থন প্রত্যাশা করে।