আরেক রকম ● দশম বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২২ ● ১৬-৩০ চৈত্র, ১৪২৮

প্রবন্ধ

কাঠগড়ায় ডেউচা-পাঁচামি কয়লাখনি প্রকল্প

প্রসেনজিৎ বসু


ডেউচা-পাঁচামি কয়লাখনি প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ এবং পরিবেশ সংক্রান্ত প্রশ্নগুলিকে রাজ্য সরকার যেভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে, তাতে উদ্বেগ দানা বাঁধছে। মুখ্যমন্ত্রী মুখে বলছেন ডেউচা-পাঁচামিকে সিঙ্গুর হতে দেবেন না। অথচ ৬ জানুয়ারি ২০২২ বীরভূম জেলাশাসকের দপ্তরে তথ্যের অধিকার আইনের আওতায় কয়লাখনি প্রকল্প সংক্রান্ত কিছু তথ্য জানতে চেয়ে আবেদন করায়, দেড় মাস ধরে ঘুরিয়ে অবশেষে আবেদনটাকেই খারিজ করে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ডেউচা-পাঁচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙ্গায় প্রশাসন কোন আইনে জমি অধিগ্রহণ করছে এই সরল প্রশ্নের জবাবও জেলাশাসক দিতে নারাজ।

প্রকল্প অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের উদ্যোগে গত ২০ ফেব্রুয়ারি দেওয়ানগঞ্জ গ্রামে আয়োজিত একটি প্রতিবাদ সভায় এই বিষয়গুলি সামনে আসে। সভার শেষে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় নেতারা ইচ্ছাকৃতভাবে গণ্ডগোল বাধায়। শাসকদলের নির্দেশে পুলিশ ৭ জন সমাজকর্মী এবং ২ জন আদিবাসীকে গ্রেপ্তার করে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে জেলবন্দি করে। জামিন হয় ৯ দিনের মাথায়। মহম্মদবাজার থানায় ২৭ জনের বিরুদ্ধে দাঙ্গা, অপহরণ, খুনের চেষ্টার মতন এক গাদা ভুয়ো অভিযোগ দিয়ে কেস সাজানো হয়েছে।

এই দমন পীড়নের ফলে কিন্তু কয়লাখনি বিরোধী আন্দোলন দমে যায়নি, বরং আরও তীব্র হয়েছে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সময় শিল্পায়ন এবং জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত প্রশ্নগুলি যেভাবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিল, সেভাবেই ডেউচা-পাঁচামি কয়লাখনি প্রকল্প নিয়ে উঠে এসেছে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের পক্ষে প্রশ্নগুলিকে এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল।

[১]

১৮৯৪ সালের ঔপনিবেশিক ভূমি অধিগ্রহণ আইন বাতিল করে ২০১৩-তে যে নতুন আইন এবং নিয়মাবলী বলবত হয়েছে তাতে জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে প্রকল্পের সামাজিক প্রভাব মূল্যায়নের (সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) একটি রিপোর্ট তৈরি করার কথা। এই মূল্যায়নের খসড়া নিয়ে প্রকল্প অঞ্চলের বাসিন্দাদের তিন সপ্তাহ আগে থেকে জানিয়ে গ্রামসভা ভিত্তিক গণশুনানি করা বাধ্যতামূলক। গণশুনানিতে প্রকল্পের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে আপত্তি করার পূর্ণ অধিকার আইনে দেওয়া হয়েছে।

২০১৩-র আইন অনুযায়ী বেসরকারি প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে যারা বাস্তুহারা বা জমিহারা হতে চলেছেন তাদের অন্তত ৮০ শতাংশের সম্মতি এবং সরকারি-বেসরকারি যৌথ মালিকানার (পিপিপি) ক্ষেত্রে অন্তত ৭০ শতাংশের সম্মতি থাকতে হবে। প্রকল্পের কারণে সম্ভাব্য জমিহারা-বাস্তুহারাদের ব্যক্তিগত লিখিত সম্মতি এবং প্রকল্প অঞ্চলের গ্রামসভাগুলির লিখিত সম্মতি নিয়ে তবেই জমি অধিগ্রহণ করা যাবে। সম্মতি আদায়ের প্রক্রিয়ায় কোনরকম জোর-জবরদস্তি, ভীতিপ্রদর্শন অথবা বেআইনি চাপ সৃষ্টি যাতে না করা হয় সেটা সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের।

ডেউচা-পাঁচামির প্রস্তাবিত কয়লাখনির ক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণ আইনের এই গুরুত্বপূর্ণ বিধানগুলি লঙ্ঘিত হয়েছে। সামাজিক প্রভাব মূল্যায়নের খসড়া রিপোর্ট এখনো পর্যন্ত জনসমক্ষে আনা হয়নি, যার ফলে প্রকল্প সংক্রান্ত বিশ্বস্ত তথ্য সমস্ত বিষয়ে এখনো উপলব্ধ নয়। সম্ভাব্য জমিহারা এবং বাস্তুহারাদের জন্য গণশুনানি করে গ্রামসভার সম্মতি নেওয়ার কোনো প্রচেষ্টাও হয়নি। বরং খনি প্রকল্পের সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন চূড়ান্ত করার আগেই ২০২১-এর নভেম্বরে রাজ্য বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ডেউচা-পাঁচামি প্রকল্পের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার একটি ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসন প্যাকেজ ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে।

মূল্যায়ন রিপোর্টের পরিবর্তে এই ক্ষতিপূরণ প্যাকেজের বিবরণ দিয়ে একটি প্রচার পুস্তিকা স্থানীয় মানুষের মধ্যে বিলি করা হয়েছে। এই পুস্তিকায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী খনি প্রকল্পের জন্য ৩,৪০০ একর জমি নেওয়া হবে যার মধ্যে ২,২৬৭ একর জমি ব্যক্তিমালিকানাধীন। ১৮টি গ্রামে ৩,০১০টি পরিবার বাস্তুহারা হবে, যার মধ্যে ১,০১৩টি আদিবাসী পরিবার। এছাড়া আরও ১,৮২৮টি অন্য অঞ্চলে বসবাসকারী পরিবারের জমিও অধিগৃহীত হবে; অর্থাৎ সরকারি হিসেবে খনি প্রকল্পের জন্য মোট ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ৪,৮৩৮। জেলা প্রশাসন দাবি করছে যে, এর মধ্যে ১,৬০০ পরিবার নাকি ইতিমধ্যেই জমি অধিগ্রহণের জন্য সম্মতি জানিয়েছে। ইতিমধ্যে ক্ষতিপূরণের চেক, জমির পাট্টা বা চাকরির নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে ২০৩ জনকে। অর্থাৎ জমি অধিগ্রহণের জন্য সম্মতি নেওয়ার প্রক্রিয়া আইন অনুযায়ী শেষ না করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কাজ শুরু করে দেওয়া হয়েছে।

রাজ্য সরকারের সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের প্যাকেজে বাস্তুহারা পরিবারপিছু পাওয়া যাবে বিঘাপ্রতি ১৩ লক্ষ টাকা, পুনর্বাসন কলোনিতে ৭০০ বর্গফুটের একটি করে বাড়ি অথবা ৭ লক্ষ টাকা, পরিবারপিছু একজনের পুলিশ কনস্টেবলের চাকরি, স্থানান্তর এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য পরিবার প্রতি আরও ২.২ লক্ষ টাকা এবং জমিতে গাছপালা, শস্য, গোয়ালঘর, পশুখামার, নলকূপ খনন ইত্যাদি বাবদ ক্ষতিপূরণ। জমিহারারাও একই দামে জমি, গাছপালা, শস্য ইত্যাদির ক্ষতিপূরণ পাবে, সাথে পরিবারপিছু একজনের জন্য সরকারি চাকরি। বাস্তুহারা এবং জমিহারা পরিবার ছাড়াও ২৮৫ জন ক্রাশার মালিক, ৯ থেকে ১০ জন পাথর খাদান মালিক, প্রায় ৩ হাজার খাদান ও ক্রাশার শ্রমিক, ১০৪ জন নথিভুক্ত বর্গাদার, ১৫০ জন খেতমজুর, ৩৯ জন ছোট ব্যবসায়ী-দোকানদার, ২৪টি ভাড়াটে পরিবার এবং ১৫ জন জবরদখল করে বসবাসকারীর জন্যে আলাদা আলাদা ক্ষতিপূরণের প্যাকেজ আছে।

[২]

এই ক্ষতিপূরণের প্যাকেজ নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন আছে। প্রথমত, প্রশাসন যাদের ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে জমি দিতে ইচ্ছুক বলে চিহ্নিত করছে তাদের অনেকেই এখন আর ডেউচা-পাঁচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙ্গা অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা নন; ওখানে তাদের জমি আছে যেটা তারা ভালো দামে বিক্রি করে দিতে চাইছে। কিন্তু ওখানে বসবাসকারী সাঁওতাল আদিবাসীদের বহুলাংশই কয়লাখনি প্রকল্পের জন্য নিজেদের বাস্তুভিটে, চাষের জমি, জাহের থান, মাঝি থান, চারণভূমি এবং জীবনশৈলী ছেড়ে প্রতিশ্রুত কোনো এক পুনর্বাসন কলোনির ৭০০ বর্গফুটের বাড়িতে চলে যেতে অনিচ্ছুক।

গত কয়েক দশকে বীরভূমের ওই অঞ্চলে খাদান-ক্রাশারের বেলাগাম বৃদ্ধি একদিকে যেমন স্থানীয় পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের উপর নানাবিধ কুপ্রভাব ফেলেছে, অন্যদিকে কিন্তু কয়েক হাজার আদিবাসীকে জীবিকা নির্বাহের জন্য এই খাদান-ক্রাশার অর্থনীতির উপরেই নির্ভরশীল করে তুলেছে। তার জায়গায় কয়লাখনি হলে আদিবাসীদের শুধু ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হতে হবে না, কর্মচ্যুতও হতে হবে। কিছু টাকা ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে জীবন-জীবিকার এতবড় সঙ্কটকে তারা ডেকে আনতে নারাজ।

দ্বিতীয়ত, বিশ্বের সর্ববৃহৎ কয়লা উৎপাদক সংস্থা কোল ইন্ডিয়া, যে ভারতজুড়ে ৩৪৫টি কয়লাখনি চালিয়ে ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ৫৪ কোটি টন কয়লা উৎপাদন করেছে, ২০২২-এর জানুয়ারিতে তার মোট কর্মীর সংখ্যা ছিল ২.৫ লক্ষ। এক দশক আগে, ২০১১-১২ অর্থবর্ষে কোল ইন্ডিয়ার উৎপাদন ছিল ৪৩ কোটি টন, মোট কর্মী ছিল ৩.৭ লক্ষের বেশি। এর থেকেই কয়লা শিল্পে কর্মসংস্থানের দীর্ঘমেয়াদী প্রবণতা বোঝা যায়। তাই মুখ্যমন্ত্রী মুখে যতই দাবি করুন, বাস্তবে ডেউচা-পাঁচামির মতন কেবলমাত্র একটা বৃহৎ কয়লাখনি প্রকল্প থেকে এক লক্ষ কর্মসংস্থান হওয়া তো দূরের কথা, তার একটা ছোট ভগ্নাংশও হবে কিনা সন্দেহ। তদুপরি এই কয়লাখনি যে আধুনিক যন্ত্রনির্ভর প্রযুক্তিতে চলবে তাতে অদক্ষ গ্রামীণ শ্রমিকদের কর্মনিযুক্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ।

সেটার বড় প্রমাণ ক্ষতিপূরণের প্যাকেজে প্রকল্পের মূল নির্বাহক পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম বা ওয়েস্ট বেঙ্গল পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড (ডব্লিউবিপিডিসিএল) কিন্তু চাকরির কোনো প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে না, প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশে কনস্টেবলের চাকরির। তাও সমস্ত জমিহারা-বাস্তুহারা পরিবার সরকারি চাকরি পাবে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে, বিশেষত যারা সংখ্যালঘু, দলিত অথবা অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত। হিংলো বাঁধ প্রকল্প, বক্রেশ্বর তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিবপুর মৌজায় শিল্পের নামে জমি নিয়ে আবাসন নির্মাণের মতন বীরভূম জেলার বিভিন্ন প্রকল্পের জমিহারারা প্রশাসনের প্রতিশ্রুত চাকরির দাবিতে এখনো আন্দোলন করে যাচ্ছে। ডেউচা-পাঁচামির সম্ভাব্য বাস্তুহারারা তাই আশঙ্কিত।

তৃতীয়ত, ক্ষতিপূরণ প্যাকেজের হিসেব অনুযায়ী ৯-১০টি চালু পাথর খাদান এবং ২৮৫টি ক্রাশার ইউনিটকে উচ্ছেদ করা হবে। খাদান মালিকদেরকে অন্যান্য জমিহারাদের হারেই কাঠাপিছু ৫০ থেকে ৬৫ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে জানিয়ে তারপর বলা হয়েছে "জমিতে সৃষ্ট সম্পদ স্থানান্তরযোগ্য না হলে, সরকার নির্ধারিত দাম পাবেন"। অর্থাৎ পাথর খাদানের ক্ষতিপূরণ আসলে কত সেটা নিয়ে কোন স্বচ্ছতা নেই। এটা নিয়ে হেরাফেরি হওয়ার আশঙ্কা।

ক্রাশার ইউনিটগুলিকে জমির দাম ছাড়া একটি প্রস্তাবিত 'ব্যাসল্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে' ইউনিটপিছু তিন লাখ টাকা বাজার মূল্যের জায়গা বিনামূল্যে দিয়ে স্থানান্তরিত করার কথা বলা হয়েছে। প্যাকেজে স্থানান্তরিত হওয়া প্রতিটি ক্রাশার ইউনিটকে ব্যবসার ক্ষতিপূরণ বাবদ ছয় মাস ধরে বিনামূল্যে রোজ ১০ ট্রাক পাথর দেওয়ার কথাও বলা আছে, যার বাজার মূল্য প্রায় ১ কোটি টাকা। প্রশ্ন হল, যদি কয়লাখনি প্রকল্পের জন্য চালু পাথর খাদান এবং ক্রাশার ইউনিটগুলিকে উচ্ছেদ করতে হয় সেক্ষেত্রে তাদের ক্ষতিপূরণ বাবদ রোজ যে ১০ ট্রাক পাথর দেওয়া হবে সেটা আসবে কোথা থেকে? কালো পাথরের বাজারদর তার গুণমানের উপর নির্ভরশীল; পাঁচামির খাদানের পাথরের যা দাম নলহাটির খাদানের পাথরের দাম তার থেকে অনেকটাই আলাদা হতে পারে। ক্রাশার ইউনিটগুলিকে পাথর যোগানের বিষয়ে স্বচ্ছতা না থাকলে ব্যবসার ক্ষতিপূরণ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠতে বাধ্য।

মুখ্যমন্ত্রীর প্যাকেজ নিয়ে সব থেকে বড় প্রশ্ন যে ক্ষতিপূরণের ঘোষিত অঙ্ক ১০ হাজার কোটি টাকা আসবে কোথা থেকে? গত দুই বছরে করোনা অতিমারির জনিত অর্থনৈতিক সঙ্কট সামলাতে রাজ্য সরকারের ব্যয় বেড়েছে, অন্যদিকে আয় কমেছে। ফলে রাজস্ব ঘাটতি ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে ১৯.৭ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০২১-২২ অর্থবর্ষে হয়েছে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা। মার্চ ২০২০ থেকে মার্চ ২০২২-র মধ্যে রাজ্য সরকারের মোট ঋণের বোঝা বেড়েছে ৯৬ হাজার কোটি টাকা।

কোষাগারের এই বেহাল দশার প্রেক্ষিতে ডেউচা-পাঁচামি খনি প্রকল্পের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার বাড়তি বোঝা রাজ্য সরকারের পক্ষে বহন করা কি সম্ভব? বিশেষত যেখানে উপকৃত মানুষের সংখ্যা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বা স্বাস্থ্যসাথীর মতন জনপ্রিয় সামাজিক প্রকল্পগুলির তুলনায় অনেক কম। এই জন্যেই সম্প্রতি বিধানসভায় পেশ হওয়া রাজ্য বাজেটে এই ১০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ কোন মন্ত্রককে বরাদ্দ করা হয়েছে তাই নিয়ে কোনরকম স্পষ্টতা নেই। স্বচ্ছ বাজেট বরাদ্দ ব্যতীত ১০ হাজার কোটি টাকার অঙ্ক নিয়ে সংশয় থেকে যাবে।

[৩]

রাজ্য বাজেটে জানানো হয়েছে যে বীরভূমের ডেউচা-পাঁচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙ্গায় প্রস্তাবিত কয়লাখনি প্রকল্পটিকে রাজ্য সরকার "বিশেষ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গড়ে তুলতে আগ্রহী"। অর্থাৎ করোনা অতিমারির ধাক্কায় বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে ফের চাঙ্গা করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এই কয়লাখনি প্রকল্পে অনুমিত বিনিয়োগের উপর ভরসা রাখছে। এই প্রত্যাশা কি যুক্তিসঙ্গত? নাকি ভারতের ‘সর্ববৃহৎ’ এই কয়লাখনি প্রকল্পে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি?

ডেউচা-পাঁচামিতে কয়লাখনি করার উদ্যোগ শুরু হয় বামফ্রন্ট আমল থেকেই। ২০০৮ সালে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত খনন সংস্থা ন্যাশনাল মিনারেল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (এনএমডিসি) মউ সই করে রাজ্য সরকারের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ওয়েস্ট বেঙ্গল মিনারেল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেড (ডব্লিউবিএমডিটিসিএল)-এর সাথে। কোল ইন্ডিয়ার সাথে মিলে এনএমডিসি এবং ডব্লিউবিএমডিটিসিএল যৌথ উদ্যোগে খনি প্রকল্প শুরু করার প্রচেষ্টা হয়, কিন্তু কোল ইন্ডিয়া উৎসাহ না দেখানোয় প্রকল্প এগোয়নি।

তারপর ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রক পশ্চিমবঙ্গ সহ ছয়টি রাজ্যকে ডেউচা-পাঁচামি কয়লা ব্লকটি বরাদ্দ করেছিল তাদের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির জন্য। ২০১৪-তে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সেই কয়লা ব্লক বণ্টন বাতিল হয়ে যাওয়ার পর যখন নতুন করে নিলাম করা হয় তখন উত্তরপ্রদেশ, বিহার, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক এবং পাঞ্জাবের রাজ্য সরকারগুলি আর আগ্রহ দেখায়নি। ফলে ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমকেই এই কয়লা ব্লকটি পুনঃবরাদ্দ করা হয়।

ডেউচা-পাঁচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙ্গায় ১২.৩ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে আনুমানিক ২০০ কোটি টনের সুবিশাল কয়লার ভাণ্ডার মজুত থাকা সত্ত্বেও দেশের 'সর্ববৃহৎ' এই কয়লাখনি প্রকল্পটি বার বার হোঁচট খেল কেন? কোল ইন্ডিয়া থেকে বিভিন্ন রাজ্য সরকারগুলি কেন আগ্রহ দেখাল না এই কয়লাখনি নিয়ে? এর কারণ জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (জিএসআই) জরিপ করে অনেক আগেই জানিয়েছে যে ডেউচা-পাঁচামিতে ভূগর্ভস্থ কয়লাস্তরের গভীরতা এবং পুরুত্ব ভারতের অন্যান্য কয়লাখনিগুলির তুলনায় অনেক বেশি।

এখানে কয়লাস্তর চাপা পড়ে রয়েছে ৯০ থেকে ২৪৫ মিটার পুরু আগ্নেয়গিরিজাত ব্যাসল্ট পাথরের স্তরের নিচে। এই পুরু স্তরের কালো পাথরের ওভারবার্ডেন তুলে, ১২০০ মিটার পর্যন্ত গভীরতায় নেমে, ৮০ মিটার অবধি পুরু স্তর থেকে কয়লা খনন করতে যে দুর্লভ প্রযুক্তির প্রয়োজন ভারতে তা উপলব্ধ নয়। জিএসআই রিপোর্ট অনুযায়ী ডেউচা-পাঁচামির কয়লার গুনমান বা গ্রেডও খুব একটা উৎকৃষ্ট নয়। ফলে বিদেশী প্রযুক্তি এনে এখানে কয়লা খনন করলে আদপেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের পড়তায় পোষাবে কি? এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে এটা একটা বড় প্রশ্ন যার কোনো সদুত্তর পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম বা রাজ্য সরকার এখনো দিতে পারেনি।

মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি জানিয়েছেন ডেউচা-পাঁচামির কয়লাখনি প্রকল্পে নাকি ৩৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের মোট বার্ষিক আয় এবং ব্যয় সাম্প্রতিক কালে থেকেছে ১০ হাজার কোটি টাকার আশেপাশে, ২০২০-২১ অর্থবর্ষে নিগমের মুনাফা হয়েছে ২৫২ কোটি টাকা। রাজ্য সরকারের বিদ্যুৎ দপ্তরের সামগ্রিক খরচ ২০২১-২২ অর্থবর্ষে হয়েছে ৩,৮৯৪ কোটি টাকা, ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে মোট বাজেট বরাদ্দ ২,৮৩৮ কোটি টাকা। তাই এই কয়লাখনিতে ৩৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের সিংহভাগ কিন্তু রাজ্য সরকার বা বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম থেকে আসবে না। এই পরিমাণ বিনিয়োগ দেশী বা বিদেশী কোনো বড় কর্পোরেট সংস্থার মাধ্যমেই হতে পারে। কিন্তু বেসরকারি পুঁজি তখনি আসবে যখন বড় মুনাফার ইনসেন্টিভ থাকবে।

ডেউচা-পাঁচামির কয়লার গুনমান উৎকৃষ্ট না হলেও ওখানকার কালো পাথরের যে বাজারে বিশাল চাহিদা তা সর্বজনবিদিত। জিএসআই রিপোর্টের মতে কয়লা খনন করতে যে পরিমাণ কালো পাথর তুলতে হবে তাতে পশ্চিমবঙ্গে সড়ক তৈরি, রেল লাইনের ব্যালাস্ট এবং নির্মাণ শিল্পের সামগ্রিক চাহিদা মেটানোর পরে বাইরের রাজ্যেও রপ্তানি করা যাবে। ফলে ডেউচা-পাঁচামির মাঝারি থেকে নিম্ন গ্রেডের কয়লা খননের জন্য কোনো কর্পোরেট সংস্থাকে আকর্ষণ করার জন্য উৎকৃষ্ট মানের কালো পাথর রাজ্য সরকার সেই সংস্থাকে বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে দিয়ে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে এখন চালু কয়েকশ' ছোট থেকে মাঝারি পাথর খাদান-ক্রাশার ইউনিটের জায়গায় একটা বৃহৎ একচেটিয়া সংস্থা পাথর এবং কয়লা দুটোই একসাথে খনন করবে। এর আর্থ-সামাজিক লাভ-ক্ষতির যথার্থ বিশ্লেষণ করে তবেই এগোনো উচিৎ।

বিদেশী প্রযুক্তি এবং বড় কর্পোরেট বিনিয়োগ ছাড়া যদি ডেউচা-পাঁচামির কয়লাখনি প্রকল্প বাস্তবায়িত করা সম্ভবপর না হয়, সেক্ষেত্রে এই প্রকল্পের মালিকানার চরিত্রে বদল আসবে। জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রেও বেসরকারি এবং যৌথ মালিকানার প্রকল্পের জন্য আলাদা মাপকাঠি রয়েছে। তাই প্রকল্পের মালিকানার চূড়ান্ত চরিত্র নির্ণয় না করে জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করাও উচিৎ নয়। সরকারি বা রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের খনি প্রকল্পের হিসেবে জমি অধিগ্রহণ করে পরে বেসরকারি সংস্থাকে খনন করতে দিলে সেটা আইনসম্মত হবে না।

[৪]

ডেউচা-পাঁচামির মতন বৃহৎ কয়লাখনি প্রকল্পের জন্য সামাজিক প্রভাব মূল্যায়নের সাথে সাথে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (এনভাইরনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) করাও পরিবেশ সুরক্ষা আইন এবং নিয়মাবলী অনুযায়ী বাধ্যতামূলক। খনি প্রকল্পের মূল নির্বাহক পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম কিন্তু পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন করার প্রক্রিয়া এখনো শুরুই করেনি। অথচ জমি অধিগ্রহণের জন্য সম্মতি আদায় করার কাজ শুরু হয়ে গেছে।

একটি বৃহৎ খোলা মুখ কয়লাখনি হলে প্রকল্প এলাকা এবং আশেপাশের অঞ্চলের পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র এবং সমাজজীবনের উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে। রাণীগঞ্জ-আসানসোল-ধানবাদ-বোকারোর অভিজ্ঞতা চোখের সামনেই আছে। প্রকল্প এলাকার চারপাশের বহু গ্রাম, গঞ্জ ও শহরের আকাশ-বাতাস ও জনস্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ডেউচা-পাঁচামির ভূগর্ভস্থ জলস্তর, দ্বারকার মতন নদী এবং প্রকল্পের বহুদূর পর্যন্ত কৃষিক্ষেত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। স্থানীয় পরিবেশের উপর যে কুপ্রভাব পড়বে তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে?

সর্বোপরি, নতুন করে আরও ২০০ কোটি টন কয়লা তুলে পোড়ালে যে বিপুল কার্বন নিঃসরণ ঘটবে তা বিশ্ব উষ্ণায়নকে ত্বরান্বিত করবে। পশ্চিমবঙ্গে সুন্দরবন সহ দুই চব্বিশ পরগণা ও পূর্ব মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল আগামি কয়েক দশকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে জলের তলায় তলিয়ে যাওয়ার বিপদসীমায় দাঁড়িয়ে আছে। গত কয়েক বছরে আমফান, ইয়াসের মতন সমুদ্রঝড়ের ঘনঘন ঝাপটায় জলবায়ু সঙ্কটের ধাক্কা আমরা খানিকটা প্রত্যক্ষ করতে শুরু করেছি।

২০২১-এর নভেম্বরে গ্লাসগোতে কপ ২৬ জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বজুড়ে কয়লা চালিত তাপবিদ্যুতের অনুপাত কমিয়ে এনে বিদ্যুৎ উৎপাদনে পরিবেশবান্ধব সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি এবং অন্যান্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য বা নবায়নযোগ্য শক্তির অনুপাত বাড়ানোর বিষয়ে আন্তর্জাতিক বোঝাপড়া হয়েছে। ভারতও এই বোঝাপড়ার শরিক। ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের হিসেব অনুযায়ী দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতায় কয়লা চালিত বিদ্যুতের বর্তমান অনুপাত ৪৫% থেকে কমিয়ে ২০২৯-৩০ সালে ৩৩%-তে নিয়ে আসা হবে। অন্যদিকে ২০২১-২২ থেকে ২০২৯-৩০-এর মধ্যে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতায় সৌরশক্তির অনুপাত ২১% থেকে বেড়ে হবে ৩৪%, বায়ুশক্তির অনুপাত ১২% থেকে বেড়ে হবে ১৭%।

২০৩০ সালের মধ্যে ভারতে বছরে ৫০ লক্ষ টন গ্রীন হাইড্রোজেন উৎপাদন করার লক্ষ্যমাত্রাও ঠিক করা হয়েছে। এটা স্পষ্ট যে অন্যান্য দেশের মতন ভারতেও আগামীদিনে কয়লা চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে আসবে, আর সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, গ্রীন হাইড্রোজেন, অ্যামোনিয়া-সহ অন্যান্য নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদন বাড়তে থাকবে। এই প্রেক্ষিতে আগামী ১০০ বছর কয়লার যোগান দেওয়ার জন্য আরেকটা নতুন কয়লাখনির আদপেও কি কোন প্রয়োজন আছে?

সি-৪০ গোষ্ঠীর সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের ৬১টি মেগাসিটির মধ্যে কয়লাজনিত বায়ুদূষণের হার সবচেয়ে বেশি কলকাতাতে। এই কয়লাজনিত বায়ুদূষণের ফলে হাঁপানি এবং অন্যান্য শ্বাসকষ্টজনিত অসুখে অপরিণত বয়সে মৃত্যু হচ্ছে অনেক বাসিন্দার, যেই তালিকার শীর্ষে কলকাতা। এই মাত্রাতিরিক্ত বায়ুদূষণের প্রধান কারণ পশ্চিমবঙ্গ-সহ সমগ্র পূর্ব ভারতের একগাদা কয়লা চালিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র।

ডেউচা-পাঁচামিতে ১০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে আদিবাসী এবং অন্যান্য গ্রামীণ বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করে কয়লাখনি চালু করার বদলে রাজ্য সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম মিলে সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুশক্তি, গ্রীন হাইড্রোজেন-সহ নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে ওই টাকা বিনিয়োগ করছে না কেন। কয়লাখনি, তাপবিদ্যুৎ ইত্যাদির তুলনায় নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে কর্মসংস্থানের সুযোগ অনেক বেশি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা।

বিশ্বজুড়ে যখন কয়লা এবং খনিজ তেলের ব্যবহার কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ কেন তার উলটো রাস্তায় হাঁটবে? একটি বিশাল কয়লাখনি নতুন করে খুলে আরও বেশি কয়লা চালিত তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন করার ভাবনাটা কি খুব দূরদৃষ্টিসম্পন্ন? ডেউচা-পাঁচামি কয়লাখনি প্রকল্প সংক্রান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার আগে রাজ্য সরকারকে এর জবাবদিহি করতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নতুন কয়লাখনি প্রকল্প জনস্বার্থে কিনা সেটা আলোচনা-বিতর্কের মধ্যে দিয়ে জনগণকেই নির্ণয় করতে হবে।


______________________________
এই নিবন্ধের একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ গত ৩০ মার্চ ২০২২, আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।