আরেক রকম ● দশম বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২২ ● ১৬-৩০ চৈত্র, ১৪২৮

প্রবন্ধ

যে উন্নয়ন উন্নয়নেরই অন্তরায়

বুদ্ধদেব ঘোষ


২০১১ সালে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরপরই শ্রীমতী মমতা ব্যানার্জি ঘোষণা করেন যে উন্নয়নই তাঁর সরকারের প্রধান লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে তাঁর নতুন উন্নয়ন পরিকল্পনা সম্পর্কে কোন দিশা না দেখিয়েই শ্রীমতী ব্যানার্জি প্রতি বছর বিভিন্ন প্রকল্পের সুচনা করতে থাকেন। কোনও কোনও বামপন্থীর মতে তাঁর ঘোষিত অনেকগুলি প্রকল্পের মধ্যে বেশ কিছু প্রকল্প সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধনে সক্ষম। সুতরাং সেইসব প্রকল্পগুলিকে অবশ্যই উৎসাহিত করা উচিৎ। টিএমসি নেতারা মনে করেন যে তাঁদের সরকারের ঘোষিত প্রকল্পগুলির মাধ্যমে সাধারণ ও গরীব মানুষের উপকার হওয়ায় ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকতে একটি শক্তিশালী ভোট ব্যাঙ্ক তৈরি করতে তাঁরা সক্ষম হয়েছেন। ভোট ব্যাঙ্ক তৈরি করতে এই প্রকল্পগুলি হয়ত সাহায্য করেছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান-এর উন্নতিকল্পে এই প্রকল্পগুলি কোনওরকম ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে তা মনে হয় না। সুতরাং উন্নয়ন প্রকল্পর নামে বর্তমান সরকার যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে চলেছে তার পেছনে আসল উদ্দেশ্যটা হল ভোট ব্যাঙ্ক তৈরি করা। প্রায় সমস্ত প্রকল্পেরই এছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্য নেই।

উন্নয়নকে নানাভাবে দেখা যেতে পারে। জাতীয় আয় বা মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হারকে উন্নয়নের সূচক হিসাবে ধরা যেতে পারে, যদিও তা জাতীয় সম্পদ বণ্টনের বিষয়ে কোনওরকম আলোকপাত করে না। এই সূচকের বিচারে তৃণমূল সরকার সাফল্যের বিশেষ নজির রাখতে পারেনি। তাদের রাজত্বকালের প্রথম আট বছর অর্থাৎ ২০১২-১৩ সাল থেকে ২০১৯-২০ সাল পর্যন্ত স্থির মূল্যে (২০১১-১২ ভিত্তি বছরের) পশ্চিমবঙ্গের মাথাপিছু আয় বেড়েছে গড়ে বার্ষিক ৪.২৩ শতাংশ হারে, যেখানে এই সময়কালে সমগ্র ভারতের মাথাপিছু আয়ের বার্ষিক বৃদ্ধির হার গড়ে ৫.১২ শতাংশ। এই সময়কালে সারে পাঁচ শতাংশ বা তারও বেশি হারে গড় আয় বৃদ্ধি পেয়েছে এমন রাজ্যের সংখ্যা অন্তত ৯টি (সূত্রঃ পরিসংখ্যান ও পরিকল্পনা রুপায়ন মন্ত্রালয়, ভারত সরকার)।

অন্যভাবে, বস্তুগত পরিকাঠামো যেমন রাস্তা, সেচব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ইত্যাদি এবং সামাজিক পরিকাঠামো যেমন গ্রামীণ উৎপাদনের বিক্রির ব্যাবস্থা, কৃষি ঋণের সুযোগ সৃষ্টি, সমবায় ব্যবস্থা ইত্যাদির উন্নতিও উন্নয়নের সূচক রূপে ভাবা যেতে পারে। এই সূচকের নিরিখেও পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে আছে। দুই-একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে অর্থাৎ ৭ বছরে পশ্চিমবঙ্গে রাস্তার উন্নতি (দৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে) হয়েছে ৪ শতাংশ। অন্যান্য প্রায় সব রাজ্যেই উন্নতির হার অনেক বেশি। ৯/১০টি বড় রাজ্যে দেখা যাচ্ছে যে তাদের রাস্তা সাত বছরে ৮ থেকে ৩৫ শতাংশ বেশি দীর্ঘ হয়েছে (সূত্রঃ সড়ক পরিবহন ও রাজপথ মন্ত্রালয়, ভারত সরকার)। যদি মাথাপ্রতি বিদ্যুৎ প্রাপ্তির হিসাব দেখি, তাহলে দেখা যাবে যে এই রাজ্যে ২০১২-১৩ থেকে ২০২০-২১ অর্থাৎ গত ৯ বছরে তা ২৫ শতাংশ বেড়েছে, যেখানে সারা ভারতের গড় বৃদ্ধির হার হল ৩৭ শতাংশ (সূত্রঃ বিদ্যুত মন্ত্রালয়, ভারত সরকার)। শ্রীমতী ব্যানার্জির ঘোষিত অন্তত সত্তরটির বেশি প্রকল্পের মধ্যে এমন প্রকল্প খুঁজে পাওয়া কঠিন, যা কিনা বস্তুগত পরিকাঠামো নির্মাণের উদ্দেশে সৃজিত হয়েছে।

টিএমসির উন্নয়ন প্রকল্পগুলি কি সামাজিক ক্ষেত্রের বিষয়গুলি যেমন শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, পুষ্টি, লিঙ্গ সমস্যা বা সামাজিক ন্যায়বিচার ইত্যাদির উপর একেবারেই মনোযোগ দেয়নি? এমন অনেকগুলি প্রকল্প অবশ্যই আছে যা সামাজিক ক্ষেত্রের উন্নতি সাধনে সক্ষম। কিন্তু সেগুলির বেশিরভাগই কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প যেমন এনআরইজিএস, খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্প, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, স্যানিটেশন প্রোগ্রাম, মিড ডে মিল প্রকল্প ইত্যাদি। কিছু পুরনো চালু প্রকল্প যেমন আইসিডিএস, তফশিল জাতি উপজাতি ও মহিলা শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষা অনুদান, বার্ধক্য ভাতা, সরকারী পাঠাগার ইত্যাদি হয় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নয় তার অনুদান কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।

রাজ্যের নিজস্ব প্রকল্প

শ্রীমতী ব্যানার্জির উন্নয়ন-চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে রাজ্য সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত প্রকল্পগুলিতে যাদের মধ্যে বেশ কিছু প্রকল্প বিপুল প্রচারের আলোয় আলোকিত হয়েছে। এই প্রকল্পগুলির কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। সেগুলি হলঃ

• প্রকল্পগুলি হচ্ছে পপুলিস্ট প্রকল্প যার দ্বারা ভোক্তার (ভোটার) মধ্যে তার ‘ভাল লাগার’ অনুভূতি অনেক বড় হয়ে ওঠে তার যথার্থ উন্নয়ন-এর প্রশ্ন থেকে।
• অনেক প্রকল্প হচ্ছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক অথবা তার পরিবারকেন্দ্রিক (ভোটার) জনসাধারণের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পায় এমন প্রকল্প সেখানে অগ্রাধিকার পায়না।
• কিছু দিশাহীন প্রকল্পে অনর্থক অর্থ ব্যয় হচ্ছে যেমন (i) অব্যবহৃত বা স্বল্প-ব্যবহৃত কিষাণ মান্ডি, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক-হীন সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল ইত্যাদি এবং (ii) পরিচালন এবং রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা ছাড়াই সৌন্দর্যায়ন প্রকল্প, যার ফলে প্রকল্পটিতে যদিও বা কোনও উপকার হয়, তা একান্তই ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতির।
• টিএমসির প্রকল্পগুলির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভোক্তার (ভোটার) মধ্যে তাৎক্ষণিক আনন্দের সঞ্চার করা। তাই দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পগুলি অগ্রাধিকার পায়না।
• প্রকল্পগুলি সুবিধাভোগীদের কাছে আসে সাধারণ ত্রাণের প্রকৃতিতে, তাদের বাস্তবায়নের সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হল হালকা শর্তে অথবা বিনা শর্তে নগদ টাকা হস্তান্তর।

উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলির দিকে নজর দিলে বোঝা যাবে যে সাধারণ উন্নয়নমূলক প্রকল্প এবং টিএমসি সরকার দ্বারা পরিচালিত প্রকল্পগুলির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। যথার্থ উন্নয়নের প্রকল্পগুলির উদ্দেশ্য হল বিভিন্ন উপায়ে সামাজিক সুযোগ তৈরি করা, যাতে নাগরিকরা সেগুলি গ্রহণ করে তাঁদের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়। অন্য কথায়, এই ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে, সুবিধা প্রাপক একজন সক্রিয় ব্যক্তি যিনি তাঁর সক্ষমতা প্রসারিত করার জন্য উন্নয়নমূলক রাষ্ট্র দ্বারা প্রদত্ত সুবিধাগুলি ব্যবহার করেন। অমর্ত্য সেনকে অনুসরণ করে, আমরা উন্নয়নকে সক্ষমতা (capability) সম্প্রসারণের মাধ্যমে স্বক্ষমতা (freedom) অর্জন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি। কিন্তু টিএমসির বেশিরভাগ প্রকল্পগুলি নাগরিকদের উন্নয়ন প্রকল্পের সুবিধাগুলির নিষ্ক্রিয় প্রাপক হিসাবে দেখে। সুবিধা প্রাপকদের সক্ষমতার সম্প্রসারণ নয়, তাঁদের মধ্যে তাৎক্ষণিক আনন্দের সঞ্চার করাই এই প্রকল্পগুলির প্রধান লক্ষ্য। কখনও কখনও কিছু প্রকল্পের, যদিও তারা সংখ্যায় অল্প, কিছু নির্দিষ্ট উন্নয়ন লক্ষ্য থাকে। কিন্তু প্রকল্পটির সাথে সংযুক্ত কোনো উদ্দেশ্য সফল না হলেও অর্থাৎ প্রকল্পটির পরিকল্পনা ত্রুটিপূর্ণ হলেও তা চালিয়ে যাওয়া হয়, যদি সেই প্রকল্পের ভোক্তাকে নগদ টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এটি এমন একটি উন্নয়ন নীতির উদাহরণ যা উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের চেয়ে সুবিধাভোগীর নগদ টাকা হস্তান্তর থেকে প্রাপ্ত তাৎক্ষণিক সুখকে বেশি মূল্য দেয়।

শ্রীমতী ব্যানার্জির উন্নয়নের কাজকর্ম অনেক সময়ে পুরানো কালের দানশীল জমিদারদের কথা মনে করিয়ে দেয়। ওঁরা দানধ্যান করতেন - কূপ খুঁড়িয়ে দেওয়া, মন্দিরের সংস্কার করা, গরীবদের বস্ত্রদান করা ইত্যাদি। দানধ্যানে জনপ্রিয়তা অর্জন করা যায়, কিন্তু জনগণের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্য পূরণ করা যায় না। কিন্তু মমতাদেবীর কাছে জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের চাইতে নিজের জনপ্রিয়তা অর্জন অনেক বেশি জরুরী। তাই সরকারি অর্থ তিনি দরাজ হস্তে দান করে থাকেন। ৩৭,০০০ দুর্গা পূজা কমিটিগুলির প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা অনুদান এবং বিদ্যুতের বিল ও অন্যান্য ছাড় দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। এতে খরচ হয় বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। তৃণমূল সরকার উন্নয়নের নামে এই ধরনের অসাধু খরচ করতে নির্ভীক। এইভাবেই ৪,০০০টিরও বেশি ক্লাবের প্রত্যেককে বার্ষিক ২ লক্ষ টাকা অনুদানের জন্য প্রতি বছর প্রায় ১০০ কোটি টাকা খরচ হয়। মসজিদের ইমাম এবং মন্দিরের পুরোহিতদের মাসিক অনুদান প্রদান সরকারি দানধ্যানের আরেকটি উদাহরণ।

শ্রীমতি ব্যানার্জির ফ্ল্যাগশিপ স্কিম 'কন্যাশ্রী' নিয়ে অনেক হৈচৈ করা হয়েছে। এই প্রকল্পটি ২০১৩ সালে সুনির্দিষ্ট উন্নয়ন লক্ষ্য নিয়ে চালু করা হয়েছিল। লক্ষ্যগুলি হল - মেয়েদের বাল্যবিবাহ কমানো, ১৮ বছরের কমবয়সী মেয়েদের স্কুলছুট হওয়া রোধ করা এবং মেয়েদের ক্ষমতায়নে অবদান রাখা। নানা সমীক্ষায় এই কথা প্রমাণিত হয়েছে যে তিনটি উদ্দেশ্যের একটিও বাস্তবায়িত হয়নি। যে উদ্দেশ্যটি সবচাইতে বেশি বিজ্ঞাপিত হয়েছিল - বাল্যবিবাহ রোধ করা বা কমানো - সেই ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের রেকর্ড দেশের অন্যান্য সব রাজ্য থেকে খারাপ। তবুও যে কোটি কোটি টাকা খরচ করে এই ত্রুটিপূর্ণ প্রকল্পটি চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তার কারণ প্রকল্পটির মধ্যে বড় পরিমাণের অনুদান দেবার ব্যবস্থা আছে। এই অনুদান কন্যার ক্ষমতায়নে সহায়ক এমন প্রমাণ বিশেষ মেলেনি, তবে তার বিয়ের খরচ মিটিয়ে পরিবারের স্বস্তি ঘটায় এমন প্রমাণ অনেক মিলেছে।

শ্রীমতী ব্যানার্জীর অভ্যাস আছে নূতন স্কিম/প্রকল্পগুলিকেই পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই নাটকীয়ভাবে ঘোষণা করার এবং তাদের বাস্তবায়ন সমস্যা বা কার্যকারিতা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা না করা। এই কারণেই ‘দুয়ারে রেশন’ প্রকল্পটি চালু করা যায়নি। ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্পটিও অর্থহীন, কারণ একমাত্র প্রশাসনের গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমেই সরকারকে দুয়ারে আনা সম্ভব। একথা সর্বজনবিদিত যে বিকেন্দ্রীকরণে মমতাদেবীর আস্থা নেই। তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণে বিশ্বাসী। এখন সরকারি আমলাদের দিয়ে মাঝেমধ্যে ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে সরকারকে মানুষের কাছে আনতে চাইছেন। এটি একটি হাস্যকর প্রচেষ্টা।

অন্যদিকে, স্বাস্থ্যসাথী, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্কিম, গভীর সমস্যায় পড়েছে এবং স্কিমটিতে বড় পরিবর্তন না আনতে পারলে শীঘ্রই প্রত্যাহার করতে হতে পারে। বেসরকারী খাতের হাসপাতাল/নার্সিং হোমগুলি সাস্থ্যসাথী কার্ডধারী রোগীদের ভর্তি করতে অস্বীকার করা শুরু করেছে বা এই জাতীয় কার্ডধারীদের ভর্তির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিয়েছে। এর কারণ হল সরকার যে হারে চিকিৎসার খরচ মেটাতে চান, তা খুবই কম এবং রোগীদের চিকিৎসা-খরচ মেটানোর জন্য হাসপাতালগুলো সরকারের কাছে যে বিল জমা দেয় তা মাসের পর মাস অনাদায়ী থাকে। প্রকল্পটি বীমা সংযুক্ত নয়। এই প্রকল্পের খরচ রাজ্যের নিজস্ব সংস্থান থেকে মেটানোর কথা। অন্যদিকে সবাইকে এই কার্ডের আওতায় আনা হচ্ছে। এতে প্রকল্পটির ব্যয় বেড়েছে অনেক বেশি। এত বেশি খরচের প্রকল্প চালানোর জন্য রাজ্য সরকারের কাছে পর্যাপ্ত সংস্থান নেই। বর্তমান আকারে প্রকল্পটি চালু করার কোনও যুক্তি ছিল না। এটি করা হয়েছিল টিএমসির ভোট ব্যাঙ্ককে সন্তুষ্ট করার জন্য এবং রাজনৈতিক ফায়দা অর্জনের লক্ষ্যে ‘আয়ুষ্মান ভারত’-এর মত কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পকে ছোট করে দেখানোর জন্য।

উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে উন্নয়ন প্রকল্প নির্বাচনের ফলে, কখনও কখনও টিএমসি সরকার এমন সব প্রকল্প চালু করেছে যা প্রকৃতি অর্থে উন্নয়নবিরোধী। রূপশ্রী এমন একটি প্রকল্প যার অধীনে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পরিবারগুলিকে তাদের প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বিয়ের সময় ২৫,০০০ টাকা অনুদান দেওয়া হয়। একটি সেকেলে এবং ক্ষতিকারক সামাজিক প্রথার চাহিদা মেটানোর জন্য নিজের সামর্থ্যর বাইরে ব্যয় করা এমনিতেই একটি নিকৃষ্ট কাজ, যা নির্মূল হওয়া উচিত। প্রাপ্তবয়স্ক কন্যাদের বিয়ে দিতে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় করার কারণে অভিভাবকদের যে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়, তা দূর করার জন্য প্রকল্প রচনা করা, আসলে হল একটি ক্ষতিকর সামাজিক প্রথা চালু রাখতে সাহায্য করা।

কিছু অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কারণে দুর্দশাগ্রস্ত নাগরিকদের সহায়তা প্রদান একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের সর্বজনস্বীকৃত নীতি। কিন্তু কোনও বিপর্যয়ের শিকার নন এমন কোনও ব্যক্তির কাছে নগদ হস্তান্তরের ব্যবস্থা এবং তা সর্বজনীন করা জনসাধারণের অর্থের অপচয়ের সমান। প্রলুব্ধকারী ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্প এই শ্রেণির অন্তর্গত। আনুমানিক বছরে প্রায় ১৪,০০০ কোটি টাকা খরচ হবে শুধুমাত্র এই প্রকল্পটির জন্য। সরকার যদি প্রকল্পটি বাস্তবায়নে জোর দেয়, তবে বিভিন্ন উন্নয়ন দপ্তরের অনেক পরিকল্পিত এবং রুটিন কার্যক্রমের তহবিলে টান পরবে।

শ্রীমতী ব্যানার্জির উন্নয়ন খুবই ব্যায়বহুল। তাঁর কম বেশি ৭০টি প্রকল্পের খরচ আছে। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারের নানা প্রকল্প (যেগুলি অনেক ক্ষেত্রে মমতাদেবী ভিন্ন নামে চালান), যাতে রাজ্য সরকারকে একটা অনুদান দিতে হয়। তাছাড়া, শুধু উন্নয়ন খাতেই নয়, রাজস্ব খাতেও (প্রশাসন, বিজ্ঞাপন, মামলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে) খরচ বেড়েছে বিপুল পরিমাণে। পূর্ববর্তী কোনও সরকার এত খরচের ভার বহন করতে সক্ষম হয়নি। তাহলে তৃণমূল সরকারের পক্ষে এত অর্থের জোগান দেওয়া কীভাবে সম্ভব হচ্ছে? এই বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের ছিটেফোঁটা আলোচনাও নজরে পড়ে না। অথচ বলা প্রয়োজন যে, অর্থ সংগ্রহ করার জন্য রাজ্য সরকার এমন পদ্ধতি অবলম্বন করছে যা আকাঙ্ক্ষিত নয়, কারণ তা একদিকে আর্থিক বিশৃঙ্খলার জন্ম দিয়েছে, অন্যদিকে এমন কাজ করতে রাজ্য সরকারকে বাধ্য করছে যা শ্রমিকের স্বার্থ-বিরোধী এবং সুশাসন ও উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকারী। কি মূল্য দিয়ে মমতা দেবীর উন্নয়ন, প্রশাসন এবং প্রচার কর্মকাণ্ডের ব্যয় সামলাতে হচ্ছে, সংক্ষেপে তা পরখ করে দেখা যেতে পারে।

টিএমসি সরকারের সম্পদের যোগান

ঋণঃ

রাজ্য সরকারের সম্পদের অন্যতম প্রধান উৎস হল ঋণ। আর্থিক বাজার থেকে এই ঋণ সংগ্রহ করতে হয়। গত ১০ বছরে ঋণের পরিমাণ বিপজ্জনক ভাবে বেড়েছে। রাজ্যের বকেয়া ঋণের পরিমাণ ২০১১-১২ সালে ছিল ১.৮৭ লক্ষ কোটি টাকা। ২০২১-২২ সালে তা হবে ৫.৩৫ লক্ষ কোটি টাকা। বোঝাই যায় যে ঋণের পরিমাণ মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এর অর্থ হল প্রতি বছর যে পুরনো ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হয় তার পরিমাণও বছর বছর বেড়ে যাচ্ছে। রাজ্যের রাজস্ব আদায় থেকে এই দায় মেটাতে হয়। ঋণ পরিশোধের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের পরিমান যদি বাড়তে থাকে, তবে রাজস্বও বাড়াতে হবে। রাজস্ব বাড়াতে হলে শিল্প-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে হবে। যেহেতু সংগঠিত ক্ষেত্রে শিল্প-বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে না, তাই এইভাবে ঋণের বোঝা বাড়তে থাকলে ‘ঋণের ফাঁদে’ জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও প্রবল হয়ে উঠবে।

বেতন কাটা

এটা আশ্চর্যজনক, কিন্তু সত্য যে টিএমসি আমলে সরকারি চাকরির নৈমিত্তিককরণ ব্যাপকভাবে ঘটেছে। যেহেতু ঠিকা কর্মচারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিয়মিত কর্মচারীদের বিকল্প হিসাবে নিযুক্ত হচ্ছে, তাই সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় ঘটছে। কারণ ঐ কর্মচারীদের অন্যান্য কোন ভাতা বা সুবিধা যেমন পেনশন, গ্র্যাচুইটি ইত্যাদি ছাড়া একত্রিত বেতন হিসাবে সামান্য পরিমাণ অর্থ দেওয়া হয়।

মহার্ঘ ভাতা লোপ

অন্যদিকে, এই সরকার কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা প্রদানও বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু বন্ধই করেনি, আদালতে সরকার বলেছে যে, মহার্ঘ ভাতা দেওয়া সরকারের ইচ্ছাধীন। এটা কর্মচারীদের অধিকার নয়। আদালত এটা মেনে নেয়নি, সরকারকে ভাতা দিতে বলেছে। এরপরেও সরকার ভাতা দেয়নি এবং নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে।

সরকারি কাজের পদ বিলোপ করা

আনুমানিক পাঁচ লাখের বেশি পদ বাতিল করেছে এই সরকার। অগুনতি ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড মাস্টার, শিক্ষক, পুলিশ কনস্টেবল ইত্যাদির নিয়মিত পদে নিয়োগ বন্ধ। এইভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দক্ষ পরিষেবা প্রদানের ব্যবস্থাকে বিসর্জন দিয়ে এই খাতের বরাদ্দ অর্থ রাজ্যের কোষাগারে যায় এবং তারপরে শ্রীমতী ব্যানার্জীর পছন্দসই প্রকল্পের খাতে অথবা অন্য কোনও খাতে তা ব্যয় করা হয়।

চালু প্রকল্প থেকে সঞ্চয়

টিএমসি আমলে, উন্নয়নের নামে নানা নতুন প্রকল্প চালু হয়েছে এবং এই কথা ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছে। জনগণের কাছ থেকে যে তথ্য লুকিয়ে রাখা হয়েছে তা হল চালু থাকা অনেক উন্নয়ন ও কল্যাণমূলক প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ হয় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, না হয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এইভাবে যে সম্পদ সঞ্চিত হয়েছে স্পষ্টতই তা শ্রীমতী ব্যানার্জির মনোমতো প্রকল্পের খরচ মেটাতে ব্যবহৃত হয়েছে।

সম্পদ বিক্রয়

কেন্দ্রীয় সরকারের মতো টিএমসি সরকারও মেট্রো ডেয়ারির মতো লাভজনক পাবলিক সেক্টর কোম্পানি বিক্রি করেছে। এছাড়া সরকারি জমি বিক্রি করে তহবিল সংগ্রহ করা হচ্ছে।

অ্যালকোহল সেবনে উৎসাহিত করা

সাম্প্রতিক কালে, টিএমসি সরকার আবগারি কর থেকে রাজস্ব বাড়ানোর জন্য অ্যালকোহল - দেশী মদ এবং বিদেশী মদ উভয়ই - বিক্রয়কে নানাভাবে উৎসাহিত করছে। এ বিষয়ে তারা সফলও হয়েছে। উভয় ধরনের মদের বিক্রি কয়েকগুণ বেড়েছে সঙ্গে রাজস্ব আদায়ও। মদ্যপানে উৎসাহিত করা সরকারের একটি অনৈতিক কাজ। দায়িত্বশীল মদ্যপান সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা এবং মদ্যপানজনিত কারণে যেসব অপরাধ (যেমন গার্হস্থ্য হিংসা) ঘটে তা বন্ধ করাও সরকারের কর্তব্য।


উপসংহারের পরিবর্তে

পরিশেষে বলা প্রয়োজন যে তৃণমূলের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক - সরকারের বিভিন্ন স্তরে সীমাহীন দুর্নীতির শিকর গেড়ে বসার কাহিনি - অনুক্ত রয়ে গেল। এ ছাড়া বর্তমান প্রবন্ধে যা বলা হল তা বিষয়টির উপক্রমণিকা মাত্র। এই রাজ্যে উন্নয়নের মুখোশের অন্তরালে যে তুঘলকি রাজত্ব এবং দুর্নীতি চলছে, তথ্যাভিত্তিক ও বিশ্লেষণাত্মক আলোচনার ভিত্তিতে তার স্বরূপ উন্মোচনের দায়িত্ব সমাজবিজ্ঞানীদের। এই কাজে তাঁদের অনুৎসাহ আমাদের বিস্মিত করে।