আরেক রকম ● দশম বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২২ ● ১৬-৩০ ফাল্গুন, ১৪২৮

প্রবন্ধ

ফিরে দেখাঃ শতবর্ষ পেরিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ

সৃজা মণ্ডল


নৃবিজ্ঞান শুধু মানুষের আদি অস্তিত্বের নিদর্শন নয়, শুধু পাথরের হাতিয়ার, মৃৎপাত্র কিংবা ফসিল হয়ে যাওয়া হাড়গোড় নয়, মানুষের চলমান জীবনযাত্রার প্রাণবন্ত ছবি নৃবিজ্ঞান। আমরা মনে করতে পারি রবীন্দ্রনাথের মানস গঠনের একেবারের শুরুর কথাটি। ‘Back to future’ নয়, ‘Ahead to past’. অর্থাৎ, অতীতকে অস্বীকার করে নয়, অতীতেই নিহিত আমাদের অগ্রসরের পথ। এই সূত্রে আমাদের ফিরে তাকাতে হয় ১৯২১ সালে। প্রতিষ্ঠিত হল ভারত তথা এশিয়ার প্রথম নৃবিজ্ঞান বিভাগ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ প্রসঙ্গে আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে সেইসব অসামান্য অধ্যাপক ও কৃতি ছাত্রদের যাদের নিরলস পরিশ্রম ও অধ্যাবসায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে গেছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইউরোপ ও আমেরিকায় মানবজাতির সামগ্রিক গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নৃবিজ্ঞান চর্চার সূচনা হয়। ‘প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি’র পাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে ১৯১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান শিক্ষার শুরু। তখন উপাচার্য দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী এবং ল্যান্সেলট স্যান্ডারসন। ১৯২০ সালে উপাচার্য হন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, তাঁরই উদ্যোগে ঐ বছরেই স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নের জন্য নৃবিজ্ঞান একটি স্বায়ত্তশাসিত বিষয়ের মর্যাদা পায়। ১৯২১ সালে স্বাধীনভাবে গড়ে ওঠে নৃবিজ্ঞান বিভাগ। বিভাগীয় প্রধান দেওয়ান বাহাদুর এল. কে. অনন্তকৃষ্ণ আইয়ার।

পৃথিবীর নৃতাত্ত্বিক জগতে পরিচিত এক ব্যক্তিত্ত্ব ছিলেন পঞ্চানন মিত্র। ‘ভারতের প্রাগৈতিহাসিক শিল্প ও কারিগরি’ বিষয়ে গবেষণাসন্দর্ভ জমা দিয়ে ‘প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ’ বৃত্তি অর্জন করেছিলেন। তাঁর এই গবেষণাসন্দর্ভের প্রসিদ্ধি তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯১৯ সালে ‘প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ বিভাগের অধ্যাপক পদে আমন্ত্রণ জানায়। পঞ্চানন মিত্র নৃতত্ত্ববিদ্যা পড়ানোর দায়িত্ব তুলে নেন। এল. কে. অনন্তকৃষ্ণ আইয়ার অবসর গ্রহণের পর ১৯৩২ সাল থেকে পঞ্চানন মিত্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ববিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ‘কারেন্ট সায়েন্স’ পত্রিকায় ১৯৩৬ সালের অগাস্ট সংখ্যায় ‘অ্যানথ্রোপলজিকাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়া’র প্রথম অধিকর্তা প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানী বিরজা শঙ্কর গুহ লিখেছেন, ‘স্যার আশুতোষের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্ববিদ্যা বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বালিগঞ্জ বিজ্ঞান কলেজে বড় পরিসরে যখন বিভাগটি তৈরি হয়, পঞ্চানন মিত্র মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন’।

সেই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ বিভাগে প্রভাষক (লেকচারার) হিসেবে যোগ দেন রমাপ্রসাদ চন্দ। অনন্তকৃষ্ণ আইয়ার-এর আগে ১৯২০-২১ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্ব বিভাগীয় প্রধান ছিলেন রমাপ্রসাদ চন্দ। ১৯৩৪ সালে নৃতাত্ত্বিক বিশ্ব সম্মেলনে তিনি ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। বক্তৃতার বিষয় ‘Indo-Aryan Races’।

দেশের প্রথম নৃবিজ্ঞান বিভাগের সূচনাকালীন সময়ের অন্যতম প্রধান অধ্যাপক শরৎচন্দ্র মিত্র ১৯২০ সালে নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কর্মজীবন মাত্র পাঁচ বছরের - ১৯২০ থেকে ১৯২৫। শরৎচন্দ্র মিত্র আচার, প্রথা, সংস্কার, ধর্ম, এমনকি লোককথা, ছড়া, ধাঁধা ইত্যাদি মৌখিক ঐতিহ্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করতেন। নৃবিজ্ঞানের লোকসাংস্কৃতিক ধারার মধ্যে দিয়ে দেশীয় ঐতিহ্যের অন্বেষণ ভারতীয় নৃবিজ্ঞানের উপাদানগত ভিতটিকে দৃঢ় করেছিল।

ইউরোপিয় নৃবিজ্ঞান চর্চার বিপরীত প্রান্তে, ভারতীয় নৃতাত্ত্বিকরা তত্ত্ব নির্মাণের চেয়ে ক্ষেত্র থেকে তথ্য সংগ্রহকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে মনে করতে হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের ছাত্রদের ক্ষেত্রসমীক্ষার কথা। সাল ১৯২৩। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের ছাত্রদের নিয়ে রায় বাহাদুর শরৎচন্দ্র রায় ছোটোনাগপুরে মুণ্ডা গ্রামে ক্ষেত্রসমীক্ষায় যাচ্ছেন। সঙ্গে শিক্ষক বিখ্যাত নৃতাত্ত্বিক দেওয়ান বাহাদুর এল. কে. অনন্তকৃষ্ণ আইয়ার। ওই ছাত্রদলে ছিলেন প্রখ্যাত নৃতাত্ত্বিক ধীরেন্দ্রনাথ মজুমদার। তিনি লিখছেন, "আমরা যে গ্রামের মধ্যে দিয়েই যাই, ‘শরৎবাবু কি জয়’ এই জয়ধ্বনি শোনা যায়।" আদিবাসী জীবনচর্যার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুসন্ধানের বিষয়ে শরৎচন্দ্রের সাহচর্য ও পথনির্দেশ পরবর্তী প্রজন্মের নৃবিজ্ঞানীদের গবেষণার কাজে বিশেষ কার্যকরী হয়েছিল।

এছাড়াও ছিলেন ক্ষিতীশ প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়-এর মতো নৃতত্ত্ববিদরা। তিনি ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্বের লেকচারার হিসাবে যোগদান করেন। সাময়িক বিরতির পর ১৯৩৭ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে পুনরায় যোগদানের পর ১৯৬২ সাল পর্যন্ত প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শুধু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ছিলেন না, ভারতের স্বাধীনতার আগে এবং পরে পশ্চিমবঙ্গে নাগরিক স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য আজীবন সংগ্রামী ছিলেন। তাঁর গবেষণার কেন্দ্র ছিল সাঁওতাল, খাসি ও কোরকু উপজাতির সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবন। ১৯৪৭ সালে তৎকালীন কলকাতা কর্পোরেশনের শ্রমিক এবং ১৯৫২ সালে বাংলার পাটকল শ্রমিকদের নিয়ে তাঁর আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা আজও উল্লেখযোগ্য। তাঁর কিছু ছাত্র যারা পরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিখ্যাত হয়েছিলেন তাঁরা হলেন সুরজিৎ চন্দ্র সিনহা, বি. কে. রায়বর্মণ, রামকৃষ্ণ মুখার্জি, আন্দ্রে বেতাই এবং আরও অনেকে।

সেদিনের নৃতত্ত্ব বিভাগ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় প্রথিতযশা সমাজতত্ত্ববিদ আন্দ্রে বেতাই-এর স্মৃতিকথায়। আন্দ্রে বেতাই নৃতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন পঞ্চাশের দশকে। তিনি লিখছেন, "There were only a couple of classrooms which were used for B.Sc. classes in the morning and M.Sc. classes during the day. The practical classes were mainly for physical anthropology and prehistoric archaeology, but the study of material culture also entailed some practical work such as drawing digging sticks and fishing traps... . Students were taken for fieldwork to areas with which the teachers were familiar from past visits. In our time we were taken to Chhotanagpur which was then in the state of Bihar and now makes up the state of Jharkhand. As students of the B.Sc. class we studied the Hos of Seraikela in Singbhum district for two weeks and as M.Sc. students we spent a whole month with the Oraons near Mandar in Ranchi district. Chhotanagpur had become a favourite location for fieldwork by students and teachers in the department of anthropology in the late forties and early fifties. Earlier some batches of students had been taken for fieldwork to Manipur."

ভারতে নৃবিজ্ঞানের প্রথম প্রজন্মের ছাত্রদের গভীর অভিনিবেশে লোকজীবন পর্যবেক্ষণ করার কৃৎকৌশল হাত-ধরে শিখিয়েছিলেন আরেক অসামান্য শিক্ষক তারকচন্দ্র দাস। ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের সময়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের কিছু দক্ষ শিক্ষক এবং গবেষকদের নিয়ে তিনি একটি অনুসন্ধানী দল গঠন করেন। এই সমীক্ষক দল ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও জ্ঞান, অণু-সমীক্ষা (জিনিওলজিক্যাল) পদ্ধতি ও আখ্যান পদ্ধতি অনুসরণ করে কলকাতা তথা অবিভক্ত বাংলার জেলায় জেলায় ঘুরে এথনোগ্রাফির মাধ্যমে দুর্ভিক্ষে মৃতদের প্রকৃত সংখ্যা ও দুর্ভিক্ষের কারণ নির্ণয়ের চেষ্টা করে। রচনা করেন ‘Bengal famine (1943): As revealed in a survey of the destitutes of Calcutta’ (১৯৪৯) - বাংলার দুর্ভিক্ষ বিষয়ক একটি তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ। জওহরলাল নেহরু ‘The Discovery of India’য় তারকচন্দ্র পরিচালিত সমীক্ষাটির প্রশংসা করেন। অমর্ত্য সেনও বাংলার দুর্ভিক্ষ বিষয়ক তাঁর অমূল্য রচনায় তারকচন্দ্র দাসের এথনোগ্রাফিকে কাজে লাগিয়েছেন। তারকচন্দ্র দাস দক্ষিণ কলকাতার একটি লঙ্গরখানাও পরিচালনা করতেন দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের জন্য। বিখ্যাত নৃবিজ্ঞানী সুরজিৎ চন্দ্র সিনহাকে তিনিই প্রথম তৎকালীন বিহার রাজ্যের ভূমিজ জনজাতির ওপর গবেষণা করার পরামর্শ দেন। তারকচন্দ্র দাস-এর মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য ছাত্র সুরজিৎ চন্দ্র সিনহা লিখেছিলেন, "India lost one of her most devoted specialist on tribal ethnography and a great teacher who was ever experimenting with methods for training the students in field work during his long tenure as a teacher in the Calcutta University (1921-63)".

নৃতত্ত্ব বিভাগের অন্যতম কৃতি ছাত্র নির্মলকুমার বসু। ১৯৩৮ সালে উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে তিনি নৃতত্ত্ব বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে যোগ দিলেন। তাঁর চিন্তাভাবনা এক অসাধারণ মৌলিকত্বে জারিত। পড়াতেন প্রাগৈতিহাসিক পুরাতত্ত্ব। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রাগৈতিহাসিক পুরাতত্ত্বকে জানতে হলে যেতে হবে মাটির কাছাকাছি, মাটি খনন করে দেখতে হবে, জানতে হবে সবকিছু। সুযোগ এল ওড়িশার ময়ুরভঞ্জে খনন কাজ ও অনুসন্ধানের। ১৯৪৮ সালে নৃতত্ত্ব বিভাগের অন্যতম অধ্যাপক ধরণী সেন-এর সঙ্গে প্রকাশ করলেন ‘Excavations in Mayurbhanj’. ময়ূরভঞ্জ থেকে সংগৃহীত প্রস্তর যুগের সামগ্রী আজও সংরক্ষিত আছে নৃবিজ্ঞান বিভাগের মিউজিয়ামে। তাঁর ছাত্ররা পরবর্তীকালে লিখেছেন, ‘নির্মলকুমার বসু আমাদের শিখিয়েছিলেন সবকিছু হাতে কলমে। কিভাবে প্রত্নসামগ্রী চিনতে হয়, জানতে হয়, যাচাই করতে হয়, যত্নে সংগ্রহ করতে হয়, সংরক্ষণ করতে হয়’। প্রাগৈতিহাসিক পুরাতত্ত্বে অমূল্য অবদানের জন্য আমাদের মনে রাখতেই হবে প্রফেসর অশোক ঘোষ, মণিব্রত ভট্টাচার্য ও রঞ্জনা রায়-কে।

নির্মলকুমার বসু প্রায়ই পশ্চিমবঙ্গের অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার আদিবাসীদের জীবন ও সংস্কৃতি অধ্যয়নের জন্য গবেষকদের পাঠাতেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রবোধ কুমার ভৌমিক। নির্মলকুমার বসুর অধীনে প্রথম বৃত্তিপ্রাপ্ত পিএইচ.ডি. গবেষক হিসাবে কাজ করবার সুযোগ ঘটেছিল তাঁর। একদা অপরাধপ্রবণ জনজাতি হিসাবে পরিচিত লোধা জনজাতির সমস্যা বিষয়ে গবেষণার জন্য অধ্যাপক বসু তাঁকে তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। অধ্যাপক বসু গবেষককে নিয়ে মূল ক্ষেত্রে যেতেন, সেখানেই তাঁকে সমস্যা সরসভাবে বুঝিয়ে দিয়ে কি করতে হবে নির্দেশ দিতেন। প্রবোধ কুমার ভৌমিক লিখছেন, ‘তিনি (নির্মলকুমার বসু) উৎসাহ দিয়ে বলতেন, শুধু কেতাবি ডিগ্রি লাভের জন্য কাজ করা নয়, পরামর্শ দিতেন অসহায় পদদলিত মানুষগুলোর কল্যাণের জন্য কিছু কাজ করতে, কাজের ও আত্মবিশ্বাসের মধ্য দিয়ে তারা যাতে বর্তমান মধ্যবিত্ত জীবনযাত্রার সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারে। তিনি অবশ্যই চাইতেন যে সরকারী অনুদান ছাড়াই, কিছু স্বনির্ভর প্রক্রিয়ায় মানবিক ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে উন্নত প্রযুক্তি ও জ্ঞানের যথার্থ প্রয়োগের মাধ্যমে ঐসব গোষ্ঠীগুলির উন্নতি সাধন করতে’। নির্মলকুমার বসু-র অনুপ্রেরণায় প্রবোধ কুমার ভৌমিক সেই এলাকার লোধাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি এবং শিক্ষাগত অগ্রগতির জন্য ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন আশ্রম তথা গবেষণা কেন্দ্র ‘বিদিশা’, যার মূল লক্ষ্য ছিল লোধা উপজাতির পুনর্বাসন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগে ১৯৬২ সালে তিনি লেকচারার পদে যোগদান করেন। রইলেন প্রায় চল্লিশটা বছর।

উত্তর-পূর্ব ভারতের খাসি জনজাতির কথা তুলে ধরলেন নৃবিজ্ঞান বিভাগের আরেক শিক্ষক তারক চন্দ্র রায়চৌধুরী, গারো ও কুকি সম্প্রদায়ের ওপর আলোচনা করলেন জ্যোৎস্নাকান্ত বোস। শ্যামলকান্তি সেনগুপ্ত তাঁর প্রথম মনোগ্রাফ ‘The Portrait of Mahali Economy in Midnapur’-এ তুলে ধরলেন মেদিনীপুরের মাহালি উপজাতির সেইসব শ্রমিকদের অর্থনৈতিক অবস্থা যারা বাঁশের বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে - মধ্য ভারতের উপজাতীয় অঞ্চলে বসবাসকারী কারিগর সম্প্রদায়ের ওপর লেখা একটি অন্যতম প্রথম মনোগ্রাফ। এছাড়াও এই সঙ্গে উঠে এল কৃষি শ্রমিকদের অর্থনীতির ছবি। তিনি তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘The Social Profiles of the Mahalis’-এ নৃতাত্ত্বিক বিবরণের আলোকে বর্ণনা করলেন মাহালিদের সামাজিক সংগঠন এবং তাদের উপর হিন্দু জীবনধারার প্রভাব।

মনে করতে হয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের প্রথিতযশা অধ্যাপক শশাঙ্কশেখর সরকারকে। কলকাতা পুলিশের সেই বিখ্যাত কমলা মার্ডার কেস - কেবলমাত্র পায়ের পাতাটুকু পাওয়া গিয়েছিল। খুনিকে শনাক্ত করা সম্ভবপর হয়েছিল শশাঙ্কশেখরের সাহচর্যে। এছাড়াও ছিলেন অনন্তনাথ চ্যাটার্জি - শারীরিক নৃবিজ্ঞানের প্রভাষক। তিনি শিক্ষার্থীদের শারীরিক পর্যবেক্ষণ এবং পরিমাপের প্রশিক্ষণ দেন। তিনি দেখেছিলেন বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের একই জাতিগোষ্ঠীর ছাত্রদের মধ্যেও শারীরিক পরিমাপের পার্থক্য রয়েছে। এছাড়াও জৈবিক নৃবিজ্ঞানে তুলিকা সেন, দেবপ্রসাদ মুখার্জি, অমূল্য রতন ব্যানার্জি, অসিত বরণ দাস চৌধুরীর অবদান অনস্বীকার্য।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান চর্চার প্রথম দিকে শুধুমাত্র মানবশরীরের গঠন এবং বিপাকীয় ব্যাধিগুলির উপর গবেষণাকে প্রথম সারির গবেষণার ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচনা করা হত। এখন জৈবিক নৃবিজ্ঞানে বাহ্যিক দৈহিক বৈশিষ্টের চেয়ে মানবজাতির অন্তর্নিহিত জেনেটিক বৈচিত্র্য অধ্যয়নের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়। বর্তমানে নৃবিজ্ঞানের বিবিধ গবেষণা প্রমাণ করেছে যে মানব জীববিজ্ঞান অধ্যয়ন করার অর্থ শুধুমাত্র কিছু শারীরিক বৈশিষ্ট্য পরিমাপ করা নয়, বরং মানব জীববিজ্ঞানকে প্রভাবিত করে এমন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণগুলি শনাক্ত করাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

সমকালীন নৃবিজ্ঞানীরা শুধু আদি জনজাতির গবেষণায় নিজেদের সীমিত রাখেননি। তাঁদের গবেষণার ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে কৃষক অধ্যুষিত কোনো গ্রাম, শহরের মধ্যবিত্ত-অধ্যুষিত এলাকা অথবা বানিজ্যিক কেন্দ্র বা শিল্পাঞ্চল। এগুলো হল বাহ্যিক পরিসরে নৃবিজ্ঞানীদের বিচরণের নতুন নতুন ক্ষেত্র। তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে কেউ নিজেকে চিহ্নিত করতে পারেন নারীবাদী, পরিবেশবাদী বা উত্তর আধুনিকতাবাদী হিসাবে।

শতবর্ষীয় এই নৃতত্ত্ব বিভাগের ইতিহাস এত স্বল্প ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। তবে বলতে দ্বিধা নেই, গত ১০০ বছরে দেশজুড়ে নৃবিজ্ঞানের প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ। জনজীবনকে এবং জনজীবন চর্চার মাধ্যমে সামগ্রিক নৃবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে এই নৃবিজ্ঞান বিভাগ, শ্রদ্ধা অর্জন করেছে সারা বিশ্বের। প্রথাগতভাবে নৃবিজ্ঞান পঠনপাঠনের একশো বছরে অনেক বিশিষ্ট নৃবিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে এশিয়ার প্রাচীনতম এই নৃতত্ত্ব বিভাগ দেশকে, আমাদের স্থির বিশ্বাস, আরও সমৃদ্ধ করবে। জ্ঞানের চর্চা হবে, জ্ঞান আহরণ হবে, গবেষণাও চলবে। তবে এসব কিছুর একটাই লক্ষ্য মানুষের কল্যাণ ও মানবতার সম্মান।


সংযোগঃ
সৃজা মণ্ডল

ঠিকানাঃ
১২, ওলাবিবিতলা লেন,
দ্বিতীয় তল, ফ্ল্যাট নং-২০১,
শিবপুর, হাওড়া-৭১১১০২
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

মোবাইল নং -
+৯১ ৯৪৩২৪৯৮৯৮৮