আরেক রকম ● দশম বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২২ ● ১৬-৩০ ফাল্গুন, ১৪২৮
প্রবন্ধ
প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কবিতা
প্রবালকুমার বসু
হয়তো প্রতিটি দেশই ভারতবর্ষের সঙ্গে একই সীমান্ত ভাগ করে নেয় না, যেমন আফগানিস্তান, কিন্তু ১৯৪৭-এর আগে সব কটি দেশই অখণ্ড ভারতবর্ষের আক্ষরিক প্রতিবেশী ছিল। সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক ঐতিহ্যের পরিপ্রেক্ষিতে এবং ভাবগত জায়গায়। প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাছতে গিয়ে আমার নির্বাচন তাই আফগানিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, পাকিস্তান আর বাংলাদেশ। রাজনৈতিক আর ভৌগোলিক ভাবে এরা সকলেই দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্তর্গত। আপাতত আফগানিস্তান, নেপাল শ্রীলঙ্কার কবিতা প্রসঙ্গে দু'-চার কথা।
যে কোনো দেশের সাহিত্যই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেই দেশের রাজনৈতিক সামাজিক অবস্থানের প্রতিচ্ছবি। দিনের প্রথম আলো যে দেশে প্রত্যাশা বা সম্ভাবনার পরিবর্তে নিয়ে আসে এক ধরনের আশঙ্কা বা সন্ত্রাসের ভয়, প্রিয় বা পরিচিত জনদের হত্যা দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠে যে দেশের শিশু, যাদের জীবনে প্রেম ভালোবাসার কোনো পরিসর আসে না, যাদের যাপনচিত্রে শুধুই দমন আর ঝরা ফুলের বিষণ্নতা, ধূসরতা আর রক্ত যাদের জীবনের একমাত্র রঙ তাদের কবিতা নিশ্চিতভাবেই সেই বীভৎসতাই বহন করে চলে, যা এই উপমহাদেশের বাংলা ভাষায় যাঁরা কবিতা লেখেন তাঁদের চেয়ে আলাদা।
শুধুই কি তাই? একই বাংলা ভাষায় লেখা দুই দেশের কবিদের কবিতার ভাষা, কাব্যদর্শন, উপস্থাপনা কি স্বতন্ত্র নয়? তার কারণই তো রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত।
আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক টানাপোড়েন যতই থাক আপাতভাবে আমাদের সামাজিক জীবনে তেমন কোনো আলোড়ন আসেনি নকশালবাড়ি আন্দোলনের পর। তাই আমাদের কবিতা রুক্ষতাহীন, কোমলতা বড় বেশি। সাহিত্যে আমাদের প্রতিবাদও নমনীয়। তাই আমাদের এখানে কোনো কবি লিখতে পারেন ‘প্রতিবাদ মানে হলুদ শস্য, রামধনু রঙ’ অথবা ‘কতদিন হল ভুলে গিয়েছি চুম্বনের স্বাদ, ঠোঁট প্রায় শাদা, লোকে কাশ্মীর বলে’। কাছাকাছি সময়ে বাংলাদেশে লেখা হচ্ছে - ‘রক্তে ফোটে শুদ্ধ আগুন টগবগিয়ে/ হিমেল হাওয়ার বধ্যভূমি কে খুঁড়েছে/ মাটির তলের লাশের পাহাড় জ্যান্ত হয়ে/ ধেয়ে আসে মুন্ডুবিহীন লোকালয়ে’ (রবিউল হুসাইনের কবিতা), আমরা আফগানিস্তানের এম. আফসর রহবিনের কবিতায় পাচ্ছি - ‘কালো মেঘেদের বলো/ এই দ্বীপে ঝরে না পড়তে/ আমি চাই সমুদ্র শুকিয়ে যাক/ যাতে আমি খুঁজে নিতে পারি আমার হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের’। সমস্ত চাওয়া আকাঙ্খার মধ্যে কোথায় যেন লুকিয়ে আছে বীভৎসতার হাহাকার। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হোক সমসময়ের রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রভাব একজন কবি বা শিল্পী কেউই এড়িয়ে যেতে পারেন না। কোনো সৃষ্টিই আসলে সমসময়ের বাইরে তো নয়।
।। এক ।।
আমরা অধিকাংশই আফগানিস্তানকে চিনেছি রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ দিয়ে। আমাদের যাঁদের জন্ম গত শতকের পাঁচের বা ছয়ের দশকে অথবা তারও আগে আমাদের স্মৃতিতে রয়েছে বাড়ির সামনে দিয়ে চলে যাওয়া দু-একজন কাবুলিওয়ালা মূলত যাদের ব্যবসা ছিল হিং, আতর আর কাজু অথবা আখরোটের মতন শুকনো ফলের। কারো কারো অবশ্য সুদের কারবারও ছিল। আমরা শুধু জানতাম সুদূর কাবুল থেকে আসে বলে এরা কাবুলিওয়ালা।
এই কাবুলও তো সুন্দর ছিল একসময়। পশ্চিমী প্রভাবে বেড়ে ওঠা অনেকটাই সংস্কার মুক্ত। প্রাচুর্য হয়তো ছিল না, কিন্তু আনন্দ ছিল। আর পাঁচটা স্বাভাবিক দেশের মতনই তাদের কবিতার বিষয় ছিল প্রেম প্রকৃতি আর দৈনন্দিন জীবন। ১৯৭৯ সালে রাশিয়ার আগমনে পাল্টে যায় এদের যাপনের ভারসাম্য। শুরু হয় রাশিয়ার এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কবিতা লেখা। অর্থাৎ কবিতায় অনুপ্রবেশ ঘটে রাজনীতির। আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এই কবিতা প্রায় আন্দোলনের চেহারা নেয়, শুরু হয় প্রতিবাদ আর তার সঙ্গে দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলা। এই সময়ই কবিতায় আসতে থাকে যুদ্ধের নানান শব্দ যেমন বন্দুক, গুলি, বোমা, ধ্বংস, হত্যা এই সমস্ত।
সমস্ত শিল্প সাহিত্যই তো একটা প্রতিবাদ। আর যারা প্রতিবাদ করে আগ্রাসন শক্তি তাদের উপরেই নেমে আসে প্রথম। রাষ্ট্রের অন্যতম সহজ হাতিয়ার হল গ্রেফতার, প্রতিবাদী হলেই গ্রেফতার কর। আফগানিস্তানের প্রায় সকল কবিই তাই কোনো কোনো সময় কারাগারে কাটিয়েছেন। সেই অভিজ্ঞতাই প্রাধান্য পেয়েছে হাল আমলের আফগানিস্তানের কবিতায়। প্রেম আর যুদ্ধ পাশাপাশি থেকে গিয়েছে সহোদর-সহোদরার মতন।
আফগানিস্তানে সরকারি ভাষা দুটো। পারসিয়ান (দারি) আর পশতু। এছাড়া সরকারিভাবে স্বীকৃত নয় এমন কিছু ভাষাও রয়েছে। তবে পারসিয়ান ভাষার বিস্তার সবেচেয়ে বেশি, সাহিত্যচর্চাও এই ভাষাকেই সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আফগান কবিতায় মেয়েদের উপস্থিতি। মেয়েদের ছাড়া আফগানিস্তানের কবিতা অসম্পূর্ণই বলা চলে।
আফগানিস্তানের দু'-একটি কবিতা পড়ে নেওয়া যাক।
অক্ষমতা
নুরুল হাবিব নিসার
-----------------------------------
এক সুন্দর বিকেলবেলায়
যখন সমুদ্রের ওপারের পাহাড় জড়িয়ে নিচ্ছে আমাদের
তখন আখরোটগাছের তলায়
তুমি একটা গল্প বলছিলে
চাপা কান্নার সঙ্গে সঙ্গে
চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিল তোমার মুখ বেয়ে
আমি শুধু স্তব্ধ হয়ে দেখছিলাম এই বেদনাদায়ক দৃশ্য
আর কিছুতেই আমার জামা দিয়ে মুছে দিতে পারছিলাম না তোমার অশ্রু
ফেরা
নুরুল হাবিব নিসার
-----------------------------------
আমি দেখতে পাচ্ছি ওদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আশাগুলোকে
এটা নিশ্চয়ই প্রজাপতিদের কম্পন
যাতে আবার সেই নিভে যাওয়া প্রদীপ জ্বলে উঠছে
(অনুবাদঃ তৃণা চক্রবর্তী)
[নুরুল হাবিব নিসার। আফগানিস্তানের বিশিষ্ট কবি, সাংবাদিক, নির্দেশক, সম্পাদক ও অনুবাদক রচনা করেছেন পনেরোটি গ্রন্থ।]
প্রেমের কবিতা
আব্দুল মান্নান
-----------------------------------
যখন হাওয়া
গেয়ে ওঠে তোমার চুলে
সমস্ত পাখি তোমারই প্রেমে
যখন শীত আসে
বাড়িয়ে দিও তোমার হাত
যখন বেঁধে নেবে তোমার চুল
খেয়াল রেখো
সহস্র চাঁদ মরে যেতে পারে
যখন হাওয়া
গেয়ে ওঠে তোমার চোখে
কবিদের বলো
তোমার অসামান্য শব্দ লিখে নিতে
যখন হাওয়া
গেয়ে ওঠে তোমার জন্য
তোমার কররেখায়
পড়ে নিতে দাও আমার আগামী
(অনুবাদঃ তৃণা চক্রবর্তী)
[আবদুল মান্নান। তরুণ আফগান কবি। পেশা শিক্ষকতা ও রেডিও আফগান-এ কর্মরত। দারি, পশতু, আরাবিক, উজবেক, ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার জন্য সুপরিচিত।]
।। দুই ।।
হিমালয়ের কোল ঘেঁসে নেপাল। দীর্ঘদিন অবধি নেপাল শাসন করত রাজ পরিবার। কাশ্মীরের মতন নেপালকেও অনেকে ভূস্বর্গ বলত একসময়। সৌন্দর্যের মোড়কে ঘেরা নেপাল ছিল আপাতভাবে শান্ত তুষারাবৃত হিমালয়ের মতনই। সেই রাজ্যে সাহিত্যের উৎপত্তি লোকসংস্কৃতি আর লোকসাহিত্য থেকে। অন্যান্য বহু দেশের মতন কবিতাই ছিল সাহিত্যের প্রকাশ মাধ্যম। মূলত বীরগাথা বা বীরত্বের বন্দনাই হত কাব্যের অন্তর্নিহিত প্রবাহ। কিন্তু ধীরে ধীরে এই ধারা বদলে যেতে থাকে। ইংরেজদের অনুপ্রবেশের সঙ্গে কবিতাও একটা নির্দিষ্ট বাঁক নেয়। ১৮১৪ সালে ইংরেজদের সঙ্গে নেপালের যুদ্ধাবসানই সূচনা করে নতুন যুগের। নেপালের পরাজয়ের হতাশা কবিতায় নিয়ে আসে আধ্যাত্মিকতা ও ধর্মীয় অনুষঙ্গ। এই সময়ের প্রধান কবি ভানুভক্ত যিনি সংস্কৃত থেকে 'রামায়ণ' নেপালি ভাষায় অনুবাদ করেন। নেপালি কবিতায় আধুনিকতার শুরু মূলত রোমান্টিক লেখালিখি দিয়ে। আপাত নিস্তরঙ্গ নেপালের জীবনে যে সংঘাত একেবারে আসেনি তা নয়। কখনো কোনো রাজা স্বৈরাচারী হয়ে উঠলে ও আবার পরবর্তিতে অন্য কোনো রাজার দ্বারা সাম্য ও গণতান্ত্রিক শাসন প্রবর্তিত হলে তার প্রভাব অবশ্যই সাহিত্যে এসেছে।
১৯৫১ সালে শতাধিক বছরের রাণা রাজত্বের অবসান হয়, নেপালে গণতন্ত্রের শুরু সেই থেকে। সময়ের ওপর থেকে যেন একটা পাথর সরিয়ে নেওয়া হল, লেখক কবিরা যেন মুক্ত চিন্তা ও তা প্রকাশের স্বাদ পেলেন। ক্ষোভ বা প্রতিরোধের কথা উঠে আসতে থাকল কবিতায়। শুধু তাই নয়, ব্যক্তিস্বপ্ন, প্রত্যাশা, হতাশা রোমান্স একে একে সবই আসতে থাকল কবিতায়। এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কবিরা ছিলেন - গোপাল প্রসাদ বিমল, লক্ষ্মী প্রসাদ দেবকোটা, বালকৃষ্ণ সামা, কেদারমান ভিয়াতিট-রা। কিন্তু লেখকদের স্বাধীনতা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৬১ সালে নেপালের রাজা মহেন্দ্র'র কারসাজিতে স্বৈরতন্ত্র পুনরায় স্থাপিত হলে পঞ্চায়েতি রাজ শুরু হয়। রাজা মহেন্দ্রর পছন্দের লোকদের এই শাসনভার দেওয়া হলে আগের দশ বছরের গণতান্ত্রিক পরিবেশকে সম্পূর্ণভাবে সীমায়িত করে স্বাধীন চিন্তা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতার ইতি ঘটায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই সাহিত্যে ও কবিতায় এর প্রতিফলন ঘটে কিন্তু তা ঘটে আস্তরণের আড়ালে যাতে শাসকরা প্রকৃত অর্থ উদ্ধার করতে না পারে। এইরকম অবস্থায় স্বাভাবিক নিয়মে নেপালি কবিতা থেকে রোম্যান্স আর রোমান্টিসিজম দুই-ই সরে যেতে থাকে। রূপকের আশ্রয় নিতে গিয়ে কবিতা হয়ে ওঠে বহুমুখীন। এই বহুমুখীনতা নিয়ে আসে কবিতায় নানারকম নিরীক্ষার অবকাশ। এই নিরীক্ষাগুলোই এক একটি সাহিত্যের আন্দোলনের আকার নেয়। থার্ড ডাইমেনশন আন্দোলন, রালফা আন্দোলন এই সময়েরই প্রতিফলন। মদন রেগমি, মোহন কৈরালা, দ্বারিকা শ্রেষ্ঠা, রত্না শামসের থাপা, ঈশ্বর বল্লভ এই সময়কার উল্লেখযোগ্য কবি।
আমরা সমসাময়িক কবিতা কাকে বলব? সমসাময়িক নেপালি কবিতার শুরুই বা কোন সময় থেকে? এই যে প্রকৃতির কোলে শায়িত আপাত শান্ত যে দেশ, যে প্রকৃতির সৌন্দর্যের আবেশ লেগে থাকার কথা কবিতায়, সমসাময়িক নেপালি কবিতার শুরু কিন্তু সেভাবে নয়। সামাজিক, রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক চিত্র ফুটে ওঠে যে সাহিত্যে, তাই তো সমসমায়িক সাহিত্য। নেপালি সাহিত্যে এই সমসাময়িকতা শুরু গত শতকের শেষের, একদম শেষে, ছাত্র আন্দোলন থেকে। এই একই সময়ে ‘সড়ক কবিতা ক্রান্তি’ বলে আরো একটা আন্দোলন পাই, যা মূলত কবিতার আবরণ সরিয়ে কবিতাকে সরাসরি হতে বলে, আরো সহজ হতে বলে। রাজ প্রকোপ থেকে বাঁচতে যে গোপনীয়তা আর রূপকের আশ্রয় নেওয়া নেপালী কবিতায় শুরু হয়েছিল, কবিতার পাঠক তার জন্য তৈরি ছিল না, ফলে সংযোগ যাচ্ছিল হারিয়ে। এই দুই আন্দোলন পাঠককে আবার নিয়ে আসতে সচেষ্ট হল কবিতার কাছাকাছি, কবিতার ভাষা ও প্রকাশ হয়ে উঠল অনেকটাই সরাসরি, রূপকের ব্যবহার ব্যতিরেকে।
আসলে যখনই কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের উত্থান ঘটেছে, তার প্রভাব সরাসরি ভাবে এসেছে নেপালি সাহিত্যে। আশ্চর্য্য ভাবে নেপালের প্রকৃতি এর নিয়ামক হয়নি। প্রকৃতি এসেছে পরিবেশ সচেতনতার আড়ালে। আর এই রাজনৈতিক আন্দোলন নেপালি কবিতার ভুবনকে দিয়েছে বিস্তৃতিও। শিক্ষিত নেপালিরা যত নেপালের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে, নেপালি কবিতায় তত এসে মিশেছে আন্তর্জাতিকতা।
সমসাময়িক নেপালি কবিতার আরও একটা দিক উল্লেখ না করলেই নয়, সেটা হচ্ছে নারীবাদ। কীভাবে মেয়েরা নেপালি সমাজে শোষিত হয়ে এসেছে এবং শেষ পর্যন্ত পুরুষ শাসিত সমাজে সমমর্যাদা পায়নি। প্রথম দিকে কবিতায় এই প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর মৃদু আকারে দেখা দিলেও পরবর্তীতে তা বেশ জোরালো হয়ে ওঠে। দীর্ঘমেয়াদি মাওবাদী আন্দোলন ও ২০০৫-এ গণ অভ্যুত্থানের পর প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র হিসেবে নেপালের প্রতিষ্ঠা মেয়েদের লেখালিখিতেও নিয়ে আসে বলিষ্ঠতা, মেয়েদের নানান বিষয়, সামাজিক অসাম্য ইত্যাদি উঠে আসতে থাকে তাদের লেখায়। মিশ্রা বৈজয়ন্তি, কুমারি লামা, সরিতা তিওয়ারি, নিভা শা এই সময়কার বিশিষ্ট উচ্চারণ, যাঁদের লেখায় নানানভাবে বারবার এসেছে লিঙ্গ বৈষম্যের কথা। আমার মনে হয়েছে নেপালি কবিতার আধুনিকতার যাত্রা আসলে শুরু হয়েছে ২০০৫ এর পর থেকে, যা নেপালি কবিতাকে বিষয় নির্বাচন, উপমা ব্যবহারে আন্তর্জাতিক কবিতার সমতুল্য করে তোলে।
এই অবসরে নেপালের দুটি কবিতা পড়ে নেওয়া যায়।
বৃষ্টিতে, বুদ্ধ মূর্তির সামনে
সুমন পোখরেল
-----------------------------------
ভিড়
জমাট বেঁধে এগিয়ে চলেছে
রাস্তার ঠিক মাঝখান দিয়ে
উৎসবের মেজাজে তারা ভুলে গিয়েছে
অসমাপ্ত কাজ আর ফাইলগুলো
শুধু মানুষ মানুষ আর ছাতা
শুধু ছাতা ছাতা আর মানুষ
ছাতার নিচে আশ্রয় পেয়েছে মাথাগুলো
কেউ জেবুন্নিসা, কেউ ক্যাথরিন
কেউ ক্লিওপেট্রা বা ফেনিকা
নিজের নিজের গল্পের ভেতর
যদি এমন না হতো
বাগমতির জলের সঙ্গে কিছুটা মিশে যেত টেইমস্
কিছুটা নীল নদ বয়ে যেত পিখুয়া ধারায়
তাহলে কী করে বলছ, বুদ্ধর কাছে কোনও পিস্তল ছিল না
অথবা তিনি কখনো পিয়ানো বাজাননি
আমরা একথাও জানি না, যে তিনি ছবি আঁকতেন কি না
আসল কথা হচ্ছে
আমরা আঙ্গুলিমালার প্রশংসা করি
আর আম্রপালিকে সম্মান জানাই
এতে কিছু যায় আসে না
এই মুহূর্তে
আমি বীরত্বের সেই গল্পগুলো জানতে চাইছি
যা বন্যার জলের সঙ্গে ধুয়ে যাওয়াকে রুখতে চাইছে
যা কোনো অতীত ইতিহাসের মায়াকাব্যের সঙ্গে লেগে থাকা
বিমূর্ত ধারণামাত্র নয়
বন্যার জল রাস্তা বন্ধ করে দিলে
আমি শঙ্কিত হয়ে পড়ছি,
কেননা আমার মাটি ধুয়ে যাচ্ছে
অফিসে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাওয়ার তুলনায়
এই শঙ্কা অনেক বড়
এই বন্যা হয়ত পাহাড়কে ভেঙ্গে সমতলে মিশিয়ে দেবে
এরকম একটা ভয়
আমাকে ক্রমাগত চেপে ধরছে
(অনুবাদঃ তৃণা চক্রবর্তী)
জীবনের সৌন্দর্য
ভীষ্ম উপ্রেতি
-----------------------------------
আমাদের একটা ছবি তুলে দেবেন, প্লিজ?
ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, প্রত্যাশায় ঝলমল করছে মুখ
ওরা বলল আমাকে
ওদের কণ্ঠস্বরে উজ্জ্বল প্রত্যাশার বিচ্ছুরণ
আমি ওদের এক লাইনে দাঁড়াতে বলে
ছবি তুলে দিলাম
তারপর ছবির দিকে দেখি
আর একবার ওদের দিকে
কিন্তু ছবিতে কী যেন নেই
ওদের চোখের উজ্জ্বলতা নেই ঠিকমত
ওদের হাসি, হাসির সেই রঙ নেই
ওদের মনের কথাগুলো নেই
নেই সেই বিশুদ্ধ উষ্ণতা
ছবিতে শুধুমাত্র কয়েকটা অবয়ব আছে
শুধুমাত্র একটা ছবি
আমি ছবিটা তুলতে পেরেছিলাম ঠিকই
কিন্তু সেই উৎসারিত সৌন্দর্যকে
ধরতে পারি নি একটুও
(অনুবাদঃ তৃণা চক্রবর্তী)
।। তিন ।।
ঐতিহাসিকভাবে বৌদ্ধ ধর্ম প্রতিষ্ঠার সময় থেকে শ্রীলঙ্কায় কবিতা আর শিল্পের শুরু। সামাজিক গঠনে বা পরিবর্তনে অনেকটাই ভূমিকা নিয়েছে শিল্প ও কাব্যচর্চা। সমসময়ের শ্রীলঙ্কার কবিতা মূলত লেখা হয় তিনটে ভাষায়। সিংহলী, ইংরেজি আর তামিল।
শ্রীলঙ্কার গদ্য আর কাব্যচর্চার ইতিহাস প্রায় এক হাজার বছরের। প্রাচীন যে লিপি সংরক্ষণ করা গেছে তা সম্রাট পরাক্রম বালুর (১১৫৩-১১৮৬ খ্রী) সময়ের। এই সময়েই শ্রীলঙ্কায় পাঠাগার (লাইব্রেরি) স্থাপনের সংবাদ পাওয়া যায়। যদিও এই সময়ের লিখিত বিষয় বেশিরভাগই ছিল বিজ্ঞান, সামাজিক, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় সংক্রান্ত, নানান আদান প্রদান বা সমঝোতা পত্র। কিছু গদ্যে লিখিত হলেও অধিকাংশই তখন লেখা হত পদ্য ছন্দে।
শ্রীলঙ্কার সাহিত্য, কবিতায় আধুনিকতার শুরু গত শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে। এই সময় ‘কলম্বো পোয়েট’ বলে অপেক্ষাকৃত তরুণদের এক গোষ্ঠি উঠে আসে মূলত সিংহলি সাহিত্যের ঐতিহ্যকে অস্বীকারের মধ্যে দিয়ে। কবিতার ভাষায় বদল ঘটাতে এরা নিয়ে আসে সাংবাদিকতার ভাষা, পশ্চিমি গদ্য সাহিত্যের সিংহলি যা চলন কাব্যিক ঐতিহ্যের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ফলত খুব হৈ হৈ করে হাজির হলেও এদের স্থায়িত্ব দু'দশকের বেশি হয়নি। পেরাদেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে আরও তরুণ এক গোষ্ঠি উঠে আসে, যারা পশ্চিমি সাহিত্যে শিক্ষিত ও অনেকাংশেই তাদের দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু তাদের সাহিত্য সৃষ্টিও ছিল শ্রীলঙ্কার সাহিত্য ঐতিহ্যের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের কাব্যভাষা, চিত্রকল্প, স্যাটায়ারের ব্যবহার সিংহলি পাঠকের ঐতিহ্যের অভিজ্ঞতার সঙ্গে কোনোভাবে মিলল না। পাঠক ফেলল আগ্রহ হারিয়ে। এঁদের পরবর্তী পর্বে যাঁরা এলেন, আধুনিক যাপনচিত্রের সূক্ষ্মতা, অনুভূতিকে কবিতায় নিয়ে এলেন সিংহলি লোকায়ত কবিতার ঐতিহ্যকে রেখে, তৈরি হল কবিতার নতুন ডিকশন। মুনিদাসা কুমারতুঙ্গা এই সময়ের একজন উল্লেখযোগ্য কবি।
কিন্তু তামিল কবিতাকে বাদ দিয়ে সিংহলি কবিতা সম্পূর্ণ হয় না। গত শতকের সাতের দশক থেকে সিংহলি নিয়ন্ত্রিত প্রাতিষ্ঠানিক আক্রমণ শুরু হয় সংখ্যালঘু তামিলদের ওপর। ১৯৮১ সালে জাফনার পাবলিক লাইব্রেরি পুড়িয়ে দেয় সিংহলি পুলিশ, প্রায় ৯৫০০০ তামিল ভাষায় লেখা বই আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় যার মধ্যে অনেক দুষ্পাপ্য ও প্রাচীন গ্রন্থও ছিল। আসলে এর পিছনে এক উদ্দেশ্য ছিল শ্রীলঙ্কায় তামিল অভিনিবেশকে একপ্রকার বিলুপ্ত করা। তামিলরা নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাবার তাগিদে গঠন করে লিবারেশন টাইগার অফ তামিল ইলাম, যাদের প্রতি আক্রমণে নিহত হয় ১৩ জন সিংহলি সেনা। এরপরই শুরু হয় সিংহলিদের নারকীয় সন্ত্রাস যা গৃহযুদ্ধে পর্যবসিত হয়। এই রক্তাক্ত ইতিহাস স্বাভাবিক ভাবেই উঠে আসতে থাকে শ্রীলঙ্কার তামিল কবিতায়। সন্ত্রাসবাদে আক্রান্ত মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম উঠে আসতে থাকে তামিল কবিতায়। প্রেম, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ সবই ক্রমশ হয়ে উঠতে থাকে রক্তাক্ত। অস্তিত্ব, ভাষা জাতিস্বত্ত্বা রক্ষার সংগ্রামে ক্রমাগত বিধ্বস্ত হতে থাকা মানুষদের দিক চিহ্ন সামগ্রিক শ্রীলঙ্কার কবিতার এক তাৎপর্যময় দিক।
শ্রীলঙ্কার এই সময়ের দু'টি কবিতা পড়ে নেওয়া যেতে পারে।
মুখ
এ. ইয়েসুরাসা
-----------------------------------
হাসতে হাসতে দুলছিল লোকটা
মাস্তুলে টাঙানো পতাকা থেকেও
গড়িয়ে নামছিল শব্দগুলো
‘আমরা তোমাদের আত্মীয়’
আমার চোখে যাতে পড়ে সবকিছু
মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চার
ট্যাঙ্ক থেকে ছুটে আসা মিসাইল
ক্লাস্টার বোমা
গজরাতে থাকা কেফাইর জেট
ধোঁয়ার মেঘের ভেতর
স্বপ্ণের মধ্যেই আমি
শাস নেওয়ার জন্য ছটফট করলাম
তেতো ঘেন্না-ভোঁতা রাগ আস্তে আস্তে
একটা ফিকে হাসিকে রাস্তা করে দিল
যেটা এখন আমার মুখে লেগে আছে
(অনুবাদঃ শৌভিক দে সরকার)
[এ. ইয়েসুরাসা (১৯৪৬- ): জাফনার বাসিন্দা এ. ইয়েসুরাসা আধুনিক তামিল কবিতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবি। সত্তরের দশকের শেষদিকে ‘আলাই’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি।]
আমার দুঃখগুলো একটা সরলরেখায় দাঁড়িয়ে আছে
মজিদ
-----------------------------------
কাঁদতে থাকা চোখদুটোর
গাঢ় গর্তের ভেতর
তোমার দুঃখের প্রতিধবনি শোনা যাচ্ছে
আমার মন থেকে হাতের মুঠোয় ধরে রাখা
সবকটা দৃশ্যই মুছে গিয়েছে ঠিক যেভাবে
একটা প্রজাপতি তার ডানার রঙ হারিয়ে ফেলে
সময় বারবার ছোট ছোট প্রশ্নগুলো রেখেছে
আর ভুল উত্তরগুলো বারবার দেওয়া হয়েছে
আমার ভেতরের কবিতাগুলো একটা সরলরেখার
জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে
কী উচ্চারণ করবো আমিমানুষের জন্য?
সময় আমাকে বঁড়শিতে গাঁথা পোকার মতো গেঁথে
জীবনের ভেতর ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে
অনেকবার আমি নিজেকে ধু ধু বালির ওপর
ঝরে পড়া বৃষ্টির মতো ভেবেছি
অনেকবার আমি চালের ফুটো দিয়ে চুইয়ে পড়া
বৃষ্টির ফোঁটার মধ্যে মিলিয়ে গিয়েছি
পিপড়েদের সারির মতো
আমি আমার মনের কথাগুলো সাজিয়ে নিয়েছি
একটা সরলরেখায় একটার পর একটা শব্দ
বর্ণহীন একটা কবিতা
এখন থেকে আমার মন হাতের মুঠোয় ধরে রাখা
সবকটা দৃশ্যই মুছে ফেলবে ঠিক যেভাবে
একটা প্রজাপতি তার ডানার সব রঙ হারিয়ে ফেলে
(অনুবাদঃ শৌভিক দে সরকার)
[মজিদ (১৯৬৯- ): পূর্ব শ্রীলঙ্কার বাসিন্দা আদাম কান্দু আব্দুল মজিদ আক্কারাইপাত্রু শহরে থাকেন এবং বর্তমানে একটি লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক। ভেত্রাক্কি নিনরা ভেলি তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।]