আরেক রকম ● দশম বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২২ ● ১৬-৩০ ফাল্গুন, ১৪২৮
প্রবন্ধ
বিষাদবৃক্ষের আলাপচারিতা
রঞ্জন রায়
সম্প্রতি প্রয়াত মিহির সেনগুপ্ত (সেপ্টেম্বর ১৯৪৭-জানুয়ারি, ২০২২) এই সময়ের পরিচিত সাহিত্যিক। তিনি আদ্যোপান্ত বরিশালের ভূমিপুত্র। বাংলাদেশের বরিশাল (অবিভক্ত) জেলা তাঁর অধিকাংশ সৃজনের পটভূমি। আবার বরিশাল তাঁর অহঙ্কার।
গত দশকে ঘটনাচক্রে তাঁর সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ের সুযোগ হয়েছিল। গড়ে উঠেছিল এক অহৈতুকী সখ্য ও ভালবাসার সম্পর্ক। তারপর কলকাতা ত্যাগ, কোভিড-১৯শের দাপটে কুঁকড়ে গিয়ে সুদূর হরিয়ানার গুরগাঁও জনপদে প্রায় গুহাবাসী হয়ে বছর দুয়েকের অবরুদ্ধ জীবনযাপন। টেলিফোনের কুশল মঙ্গল বিনিময় ধীরে ধীরে কমতে কমতে শূন্যতে নেমে আসে। ইদানীং ফের কলকাতা যাবার কথা ওঠায় প্রথমেই মনে পড়ল ভদ্রেশ্বর নিবাসী মিহিরদার কথা - তাঁর নো-বারড ব্যক্তিগত জীবনের স্মৃতিচারণ ও প্রাণখোলা হাসির কথা। এমন সময় খারাপ খবরটা পেলাম। এই অবসরে ওঁর সাহিত্য ও ব্যক্তিত্বের রূপ-রস-গন্ধ সমেত খানিকটা পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা হয়তো এক অর্থে তর্পণের প্রয়াস।
বুঝতে পারছি, এ এক অসম্ভব প্রয়াস। কারণ, বিষাদবৃক্ষ-এর রচয়িতার বহিরঙ্গে অফুরন্ত আশাবাদ ও জীবনকে উপভোগের উল্লাস। একের পর এক বইয়ে দেশভাগের অন্তর্লীন যন্ত্রণাকে তিনি আত্মস্থ করেছেন। স্বীকার করেছেন বদলে যাওয়া সময়কে। কিন্তু হাল ছাড়েননি। তাই যতদিন শরীরে সয়েছে ফিরে ফিরে গেছেন বরিশালের সেই গ্রামে, দুর্গাপুজোর সময়ে - তাঁর জননীযন্ত্রণার কাছে।
একজন প্রকাশকের অনুরোধ এসেছিল একটি পাণ্ডুলিপি দেখে যদি কিছু মন্তব্য করি। আমি অবাক। কারও পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করব?
না না, সম্পাদনা-টনা করতে হবে না। আমার জ্ঞানগম্যি নিয়ে প্রকাশকের কোনো ভ্রম নেই। শুধু পড়ে কিছু ফীডব্যাক দিলেই চলবে। এবার রাজি না হয়ে উপায় নেই। ফোকটে একটা গল্প বা উপন্যাস পড়া যাবে, আর কী চাই? তা’ কত শব্দের লেখা? কোন ফন্টে?
জবাব শুনে আমার উৎসাহের বেলুন চুপসে যায়। কম্পিউটারে লেখা নয়, এই পাণ্ডুলিপিটি ক্যুরিয়ারে ওনার দপ্তরে এসেছে। বড়ো একটি লাইন টানা খাতায় হাতে লেখা!
খিঁচিয়ে উঠি। পারব না, বয়েস হচ্ছে। আতস কাঁচ দিয়ে পিঁপড়ের সারি অক্ষর দেখে তার রস গ্রহণ করব অমন রসিয়া আমি তো নই।
- পাকামি কোরো না। উনি আনন্দ পুরষ্কারপ্রাপ্ত লেখক মিহির সেনগুপ্ত। ওনার ‘বিষাদবৃক্ষ’ বা ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’ পড়েছ? ওনার ভাই অভিজিৎ সেনগুপ্তের লেখা ‘রহু চন্ডালের হাড়’ পড়েছ? ধুর! কিছু না পড়েই ‘সফরী ফরফরায়তে’?
আমি মিইয়ে যাই। কারণ কোনো বই স্কুল কলেজে পাঠ্যপুস্তক হয়েছে, কিংবা কোন পুরস্কার পেয়েছে শুনলেই আমার উৎসাহ চলে যায়।
প্রকাশক বোঝান - মিহিরবাবু নিজে তোমার থেকে ফীডব্যাক নিতে রাজি হয়েছেন।
কিন্তু আমি তো ওনাকে চিনি না। কোনো পরিচয় হয় নি। তাহলে?
শোনো, ওনার রয়েছে তিন ‘ব’। এটার মানে নিশ্চয়ই জানা আছে?
- হ্যাঁ, বাঙাল-বদ্যি-বরিশাল। অ, উনি বরিশালের? তপন রায়চৌধুরির মতো?
- তপনবাবুর সঙ্গে ওনার হৃদ্যতার সম্পর্ক। সেসব পরে হবে। সাতদিন পরে আমার দপ্তরে এসে পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে যেও। পনেরো দিনের মধ্যে পড়ে পাঠ-প্রতিক্রিয়া লিখে পাঠাবে।
- কিন্তু ওই হাতে-লেখা, খুদে-পিঁপড়ের সারি?
- ফের বাজে কথা! উনি বড় বড় অক্ষরে ডাবল স্পেস দিয়ে লেখেন। সুন্দর হাতের লেখা। আরে আনন্দ পাবলিশার্স ওনার হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি পড়ে ফেলে আর তোমার যত ন্যাকামি! আর তোমাকে বেছে নেওয়ার কারণ হল তুমি ব্যাঙ্কে চাকরি করেছ। উনিও তাই। তুমি ব্যাঙ্কের ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলে। উনিও তাই।
- উনিও তাই? আমি ফোনে প্রায় চেঁচিয়ে উঠি।
- ঠিক ধরেছ, এবার বুঝলে - কেন তুমি? ও হ্যাঁ, আরেকটা ফ্যাক্টর। গাঙচিল থেকে প্রকাশিত তোমার ‘বাঙাল জীবনের চালচিত্র’ উনি পড়েছেন। খুশি হয়েছেন। ওনার লেখার মূল থিম হল - দেশভাগ। এ’নিয়ে উনি ঋত্বিক ঘটকের মতই অবসেসড্।
আমি ছোটকার বাড়ি গিয়ে বলি – তোমার কাছে ‘বিষাদবৃক্ষ’ আছে? পড়তে চাই।
– চমৎকার লেখা, নিয়ে যা। সঙ্গে পরের বইটাও নে। ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’।
আমি দুটোই বগলদাবা করি এবং ঘরে ফিরে বুঁদ হয়ে পড়তে থাকি।
ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে এক শতাব্দী আগের একটি সম্পন্ন হিন্দু পরিবারের গল্প। ইংরেজি জানার সুবাদে সেই সময়ে মিহিরের চাণক্য-বুদ্ধি জ্যাঠামশায় কীভাবে স্কুল পরিচালনা, মিউনিসপ্যালিটি, সবেতেই নিজের ক্ষমতা কায়েম করেছিলেন তার এক নির্মম নিরপেক্ষ বর্ণনা। তার পাশাপাশি দেখতে পাই মুসলমান প্রজাদের। কৃষক পরিবার ও এক জেদি কিশোর মিহিরকে। দেশভাগের পটভূমিতে আর দশটা বাজারচলতি লেখাগুলোর থেকে এটি কত আলাদা! এই লেখায় টের পাই কেন দেশভাগ অমন রক্তক্ষয়ী হয়েছিল।
যথাসময়ে পাণ্ডুলিপিটি পড়ে ফেলি। সেখানেও সাদা-কালো মানুষ নয়। ডালহৌসীতে সরকারি ব্যাঙ্কের রাশভারি বিলেত ফেরত বড়কর্তাটি বইপাগল। মাঝে মাঝে আগুনখেকো উঠতি ইউনিয়ন কর্মী মিহিরকে ডেকে পাঠান নিজের চেম্বারে। শাসন করতে নয়, বই নিয়ে আলোচনা করতে। সে’তালিকায় ঢুকে পড়ে মাওয়ের দার্শনিক রচনাও।
সত্তরের দশকে রাস্তার থেকে সিআরপি তুলে নেয় এক সহকর্মীকে। সরকারি ইউনিয়ন এবং কর্তৃপক্ষ আইনের অজুহাতে এ’নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে অস্বীকার করেন। খ্যাপা মিহির ব্যাঙ্কের কাজ বন্ধ করিয়ে জনাকয়েক সঙ্গীকে নিয়ে সেই বড়সাহেবের চেম্বারে ঢুকে তাঁকে আটকে রাখেন। দাবি - অফিসে আসার পথে ধরা পড়া ব্যাঙ্ক কর্মচারির বিনা ওয়ারেন্টে সিআরপি তুলে নিয়ে গেছে। ব্যাঙ্ক তার নৈতিক দায়িত্ব এড়াতে পারে না। কিছু করুক, লালবাজারে এবং লর্ড সিনহা রোডে ফোন করুক। নইলে ঘেরাও চলবে।
আলোচনার পর রাস্তা বাতলে দিলেন সেই বড়সাহেব। ব্যাঙ্ক হেবিয়াস কর্পাস করবে এবং তার আগে পুলিশের উচ্চস্তরে খোঁজ করবে। মিহির অটল। আগে ছেলেটি ব্যাঙ্কে ফিরে আসুক, তবে ঘেরাও উঠবে। তাই হল, ছেলেটি রাস্তায় পড়ে থাকা অনামা মৃতদেহ হওয়ার দুর্ভাগ্য থেকে রেহাই পেল।
খবর এল, আমি সসংকোচে যে ক’টি পরিবর্তন সুপারিশ করেছিলাম সবক’টি ওনার যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। উনি অসুস্থ, আমাকে দেখা করতে বলেছেন। যেতে হবে ভদ্রেশ্বরে।
অনুজপ্রতিম কবি বিকাশ গণচৌধুরিকে অনুরোধ করায় ও সঙ্গে সঙ্গে রাজি। যেদিন স্টেশনে নামলাম তার আগের দিন ওখানে জনৈক ট্রেড ইউনিয়ন নেতার মৃত্যু হয়েছে। রাজনৈতিক হত্যা। অটোচালক বলে - সন্ধ্যের আগে ফিরে আসবেন। আমরা রাস্তার থেকে গাড়ি তুলে নেব।
একটি সরকারি স্কুলের সামনে স্টপেজ। তারপর খানিকটা হন্টন। মাঝে মাঝেই ফোন করি – ল্যান্ডমার্ক বলি, হারিয়ে যাচ্ছি না তো! চশমা চোখে অসুস্থ মানুষটি দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তার উপরে। লজ্জা পাই।
তারপর কথা আর কথা, গল্প আর গল্প। খাওয়া আর খাওয়া। ভাজাভুজি এড়ানোর চেষ্টা করি। মিষ্টি দেখে নিজেকে সামলাতে পারি না।
ঐতিহাসিক বরিশালিয়া তপন রায়চৌধুরির কথা তোলায় মিহির আবেগে ফেটে পড়েন।
– অনেক বড় মাপের মানুষ, বুঝলে? ওনার ‘রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিত চর্চা’ পড়ে কয়েকটা বরিশালি ভুল চোখে পড়ল। বয়েস কম ছিল, সোজা অক্সফোর্ডে চিঠি লিখলাম। কী আশ্চর্য? অল্পদিনের মধ্যেই উত্তর এল। সবিনয়ে সবকটি কথা মেনে নিয়েছেন। অতবড় পণ্ডিত মানুষ। কিন্তু অহঙ্কার নেই। এরপর উনি কখনও কলকাতায় এলে আগাম খবর দিতেন। তারপর আমরা - দুই অসমবয়েসি, বরিহালিয়া ডায়লেক্টে আড্ডা দিতাম।
আমাদের দুজনকে অটো হরতালের আগে বেরিয়ে পড়তে হবে। উঠতে ইচ্ছে করছিল না। বললেন - যখন কলকাতায় ছিলাম তখন কেন পরিচয় হয়নি? তাহলে রোজ আড্ডা দিতাম। আমি বলি - “দেখা হইল নারে শ্যাম আমার সেই ‘নত্তুন’ বয়সের কালে”!
হো হো করে হেসে উঠে বলেন - মুজতবা আলীর ছোট বেলায় শোনা কীর্তন? ঠিক বলেছি?
আমি হেসে উঠে সায় দিই।
রাস্তায় নামার পর বলি - আপনাদের পরিবার আগে পার্কসার্কাসের সার্কাস এভিনিউয়ে থাকতেন, বড়দার সংসারে। পরে আপনারা চার নম্বর পুলের কাছে গোবরা কবরখানার পাশে উঠে যান।
উনি চমকে উঠে বললেন - এসব আপনি জানলেন কী করে?
পঞ্চাশ-ষাটের দশকে আপনার সেজদা দিলীপ, ডাকনাম কানু, আমাদের পার্কসার্কাসের ধাঙড় বাজারের সামনের ভাড়া বাড়িতে কাকাদের ব্যাচেলরস্ ডেন ঘরটায় আড্ডা দিতে আসতেন। প্লেট বাটি বাজিয়ে গান ধরতেন, হৈ হৈ করে জমিয়ে রাখতেন। উনি আমার ছোটকার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আমাদের নীচের তলার মুন্নাদার সঙ্গে মডার্ন স্কুলে পড়তেন। কিন্তু আপনার আরেক দাদা পারিজাত ছিলেন আমার কাকার সহপাঠী। কাজেই দেখতে পাচ্ছেন - বরিশাল বা বদ্যি না হলেও -
বিকাশ তাড়া দেয়। স্টেশন অনেকটা দূর। শেষ অটো মিস করলে ভুগতে হবে।
ফিরে এলাম উপহার পাওয়া কয়েকটি বই নিয়ে - ‘ভাটিপুত্রের বরিশালি গদ্যসংগ্রহ’, ‘ধানসিদ্ধির পরণকথা’ ও ‘বিদুর’। কথা দিলাম নিয়মিত যোগাযোগ রাখব বলে।
কথা রেখেছিলাম, দুজনেই। ফোনে আড্ডা হত। আমি 'গুরুচন্ডালি'-তে প্রাথমিক খসড়া বেরোনো ‘ছত্তিশগড়ের চালচিত্র’-এর পান্ডুলিপি প্রকাশকের দপ্তরে পাঠানোর আগে ওনাকে দেখিয়ে নিলাম।
খবর পেলাম হার্টের অপারেশন হয়েছে। উনি চেক আপ এবং রিকভারি করিয়ে ভদ্রেশ্বর ফিরলে দেখা করতে গেলাম, স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে - ওনার আদেশ ছিল।
আড্ডা জমল দুই দম্পতির চা-পান পর্বে।
অকস্মাৎ নীল আকাশে বিদ্যুৎ। কোন প্রকাশক বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছু মহিলার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সংকলন প্রকাশের জন্য সংগ্রহ করছিলেন। এর মধ্যে ওনার স্ত্রীর অভিজ্ঞতাও ছিল। কিন্তু প্রাথমিক পাঠান্তে কারও ফীডব্যাক আসে যে বালুচ কম্যান্ডারের বদান্যতার কথা বাদ দিতে হবে।
মিহিরবাবুর স্ত্রী আমাকে বললেন - নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা লিখেছি। ফরমাইশে সাদাকে কালো করে মিথ্যে কথা লিখব না। তাতে না ছাপতে হয় না ছাপবে!
আমি একবাক্যে সমর্থন জানালাম। সুখের কথা, সংকলনে ওনার লেখা প্রকাশিত হয় একটুও কাটছাঁট না করে।
মিহিরদা আমাকে দিলেন তাঁর আরও দুটো গ্রন্থ - ‘নিষ্পাদপ অরণ্যে’ এবং ‘যুদ্ধান্তে’। কথায় কথায় জানলাম, নতুন করে মহাভারত পড়ছেন এবং তার কিছু আখ্যান নিয়ে আজকের চোখে কাহিনির পুনর্নির্মাণ করে লিখছেন।
এতদিন লিখেছেন ব্যক্তিগত স্মৃতি ও অনুভবের আখ্যায়িকা, সেগুলোও কোনো উপন্যাসের চেয়ে কম নয় । উনি কোথাও পাত্রপাত্রীর বা স্থানকালের বর্ণনা বদলে দেননি। কিছুই লুকোনোর দরকার বোধ করেননি। ‘কোথাও কোনো মিল দেখা গেলে তা কাকতালীয়’ গোছের ক্লিশে হয়ে যাওয়া বাক্যবন্ধে ওনার ছিল ঘোর আপত্তি। একজন নামজাদা প্রকাশককে, ওনার ভাষায়, কলার ধরে শূন্যে তুলে দিয়েছিলেন। কারণ, সে ভদ্রলোক টাকাপয়সার ব্যাপারে কথার খেলাপ করে, উলটে অস্বীকার করছিলেন।
সেদিন তাঁর মুখে শুনি দীর্ঘ বর্ণনা। কীভাবে তাঁর চোদ্দবছরের শালীকে খানসেনারা তুলে নিয়ে যায়। কারণ, স্থানীয় বাঙালী রাজাকারেরা মেয়েটিকে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন সাহায্যকারী এবং অন্তর্ঘাতে যুক্ত বলে খবর দিয়েছিল। মিথ্যে অভিযোগ, উদ্দেশ্য অসৎ। কিন্তু মেয়েটি রক্ষা পায় বালুচ ক্যাম্প কম্যান্ডারের জন্যে। সেই কম্যান্ডার রাজাকারদের কথা না শুনে কিশোরীর কথা বিশ্বাস করেছিল এবং তাকে সুরক্ষা দিয়ে মেয়েটির কথামত কাছের এক গাঁয়ে পরিচিতের বাড়িতে নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছিল।
আমি বলি - এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বিভীষণ তো রাবণের আপন ভাই এবং মাস্টারদা সূর্য সেনকে ধরিয়ে দিয়েছিল নেত্র সেন, যে নাকি ওনার আত্মীয়!
তারপর শুনি - সামান্য কটা টাকা সম্বল করে লুঙ্গি পরে মুসলমান সেজে বেআইনি ভাবে সীমান্ত অতিক্রমণের চেষ্টায়, পথে ঠগের হাতে সব টাকা হারিয়েও, সেরেফ জেদের বশে মিহির কীভাবে ইছামতী পেরিয়ে গেলেন। তারপর কপর্দকহীন অবস্থায় বরিশালে নিজের গাঁয়ে পৌঁছে হবু শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে আলোচনা করে বিয়ে করে স্ত্রীকে নিয়ে, ১৯৭২-এ সরকারি ভাবে সীমান্ত পেরিয়ে কলকাতার বাসায় ফিরে এলেন।
মিহির সেনগুপ্ত জানিয়েছিলেন যে ১৯৯৩ সালে ‘নাইয়া’ পত্রিকার মাধ্যমে তাঁর লেখকজীবন শুরু। এরপর লেখালেখি করেছেন ‘বর্তিকা’, ‘কালান্তর’, ‘কম্পাস’ ও অন্যান্য কিছু পত্রপত্রিকায়।
তবে দাদা অভিজিৎ সেন তার আগেই প্রতিষ্ঠিত লেখক। ইতিমধ্যে ‘এক্ষণ’ পত্রিকায় বেরিয়ে গেছে ওঁর ‘বর্গক্ষেত্র’ এবং ‘রহু চণ্ডালের হাড়’।
কিন্তু ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরির লেখায় বরিশালিয়া ছড়ায় ছন্দের ভুল ধরা এবং সেই নিয়ে ৮৫ পৃষ্ঠার চিঠিচাপাটির মাধ্যমে গড়ে উঠল মিহিরের প্রথম বই 'ভাটিপুত্রের পত্র বাখোয়াজি' (১৯৯৫) এবং মহাভারতের চরিত্র নিয়ে 'বিদুর' (১৯৯৫)। মিহিরের লাভ হল প্রবীণ ঐতিহাসিকের সঙ্গে অসমবয়েসি বন্ধুত্ব। এরপর এল 'সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম' (১৯৯৬), ‘বিষাদবৃক্ষ (২০০৪) এবং 'শরণার্থীর মুক্তিযুদ্ধ' (২০১৫)। ২০০২-এ তাঁকে প্রথম স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশ শ্রুতি অ্যাকাডেমি ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’ গ্রন্থের জন্য ‘শ্রেষ্ঠ রচনা’র পুরস্কারে সম্মানিত করে। এপার বাংলায় আনন্দ পুরস্কার এল ২০০৫-এ আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘বিষাদবৃক্ষ’-র জন্য।
অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘উজানিখালের সোঁতা’, ‘টাঁড় পাহাড়ের পদাবলি’, ‘হেমন্ত শেষের পাখিরা’, ‘গোধূলি সন্ধির রাখাল’, ‘নীল সায়রের শালুক’, ‘একুশ বিঘার বসত’, ‘সুবর্ণ উত্তরণ’, ‘নিষ্পাদপ অরণ্যে’, ‘যুদ্ধান্তে’। ওঁর শেষের দিকের লেখা ‘বলেশ্বরী পেরিয়ে’ এবং ‘কালচক্রযান’ ইত্যাদি।
মিহির ১৯৬৩ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজের ইন্টারমিডিয়েট পড়া ছেড়ে কলকাতায় এসে ফের প্রথম বিভাগে স্কুল ফাইনাল পাশ করে ব্যাঙ্কের চাকরিতে ঢুকলেন। ১৯৬৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হলেন ইংরেজি সাহিত্যে। চাকরি থেকে অবসরের পর বাকি জীবন রইলেন হুগলী জেলার ভদ্রেশ্বরে।
বোধহয় কলকাতা মহানগরীর ইঁটকাঠ লোহাসিমেন্টের কাঠামোয় উনি স্বচ্ছন্দ ন’ন, মন বসেনি। ওঁর লেখকসত্ত্বা মুক্তি পায় পূববাংলার বরিশালের ঝালকাঠি এলাকায়, মাঠ খালবিল ও নদীর ধারে। ওঁর ‘ভাটিপুত্রের পত্র বাখোয়াজি’, ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’, ‘ধানসিদ্ধির পরনকথা’, ‘ভাটিপুত্রের বরিশালি গদ্যসংগ্রহ’ প্রমুখ নানা লেখার মধ্যে রয়েছে বরিশালের ভাষা ও আখ্যানের বুনোট।
আবার ‘টাঁড় পাহাড়ের পদাবলি’তে রয়েছে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের পর প্রমোশন পেয়ে কিছুদিন কলকাতা ছেড়ে ছোটনাগপুর সীমান্তে এক শাখায় বদলি হওয়া এবং তারপর মনের অ্যালবামে ধরে রাখা সেখানকার সাধারণ মানুষ ও স্থানীয় জনজাতি জীবনের অচেনা ছবিগুলো।
এই স্বল্প পরিসরে আমি একটু খেই ধরিয়ে দিতে চাই তাঁর চারটি বইয়ের - ‘বিষাদবৃক্ষ’, ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’, ‘কালসন্ধ্যা’ ও ‘কালচক্রযান’।
‘বিষাদবৃক্ষ’তাঁর সবচেয়ে পরিচিত বই। দেশভাগের স্মৃতি ও বেদনা নিয়ে লেখা অজস্র বইয়ের ভিড়ে এই বইটি একেবারেই আলাদা। কেন? এতে সেই সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাবলীর পটচিত্র মাত্র, তৎকালীন নেতারা ছায়াশরীর। মিহির ঝালকাঠি জেলার কেওড়া গ্রাম, পিছারার খাল, নৌকো, মাঠ, ধানক্ষেত ও জেলেদের জীবনের উপরিতলের বর্ণনায় আটকে না থেকে ডুব দিয়েছেন গভীরে, হিন্দু-মুসলমানের সমাজ, পালাপার্বন, ধর্মবিশ্বাসের দৈনন্দিন জীবনচর্যার গোষ্ঠীচেতনায় এবং ব্যক্তিমানুষের মগ্নচৈতন্যে।
দেশভাগের সময় ঘরবাড়ি মুসলমান তালুকদারদের হাতে গচ্ছিত রেখে বা বিক্রি করে রাতারাতি ভারত পাড়ি দেয়া বক্সিবাবুদের সংখ্যা বেড়ে চলে। (এইখানে মিহিরের বরিশাল এবং বর্তমান প্রাবন্ধিকের মৈমনসিং এক হয়ে যায়।)
কিন্তু মিহিরের পরিবার সহ আরো কিছু পরিবার জন্মভূমির মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। মিহিরের বুড়ি পিসিমায়ের দেখা 'সপপন্' যেন তাদের তখনো আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছিল, "...হিন্দুস্তান পাকিস্তান বেয়াক ভাগাভাগি মিডইয়া গেছে। বেয়াক কিছুই আবার আগের ল্যাহান। গোলায় ধান, পুহইরে মাছ, গাছে ফলফলাদি..."
মিহির তাই লিখতে পারেন "...দোষে গুণে আমরা উভয় সম্প্রদায়ই তুল্যমূল্য। কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে, বরাবর আমরা একে অন্যকে দুষে আসছি। কেউই কখনও নিজেদের দোষের পসরা নিয়ে বলিনি, দেখ ভাই এই আমাদের দোষ, এগুলোকে তুচ্ছ করে এসো আমরা ভালোয় মন্দে বাঁচি, এবং এই দোষগুলোর সংশোধন করি। না, আমরা কদাপি এরকম সুবুদ্ধিতে পরিচালিত হইনি। না হিন্দুরা, না মুসলমানেরা।"
বইটিকে মিহির নিজে বলেছেন ‘কালচারাল অ্যান্থ্রোপলজি’। ওঁর লেখায় হিন্দু বা মুসলমান কেউ পুরোপুরি ভিলেন নয় বরং কালচক্রের অসহায় ক্রীড়নক। এই অন্বেষণ প্রভাবিত করেছে ওঁর লেখন শৈলীকে। তাই বইটি আত্মজীবনের একরৈখিক ক্রনোলজি না হয়ে আকার নিয়েছে স্মৃতির রামধনু কোলাজের।
এরপর‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’পড়ে হতবাক হই। দেশভাগের পর আবার সাহস করে জন্মভূমিতে উঁকি মারা?
বুঝে যাই, ইনি আমার মতো কলকাত্তাই বাঙাল ন’ন। এর বুকের মধ্যে ছলছল জলেশ্বরী ঢেউ তোলে। তার টানে উনি ফিরে যান দুর্গাপূজোর সময় নদীর তীরে পিতৃপুরুষের ভিটেয়, একবার নয় - নিয়ম করে ছ’টি বছর। ৮০ -৯০ দশকে। সেখানে সারারাত পালা দেখেন, খেয়াল করেন পুজোয় টিন কম পড়লে মসজিদ কমিটির অল্পবয়েসি সেক্রেটারি সেখান থেকে যোগান দেয়। হ্যাঁ, দ্বিধা দ্বন্দ্ব রয়েছে। অনায়াসে কাফের হিন্দুদের জন্য উচ্চারিত হয় নিন্দাসূচক শব্দ - মালাউন। একইভাবে ম্লেচ্ছ মুসলমানদের জন্য সম্বোধন হয় ‘শ্যাকের ব্যাডা’!
পুতুলপুজোয় মসজিদের টিন! গোঁড়াদের চক্ষে ব্লাসফেমির নামান্তর। কিন্তু ধমক এবং ভয় দেখানো সব ছাড়িয়ে বিজয়ী হয় ভালবাসা।
মিহির এগিয়ে যান সেলিমাবাদের এক অখ্যাত গ্রাম সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম ফকিরের খোঁজে, তাঁর আস্তানায়। উর্দূ মোকাম শব্দটির আরেক মানে হল অন্তিম গন্তব্য বা ডেস্টিনেশন। ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’ এবং ‘ধানসিদ্ধির পরণকথা’ – দুটো বইয়েই দেখি মিহির দুর্গাপুজো ও ঈদের মধ্যে আজকের বাংলাদেশে হিন্দু মুসলমানের সহাবস্থান এবং দ্বন্দ্বের রহস্যকে ছুঁয়ে ফেলে ধর্মাচরণে মানুষের পরিচয় এবং গোষ্ঠীচেতনার মেলবন্ধনের দরজায় ঘা দিচ্ছেন। উনি যেন ওই জীবনের কথকঠাকুর।
মিহিরের‘কালসন্ধ্যা’আমার প্রিয় বইগুলোর মধ্যে একটি। ‘কালসন্ধ্যা’র বিষয় - মহাভারতের আঠেরো দিন যুদ্ধের সমাপনে দ্বৈপায়ন হ্রদের তীরে ভগ্ন-ঊরু কৌরব শ্রেষ্ঠ দুর্যোধনের অন্তিম রাত্রির কল্পিত আত্মকথন। এতে ফুটে উঠেছে রাত্রিতে পাণ্ডব শিবিরে অশ্বত্থামা ও কৃপাচার্য্যের চোরাগোপ্তা হামলায় পঞ্চ পাণ্ডবের পাঁচ সন্তানের নির্মম হত্যায় দুর্যোধনের আত্মগ্লানি। এছাড়া কথিত ধর্মযুদ্ধে পাণ্ডবদের বেশ কয়েকবার অনীতি ও অধর্মের আশ্রয় গ্রহণ নিয়ে ক্ষোভ। আর মৃত্যুর পূর্বে আশঙ্কা যে ব্যাসদেবের পরবর্তী কালে রচিত মহাভারতে সত্যিকথা লেখা হবে? পরাজিত কৌরবদের ব্যাপারে কোন ভাল কথা থাকবে? মিহিরের লেখায় আমরা বুঝে যাই এ’ধরণের সর্বগ্রাসী বিধ্বংসী যুদ্ধে কেউ বিজয়ী হয় না। কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতিতে মানবতা নিশ্চিত পরাজিত হয়। এ যেন বর্তমান পৃথিবীর অস্তিত্ব হানিকর সংকটের প্যারাবল। এখন বইটি পড়লে পাঠকের মনে অনিবার্য রূপে ভেসে উঠবে রাশিয়া ও ইউক্রেন।
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল‘কালচক্রযান’উপন্যাসটি সম্পাদনা করার। মিহিরের কেরাণীজীবন শুরু হয় ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের আগের যুগে, যখন ব্যাঙ্ক চলত ব্যাক্তিমালিকানায়। সেখানকার ওয়ার্ক কালচার আজকের প্রজন্মের কাছে রূপকথার মতো মনে হবে। বইটির আখ্যানের পরতে পরতে রয়েছে নানা চরিত্রের প্রদর্শনী, সময়ের ছোঁয়ায় রঙ ফিকে হয়নি।
ইউনিয়নের সংগ্রামী দিন থেকে ৩৫ বছর ধরে বন্ধু দিলীপ সাহা বা মাসের মাইনে হাতে পেলেই বই কিনে ফেলা সাহিত্যপ্রেমী সমীরদা। জ্যোতিষচর্চা করা ইন্দ্রসায়েব, অতি-বাম রাজনীতির দিনে মিহিরের রিক্রুট চতুর্থ শ্রেণির স্টাফ ছেলেটি। কিন্তু অবাক করা চরিত্র ওপরওয়ালা পি কে মিটার। এলেমে লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সের ছাত্র, চোস্ত ইংরেজি বলা সায়েব। কিন্তু মাঝে মধ্যেই ব্যুরোক্র্যাটিক পোশাকটি আলগা হয়ে ভেতরের স্পর্শকাতর মানবিক চরিত্রটি উঁকি মারে।
মিহিরদার লেখায় আমাকে যা টানে তা হল ব্যক্তিমানুষের সজীব চিত্রণ। নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েও তারা স্বকীয় মহিমায় উজ্বল। তাঁর প্রথম জীবনে ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যায় অর্জিত আস্থা শেষ বয়সেও বিশেষ টাল খায়নি। কিন্তু ধরাবাঁধা চরিত্রচিত্রণ তাঁর ঘোরতর না-পসন্দ।
আমাকে বোঝাতে থাকেন যে সেই নির্ধারিত শ্রেণি কাঠামোর মধ্যে থেকেও মানুষেরা কাঠের পুতুলের মতো হাত-পা নাড়ে না। ঠিক যেমন একই ক্লাসে একই টিচারের সব ছাত্রের রেজাল্ট একরকম হয় না। খাতায় লেখা উত্তরগুলো ঠিক কার্বন কপি হয় না। নিশ্চয়ই জানো যে লেনিনের ‘ইস্ক্রা’ পত্রিকায় টাকা ঢেলেছিল সাশা মরোজভ নামের এক পুঁজিপতি। কেন? লেনিনের ভাষায় - সে ছিল নিজের শ্রেণির প্রতিই বীতশ্রদ্ধ। অথবা গোর্কির নাটকে ইয়েগর বুলিচভ বলে বৃদ্ধ বণিকটি, যে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অনুভব করে তার শ্রেণির মৃত্যুঘন্টা বাজছে!
তাই পূববাংলায় তাঁদের সংযুক্ত পরিবারের কর্তাব্যক্তি, তাঁর আপন জ্যাঠামশায়, নিজের ভাই এবং ভাইয়ের পরিবারের সদস্যদের প্রতি অকরুণ নির্মম হয়েও এই বেয়াড়া ভাইপো মিহিরের প্রতি একটা চোরা টান অনুভব করেন। (বিষাদবৃক্ষ)।
বাংলাদেশের জন্মলগ্নের সংগ্রামের সময় মুক্তিবাহিনীর চর সন্দেহে বন্দি হওয়া চোদ্দ বছরের মেয়েটিকে হেনস্থা হতে হয় স্থানীয় বাঙালী মুসলমানদের চক্রান্তে। অথচ তাঁকে রক্ষা করে সসম্মানে তার বাড়িতে পৌঁছে দেন দখলদারী খানসেনার বালুচ কম্যান্ডার। সাদা-কালো হিসেব মেলে না।
সত্তরের অতিবাম রাজনীতির সময়ে মিহিরের রিক্রুট হয়েছিলেন তাঁর ব্যাঙ্কের শাখায় কর্মরত এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি। মিহির ওঁকে রিক্রুট করতে পেরে গর্বিত; - ও যে ওয়ার্কিং ক্লাস, মিহিরের মতো সুবিধাভোগী পেটিবুর্জোয়া মধ্যবিত্ত নয়। সেই কমরেড ধরা পড়ে, কিছুদিন পরে মিহিরও।
পরে মিহির টের পেলেন যে বাড়ির চাপে সেই লড়াকু কমরেডই মিহিরকে ধরিয়ে দিয়েছিল। আবার চোস্ত ইংরেজিতে কথা বলা ব্যাংকের ডালহৌসি শাখার বড়সায়েব মিহিরের কাছ থেকে মাওয়ের ‘অন কন্ট্রাডিকশন’ নিয়ে পড়েন। এবং একজন কর্মচারি সিআরপি’র হাতে বন্দী হলে তার জন্য হেবিয়াস কর্পাস করাতে এবং লালবাজারে টেলিফোন করতে রাজি হন। বাঁধা ছক বারবার ভেঙে ভেঙে যায়। (কালচক্রযান)।
এরপরে আমি কলকাতার বাস তুলে ভিন মুলুকে চলে আসায় আর ওনার সঙ্গে মুখোমুখি আড্ডা হয়নি। শেষ বলেছিলেন মাথায় যন্ত্রণা হয়। আর বই পড়তে বা লিখতে উৎসাহ পাচ্ছেন না। হার্ট অপারেশান আগেই হয়েছিল, এখন লড়াই চালাচ্ছেন ব্লাড ক্যান্সারের সঙ্গে। একটা জীবনে আর কত?
ধীরে ধীরে ফোনে বার্তালাপ কমে গেল। গত সপ্তাহে স্ত্রীর সঙ্গে কথায় কথায় বলছিলাম অনেকদিন মিহিরদার খবর নেওয়া হয়নি। আমিই ফোন করব। কিন্তু এখন বোধহয় ওঁর বিশ্রামের সময়, এখন বোধহয় ওঁর -।
এইসব করতে করতে দুঃসংবাদ এল, নিজেকে এখন অপরাধী মনে হচ্ছে।
আমিও এখন এক বাহাত্তুরে বুড়ো; দুই বুড়োয় অনেক কথা বলার ছিল। অনেক প্রাইভেট জোকস্ জমে ছিল যে!