আরেক রকম ● দশম বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২২ ● ১৬-৩০ ফাল্গুন, ১৪২৮

প্রবন্ধ

কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২২-২৩-এর রাজনৈতিক অর্থনীতি

জয়ন্ত আচার্য


গত ১ ফেব্রুয়ারি লোকসভায় দেশের অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবর্ষের জন্য যে বাজেট পেশ করেছেন সে সম্পর্কে ইতিমধ্যে অনেক সংবাদপত্র এবং বিশেষজ্ঞ মতামত প্রকাশ করেছেন। এই নিবন্ধে ২০২২-২৩ এর বাজেটের প্রস্তাব ও ঘোষিত নীতির মধ্য দিয়ে অর্থমন্ত্রীর তথা এই সরকারের যে 'রাজনৈতিক অর্থনীতিʼ-র প্রতিফলন ঘটেছে তা বুঝবার চেষ্টা করা হবে।

ধনতন্ত্রের বিকাশের স্বর্ণযুগে অর্থনীতিবিদরা মুক্ত অবাধ প্রতিযোগিতার বাজারের অশেষ মহিমার কথা লিখলেন। বলা হলো, উৎপাদক কিছু দ্রব্য উৎপাদন করে বাজারে জোগান দিতে পারলেই ঐ দ্রব্য বিক্রি হওয়ার কোনো সমস্যা নাই। জোগানই দ্রব্যের চাহিদা সৃষ্টি করে নেবে। অবাধ ও মুক্ত বাজারের এমনই ক্ষমতা যে, দেশের সরকার বাজারের কার্যকলাপে যদি কোনও রকম হস্তক্ষেপ না করে তাহলে দীর্ঘকালীন সময়ে বাজারে কোনও অবিক্রীত দ্রব্য থাকবে না, কোনও অনিযুক্ত বেকার শ্রমিকও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই তত্ত্বের উদ্ভব ঊনিশ শতকের ঊষালগ্নে, ১৮০৪ সালে। এর উদ্গাতা ফ্রান্সের এক অর্থনীতির অধ্যাপক - জাঁ ব্যাপটিস্ট সে। তাঁর এই তত্ত্ব 'সে'জ ল অফ মার্কেটʼ নামে অর্থনীতি শাস্ত্রে খ্যাত হয়ে গেছে।

আলোচনার শুরুতেই এই প্রাচীন তত্ত্ব ও তাত্ত্বিক সম্পর্কে এই কথাগুলি বলে নিতে হলো এই কারণে যে আলোচ্য বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে এই তত্ত্বের উপর অর্থমন্ত্রীর ও তাঁর দলের গভীর আস্থা ও বিশ্বাস। এবং সেই বিশ্বাসে ভর করেই তাঁরা অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যদিও এ তত্ত্ব আজ অর্থনীতি পরিচালনায় ও নীতি নির্ধারণের কাজে বহুদিন পরিত্যক্ত। গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে ধনতন্ত্রের যখন গভীর গভীরতর অসুখ, যখন ইউরোপ আর আমেরিকায় দেখা গেল শতকরা ১০ থেকে ২০ ভাগ মানুষ কর্মহীন তখন মুক্ত ও অবাধ বাজারের দক্ষতায় আর বিশ্বাস রাখা গেল না। জন মেয়ার্ড কেইনস - একজন বৃটিশ অর্থনীতিবিদ লিখলেন নতুন তত্ত্ব যাতে বলা হলো সংকটাপন্ন ধনতন্ত্রকে বাঁচাতে হলে প্রয়োজন চাহিদার উজ্জীবন। উজ্জীবিত চাহিদাই অর্থনীতিকে সচল করে রাখতে পারে। এর জন্য কাজ বা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। কলকারখানার বা জমির মালিক যদি কাজ না দিতে পারে, তবে সরকারকেই সেই কাজ দিতে হবে। কাজে নিযুক্ত হলে শ্রমিকের আয় হবে, ফলে তার ক্রয়ক্ষমতা তৈরি হবে। দ্রব্যসামগ্রী কেনার চাহিদা বাড়বে। স্বল্প সময়ে অর্থনীতির মন্দা কাটিয়ে ওঠার এটিই সঠিক পথ। শুধু জোগান বৃদ্ধি করে বেকারি ও মন্দার সমস্যা সমাধানের জন্য বাজারের উপর দীর্ঘকাল নির্ভর করে থাকা যায় না। দীর্ঘকাল ব্যাপী আমরা বেঁচে থাকব না।

তাই সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করে কাজের সুযোগ তৈরি করতে হবে। কী কাজ দেবে সরকার ? কেইনসের উত্তর, কোনও কাজ না পেলে গর্ত খোঁড়ার কাজেই লাগাতে হবে কর্মহীন শ্রমিকদের। প্রয়োজনে গর্ত খুঁড়ে পুনরায় তা ভরাট করার কাজও দিতে হবে। ভারতেও ২০০৫ সালে একটি আইন পাশ করা হয় পার্লামেন্টে - 'মহাত্মা গান্ধী রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি আক্টʼ। এই আইনের বলে যে কোনো কর্মহীন গ্রামীন শ্রমিকের পরিবারের একজনকে বছরে ১০০ দিনের কাজ সরকারকে দিতে হবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর তাঁর সরকারের প্রথম বাজেট অধিবেশনে ঘোষণা করেছিলেন যে, গ্রামীণ কর্মসংস্থানের এই প্রকল্প চালিয়ে যাওয়া যদিও যুক্তিহীন, তবুও তাঁর সরকার একে রেখে দেবেন অর্থ অপচয়ের স্মারক হিসেবে। সে দিনই বোঝা গিয়েছিল গরীব কর্মহীন মানুষের প্রয়োজনের প্রতি দায়বদ্ধ না থাকাটাই এই সরকারের রাজনৈতিক অর্থনীতি বা অর্থনৈতিক দর্শন। কিন্তু ইতিহাসের কী দুরপনেয় পরিহাস লকডাউনে অচল দেশে এই প্রকল্পই দেড় কোটি পরিযায়ী শ্রমিকের গ্রাসাচ্ছাদনের আশ্রয় হয়ে উঠেছিল এবং তাঁর সরকারকে বরাদ্দ করতে হলো ১ লক্ষ ১১ হাজার কোটি টাকা। আর বিস্ময়কর ব্যাপার হলো অতিমারীজনিত কর্মহীনতা ও দারিদ্র্য অব্যাহত থাকলেও পরের বছর এই প্রকল্পেই বাজেট বরাদ্দ ১৩,০০০ কোটি টাকা কমিয়ে করা হলো ৯৮,০০০ কোটি টাকা। বর্তমান বছরের বাজেটেও এই প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ আরও কমিয়ে করা হলো ৭২,০০০ কোটি টাকা। এই হলো কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক দর্শনের অতি নিষ্ঠুর ভাষ্য।

নিষ্ঠুরতার ও হৃদয়হীনতার এই ছবি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও বরাদ্দের প্রবণতা থেকে পাওয়া যাবে। অর্থমন্ত্রী যেদিন বাজেট পেশ করছেন সেদিনই এদেশে কোভিডে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ১০ লক্ষেরও বেশি। মহামারী ততদিনে প্রাণ হরণ করে নিয়েছে ৪ লক্ষ ৯৫ হাজার জন ভারতবাসীর। এই বিধ্বংসী মারণযজ্ঞের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে তিনি আগামী বছরের জন্য স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বরাদ্দ তো বাড়ালেনই না বরং দেশের মানুষকে কোভিড ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য গত বাজেটে যেখানে বরাদ্দ ছিল ৩৯ হাজার কোটি টাকা, সেখানে আগামী বছরে এই উদ্দেশ্যে বরাদ্দ করলেন মাত্র ৫,০০০ কোটি টাকা। গতবছর ওঁরা একটা প্রকল্প ঘোষণা করলেন গ্রামীণ ও শহরের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো উন্নত করার জন্য - 'প্রধানমন্ত্রী আয়ুষ্মান ভারত ইনফ্রাস্ট্রাকচার মিশন'। বরাদ্দও করা হলো ৬৪০০০ কোটি টাকা। কিন্তু বছর শেষে দেখা গেল খরচ করা হয়েছে মাত্র ৯০০ কোটি টাকা। বাজেটে যে টাকা দেওয়া হলো তাও পুরো খরচ করেন না ওঁরা ! গ্রাম গ্রামান্তরে এবং শহরাঞ্চলে উন্নত মানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার এই প্রকল্পে এবার অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে করা হলো ৬০০০ কোটি টাকারও কম। শিক্ষা খাতের জন্য যা ব্যয় বরাদ্দ হয়েছে তা গতবছরের তুলনায় কিছু বেশি হলেও মুদ্রাস্ফীতি যে হারে হয়েছে, ততা এই অকিঞ্চিৎকর বৃদ্ধি কে খেয়ে ফেলবে। তার উপর সরকারের বিশ্বাস শিক্ষার প্রসার হতে পারে ডিজিট্যাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে। তার জন্যই বাজেটের বরাদ্দ বেশি। অতিমারীর সংকট কালে শিক্ষা দানের যে ব্যবস্থা হয়েছিল তার হাত ধরেই দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডিজিট্যাল বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। এবছরের শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দ এবং ঘোষিত নীতি সেই বৈষম্য চিরস্থায়ী করে রাখবে।

শিক্ষা, কর্মসংস্থান, খাদ্য, রুজি রোজগার, এবং স্বাস্থ্যোজ্জ্বল পরমায়ু মানব সক্ষমতার ও জীবনযাপনের মৌল হাতিয়ার। এই মৌল ক্ষেত্রগুলিতে দেশের বিরাট অংশের মানুষের অধিকার ভয়ানক বিপন্ন হয়েছে শুধুমাত্র গত দুই বছর ব্যাপী অতিমারীর উপর্যুপরি আক্রমণের ফলে নয়। তার অনেক আগে থেকেই ভারতের অর্থনীতিতে ধীর গতির সূচনা হয়েছে। উৎপাদন আয় ক্রমশই নেমে আসছিল, বেকারি বাড়ছিল। অতিমারীর প্রাদুর্ভাবে সংকট অভূতপূর্ব আকারে দেখা দিল। জাতীয় উৎপাদন সংকুচিত হলো এক বছরে শতকরা ৬.৫ ভাগ, ১১ কোটি মানুষ কাজ হারালেন। ২০২২-২৩ অতিমারীর প্রলম্বিত ছায়া যখন দূরে সরে যায়নি, তখন প্রয়োজন ছিল কাজের সুযোগ তৈরি করা, খাদ্যের ভরতুকি অব্যাহত রেখে খাদ্য সরবরাহ সুনিশ্চিত করা, কৃষিকাজ লাভজনক করার ব্যবস্থা নেওয়া, শিক্ষাক্ষেত্রে ডিজিটাল বৈষম্য দূর করে যে বিপুল ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করতে শিক্ষায় সরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ সরকার ফেরি করেছেন করা এবং সব বয়সের মানুষের জন্য সরকারি উদ্যোগে প্রতিষেধক দেওয়ার ব্যবস্থা করে আধুনিক জনস্বাস্থ্য গড়ে তোলা। আশ্চর্যের কথা অর্থমন্ত্রী এই জরুরী কাজে হাত না দিয়ে বাজেটে শুনিয়েছেন পঁচিশ বছর পরের দূর ভবিষ্যতের কথা, ২০৪৭ সালের কথা, যখন দেশের স্বাধীনতার বয়স হবে একশো বছর। বলেছেন এক বায়বীয় প্রকল্প - 'প্রধানমন্ত্রী গতি-শক্তি প্রকল্পʼ-এর কথা যার মাধ্যমে ভারতের সব নদ নদী, রাজপথ, রেলপথ পরস্পর সংযুক্ত হয়ে এবং সাইবার ক্ষমতায় বলীয়ান ভারত সেদিন হয়ে উঠবে হাই স্পিড ডিজিট্যাল নয়া ভারতবর্ষ। যদিও পরিবেশবিদ ও নদী বিশেষজ্ঞরা শঙ্কিত হয়েছেন নদ-নদী- সংযুক্তি -র ভয়াবহ পরিণামের চিন্তা করে। বর্তমানের সব সমস্যাকে অক্ষত রেখেই বাজেটে এই সরকার ফেরি করেছেন সেই 'লং রান' এর স্বপ্ন যা শুনে কেইনসের সেই বিখ্যাত বিদ্রূপাত্মক উক্তি, 'ইন দ্য লং রান উই আর ডেডʼ।

ভাষান্তরে আমাদের কবির অমোঘ প্রশ্নেই ফিরতে পারি - সে 'পরবাসে রবে কে'?