আরেক রকম ● দশম বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২২ ● ১৬-৩০ ফাল্গুন, ১৪২৮

প্রবন্ধ

উক্রাইনে রাশিয়ার আগ্রাসনঃ একটি পর্যবেক্ষণ

রজত রায়


রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন উক্রাইনে সামরিক অভিযান শুরু করার পরেই যে বিবৃতি দিয়েছেন তা প্রণিধানযোগ্য। পুতিনের বক্তব্য, এটা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল রাশিয়ার নিজের মানুষদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে। এই নিজেদের মানুষ কারা?

স্তালিনের আমল থেকেই তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন তার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে রুশভাষাভাষীদের বসবাসের ব্যবস্থা করে এবং রুশ ভাষাকে সরকারি এবং ব্যবহারিক ভাষার স্বীকৃতি দিয়ে জোর করে রুশীকরণের কাজ শুরু করে। খ্রুশ্চেভ, ব্রেজনেভের আমল পর্যন্ত এই ব্যবস্থা বহাল ছিল উক্রাইন সহ বাল্টিক দেশগুলিতে এবং মধ্য এশিয়ার আজারবাইজান, কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান প্রভৃতি দেশে। ফলে, এই সব দেশেই সংখ্যালঘু হলেও জনসংখ্যার একাংশ রুশ জাতির মানুষ। উক্রাইনের রুশ সীমান্তবর্তী দনেৎস্ক (Donetsk) ও লুহানস্ক (Luhansk) প্রদেশে রুশীরা ২০১৪ সাল থেকেই নিজেদের উক্রাইন থেকে বিচ্ছিন্ন ও স্বাধীন ঘোষণা করে রাশিয়ান ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবি তুলছিল। রাশিয়া থেকে গোপনে সমরাস্ত্র, সামরিক প্রশিক্ষণ ও অর্থ সাহায্য পেয়ে তারা নানাভাবে উক্রাইন সরকারকে উত্যক্ত করে চলেছিল। গত ২১ ফেব্রুয়ারি পুতিনের সরকার তাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয় এবং এখন পুতিনের দাবি সেই রুশীদের নিরাপত্তা দিতেই এই সামরিক অভিযান শুরু হয়েছে। আরও একটি দেশ ক্রিমিয়া'কে রাশিয়া ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি দখল করে রুশ ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত করেছে। সেখানে নির্বাচিত সরকারকে সরাতে রুশ সেনারা আচমকা অভিযান চালিয়ে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ দখল করে, নিজেদের পেটোয়া কিছু লোককে দিয়ে একটা নির্বাচনের প্রহসন করে পুতুল সরকার গঠন করেছিল। একই সঙ্গে আরও একটি হাস্যকর কারণও পুতিন দিয়েছেন। তাঁর দাবি, উক্রাইনের বর্তমান সরকার নাৎসিদের নিয়ন্ত্রণে। তাই উক্রাইনকে নাৎসিদের হাত থেকে মুক্ত করতে, এবং তার সামরিক শক্তির বিলোপ ঘটাতে রুশ সেনাবাহিনী সে দেশে অভিযান শুরু করেছে।

কিন্তু পুতিন তাঁর দীর্ঘ ভাষণে আরও কিছু কথা বলেছেন যা হাল্কা ভাবে নেওয়ার উপায় নেই। তিনি রাশিয়ার মানচিত্র নতুন করে তৈরি করার কথা বলেছেন। এই মানচিত্র পুতিনের মতে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনস্থ এলাকা অনুযায়ী হতে হবে। এ থেকে বামপন্থী মনোভাবাপন্নদের উল্লসিত হওয়ার কোনও কারণ নেই, কারণ, পুতিনের ভাবনায় আবার কমিউনিস্ট শাসন ফিরিয়ে আনার কথা নেই। রয়েছে, জারের আমলের রুশ সাম্রাজ্যকে ফিরিয়ে আনার ভাবনা। স্তালিনের আমল থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নকে ফেডারেশন হিসাবে দেখিয়ে একের পর এক প্রতিবেশী দেশকে বলপ্রয়োগ করে তার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। বাল্টিক দেশ লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া ও লাতভিয়াকে এ ভাবেই ১৯৪০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গরাজ্য করা হয়েছিল। জার্মানির সঙ্গে রাশিয়ার ১৯৩৯ সালে অনাক্রমণ চুক্তি করার সময় চুক্তির অন্তর্গত গোপন বোঝাপড়া অনুযায়ী পোল্যান্ডকে হিটলার ও স্তালিন জোর করে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল। একই সময়ে ফিনল্যান্ডকে একতরফাভাবে আক্রমণ করে রাশিয়া সে দেশের কারেলিন প্রদেশের বেশ কিছুটা জায়গা দখল করে নেয়, যা আজও রাশিয় ছাড়েনি। আবার এখনকার বেলারুশের (অতীতের বাইলোরুশিয়া) মানচিত্রও বার বার বদলেছে, তবু মনে রাখতে হবে ১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার সময় যে চারটি দেশ অংশ নিয়েছিল, তার মধ্যে উক্রাইন ও বেলারুশও ছিল।

কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময়ে বেলারুশ, উক্রাইন প্রভৃতি দেশ স্বাধীন স্বত্তায় আত্মপ্রকাশ করে। একই সময় তিন বাল্টিক দেশ লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া ও লাতভিয়া স্বাধীন হয়। তার পরে ২০০৪ সালের মধ্যে তারা সবাই নেটো (NATO) জোটের সদস্য হয়ে যায়। বেলারুশ রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে থাকে আর উক্রাইন নেটোর সদস্য হতে চাইলেও বিষয়টি ঝুলে রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রায় সমসাময়িক কালেই পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক শিবিরও তাসের দেশের মতো ভেঙে পড়েছিল। এখন সেই দেশগুলিও (যেমন, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, রুমানিয়া, ক্রোয়েশিয়া (আগেকার যুগোশ্লাভিয়া ভেঙে জন্ম নেওয়া), চেক প্রজাতন্ত্র ও স্লোভেনিয়া (আগেকার চেকশ্লোভাকিয়া ভেঙে তৈরি), বুলগেরিয়া) নেটোর সদস্য। ফলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে স্তালিন, চার্চিল ও রুজভেল্টের মধ্যে আলোচনা অনুযায়ী পূর্ব ইউরোপে রাশিয়ার আধিপত্য স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল। তাই যখন রাশিয়ার রেড আর্মি একের পর এক দেশকে হিটলারের জার্মান সেনাবাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করার পরেই সেখানে রাশিয়ার অনুগত সরকার খাড়া করানো হয়েছিল। ঠাণ্ডা যুদ্ধের শুরুতেই রাশিয়ার প্রভাব বিস্তারকে রুখতে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি, গ্রেট ব্রিটেন, আমেরিকা ও কানাডা মিলে এই নেটো জোট তৈরি হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে একে একে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিও নেটোর ছত্রচ্ছায়ায় চলে এসেছে। বলা যায়, রাশিয়ার পশ্চিম সীমান্তের গায়েই এখন নেটো নিঃশ্বাস ফেলছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় নেটোর সদস্য রাষ্ট্র ছিল ১৬, যা বেড়ে এখন হয়েছে ৩০।

পুতিনের ভাবনার গভীরে রয়েছে শ্লাভ জাত্যাভিমানকে কেন্দ্র করে রাশিয়াকে আবার ইউরোপের প্রধান সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার বাসনা। তাই নেটো যে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি, এমনকি বাল্টিক দেশগুলিকে তাদের ছত্রচ্ছায়ায় আশ্রয় দিল, পুতিন সেটাকে অতীতের চুক্তিভঙ্গ করা হয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। বলছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের আমলের মানচিত্রে ফিরে যেতে হবে।

নেটো এ ভাবে ক্রমশই রাশিয়ার দোরগোড়ায় চলে এলেও উক্রাইন যেহেতু নেটো জোটের সদস্য নয়, তাই রাশিয়া অবলীলাক্রমে উক্রাইনে আক্রমণ করার সাহস দেখাতে পেরেছে। পুতিনের হিসাবে পশ্চিমী দুনিয়া কিছু তর্জন গর্জন, কিছু অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ চাপানো ছাড়া আর কিছুই করবে না। তার এই হিসাবের কারণ, ২০১৪ সালে পুতিন যখন জোর করে ক্রিমিয়া দখল করে রুশ ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত করে, তখনও নেটো ও পশ্চিমী দুনিয়া বিশেষ কিছু করেনি। এবারও নেটো কর্তারা এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে তাঁরা রুশ সেনার আক্রমণের বিরুদ্ধে উক্রাইনের পাশে দাঁড়াতে সেনাবাহিনী পাঠানোর কথা ভাবছেনই না।

ইতিহাস কখনও কখনও পুনরাবৃত্তি ঘটায় বৈকি। তবে কখনই তা হুবহু একইরকম ভাবে ফিরে আসে না, ১৮৫২ সালে কার্ল মার্কস তাঁর The Eighteenth Brumaire of Luis Bonaparte বইয়ে এই প্রসঙ্গে যা বলেছিলেন, বাংলায় তার সংক্ষিপ্ত ভাবানুবাদ করলে যা দাঁড়ায় তা হল, ইতিহাস কখনই পুনরাবৃত্তি ঘটায় না। প্রথম বার যদি ট্র্যাজেডির আকারে আসে, তা হলে পরের বার প্রহসনের চেহারা নেয়। উক্রাইনে রাশিয়ার এই সদ্য শুরু হওয়া সামরিক আক্রমণের প্রেক্ষিতে কথাটা আবারও মনে পড়তে বাধ্য।

Lebensraum বলে জার্মান ভাষায় একটা কথা আছে, যার অর্থ, জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জমিজায়গা। Mein Kamph বইয়ে হিটলার কথাটার প্রয়োগ করে বৃহত্তর জার্মানির জন্য প্রতিবেশী দেশগুলি, বিশেষ করে যে সব দেশে জার্মান জনগোষ্ঠীর মানুষজন উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বাস করত, সেই দেশগুলি জার্মানিতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলতে শুরু করে। সে জন্য ১৯৩৮ সালে চেকশ্লোভাকিয়ার সুদেতানল্যান্ড অংশটি দাবি করে। হিটলারের এই আগ্রাসী চেহারা দেখে শঙ্কিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেন ছুটে যান জার্মানিতে। তারপর সে বছরই ৩০ সেপ্টেম্বর মিউনিখ চুক্তিতে সই করে চেম্বারলেন, ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী দালাদিয়ের জার্মানির হাতে সুদেতানল্যাণ্ড ছেড়ে দিতে চেকশ্লোভাকিয়াকে বাধ্য করেন। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ধারণা ছিল, সুদেতানল্যাণ্ড পেয়ে হিটলার শান্ত হবে। কিন্তু পরের বছরই মার্চে হিটলার চেকশ্লোভাকিয়ার বাকি অংশটাও দখল করে নেয়। তার পর কী করে একে একে হিটলার অর্ধেক ইউরোপ দখল করে বসে, তা এখন ইতিহাস।

২০১৪ সালে ক্রিমিয়া যখন রাশিয়া দখল করে তখন এবং পরে উক্রাইনের দনবাস ও লুহানস্ক এলাকার দিকে নজর দেওয়ার সময়েও পুতিন হিটলারের মতোই নিজের মানুষদের জন্য জমিজায়গা (দেশ) নিশ্চিত করার যুক্তি দিচ্ছিল। হিটলারকে নিরস্ত করতে চেম্বারলেন, দালাদিয়েররা ছুটেছিলেন মিউনিখে। এবার পুতিনকে কিছুটা নিরস্ত করতে বেলারুশের রাজধানী মিনস্ক শহরে দুই দফায় চুক্তি হয়। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয় দফার চুক্তির সময় পুতিন ও উক্রাইনের তদানীন্তন রাষ্ট্রপ্রধান ছাড়াও Organisation for Security and Cooperation in Europe (OSCE) এর তরফে জার্মান চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল ও ফরাসী প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোঁয়া অঁল্যান্দ, উপস্থিত ছিলেন। কিন্ত চুক্তিতে উক্রাইনের এলাকার উপর সে দেশের সরকারের সার্বভৌমত্বের কথা স্বীকার করে সবরকম সংঘর্ষ বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলা হলেও কার্যত কিছুই মানা হয়নি। পুতিন তো মিনস্ক চুক্তিকে গুরুত্বই দিতে রাজি নন। গত আট বছরে উক্রাইনে রুশ মদতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সক্রিয়তা অনেক বেড়েছে। তারা নিজেদের স্বাধীন বলে দাবি করেছে। পশ্চিমী দুনিয়া কিন্তু নীরবই থাকল, যতদিন না রাশিয়ার সেনাবাহিনী উক্রাইনে সার্বিক আক্রমণ শুরু না করে। রাষ্ট্রপুঞ্জও বিশেষ নড়াচড়া করছে না। আমেরিকা সহ নেটো নেতৃত্ব জানিয়ে দিয়েছে, উক্রাইন নয়, তারা পূর্ব ইউরোপের নেটো সদস্য দেশগুলির নিরাপত্তার জন্য জরুরি ভিত্তিতে সেনা নামাচ্ছে।

অথচ, ১৯৯০ সালের অগস্টে সাদ্দাম হুসেনের ইরাক যখন আচমকাই কুয়েত দখল করে নেয়, তখন রাষ্ট্রপুঞ্জ ও পশ্চিমী দুনিয়ার অতিসক্রিয়তা ছিল দেখার মতো। সাদ্দাম হুসেনেরও যুক্তি ছিল, কুয়েত ঐতিহাসিকভাবে ইরাকেরই অঙ্গ, ইরাকের উনিশতম প্রদেশ। কুয়েত যদিও নেটোর সদস্য ছিল না, তবুও আমেরিকা এবং নেটোর ইউরোপীয় সদস্যরা "নৈতিক কারণ" দেখিয়ে ইরাকে বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। রাষ্ট্রপুঞ্জের পতাকার তলায় আমেরিকার নেতৃত্বে বহুরাষ্ট্রীয় সেই সামরিক অভিযান অচিরেই কুয়েতকে ইরাকের দখলমুক্ত করেছিল।

কেন কুয়েতকে বাঁচাতে পশ্চিমী দুনিয়া যুদ্ধ করতে এগিয়ে আসতে পারে, আর উক্রাইনের জন্য পারে না? কারণটা সহজবোধ্য। সোভিয়েত ইউনিয়ন ধ্বংস হলেও রাশিয়ার সামরিক শক্তি এখনও বিশাল। তার চাইতেও জরুরি কথা হল, রাশিয়া পরমাণু অস্ত্রে বলীয়ান। যুদ্ধের কদিন আগেই রাশিয়া পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের মহড়া দিয়েছে। উক্রাইনে আক্রমণ শুরুর পরেই পুতিন হুঁশিয়ারি দিয়েছে, যদি অন্য কোনও বহিরাগত শক্তি উক্রাইনে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করে, তাহলে রাশিয়া এমন শাস্তি দেবে যা কোনও দিন ভুলতে পারবে না। অর্থাৎ, স্পষ্ট করে না বললেও হুমকির ইঙ্গিত কোন দিকে তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

অন্য দিকটা হল, পশ্চিমী দুনিয়ার দ্বিচারিতা। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে রাশিয়ার পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ছিল উক্রাইন। ভৌগলিক দিক থেকে রাশিয়ার পশ্চিমে অবস্থান হওয়ার কারণে রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ তেল ইউরোপে পৌঁছনোর পাইপলাইন উক্রাইনের ভিতর দিয়ে গেছে। ১৯৯১ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়, তখন উক্রাইনে আগে থেকে রাখা বিপুল পরমাণু অস্ত্র ভাণ্ডার নিয়ে কী করা যায়, তা নিয়ে রাশিয়া এবং পশ্চিমী দুনিয়া প্রচুর চিন্তিত ছিল। সোভিয়েত আমলে পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকার বিরুদ্ধে ব্যবহারের সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে উক্রাইনে বেশ কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি বসানো হয়েছিল। তার মধ্যে অনেকগুলিই ছিল পরমাণু বোমাবাহী আই সি বি এম বা আন্তর্মহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র। সেই সময় বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম (আমেরিকা ও রাশিয়ার পরেই) পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডার ছিল উক্রাইনে। এছাড়া প্রতিবেশী বেলারুশ এবং মধ্য এশিয়ার কাজাখস্তানেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পরমাণু আস্ত্র ছিল। তবে ওই সব পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করার চাবিকাঠি রাশিয়ার হাতেই ছিল। তাই ওই সব পরমাণু অস্ত্র নিজেদের কাছে রেখে দিয়ে ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে বেশ কয়েক বছরের প্রচেষ্টা ও অর্থবরাদ্দ দরকার ছিল। এই অবস্থায় বেশ কিছু দিন চাপ দেওয়ার পরে উক্রাইন, বেলারুশ ও কাজাখস্তান যাবতীয় পরমাণু অস্ত্র ভাণ্ডার নষ্ট করতে বা রাশিয়ার হাতে তুলে দিতে রাজি হয় এবং নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিতে সই করতে রাজি হয়। বিনিময়ে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য কিছু সহজ শর্তে ঋণ ও সাহায্য পায়। এ জন্য হাঙ্গেরির বুদাপেস্তে ১৯৯৪ সালের ৫ ডিসেম্বর আমেরিকা, রাশিয়া ও ব্রিটেনের সঙ্গে উক্রাইন, কাজাখস্তান ও বেলারুশের মধ্যে এক চুক্তি হয়। তাতে উক্রাইন, বেলারুশ ও কাজাখস্তানকে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিভুক্ত দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে এই তিন দেশকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য এক গুচ্ছ ধারায় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। তাতে উক্রাইন সহ এই তিন দেশকে আক্রমণ করা থেকে সবাইকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। এটাও বলা হয়েছে, কোনো অর্থনৈতিক অবরোধ জাতীয় আক্রমণও করা চলবে না। তা সত্ত্বেও যদি কোনও দেশ আক্রমণ করে তাহলে অবিলম্বে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে গিয়ে তাদের হস্তক্ষেপ চাইতে হবে।

রাষ্ট্রপুঞ্জের Charter-এর Chapter VII. Art. 42-তে স্পষ্ট বলা হয়েছে, যদি কথায় এবং অন্যান্য ব্যবস্থায় কাজ না হয় তা হলে আক্রমণকারী শক্তি বা দেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপুঞ্জ সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতেই পারে। এই ধারা অনুযায়ীই ১৯৯০-৯১ সালে কুয়েতকে মুক্ত করতে ইরাকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপুঞ্জের পতাকা নিয়ে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ হয়েছিল। রাষ্ট্রপুঞ্জের চার্টারের ওই ধারাতেই আমেরিকা ২০০৩ সালে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে চেয়েছিল। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিনী প্রস্তাব পাস না হওয়ায় মার্কিনী সেনাবাহিনীকে আমেরিকার পতাকা নিয়েই ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়। কিন্তু সেটা ছিল ইরাক গোপনে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র এবং রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি ও মজুত করছে বলে আমেরিকা যুদ্ধের অজুহাত দিচ্ছিল, যা উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে অনেকেই গ্রহণ করেনি। এবার তো রাষ্ট্রপুঞ্জে কোনও প্রস্তাব পাস করানোই অসম্ভব। কারণ, নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্যের মধ্যে রাশিয়া আছে, সঙ্গে আছে চিন। বাকি তিন স্থায়ী সদস্য ফ্রান্স, ব্রিটেন ও আমেরিকার মতোই রাশিয়া ও চিনের হাতেও 'ভেটো' দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। তাই নিরাপত্তা পরিষদের মোট ১৫টি দেশের (অর্থাৎ, সাধারণ পরিষদের সদস্য দেশগুলি থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ১০টি দেশকে নিরপত্তা পরিষদে নেওয়া হয়।) সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ উক্রাইনে রাশিয়ার আক্রমণের বিরুদ্ধে কোনও প্রস্তাব নিতে চাইলেও রাশিয়া বা চিনের ভেটো প্রয়োগে তা তৎক্ষণাৎ নাকচ হতে বাধ্য। বাস্তবেও তাই হয়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাব রাশিয়া ভেটো দিয়ে বাতিল করে দিয়েছে। ভারত,চিন ও সংযুক্ত আরব আমীরশাহি (UAE) ভোটাভুটির সময় ভোট না দিয়ে কক্ষত্যাগ করে।

এই অবস্থায় রাশিয়ার আক্রমণের বিরুদ্ধে উক্রাইন কার্যতই একা লড়ছে। উক্রাইনের প্রেসিডেন্ট, প্রতিরক্ষামন্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ বলে চলেছে যে রাষ্ট্রপুঞ্জ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে সব ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছে, তা মোটেই যথেষ্ট নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ও আমেরিকার অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও স্বীকার করছেন যে এই সব ব্যবস্থায় রাশিয়া আর্থিক দিক থেকে চাপে পড়বে ঠিকই, তবে এখনই নয়, অনেক সময় লাগবে। আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটেন, কানাডা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া একযোগে রাশিয়ার প্রচুর ধনসম্পত্তি (যা রাশিয়ার বাইরে প্রধানত পশ্চিমী দুনিয়ায় গচ্ছিত) বাজেয়াপ্ত বা আটক করেদেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া এমন অনেক সব প্রযুক্তি পশ্চিমী দুনিয়া থেকে রাশিয়াতে নিয়ে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে যা প্রতিরক্ষা শিল্পের ক্ষেত্রে অতিপ্রয়োজনীয়। কিন্তু লক্ষণীয়, রাশিয়া থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ তেল ইউরোপে রফতানির উপর কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়নি। কারণ, জার্মানি, ইতালি সহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি সদস্য রাষ্ট্র রাশিয়া থেকে আনা জ্বালানির উপর একান্তই নির্ভরশীল। সেই কারণেই Society for Worldwide Interbank Financial Telecommunications (SWIFT) থেকে রাশিয়াকে বহিষ্কার করার প্রস্তাব এনেও প্রাথমিক পর্যায়ে ইউরোপ আমেরিকা একমত হতে পারছিল না। কারণ, রাশিয়াকে SWIFT থেকে বার করে তার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে পঙ্গু করার চেষ্টা হলে প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ তেলের দাম না মেটাতে (যার জন্য SWIFT দরকার) পেরে জার্মানির মতো দেশও জ্বালানির অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা। শেষ পর্যন্ত অবিশ্যি রাশিয়াকে SWIFT থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। অনেকে এটাও মনে করছে যে রাশিয়া এই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে অনেক দিন ধরেই প্রস্তুত হয়েছে। এজন্য তার বিশেষ মজুত অর্থভাণ্ডার ৬০০০০ কেটি ডলারেরও বেশি। তা ছাড়া চিন এই SWIFT-এর একটা সমান্তরাল ব্যবস্থা তৈরি করতে সচেষ্ট অনেক দিন ধরে। ফলে, আন্তর্জতিক দুনিয়ায় কোনঠাসা করার চেষ্টা হলেও চিনের হাত ধরেই রাশিয়া বেরিয়ে আসতে পারে।

কিন্তু সে সব তো ভবিষ্যতের কথা। এই মুহুর্তে সবার নজর উক্রাইনের দিকে। উক্রাইন কি পারবে রুশ সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে? ২০১৪ সালে রাশিয়া সেনা পাঠিয়ে ক্রিমিয়া দখল করার পর থেকেই পশ্চিমী দুনিয়ার সাহায্য নিয়ে উক্রাইনের সেনাবাহিনীকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। তাদের আধুনিক সমরাস্ত্র রয়েছে, উন্নত প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। রাজধানী কিয়েভ এবং আরও কিছু এলাকায় রুশসেনাদের বিরুদ্ধে তারা কিছুটা প্রতিরোধও গড়ে চলেছে। কিন্তু উক্রাইন কী আর একটা আফগানিস্থান হতে পারবে? ইতিহাস বলে আফগানরা প্রথমে ব্রিটিশদের ঠেঙ্গিয়েছে, তারপরে রুশদের, এবং অধুনা মার্কিনীদেরও। কিন্তু সে জন্য তাদের স্বাধীনচেতা মনোভাব, যুদ্ধ করার ক্ষমতা ছাড়াও গেরিলা যুদ্ধ চালানোর জন্য আফগানিস্থানের অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ তাদের সাহায্য করেছিল। আফগানিস্থানের পার্বত্য পরিবেশ, অপ্রতুল যোগাযোগব্যবস্থার তুলনায় উক্রাইনে অনেকটাই সমতলভূমি বা স্তেপ, এছাড়া উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও রয়েছে। আর বেলারুশ রাশিয়ার অনুগত থাকায় রাশিয়া তিন দিক দিয়েই উক্রাইন আক্রমণ করতে পারছে। তাই বিদেশি শক্তি সক্রিয় সহযোগিতা না করলে উক্রাইনের একার পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলা বা দীর্ঘস্থায়ীভাবে চালিয়ে যাওয়া কঠিন। তাই এখনই উক্রাইন থেকে দাবি উঠছে যে নেটো এবং পশ্চিমী দুনিয়া অন্তত উক্রাইনের আকাশকে no fly zone বলে ঘোষণা করুক, যেমনটা কুয়েত যুদ্ধের পরে বহুদিন ইরাকের উপর চাপিয়ে রেখেছিল। মুশকিল হল, পরমাণু অস্ত্রহীন ইরাকের বিরুদ্ধে যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা পরমাণু অস্ত্রে সজ্জিত রাশিয়ার বিরুদ্ধে নেওয়া অসম্ভব। রাশিয়া তো দূরস্থান, উত্তর কোরিয়ার মতো দেশের বিরুদ্ধেও বেশি কিছু করা যাচ্ছে না এই কারণেই। তাদের হাতেও পরমাণু অস্ত্র এবং তা বহন করে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেপণাস্ত্র আছে। শক্তির ভারসাম্য এভাবেই বজায় থাকলে পুতিন উক্রাইনের পরে পুরনো সোভিয়েত ইউনিয়নের মানচিত্র অনুযায়ী বর্তমান রাশিয়ার মানচিত্র গড়ার চেষ্টায় আরও কিছু অ্যাডভেঞ্চার করতে এগিয়ে গেলেও বিস্ময়ের কিছু নেই।

কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে রাশিয়া উক্রাইন দখল করে পুরোপুরি রাশিয়ার সীমান্তের মধ্যে ঢুকিয়ে নেবে। বরং উক্রাইনকে আর একটা বেলারুশ বানাতে পারলে তার স্বার্থ সিদ্ধ হয়। বেলারুশের স্বৈরতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট আলেকজান্দার লুকাশেঙ্কো ১৯৯৪ থেকে সে দেশের ক্ষমতায় রয়েছেন। বাস্তব পরিস্থিতি হল, রাশিয়ার প্রত্যক্ষ মদতে তিনি জোর করে সে দেশের ক্ষমতা ভোগ করছেন আর বিনিময়ে রাশিয়ার হয়ে কাজ করছেন। এখন যেমন রুশী সেনাবাহিনী রাশিয়া ছাড়াও বেলারুশ এবং ২০১৪ সালে দখল করা ক্রিমিয়া থেকে উক্রাইনে ঢুকছে। উক্রাইনেও বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজের পছন্দমত একটা পুতুল সরকার বসিয়ে বকলমে সে দেশ শাসন করাটা রাশিয়ার পছন্দের হবে।

তবুও পুতিনের যুদ্ধাভিযানের বিরুদ্ধে রাশিয়ার মানুষের মধ্যেই প্রতিবাদের স্বর ক্রমশ জোরালো হতে থাকায় একটা ক্ষীণ হলেও আশার আলো দেখা যাচ্ছে। মস্কো, সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে শুরু করে রাশিয়ার প্রত্যন্ত এলাকায় সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করার দাবিতে সরব। অন্তত ৫০টি শহরে রুশীরা বিক্ষোভ দেখাতে রাস্তায় নেমে এসেছেন। অতীতে ইরাক যুদ্ধের সময় লন্ডনে ও ইউরোপের বিভিন্ন শহরে বিশাল যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ দেখা গিয়েছে। তাতে যুদ্ধ বন্ধ হয়নি। কিন্তু ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকার বুকেই যখন মানুষ যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন শুরু করে, তখন তা মার্কিন প্রশাসনকে যথেষ্ট চাপে ফেলে দেয়। রাশিয়ায় পুতিন যেহেতু দীর্ঘদিন ধরেই স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চালাচ্ছেন, তাই সেখানে প্রকাশ্যে পুতিন বিরোধী বিক্ষোভ সংগঠিত করা সহজ নয়। দ্য গার্ডিয়ানের খবর, শুধু গত বৃহস্পতিবারই (২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২) ১৮০০ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও যে ভাবে মানুষ সরব হচ্ছেন, তা আশাব্যঞ্জক। ২০২১ সালে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভ মস্কোর নভোয়া গেজেতা সংবাদপত্রের সম্পাদক, তিনি তাঁর দেশের মানুষের এই যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ দেখে আশাবাদী। নিজের সংবাদপত্র নভোয়া গেজেতা এতদিন শুধুই রুশী ভাষায় প্রকাশিত হলেও যু্দ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এবার তিনি রুশী ও উক্রাইন, এই দুই ভাষার সংস্করণ বার করছেন। পুতিনের প্রশাসন ইতিমধ্যেই রুশী সংবাদমাধ্যমের উপর কড়া সেন্সরপ্রথা চালু করেছে। বলা হয়েছে, 'আক্রমণ' ও 'হামলা' জাতীয় শব্দ সংবাদ পরিবেশনের সময় ব্যবহার করা যাবে না। মুরাতভ বলেছেন, তিনি এই নির্দেশ মানবেন না।

বরিস ইয়েলৎসিনের কন্যা তাতিয়ানা ইয়ুমাশেভা, ক্রেমলিন মুখপাত্র দমিত্রি পেশকভের কন্যা লিজা, রাশিয়ার অন্যতম ধনী ব্যবসায়ী রোমান আব্রামোভিচের পরিবারের সদস্যরাও প্রকাশ্যেই প্রতিবাদে সরব। প্রবীন সাংবাদিক এলেনা চেরনেঙ্কো একটা প্রতিবাদ পত্র লিখেছেন, যাতে ইতিমধ্যেই ৩০০ এর বেশি সাংবাদিক সই করেছেন। এঁদের মধ্যে বেশ ক'জন সরকারি সংবাদমাধ্যমে কর্মরত হওয়া সত্ত্বেও। একাধিক পপ স্টার তাঁদের অনুষ্ঠান বাতিল করেছেন প্রতিবাদ জানাতে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চলা থিয়েটার চর্চার কেন্দ্র মায়ারহোল্ড সেন্টারের ডিরেক্টর এলেনা কোভালস্কায়া একই কারণে তাঁর চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। কিন্তু রুশী বুদ্ধিজীবিদের অনেকেই মনে করছেন, আরও বেশি বেশি করে মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার না হলে পুতিনের যুদ্ধ থামানো যাবে না।

উক্রাইনের উপর রুশ হামলা ভারতকে মহা সমস্যায় ফেলেছে। কারণ, দীর্ঘদিন ধরেই সামরিক সরঞ্জাম, যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র ইত্যাদির জন্য রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল ভারত। এখন যে হারে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বাড়ছে, তাতে ভারতের সে সব সমরাস্ত্র পেতে সমস্যা হতে পারে। একই ভাবে রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ তেলের যোগান আন্তর্জাতিক বাজারে কমে এলে তেলের দাম লাগামছাড়া হয়ে ভারতের অর্থনীতিতে বিরাট সঙ্কট আনতে পারে। আর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চিনের বৃহত্তর ভূমিকা উত্তরোত্তর গুরুত্ব পেয়ে বাড়তি উদ্বেগের কারণ হতে পারে। মনে রাখতে হবে, চিন এখন প্রকাশ্যেই রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে। নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে রাশিয়া থেকে গম কিনছে। মনে করা হচ্ছে, ব্যাঙ্ক লেনদেনের উপর পশ্চিমী নিষেধাজ্ঞা এডাতে চিন রাশিয়ার ত্রাতা হয়ে উঠতে পারে। আর রাশিয়ার কাছে চিনের গুরুত্ব বেড়ে চলা মানে এশিয়ায় চিনকে কোনঠাসা করা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। আফগানিস্থান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পরে যে মার্কিন সেনা সহজে ইউরোপের বুকে রক্ত ঝরাতে আসবে না, এই সহজ সত্যটা বুঝেই পুতিন উক্রাইনে হাত বাড়িয়েছে। এবার চিনও যদি তাইওয়ানের দিকে হাত বাড়ায় তাহলে তাকে কে ঠেকাবে? তারপরে ভারত-চিন সীমান্তে চিন যদি আরও পেশি প্রদর্শণ করতে শুরু করে? সেটা ভারতকে এখন থেকেই ভাবাতে শুরু করেছে। এই অবস্থায় রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে চিনের মতোই ভারতও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট না দিয়ে বিরত থেকেছে ঠিকই, কিন্ত তাতে ইউরোপ আমেরিকার খুশি হওয়ার কারণ নেই। আবার চিন ও ভারতের মধ্যে কাকে রাশিয়া এই মুহুর্তে সবচেয়ে বেশি কাছে টানবে, তা বোঝা কঠিন নয়।