আরেক রকম ● দশম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ● ১-১৫ ফাল্গুন, ১৪২৮

প্রবন্ধ

শতবর্ষে সত্যজিৎ - সেলাম তোমারে সেলাম

অম্বিকেশ মহাপাত্র


মেদহীন উচ্চশির শরীরের অধিকারী, বাংলা তথা বাঙালির গর্ব সত্যজিৎ বেঁচে থাকলে শতবর্ষের সীমা ২রা মে, ২০২১ পেরিয়ে আসতেন। কিন্তু ৭১ বছরের সীমা পেরোনোর ৯ দিন আগে (২৩শে এপ্রিল, ১৯৯২) সত্যজিৎ চিরদিনের জন্যে আমাদের সকলকে ছেড়ে চলে গেছেন। ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৩, সত্যজিতের বাবা সুকুমার রায় যখন ৩৪ বছর ১০ মাস ১০ দিন বয়সে অকালে চিরদিনের জন্যে চোখ বুজলেন তখন সত্যজিতের বয়স মাত্র ২ বছর ৪ মাস ৮ দিন। কিছুদিনের মধ্যে সত্যজিতের পারিবারিক ব্যবসা উঠে গেল। কলকাতার গড়পারের পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হল দক্ষিণ কলকাতায়। এই অবস্থায় মা সুপ্রভা রায়ের বিশেষ লড়াই শুরু। এমব্রয়েডরি করে, ভোর থেকে রাত পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করে, সত্যজিৎকে ভালো ইস্কুল (বালিগঞ্জ গভঃ স্কুল), ভালো কলেজে (প্রেসিডন্সি কলেজ) পড়ালেন। মায়ের অবদানে ১৪ বছর বয়সে সত্যজিতের ম্যাট্রিক পাস। পরে প্রেসিডেন্সি থেকে অর্থনীতিতে বিএ পাস। তৎপর বিশ্বভারতী যাত্রা। এমএ পড়তে। ফিরে আবার কলকাতায়। সুকুমার রায়ের ছেলে বলে কথা, জানতে পেরে বিজ্ঞাপন দুনিয়ার মহীরূহ দিলীপ গুপ্ত সত্যজিতকে নিয়ে গেলেন ডি জে কিমার কোম্পানীতে। সত্যজিতের যোগদান জুনিয়ার ভিসুয়ালাইজার পদে, মাস মাহিনা ৮০ টাকা। পাঁচ বছর পরে আর্ট ডিরেক্টর, মাস মাহিনা বেড়ে দু’ হাজার টাকা। যদিও বিজ্ঞাপন জগতেই সত্যজিতের খ্যাতির গোড়াপত্তন, কিন্তু সত্যজিৎ ঐ কাজে অখুশি। তার সঙ্গে নিজের কাজের প্রতি ক্লান্তি এবং বিতৃষ্ণা জাগছিল। প্রত্যেকটা ক্লায়েন্টকে খুশি করার কাজ ভালো লাগছিল না। সত্যজিতের কথায় - "অনেক খেটেখুটে হয়তো একটা ভালো কাজ করলাম, কিন্তু অবুঝ ক্লায়েন্ট এক কথায় তা নাকচ করে দিলেন!" তারপর সত্যজিতের মোক্ষম উক্তি - "মনের মধ্যে তখন স্বাধীন হওয়ার প্রবল ইচ্ছে। আমার এমন কোনো কাজ চাই যেখানে আমি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারি; অর্থাৎ আমিই সর্বেসর্বা হব।"

এই ভাবনা ও স্বপ্নকে সফল করতে ৫ বছর বাদে বিজ্ঞাপন সংস্থার দু’ হাজার টাকার চাকুরিতে ইস্তফা। সিদ্ধান্ত নিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ অবলম্বনে চলচ্চিত্র তৈরি করবেন। টাকা আসবে কোথা থেকে? স্ত্রী বিজয়া গয়না বিক্রি করলেন। তাতে উৎসাহ সৃষ্টি হল বটে, কিন্তু তা দিয়ে কি একটি চলচ্চিত্র বানানো সম্ভব? না, সম্ভব নয়। শেষমেশ শ্রীমতী বেলা সেন নামে এক সহৃদয়ার সহায়তায় সত্যজিৎ মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়ের কাছে পৌঁছলেন। সরকার দায়িত্ব নিলেন চলচ্চিত্র প্রযোজনার। তৈরি হল সত্যজিতের প্রথম কাহিনি চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’। দাম্পত্য জীবনের ছ’ বছরের মাথায়, সত্যজিতের ৩৪ বছর বয়সে, ১৯৫৫ সালে ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পেল। প্রথম চলচ্চিত্রই বিশ্ববন্দিত! বিশ্বের চলচ্চিত্রমোদী জনগণ বাংলার বাঙালি জহুরী সত্যজিতকে চিনলেন। ‘পথের পাঁচালী’ সত্যজিতকে ১১টি আন্তর্জাতিক মানের পুরস্কার এনে দিল। তার সঙ্গে বিশ্বখ্যাতি। এরপর সত্যজিতকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। স্বাধীনচেতা সত্যজিৎ স্বাধীনভাবে একের পর এক চলচ্চিত্র বিশ্বের চলচ্চিত্রমোদী জনগণের জন্য নির্মাণ করলেন। এই পথে ৩৬ বছরে ৩৬টি চলচ্চিত্র বিশ্ববাসীকে উপহার দিলেন। এর মধ্যে ২৯টি পূর্ণ-দৈর্ঘ্যের কাহিনি চলচ্চিত্র, ৫টি তথ্য চলচ্চিত্র এবং ২টি স্বল্প-দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র। যার শুরু হয়েছিল ‘পথের পাঁচালী’ দিয়ে, তা এসে থামল ‘আগন্তুক’-এ।

চলচ্চিত্র জগতের সবরকমের পুরস্কার; সোনালি পদ্ম, সোনালি ভল্লুক, সোনালি সিংহ, পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ, দাদা সাহেব ফালকে, অস্কার, ভারতরত্ন, ডক্টরেট, ... সত্যজিৎ অর্জন করেছেন। সে’টা একটা বড় বিষয় নয়। বড় বিষয়, সত্যজিৎ বিশ্বের চলচ্চিত্রমোদী জনগণের শুধু মন জয় করেননি, বাংলা তথা বাঙালিকে এবং মায়ের ভাষা বাংলাকে জগৎসভায় স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যার জন্য আমরা সকল বাঙালি বিশেষ গর্ববোধ করতে পারি। একবার ভাবুন তো, সত্যজিতের কলকাতা মহানগরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা; কখনও তেমন করে গ্রামীণ জীবন প্রত্যক্ষ করেননি। কিন্তু প্রথম চলচ্চিত্র এবং ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কারজয়ী ‘পথের পাঁচালী’-তে গ্রামীণ জীবন এবং তার পরিবেশের এতো নিখুঁত চিত্রবর্ণনা, কি করে মুভি ক্যামেরা সহ সেলুলয়েডে বন্দি করলেন? এ এক অপার বিস্ময়! সত্যজিৎ নিজের সৃষ্টিতে আন্তরিক এবং বাস্তববাদী না হলে, সর্বোপরি জিনিয়াস না হলে, কখনওই তা সম্ভবপর হ’ত না। আমরা মনে করি, সত্যজিৎ কেবলমাত্র বিশ্ববরেণ্য চকচ্চিত্রকার। শুধু কি তাই? না, তা নয়। একজন লেখক, একজন কবি, একজন চিত্রশিল্পী, একজন সঙ্গীতস্রষ্টা, একজন রসিকশ্রেষ্ঠ, একজন মুভি ক্যামেরম্যান, একজন দার্শনিক, একজন বিপ্লবী, একজন বিজ্ঞাপন দুনিয়ার দিকপাল; সকলই একসাথে একপাত্রে গুলতে পারলে, যা পাওয়া যেতে পারে, তার নাম হতে পারে সত্যজিৎ অর্থাৎ সত্যজিৎ রায়।

বাবা সুকুমার রায়ের অকাল মৃত্যুর পর, সত্যজিতের ২ বছর ৪ মাস ৮ দিন বয়স থেকে একমাত্র অভিভাবক মা সুপ্রভা রায়। সত্যজিতের জীবনে সেকারণে মা এবং মায়ের ভাষা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। সত্যজিত তাঁর মায়ের প্রসঙ্গে বলেছেন - "মাকে এত কাছ থেকে দেখেছি, কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি আমার জন্য তিনি কী করেছেন। ...অবিশ্বাস্য মনে হয়। মায়ের জীবনটা স্ট্রাগলে ভরা। আমাদের ব্যবসা উঠে গেল। পৈতৃক বাড়ি ছাড়তে হল। কিছুই নেই। ...এমব্রয়ডরি করে, আমাকে খাইয়ে ইস্কুলে পাঠিয়ে মানুষ করার জন্য মা ভোর থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করতেন। আমার মায়ের গুণের কোন শেষ নেই। ...এত অভাবের মধ্যেও মা আমাকে ভালো ইস্কুলে, ভালো কলেজে পড়িয়েছেন। মাত্র ১৪ বছরে যে ম্যাট্রিক পাস করি সেও মায়ের জন্যে। তার আগে মা নিজে আমাকে পড়িয়েছেন। তাঁর ত্যাগটা যে কত বড় ব্যাপার তখন বুঝিনি, এখন বুঝি।"

প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

সত্যজিতের পূর্ণ-দৈর্ঘ্যের শেষ কাহিনি চলচ্চিত্র ‘আগন্তুক’ (International release title ‘The Stanger’) ১৯৯১ সালে মুক্তি পায়। তার পরের বছর সত্যজিতের জীবনদীপ নিভে যায়। ‘আগন্তুক’-এর কাহিনি ও চিত্রনাট্য সত্যজিতের নিজের। সত্যজিৎ ৩৪ বছর বয়সে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন ‘পথের পাঁচালী’। তার ৩৬ বছর পর ৭০ বছরের পরিণত বয়সে নিজের কাহিনি দিয়েই শেষ কাহিনি চলচ্চিত্র ‘আগন্তুক’ আমাদের জন্য রেখে গেছেন। সমাজের নানান অংশের মানুষের নানান প্রশ্ন সামনে এনে, তার উত্তর সত্যজিৎ ‘আগন্তুক’ চরিত্রের মাধ্যমে দিয়ে গেছেন। আমার বিশ্বাস মানবদরদি সত্যজিৎ সারা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে যে সকল নুড়ি পাথর কুড়িয়ে ছিলেন, যা তিনি বিশ্বাস করতেন, সকলই ‘আগন্তুক’-এর মুখ দিয়ে নিজের কথাই বলেছেন। আমাদের জন্য রেখে গেছেন অনেক মণি-মানিক্য। আমরা যখন ধান্ধার পুঁজিতন্ত্রে, তখন সত্যজিৎ ভীষণই প্রাসঙ্গিক।

সেই ‘আগন্তুক’ চিত্রনাট্যে কথিত বিভিন্ন প্রসঙ্গের মধ্যে কয়েকটি শুনি এবং অনুধাবন করার চেষ্টা করি -
কলকাতার অত্যন্ত ধনী পরিবারের সন্তান, অত্যন্ত মেধাবী, ঠাকুমা’র অত্যন্ত স্নেহের মনমোহন মিত্র বিএ পাস করবার পর হঠাৎ বাড়ি থেকে উধাও, বেপাত্তা। গৃহত্যাগের সময় মনমোহনের দিদি-কন্যা তথা ভাগ্নি তখন শিশু, বয়স মাত্র দু’ বছর। ৩৫ বছর বিভিন্ন দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়েছে মনমোহন। কখনও পরিবারের লোকজন, আত্মীয়স্বজন কারুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। ৩৫ বছর পর পশ্চিমের বিভিন্ন দেশ ঘুরে দেখার পর পূবের দেশ ঘুরে দেখবার জন্য মনস্থির করেছেন। পশ্চিম থেকে পূবে যাওয়ার পথে কলকাতা হয়ে যেতে চান। সেকারণে মনমোহন স্থির করে; দিল্লি হয়ে কলকাতায় তার একমাত্র নিকট আত্মীয় ভাগ্নির স্বামী-পুত্রের সংসারে এক সপ্তাহ কাটিয়ে যাবে। মামা ভাগ্নিকে জানলেও, ভাগ্নির কাছে মামা সম্পূর্ণ অপরিচিত, সেই অর্থে ‘আগন্তুক’। যদি ভাগ্নি মামাকে ‘আগন্তুক’ ভেবে বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি না দেয়! সেকারণে মনমোহন শান্তিনিকেতনবাসী তার দূর সম্পর্কের শীতলাকান্ত কাকার থেকে ভাগ্নির ঠিকানা (Mrs. Sudhindra N. Bose, 172/2, Rashbehari Avenue, Calcutta-29) সংগ্রহ করে এবং দিল্লি থেকে ইনল্যান্ডে চিঠি লেখে। সেই চিঠি যথাসময়ে ডাক মারফত ভাগ্নির হাতে পৌঁছায়।

প্রসঙ্গ-১: মাতৃভাষা

(ভাগ্নির হাতে খোলা ইনল্যান্ড; নানান কথোপকথন মধ্যে...)
ভাগ্নিজামাই- এনিওয়ে কি লিখেছেন? জোরে জোরে পড়, শুনি।
ভাগ্নি- I must say, ভদ্রলোকের বাংলাটা এখনও রীতিমত সড়গড়। (চিঠি পড়া শুরু করে) কল্যাণীয়েসু খুকি।
ভাগ্নিজামাই- খুকি! খুকি আবার কে?
ভাগ্নি- পড়তে তো দাও।

• • • • • •

ভাগ্নিজামাই- কি?
ভাগ্নি- তোমার attitude, আবার কি?। এই চিঠির উত্তরে ঐ টেলিগ্রাম হয় না। রীতিমত ভালো চিঠি।
ভাগ্নিজামাই- আহা সেটা তো আমি অস্বীকার করছি না। শুধু ভালো নয়, একটু বেশি ভালো। সেখানেই খটকা। যে লোকটা এতদিন দেশের বাহিরে রয়েছে, সে এত ভালো বাংলা লেখে কি করে?
ভাগ্নি- সে হয়তো চিঠিটা অন্য কাউকে দিয়ে লিখিয়েছেন। ভাষাটা অন্যের। কিন্তু ভাবটা তো ওর?
ভাগ্নিজামাই- না, না, না। এরমধ্যে কোথাও কিছু একটা গোলমাল রয়েছে। There is something very very fishy।

• • • • • •

(মামা তথা আগন্তুক ১১টা নাগাদ বাড়িতে এসেছে)
(অফিস থেকে ফোনে) ভাগ্নিজামাই- বাংলা বলে কেমন?
ভাগ্নি- তোমার আমার চেয়ে ভালো বৈ মন্দ নয়।
ভাগ্নিজামাই- এসব কি বলছ? এগুলো আমার সন্দেহ বাড়িয়ে দিচ্ছে। ...শোনো।
ভাগ্নি- আবার কি?
ভাগ্নিজামাই- পাসপোর্ট দেখতে চাও, পাসপোর্ট। আসল নকল ধরার এর থেকে আর ভালো উপায় নেই।
ভাগ্নি- তুমি কি? মাথা খারাপ নাকি? কোন মেয়ে এসব পারে? ওসব করতে হলে তুমি এসে কোরো। আমি ছাড়ছি। অনেক কাজ। (বলে ফোন রেখে দেয়)

• • • • • •

(দুপুরে খাবার টেবিলে) ভাগ্নি- আপনি তো বললেন, বাঙালি রান্না অনেকদিন খাননি। তা বিদেশে তো অজস্র বাঙালি। নিউইয়র্কে তো আমাদের চেনা অনেক বাঙালি আছে। তাদের সঙ্গে মেশেননি?
আগন্তুক- একবার যখন শিকড় তুলে, শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়েছি, তখন আর বাঙালি সঙ্গ কেন?
ভাগ্নি- কিন্তু বাংলা ভাষাটা তো ভোলেননি? দিব্যি বলেন। দিব্যি লেখেন।
আগন্তুক- আগে ডাল, পরে মাছ।
ভাগ্নি- আমরাও তাই।
আগন্তুক- ব্যাপারটা কি জান মা, মায়ের ভাষা, ভুলতে না চাইলে কেউ ভোলে না। আরা যারা ভুলতে চায়, তারা তিন মাসের মধ্যে ভোলে। তারজন্যে বিদেশে যাওয়ারও কোন দরকার হয় না। দিল্লিতে শুনলাম, ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা মা’কে বলছে মামি, বাবাকে বলছে ড্যাডি। তুমিও তাই বল নাকি বাবলু বাবু?

প্রসঙ্গ-২: ধর্ম-জাত-রাজনীতি-নেতা-রাষ্ট্রনেতা-ঠাকুর-দেবতা-গুরু-নিরপেক্ষ-প্রকৃতি-বিজ্ঞান

(ভাগ্নি-পুত্র বাবলুর বন্ধুদের নিয়ে আগন্তুক বিকেলে গড়ের মাঠে। চারিদিকে বিস্তৃত খোলা মাঠের মধ্যে একটি প্রকান্ড বটগাছের তলায় সকলে বসে। একদিকে আগন্তুক, অপরদিকে মুখোমুখি বাবলু এবং তার বন্ধুরা গোল করে বসে। চলছে গল্প-দাদুর আসর)


আগন্তুক- ভেবে দেখ, দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে উঁচু পাহাড় আন্দেস (Andes)। তার গায়, ৮ হাজার ফুট উঁচুতে এই পাথরের শহর। চারশ বছর ধরে কেউ তো জানতোই না, এখানে একটা শহর আছে। তারপর। ১৯১১ সালে। সেই যে বছর মোহনবাগান সাহেবদের হারিয়ে IFA শিল্ড নিল, সেই বছর হিরাম বিঙ্গহাম (Hiram Bingham) নামে একজন পর্যটক হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেললেন এই শহর। কি নাম বলেছিলাম শহরের?
ছোটরা সমস্বরে- মাচ্চু পিচ্চু।
আগন্তুক- মাচ্চু পিচ্চু। (বড় খাম থেকে একটি ছবি বের করে ছোটদের দেখিয়ে) এই দেখ।
ছোটরা সমস্বরে- আরেব্বাস। আপনি গেছেন এই শহরে? আপনি গেছেন?
আগন্তুক- গেছি বৈকি। এ ছবি তো আমার তোলা। আমি গেছিলাম বিশ বছর আগে। খচ্চরের পিঠে চড়ে। তাক লেগে গেছিল শহর দেখে। সেখানে সব পাথরের তৈরি। কিন্তু কাছাকাছির মধ্যে কোত্থাও পাথর নেই। ওরা কোথায় পাথর পেল? কি করে সেই পাথর পাহাড়ের গা বেয়ে অত উঁচুতে তুললো? কেউ জানে না। বড় আজব সভ্যতা ছিল ইনকা সভ্যতা!
ছোটরা সমস্বরে- আপনি আর একটা গল্প বলুন।
আগন্তুক- না না গপ্পো-টপ্পো নয়। এবার একটা ম্যাজিক। (ছোট্ট একটা কাপড়ের থলি থেকে কয়েকটি কয়েন বের করে) তোমাদের কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করবো। দেখি, ঠিক ঠিক বলতে পার কিনা? রেডি?
ছোটরা সমস্বরে- রেডি, রেডি, ...
আগন্তুক- আচ্ছা বলতো, চাঁদ বড় না সূর্য বড়?
ছোটরা সমস্বরে- সূর্য।
আগন্তুক- কেমন করে জানলে? দাঁড়াও। (বলে দুটো সমান সাইজের কয়েন সবার সামনে রেখে, একটি দেখিয়ে) এই হল চাঁদ (আর একটা দেখিয়ে) এই সূর্য। কিন্তু আকাশে তো দু’টোকে দেখে একই সাইজ মনে হয়।
ছোটরা সমস্বরে- সূর্য যে অনেক দূরে।
আগন্তুক- কত দূরে? ...আমি বলছি। সূর্য সাড়ে ৯ কোটি মাইল দূরে। আর চাঁদ? মোটে ৫ লক্ষ মাইল দূরে।
ছোটরা সমস্বরে- তাইতো দু’টোকে এক মনে হয়।
আগন্তুক- আচ্ছা ধর, চাঁদ যদি ৫ লক্ষ মাইল দূরে না হয়ে, দু’লক্ষ মাইল দূরে হ’ত?
ছোটরা সমস্বরে- তাহলে চাঁদকে অনেক বড় দেখাতো।
আগন্তুক- আর ধর যদি চাঁদ ৮ লক্ষ মাইল দূরে হ’ত?
ছোটরা সমস্বরে- অনেক ছোট দেখাতো।
আগন্তুক- কিন্তু তা তো হোলো না? চাঁদ ঠিক এমনই দূরে হোলো যাতে সূর্যের সমান হয়। তাই চাঁদ যখন সূর্যের উপর এসে পড়ে, আস্তে আস্তে তাকে ঢেকে ফেলে, একদম চাকতি চাকতি মিলে যায়...
ছোটরা সমস্বরে- সূর্যগ্রহণ।
আগন্তুক- সূর্যের পূর্ণগ্রহণ। আবার পৃথিবীর ছায়া যখন চাঁদকে ঢেকে ফেলে, তখন আবার চাকতি চাকতি মিলে যায়।
ছোটরা সমস্বরে- চন্দ্রগ্রহণ।
আগন্তুক- পূর্ণ, চাঁদের পূর্ণগ্রহণ। কি করে হয় বলতো? (ছোটরা নিরুত্তর) বলতে পারলে না? পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পণ্ডিতকে জিজ্ঞেস কর, সেও বলতে পারবে না। কেউ জানে না। এ এক বিস্ময়! আমি বলি, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে বড় বিস্ময়! সূর্য আর চাঁদ, দিনের রাজা আর রাতের রানি, আর চাঁদের উপর পৃথিবীর ছায়া, সব এক সাইজের। (তারপর দু’হাত তুলে, বড় বড় চোখ করে) ম্যাজিক।