আরেক রকম ● দশম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ● ১-১৫ ফাল্গুন, ১৪২৮

প্রবন্ধ

শ্রম শিবির, জাতি বিদ্বেষ স্বৈরতন্ত্র - “আয় সবে বেঁধে বেঁধে থাকি”

শুভাশিস মুখোপাধ্যায়


বেলিজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড, বার্লিন কনফারেন্স মারফৎ গোটা আফ্রিকাকে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী জাতিগুলির মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারার মাধ্যমে তাঁর নিজের জন্য এক বিরাট অংশ রেখে দেন। এই বার্লিন কনফারেন্স-এ বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “(আমাদের) এই কাজ আসলে বিশ্বের সেই একমাত্র অঞ্চলে ইউরোপীয় সভ্যতার আলোকবর্তিকা পৌঁছে দেওয়া... এই ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন এক বিরাট জনগোষ্ঠীকে সভ্যতার আলোয় নিয়ে আসা... এই কাজটি আমাদের কাছে এই শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্রুসেড...”।

সেই সময়টা ছিলো ১৮৮৪। সেই বিভাজনের মাধ্যমে আফ্রিকার এক বড়ো অংশে বেলজিয়ামের দখলদারি চলে বিশ শতকের গোড়া পর্যন্ত, বেলজিয়ান কঙ্গো নামে আফ্রিকার সেই এলাকাটির পরিচিতি ছিল। দুর্ভাগ্য হলো সেই ট্র্যাডিশন আজও সমানে চলছে। পরে আমরা প্যাট্রিশ লুমুম্বা-র নাম শুনেছি, কালো মানুষদের আন্দোলন ইত্যাদির আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে জাতি-বিদ্বেষের এক মহা কলঙ্কিত অধ্যায়, যে অধ্যায়ের নায়ক ছিল রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড-এর ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনী।

আমাদের দেশের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড নিজেই 'আফ্রিকান ইন্টারন্যাশানাল অ্যাসোশিয়েশন' নামে একটি কোম্পানি খুলে এই অঞ্চলের দখল নেন। ভারতের ক্ষেত্রে যেমন মহারাণী ভিক্টোরিয়া 'ব্রিটিশ ইন্ডিয়া'-র কর্ত্রী রূপে অবতীর্ন হন, এখানেও তেমনি এক সময় রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড অঞ্চলটির নাম 'কঙ্গো ফ্রি স্টেট' নাম দিয়ে অঞ্চলটি সরাসরি নিজের কর্তৃত্বের আওতায় নিয়ে আসেন। এই দখলদারী কায়েম করেই তিনি কঙ্গোর গভীর অরণ্য থেকে রাবার এবং রাবার-জাত দ্রব্য বেপরোয়াভাবে জোগাড় করে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা করা শুরু করেন।

এই 'কঙ্গো ফ্রি স্টেট' থেকে অবিশ্রামধারায় এই সব পণ্য সংগ্রহ করার জন্য লিওপোল্ড তাঁর মাফিয়া বাহিনীর মাধ্যমে স্থানীয় শ্রমিকদের এই সব রাবার দ্রব্য আহরণের দৈনিক 'কোটা' নির্দিষ্ট করে দেন। এই কোটা পূরণের জন্য হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম, প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম খাদ্যের যোগান, অস্বাস্থ্যকর স্থানে বসবাসে বাধ্য হয় এই অঞ্চলের স্থানীয় মানুষরা। এই সব কারণে ইউরোপে নাৎসি জমানার উদ্বোধনের আগেই উনিশ শতকের সবচেয়ে বড় শ্রম-শিবির, যা ভবিষ্যতের জার্মান নাৎসি শাসনের 'কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প' নামে কুখ্যাত হবে, এবং নিবিড় শ্রমদানের কারণে জাতি হিসেবে 'নিকৃষ্ট' কঙ্গো-র অধিবাসীদের গণহত্যা ঘটে। 'নাৎসি হলোকস্ট' নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, কিন্তু বেলজিয়ামের হাতে কঙ্গোবাসীদের গণহত্যার বিষয় নিয়ে তেমন কথাবার্তা শোনা যায় না!

সামান্য কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। কঙ্গোবাসীরা যাতে দ্রুত তাদের 'কাজের জায়গায়' পৌঁছোতে পারে, সেইজন্য তাদের গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করে স্রেফ পাতার ছাউনি দেওয়া 'ঘরে' গাদাগাদি করে রাখা হতো। দিনে ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা খাটনির পর এই শ্রমিকরা তাঁদের 'ঘরে' ফিরে দিনের দ্বিতীয় খাবারটি তৈরি করতে বসতেন, সপ্তাহে একদিন অতি নিকৃষ্ট 'রেশন' জুটতো তাঁদের। প্রথম কয়েক সপ্তাহ এই শ্রমিকের দল তাঁদের ওপর আরোপিত 'কোটা' মোটামুটি পূরণ করতে সক্ষম হতেন। তার পর অর্ধাহার, রোগ, ক্লান্তি ইত্যাদির কারণে তাঁদের আহরণ আরোপিত কোটা-র চেয়ে কম হতে শুরু করতো। নানান অত্যাচার, শাস্তি দিয়েও যখন আহরণ বাড়তো না, তখন এই 'কাম-চোর'দের 'উচিৎ শাস্তি' দেওয়ার জন্য সর্দার আড়কাঠির চেলারা এই সব শ্রমিকদের ডান হাতটি স্রেফ কেটে নিয়ে একটি থলিতে জমা করতো। অনেক সময় 'প্রোমোশন-প্রাপ্ত' নির্বাচিত কিছু 'কংগোলি'-দের ওপরেও এই দায়িত্ব বর্তাতো। তারাও এই 'বেয়াড়া' শ্রমিকদের ডান হাতটি কেটে সর্দারদের জমা দিয়ে কাটা হাত পিছু কিছু রোজগারও করে নিত। সপ্তাহান্তে বেলজিয়ামের মহামান্য রাজার কাছে পণ্য পাঠানোর সময় থলিভর্তি কাটা হাতও পাঠানো হতো, যাতে কোটার হিসেবে যতটা কম হয়েছে, কাটা হাতের মালিকদের জন্য আরোপিত কোটা যোগ করে যাতে হিসেব মেলানো যায়! এই প্রক্রিয়ায় মোট ১ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর হিসেব নথিবদ্ধ হয়ে আছে। ১৮৯৫ সালে একজন আয়ারল্যান্ডের অধিবাসী ব্রিটিশ নাগরিক, চার্লস স্টোকস এই ব্যবসায় 'মধু' আছে অনুমান করে বেলজিয়ামের রাজার অনুমতি ব্যতিরেকে ঐ অঞ্চলে এই ব্যবসা চালু করে দেন। তিনি বেলজিয়ামের মাফিয়াচক্রের হাতে ধরা পড়ে যান, এবং তাঁকে 'উদাহরণমূলক' শাস্তিদানের জন্য প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়। এই খবর বৃটেনে পৌঁছোলে সারা ইউরোপ জুড়ে হইচই পড়ে যায়। কিন্তু ব্রিটেন পরে এই বিষয়টি চেপে দেয়, কেননা সময়টা ছিল ভারতে সিপাহি বিদ্রোহের পরে কাল, বিদ্রোহী সিপাইদের ওপর ব্রিটেনের অমানুষিক অত্যাচারের কথাও আস্তে আস্তে ফাঁস হতে বসেছিল!

হিটলারের সূত্রে আমরা এখন জার্মান রাইখ-এর নাম সবাই জেনে গেছি। যে বার্লিন অধিবেশনের কথা আগে বলেছি, সেই অধিবেশনে দ্বিতীয় জার্মান রাইখের পক্ষ থেকে 'সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের নামে' একটি সমঝোতা নির্মিত হয়, যার মূল কথা ছিল আফ্রিকা মহাদেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলিতে ইউরোপীয় জাতিগুলির বোঝাপড়ার মাধ্যমে সম্পদ আহরণের বিলি ব্যবস্থা করা! আরব ব্যবসায়ীরা যে দাস ব্যবসা চালাতো, ক্রিশ্চান ঈশ্বরের নামে সেই ব্যবসা যাতে ইউরোপীয় দাস ব্যবসায়ীরা একচেটিয়াভাবে চালাতে পারে, তারও বন্দোবস্ত পাকা করা হয়।

১৮৮৪ সালের গোড়ার থেকে জার্মানি আফ্রিকা মহাদেশের চওড়া-চওড়ি একটা অংশ, যেখানে ছিল তোগোল্যান্ড, ক্যামেরুন, সেকালের টাঙ্গানাইকা (যা আজকের তানজানিয়া) এবং দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকা (যা আজকের নামিবিয়া)-র দখল নেয়। এই দখলের ক্ষেত্রে জার্মানির জন্য সবচেয়ে 'লাভজনক' উপনিবেশ হয়ে ওঠে দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকা বা আজকের নামিবিয়া। এখানে তারা নিজেদের দেশ থেকে ২৫০০ জন সাদা চামড়ার জার্মান নাগরিক আমদানি করে, যারা সেখানে বাগিচা, চাষ-আবাদের কাজের জন্য স্থানীয় মানুষেরা প্রচুর শ্রমের বিনিময়ে যে সব জমিতে চাষা শুরু করেছিলেন, স্রেফ বন্দুকের জোরে সেগুলি দখল করে সেই জমিতেই সেই জমির মালিকদের দাস হিসেবে খাটাতে থাকে। এই অঞ্চলে স্থানীয় অধিবাসীদের নাম ছিল হেরেরো এবং নামা (যাঁদেরকে পশ্চিমী পর্যটক এবং উপনিবেশবাদীরা হোটেনটোট বলে নামকরণ করেছিলেন)। শস্তার শ্রম, প্রায় অফুরন্ত দাসের জোগানের ফলে এই অঞ্চল থেকে প্রচুর কাঁচামাল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়কালে জার্মান সমর-ব্যবসা এবং যুদ্ধ প্রস্তুতির পক্ষে বিপুল সহায়ক ভূমিকা পালন করে। স্বভাবতই, জার্মান ব্যাঙ্কার ও শিল্পপতিরা এই অঞ্চলে বিরাট আকারে লগ্নি করে। দর্শনচর্চার এবং শিল্প-সাহিত্যের পীঠস্থান জার্মানিতে জার্মান জাতিভুক্ত ছাড়া অন্যান্য জাতি ও গোষ্ঠীর সদস্যদের মনুষ্যপদবাচ্য ভাবা হতো না, তাদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল মনুষ্যেতর স্থান। মনুষ্যজাতির এই শ্রেষ্ঠ সদস্যদের বর্বরদের হাত থেকে রক্ষার জন্য এক জার্মান সৈন্যদলকে দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকাতে পাকাপাকিভাবে রেখে দেওয়া হয়। মার্কিন দেশে ইংল্যান্ড আফ্রিকা থেকে সরাসরি আমদানি করা দাস শ্রমিকদের যে কায়দায় খাটাতো, জার্মানি তার সহজাত উদ্ভাবনী প্রতিভায় সেই অত্যাচারী ও নিপীড়নকারী প্রদ্ধতির প্রভূত উন্নতি সাধন করে।

১৯০২ সালে দুটি আফ্রিকান দেশের বিরুদ্ধে বৃটেনের দ্বিতীয় বুয়র যুদ্ধ ভয়াবহ নিপীড়নের মাধ্যমে সমাপ্ত হওয়ার প্রায় পরপরই নামিবিয়ায় উড়ে এসে জুড়ে বসা সংখ্যালঘু জার্মানদের বিরুদ্ধে নামা বিদ্রোহীরা তাদের পরম্পরাগত অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, এদের সঙ্গে যোগ দেয় হেরেরো বিদ্রোহীরাও। এই সময়েই প্রথম দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকার এই জার্মানরা মূল ভূখণ্ডে বার্তা পাঠিয়ে বলে যে আফ্রিকাতে জার্মানজাতির হাত-পা ছড়ানোর যে স্থান, অর্থাৎ 'লেবেনস্রাম', সেটি বিপন্ন। আর্য জাতির পবিত্র রক্ত এবং লগ্নিকে বাঁচানোর জন্য অবিলম্বে এই মনুষ্যেতর জাতির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান করা প্রয়োজন।

লেফটেনেন্ট জেনারেল লোথার ভন ট্রোথা-র নেতৃত্বে ১৪ হাজার আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত এক বাহিনী আদিম অস্ত্রে সজ্জিত যুদ্ধ প্রশিক্ষণহীন একদল মানুষকে নির্দয়ভাবে আক্রমণ করে। দখল করা দেশে গিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের উদ্দেশে ট্রোথা এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলেন, "হেরেরোরা যেহেতু জার্মান নাগরিক নয়, তাই এই জাতিকে অবিলম্বে এই অঞ্চল ছেড়ে চলে যেতে হবে। দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকার এই জার্মানভূমিতে কোন হেরেরোকে যদি এমনকি অস্ত্রহীন অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়, তবে তার শাস্তি মৃত্যু। ...আমার কাজ এই হেরেরো জাতিকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করা..."।

নামা-দের ক্ষেত্রেও এই একই 'সভ্য' নীতির প্রয়োগ করা হয়। এর ফল হলো সত্যি সত্যিই পৃথিবীর বুক থেকে জাতি হিসেবে মানব প্রজাতির এই সদস্যদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অস্ত্র প্রয়োগ করা হয়, যার অন্য এক নিদর্শন আমরা দেখবো নাৎসিদের দ্বারা ইহুদি ও অন্যান্য জাতির মানুষদের নির্বিচারে গণহত্যায়। নাৎসিরা সমাজের উচ্চকোটির মানুষদের চৈতন্যে লালিত যে জাতিবিদ্বেষ হাড়ে-মজ্জায় মিশে আছে, সেই জাতিবিদ্বেষকে অপবৈজ্ঞানিক মোড়কে হাজির করেছিল এবং অনেক মান্য বিজ্ঞানী এবং মান্য বিদ্যাচর্চাকেন্দ্র সেই অপবিজ্ঞানকে উৎসাহভরে সমর্থন দিয়ে গেছে!

এই গণহত্যার বিরুদ্ধে এক সময় জার্মানির অভ্যন্তরে প্রবল বিরোধিতা গড়ে ওঠে। না, কোনও নৈতিক অবস্থান থেকে নয়, এই বিরোধিতার কারণ ছিল অত্যন্ত কেজো অর্থনৈতিক কারণ। বিরোধীরা, বিশেষত জার্মান ব্যাঙ্কাররা বলতে শুরু করে যে, সব স্থানীয় অধিবাসীদের যদি মেরেই ফেলা হয় তো বাগিচা চাষ করবে কারা আর চাষ না হলে মুনাফাই বা আসবে কোত্থেকে। অতএব, বিদ্রোহীদের ছোটো দলে ভাগ করে সেই দেশের দূর দূরান্তে, বিশেষত কালাহারি মরুভূমি সংলগ্ন অঞ্চলে বেড়া দিয়ে ঘেরা শিবিরে পাঠানো হোক, সেখানে শিকারি কুকুর পাহারা হিসেবে রাখা হোক এবং প্রতি ১০ জন দাস পিছু ৪ জন সশস্ত্র প্রহরীর ব্যবস্থা করা হোক। এরাই চাষের কাজ করবে, এদের ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের চেয়ে সামান্য কম খাদ্য দেওয়া হোক। এরা জানবে যে শিবির থেকে পালানোর একমাত্র রাস্তা কালাহারি মরুভূমি পাড়ি দেওয়া!

নিবিড় শ্রমের এই শিবিরগুলিকে জার্মানিতে বলা হতে লাগলো 'কন্সেট্রেশন ক্যাম্প', ক্ষুধা, রোগ আর শ্রমের নিবিড় শিবির। এই রকম সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শিবিরটির সরকারি নাম ছিল 'শার্ক আইল্যন্ড কনশেন্ট্রেশন ক্যাম্প'। নাৎসিরা জার্মানিতে ক্ষমতা দখল করার পর তারা যখন ইহুদি ও অন্যান্য জাতির মানুষদের 'মনুষ্যেতর এবং অনার্য ও খুঁতযুক্ত প্রাণী' বলে 'চিহ্নিত' করে গণহত্যার আয়োজনে 'আউস্তউয়িটস' মৃত্যুশিবির নির্মাণ করে, তখন তারা সেখানে এই 'শার্ক আইল্যান্ড কনশেন্ট্রেশন ক্যাম্প'-এর নিয়মকানুনগুলিই চালু করে দেয়!

১৯০৬ সালের রাইখস্ট্যাগ-এর এক অধিবেশনে তৎকালীন চ্যান্সেলর, বার্নহার্ড ফন বুলো জানান যে, প্রায় ২,০০০ জন হেররোকে শার্ক আইল্যন্ড-এর লুডারলিটজ শ্রম শিবিরে পাঠানো হয়েছে। তবে চিকিৎসকরা তাঁকে নিশ্চিন্ত করেছেন যে, তাদের যে পরিমাণে খাটানো হচ্ছে এবং যে পরিমাণে খেতে দেওয়া হচ্ছে, তার ফলে তাদের মধ্যে সবচেয়ে স্বাস্থ্যবানরাও দু' বছরের কম সময় বেঁচে থাকবে! এইভাবে আর্য জার্মানদের নিকৃষ্ট জীবরা যাতে কলুষিত করতে না পারে তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, পাশাপাশি আর্থিক মুনাফাও হচ্ছে।

এই গণহত্যাকে মহিমান্বিত করার জন্য জার্মান পণ্ডিত সমাজের এক বিরাট অংশ কোমর বেঁধে আসরে নেমে পড়ে। হেরেরো এবং নামা জাতির সদস্যরা ঠিক আর্যদের মতো পূর্ণ মানব নয়, এই অপবৈজ্ঞানিক তত্ত্বের পক্ষে তারা অনেক 'বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা' হাজির করে বলে যে, এর ফলে মানবজাতি আরও উন্নততর উত্তরপুরুষ নির্মাণে সক্ষম হয়েছে! রাজনৈতিক দিক থেকে এই ট্রোথা-র মতো গণহত্যাকারীকে দেশপ্রেমিক বানানোর জন্য বীরগাথা রচনা থেকে শুরু করে জার্মান জাতির উত্থানের পেছনে এই জাতীয় ব্যক্তিদের অবদানের কাহিনী নিয়ে বই লেখা হয়েছে। বিদ্রোহীদের হাতে নিহত অত্যাচারী দাস মালিকদের শহীদের সম্মান দিয়ে তাদের অশ্বারোহী মূর্তি নির্মিত হয়েছে জার্মানির প্রতিটি মুখ্য শহরে, তাদের জয়গান করে সংগীত রচিত হয়েছে, তাদের নামে 'দিবস' উৎসর্গ করা হয়েছে। নিচু ক্লাসের পাঠ্যপুস্তকে তাদের বীরের সম্মান দেওয়া হয়েছে। এক দিকে এই সামাজিক নির্মাণ, অন্যদিকে বিরোধীদের বিরুদ্ধে কুৎসা, এই দুই হাতিয়ারের জোগান দিয়েছে, দিয়ে চলেছে সারস্বত বিদ্যৎ সমাজ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর বিভিন্ন দেশের স্বৈরতান্ত্রিক শাসকরা সেই একই জাতিবিদ্বেষের সঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির মিশেল দিয়ে সেই একই কাজ করে চলেছে। দক্ষিণ ভিয়েতনামে মার্কিন দেশ তার 'স্ট্র্যাটেজিক হ্যামলেট' নামে যা চালাতো, বা কিউবা-র দখলিকৃত অংশ, গুয়ান্তানামো বে অঞ্চলে অত্যাচার শিবিরে মার্কিন দেশ যা চালায়, তাকে ট্রোথা ও তার দলবলের হেরেরোদের ওপর চালানো অত্যাচারের জাতভাই বলাই সঙ্গত হবে।

এই মিথজীবিতা হিটলার-মুসোলিনি-র পরাজয়ের পর আজও সমান তালে অব্যাহত। পার্থক্য কেবল রূপের, খোলসের, ভেতরে শাঁস প্রায় অবিকৃত রয়ে গেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে।