আরেক রকম ● দশম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ● ১-১৫ ফাল্গুন, ১৪২৮

প্রবন্ধ

বাজেট (২০২২-২৩) বিশ্লেষণ

বিশ্বজিৎ ধর


পরবর্তী আর্থিক বছরের জন্য সরকারের অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারগুলির নীলনকশা হিসাবে বাজেট উপস্থাপন করা হয়। কখনও কখনও, একজন অর্থমন্ত্রী আগামী কয়েক বছরের অর্থনীতির জন্য একটি রোড ম্যাপ দিয়ে বাজেট অনুশীলনের সাথে যুক্ত হতে পারেন। ২০২২-২৩ বাজেট উপস্থাপনের মাধ্যমে দেশ যা প্রত্যক্ষ করল তা পুরোনো অভিজ্ঞতা ভেঙেচুরে একাকার করে দিয়েছে। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ২০২২-২৩ বাজেট পেশ করার সময় আগামী ২৫ বছরের জন্য ভারতীয় অর্থনীতির জন্য তাঁদের সরকারের অগ্রাধিকারগুলিকে 'অমৃত কাল' হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। পঁচিশ বছরের প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে অর্থমন্ত্রী বড় ভাবনা বেছে নিয়েছেন। তিনি 'প্রধানমন্ত্রী গতিশক্তি'র অধীনে বৃহৎ সংযোগ প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। সাতটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্র যথা সড়ক, রেলপথ, বিমানবন্দর, বন্দর, গণপরিবহন, জলপথ এবং পরিকাঠামো 'প্রধানমন্ত্রী গতিশক্তি' প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। এই প্রকল্পগুলিতে ব্যয় বরাদ্দের জন্য, ২০২১-২২-এর সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ২০২২-২৩-এ মূলধনী ব্যয় মাত্র প্রায় ২৪ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।

এই উদ্যোগগুলিকে অর্থনীতির নিরিখে একটি 'মিশ্র ব্যাগ' হিসেবে বিবেচনা করা যায়। পরিকাঠামো প্রকল্পগুলি, যদি কার্যকরভাবে এবং সময়মতো বাস্তবায়িত হয়, তাহলে পিছিয়ে থাকা এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে। যদিও অর্থমন্ত্রী যে ধরনের বৃহৎ পরিকাঠামো প্রকল্প ঘোষণা করেছেন, সেখানে উচ্চমাত্রার যান্ত্রিকীকরণের কারণে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা ততটা বেশি হওয়ার সম্ভাবনা কম। অর্থমন্ত্রী আশা করেন যে সরকারি বিনিয়োগের বর্ধিত মাত্রা বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহী করে তুলবে। অর্থাৎ স্পষ্ট স্বীকারোক্তি সরকার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন না করলে, বেসরকারি বিনিয়োগ আসবে না। এটি বাজেটের অর্থ বরাদ্দ সহ আরও বড় প্রশ্ন উত্থাপন করে, যা আমরা পরে আলোচনা করবো।

সরকারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সামগ্রিক উন্নয়ন। ছয়টি নদী সংযোগ প্রকল্প এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। সরকার স্পষ্টতই মনে করে যে এই প্রকল্পগুলি দেশে সেচের প্রসারকে উন্নত করবে। ফলে সংকটে জর্জরিত কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন হবে। কয়েকটি সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ, উদাহরণস্বরূপ, কৃষকদের কাছে ডিজিটাল এবং হাই-টেক পরিষেবা সরবরাহ করা এবং 'কিসান ড্রোন' ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। এখানে যে প্রশ্নটি উঠছে তা হ'ল এই উদ্যোগগুলি কি কৃষকদের উদ্বেগ দূর করার জন্য যথেষ্ট? অথচ কৃষকের কাছে চাষ করা এখন আর অর্থকরী পেশা নয়। কৃষি আইনের বিরুদ্ধে বছরব্যাপী আন্দোলনের শেষে, কৃষকরা দাবি করেছিল যে তাদের পণ্যের ন্যূনতম সমর্থন মূল্য অবশ্যই একটি আইনি অধিকার। নিজের আর্থিক সঙ্গতির কারণে কেন্দ্রীয় সরকার এই দাবিটি এখনও পূরণ করতে পারেনি।

কৃষি সংকটের এই পটভূমিতে, প্রত্যাশা ছিল যে সরকার দেশের শ্রমশক্তির বৃহত্তম অংশ এবং যারা ভারতকে একটি খাদ্য সুরক্ষিত দেশে পরিণত করেছে তাদের দুর্দশা দূর করতে কয়েকটি পদক্ষেপ নেবে। প্রত্যাশা ছিল যে কৃষকরা যাতে বাজারে সঠিক দাম পায় তা নিশ্চিত করার জন্য সরকার পদক্ষেপ করবে। বিগত কয়েক বছর ধরে সরকার কৃষক উৎপাদক সংস্থাগুলির (এফপিও) উপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে, যাতে কৃষকদের প্রাক-উৎপাদন পর্যায় থেকে পণ্যের বিক্রি পর্যন্ত সমস্ত সমস্যার নিষ্পত্তি হয়। প্রয়োজনে তার বাইরেও অন্যান্য সমাধান করতে সক্ষম হয়। কৃষকদের ক্ষমতায়ন করতে পারে এমন এফপিও-কে শক্তিশালী করার মতো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পাশাপাশি, গ্রামীণ উৎপাদন পরিকাঠামোতে যেসব ঘাটতি রয়েছে তা পূরণের জন্য সরকারের নির্দিষ্ট লক্ষ্যযুক্ত অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন ছিল।

কৃষির প্রয়োজনে সরকারের প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশার তুলনায় যথেষ্ট কম। ২০২১-২২-এর সংশোধিত ব্যয় বরাদ্দের তুলনায়, ২০২২-২৩-এর সালে কৃষি ও সংশ্লিষ্ট খাতে বাজেট বরাদ্দ প্রায় ৬ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এবং কৃষি ও কৃষকদের কল্যাণে বরাদ্দ ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। জাতীয় আয়ের প্রাথমিক অগ্রিম অনুমান (সরকার দ্বারা অনুমান করা হয়) অনুসারে যদি বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার ৮.৪ শতাংশ অব্যাহত থাকে ২০২২-২৩-এর জন্য বরাদ্দ প্রকৃত অর্থ ২০২১-২২-এর সংশোধিত অনুমানের চেয়ে কম। অর্থাৎ কৃষি ক্ষেত্র বঞ্চিত রয়ে গেল, যেমনটি কয়েক দশক ধরে ছিল।

কৃষির মধ্য-মেয়াদী কার্যকারিতার উপর যথাযথ দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে এই ক্ষেত্রে যে সংকট দেখা দিয়েছে তা মোকাবিলায় অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া যেত। অধিকন্তু, এমন দৃঢ় পদক্ষেপের জরুরী প্রয়োজন রয়েছে যা কৃষি পণ্যের উৎপাদনশীলতাকে উন্নত করতে পারে, পাশাপাশি এমন প্রতিষ্ঠানগুলিকে শক্তিশালী করতে পারে যা কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পায় তা নিশ্চিত করতে পারে। কৃষি ক্ষেত্রের আয় জোরদার করা অভ্যন্তরীণ চাহিদার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, ভারতীয় অর্থনীতিকে গতিশীল করার জন্য যা অত্যন্ত জরুরী। অর্থমন্ত্রী স্পষ্টতই এই গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে ভারতীয় কৃষির প্রয়োজনীয়তার প্রতি সাড়া দেওয়ার একটি বড় সুযোগ হাতছাড়া করেছেন।

অর্থমন্ত্রীর মতে, 'সার্বিক উন্নয়ন'-এর মধ্যে 'মানসম্মত শিক্ষার সার্বজনীনকরণ' অন্তর্ভুক্ত, যা সকলের স্বাগত জানানো উচিত। তাঁর মতে, 'সার্বজনীনকরণের' এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাবিত উপায় হল শিক্ষার উন্নত ডিজিটালাইজেশন। এই ফ্ল্যাগশিপ উদ্যোগটি হল 'পিএম ই-বিদ্যা' নামের একটি 'ক্লাস-ওয়ান টিভি চ্যানেল' প্রোগ্রাম, যা ১২ থেকে ২০০টি টিভি চ্যানেলে সম্প্রসারিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। উপরন্তু, সরকার প্রস্তাব করেছে যে 'ডিজিটাল শিক্ষকদের' মাধ্যমে ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, টিভি এবং রেডিওর মাধ্যমে সম্প্রচারের জন্য সমস্ত কথ্য ভাষায় উচ্চ-মানের ই-কন্টেন্ট তৈরি করা হবে। এবং অবশেষে, একটি 'ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়'-এর প্রস্তাব রয়েছে।

২০২২-২৩-এর বাজেটে ডিজিটালাইজেশনের জন্য বর্ধিত সমর্থনের জন্য সমর্থন গত বছর উন্মোচিত নতুন শিক্ষা নীতির অগ্রাধিকারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ডিজিটাল শিক্ষার বিরূপ প্রভাব, তরুণ মনের পাশাপাশি সমাজের উপরও কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তা ইতিমধ্যে সুপরিচিত; মহামারী এই বিষয়ে প্রচুর প্রমাণ দিয়েছে। তবুও, বাজেট প্রস্তাব প্রণয়ন করার সময় সরকার এই প্রমাণ এড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ডিজিটাল শিক্ষার ফলে আমাদের সমাজের সুবিধাবঞ্চিত অংশগুলির জন্য উল্লেখযোগ্য শিক্ষার ফাঁক রয়েছে কারণ তারা গ্যাজেটগুলির পাশাপাশি উচ্চমান সম্পন্ন ইন্টারনেট সংযোগের সামর্থ রাখে না। ভারতে আয় বৈষম্য বেশ উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে, এবং ডিজিটালাইজেশনের এই নতুন সুবিধার সাথে, সরকার ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান দ্রুত বৃদ্ধির বিষয়টি নিশ্চিত করছে। 'ইন্টারনেট আসক্তি'-র ক্রমবর্ধমান ঘটনার কারণে তরুণদের মানসিকতার প্রতিকূল প্রভাব সমানভাবে উদ্বেগজনক। শিক্ষার ক্রমবর্ধমান ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে দেশের দায়িত্বশীল তরুণ নাগরিক তৈরির ক্ষমতার বিষয়ে গুরুতরভাবে আপস করা হবে।

অবশ্যই, যদি ডিজিটালাইজেশনকে এগিয়ে নেওয়ার পথ বেছে নেওয়া হয়, তাহলে সরকারকে পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে খুব বেশি বরাদ্দ করতে হবে না, কারণ বেসরকারি খাত হবে শিক্ষা পরিষেবা প্রদানকারী। তাই আশ্চর্যের কিছু নেই, কেন্দ্রীয় সরকার চলতি অর্থবছরে স্কুল শিক্ষা এবং উচ্চ শিক্ষা উভয় ক্ষেত্রেই বছরের বাজেট বরাদ্দের চেয়ে কম খরচ করেছে। উপরন্তু, স্কুল শিক্ষার জন্য কোনো মূলধনী ব্যয় বরাদ্দ করা হয়নি, যখন উচ্চ শিক্ষার জন্য মূলধনী ব্যয় করা হয়েছে 'কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা ব্যয়'-এর জন্য। এটা নিশ্চয়ই এই দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য ভালো নয়।

স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ সঙ্কোচন প্রমাণ করে দিয়েছে যে ২০২২-২৩-এর বাজেট প্রণয়নের সময় সামগ্রিক পরিস্থিতির উপর যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বিশেষত মহামারীর দ্বিতীয় তরঙ্গের সময় দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর করুণ অবস্থা নজরে আসার পরও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে ২০২১-২২-এর সংশোধিত অনুমানের তুলনায় মাত্র ১ শতাংশ। এই খাতে মূলধনী ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। তবে নাগরিকদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিকে শক্তিশালী করার জন্য বিনিয়োগের প্রস্তাব নেই। সরকার কেবলমাত্র সুপার স্পেশালিটি বা বিশেষায়িত হাসপাতালে বিনিয়োগ করবে।

২০২২-২৩-এর বাজেট প্রস্তাবগুলির সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা হল যে অর্থমন্ত্রী 'অমৃত কাল'-এর দিকে দৃষ্টিপাত করেছেন। এমনকি দেশের অর্থনীতি যখন মহামারীর ফলে সৃষ্টি হওয়া সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, সেই বিষয়টি সযত্নে পরিহার করা হয়েছে। সুদূর ভবিষ্যতে অর্থমন্ত্রীর নজর একটি স্পষ্ট বার্তা দেয় যে সরকার মনে করে অর্থনীতি কোভিড-প্ররোচিত সংকটকে পুরোপুরি কাটিয়ে উঠেছে। এটি একটি দুঃসাহসিক অনুমান। কারণ দেশ সবেমাত্র তৃতীয় তরঙ্গ থেকে ফিরে আসতে শুরু করেছে, যথেষ্ট অনিশ্চয়তা এখনও বড়ো আকার ধারণ করছে। ২০২১-এর শেষ মাসগুলিতে উৎপাদন তার গতি হারিয়েছে বলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বেশ কয়েকটি ক্ষেত্র কম শক্তিশালী দেখাচ্ছে।

দেশের অর্থনীতির অবস্থা সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর আশাবাদ আর্থিক সমীক্ষার পূর্বাভাষের সঙ্গে তবুও কিছুটা সাদৃশ্যপূর্ণ। সমীক্ষাটি দেখিয়ে দিয়েছে যে ব্যক্তিগত খরচ এখনও প্রাক-কোভিড স্তরে পৌঁছতে পারেনি, যা ২০১৯-২০-র সময়ের স্তরকে বোঝায়। ব্যক্তিগত খরচ, বা অন্য কথায়, অভ্যন্তরীণ চাহিদা, যা ভারতের অর্থনীতিকে চালিত করছে, চাকরি এবং আয়ের তীব্র সংকোচনের কারণে গত দুই বছরে গুরুতরভাবে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে রয়ে গেছে। এটা সবার কাছে স্পষ্ট হওয়া উচিত যে, ২০২০-২১-এর অর্থনৈতিক মন্দার পরে যারা চাকরি হারিয়েছেন বা মজুরি হ্রাসের শিকার হয়েছেন তাদের একটি বড়ো অংশ কাজ না পেলে, বাজারের চাহিদা পুনরুদ্ধার হবে না। যদি চাহিদার অবস্থা প্রতিকূল থাকে, তাহলে অর্থনীতির যুক্তিসঙ্গত হারে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা কম।

সরকার এই যুক্তি দিয়ে নিজেকে সমর্থন করেছে যে, ভারতীয় অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলি প্রাক-মহামারী স্তরে পৌঁছেছে, বা ২০১৯-২০-র স্তরেই বিরাজ করছে। এটি লক্ষ্য করা উচিত যে ২০১৯-২০ একটি যথার্থ মানদণ্ড নয়, কারণ গত কয়েক বছর ধরেই ভারতীয় অর্থনীতি তীব্রভাবে সঙ্কুচিত হয়েছে। জাতীয় পরিসংখ্যান অফিস জানিয়েছে যে, জিডিপি বৃদ্ধি ২০১৭-১৮-য় ৬.৫ শতাংশের থেকে ২০১৯-২০-তে সালে ৩.৭ শতাংশে নেমে এসেছে। এটি বোঝায় যে ২০১৯-২০-কে একটি 'স্বাভাবিক' বছর হিসেবে ধরে নিয়ে, সরকার সুস্থায়ী পদ্ধতিতে কমপক্ষে ৭.০ শতাংশ বার্ষিক জিডিপি বৃদ্ধির রেকর্ড গড়ার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য ছেড়ে দিয়েছে। প্রাক-মহামারী পর্বে নিয়মিত বলা হত স্বল্প মেয়াদের মধ্যে ভারত ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির দেশ হতে চলেছে।

উচ্চাকাঙ্ক্ষার এই অভাব নির্মলা সীতারামনের ২০২২-২৩-এর বাজেটের প্রস্তাবগুলিতে দেখা যাচ্ছে। শ্রমবাজারে ব্যাপক আঘাত এবং দেশের তরুণদের মধ্যে মোহভঙ্গের আরও উদ্বেগজনক লক্ষণগুলিকে মোকাবিলার জন্য কোনও স্পষ্ট নির্দেশ বাজেটে নেই। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম তার গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্ট ২০২২-এ ইঙ্গিত দিয়েছে যে ব্যাপক সংখ্যক যুবকের মোহভঙ্গ ভারতের শীর্ষ ঝুঁকিগুলির মধ্যে একটি কারণ। তার উপরে, দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলি মহামারী জনিত সংকটের ধাক্কায় ভুগছে, তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়নি। অতীতের মতো, এই বাজেটে অর্থমন্ত্রীর ঘোষণাগুলি সামগ্রিকভাবে ক্ষুদ্র, ছোটো ও মাঝারি (এমএসএমই) শিল্পের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ঋণ প্রদানের লক্ষ্যে কোনো দিশা দেখাতে পারেনি। অর্থমন্ত্রীর জানা উচিত যে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ মূলতঃ এমএসএমই সংস্থাগুলিই করে। মাইক্রো ইউনিট ঋণ প্রদান নয়। ২০২০-এর লকডাউনের পর থেকে মাইক্রো ইউনিটের সুবিধার জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্যের সহায়তার প্রয়োজন ছিল। দুর্ভাগ্যবশত, নীতি নির্ধারকরা এই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটিকে উপেক্ষা করে চলেছেন।

সম্ভবত ২০২২-২৩ কেন্দ্রীয় বাজেটের সবচেয়ে বড় প্রভাব শ্রমিক শ্রেণী অনুভব করবে। অর্থনীতি আবার ট্র্যাকে ফিরে এসেছে এই ধারণা থেকে উদ্ভূত, অর্থমন্ত্রী দুটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি, মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি প্রোগ্রাম (MGNREGA) এবং জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইনের অধীনে বাস্তবায়িত পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমে বরাদ্দ ব্যাপকভাবে হ্রাস করেছে (NFSA)। ২০২০-২১-এ মহামারীর পরিপ্রেক্ষিতে MGNREGA-তে ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। ১.১১ লক্ষ কোটি টাকা। অথচ ২০২১-২২-এর সংশোধিত অনুমান দেখায় যে ৯৮ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে৷ যাই হোক, ২০২২-২৩-এর বাজেট প্রস্তাবে, অর্থমন্ত্রী বরাদ্দ কমিয়ে ৭৩ হাজার কোটি টাকা ধার্য করেছেন। সুবিধাবঞ্চিত অংশগুলির জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে সরকারের সমর্থনের অভাব বোঝায়। যখন ব্যক্তিগত খরচের বেলায় সরকারের ভর্তুকি যথেষ্ট কম, তখন MGNREGA-তে বরাদ্দ হ্রাস অবশ্যই ভুল পথে একটি পদক্ষেপ।

NFSA-এর অধীনে পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের জন্য বরাদ্দ আরও মারাত্মকভাবে হ্রাস করা হয়েছে। ২০২১-২২-এর সংশোধিত অনুমানের ২ লক্ষ ৮৬ হাজার কোটি টাকার বদলে ২০২২-২৩-এর জন্য এই প্রকল্পের অধীনে বরাদ্দ করা হয়েছে ২ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। অন্য কথায়, আগামী অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ চলতি অর্থ বছরে পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমে যে ব্যয়ের প্রস্তাব রয়েছে তার থেকে প্রায় ৩৯ শতাংশ কম। উচ্চস্তরের মুদ্রাস্ফীতি ইতিমধ্যেই শ্রমিক শ্রেণির পকেট কাটছে। সঙ্কুচিত পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবস্থা তাদের আরও গভীর সংকটে ঠেলে দিতে পারে।

অর্থমন্ত্রী কীভাবে ২০২২-২৩ বাজেটে অর্থ সংগ্রহের প্রস্তাব করেছেন? ২০২১-২২-এর সংশোধিত অনুমানের তুলনায় সরকারের কর রাজস্ব ৯ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা ১৫.৬ শতাংশ জিএসটি সংগ্রহের উপর নির্ভরশীল। মজার বিষয় হল, বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা ১৬ শতাংশেরও বেশি কমে গেছে, যা একটি আকর্ষণীয় পরিসংখ্যান। কয়েক মাস আগে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য সরকারি সম্পদের নগদীকরণ বা বেসরকারি ক্ষেত্রে হস্তান্তর করার প্রস্তাব করা হয়েছিল, অথচ বাজেটে তার বিপরীত ছবি ফুটে উঠেছে।

আমরা শুরুতেই বলেছিলাম যে সরকার নির্বিকারভাবে মেনে নিয়েছে যে সরকারি বিনিয়োগ না বাড়লে বেসরকারি ক্ষেত্রের বিনিয়োগ বাড়বে না। সরকার যদি বিশ্বাস করে যে বেসরকারি ক্ষেত্রের বিনিয়োগের এটাই একমাত্র উপায়, তাহলে অতিরিক্ত সম্পদ সংগ্রহ করতে হবে। একটি পদ্ধতি, যা এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, কিন্তু রাজনৈতিক অর্থনীতির বিবেচনার কারণে হয়নি, কর্পোরেটদের কর আরোপের ফাঁকগুলিকে ভরাট করছে৷ এই ধরনের ত্রুটিগুলি ই-ফাইলিং-এর মাধ্যমে কোম্পানিগুলির দেওয়া কর সংক্রান্ত বিশদ বিবরণে স্পষ্ট। এই বিষয়ে যে তথ্য সরকার কেন্দ্রীয় বাজেটে ২০০৫-০৬ থেকে প্রদান করছে তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে কোম্পানিগুলির করের আগে লাভের পরিসর ক্রমশঃ কমে যাচ্ছে।

বাজেট নথি অনুসারে ২০০৫-০৬-এর ৩.০২ লক্ষ কোম্পানির ৩৫.১ শতাংশ লোকসানে চলেছিল। তুলনায় ২০১৯-২০-তে ৯.১৭ লক্ষ কোম্পানির ৪৮.৬ শতাংশ জানিয়েছে যে তারা লোকসান করছে। অর্থাৎ লোকসানে চলা কোম্পানির সংখ্যা বিগত ১৪ বছরে ৩৮.৪৬ শতাংশ বেড়ে গেছে। ২০১৯-২০-র হিসেব অনুযায়ী ৪ শতাংশ কোম্পানি কোনো লাভ করেনি। ৪১.৫ শতাংশ কোম্পানি ১ কোটি টাকা বা তার কম লাভ করেছে। অর্থাৎ ২০১৯-২০-তে বড়ো কর্পোরেটগুলির ৯৪ শতাংশেরও বেশি ন্যূনতম কর জমা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় বাজেটের উপর এই আলোচনার শেষে একটি সহজ প্রশ্ন অবশ্যই জিজ্ঞেস করা যেতেই পারে - এটি কার বাজেট?