আরেক রকম ● দশম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ● ১-১৫ ফাল্গুন, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে রাষ্ট্রের আলোচনাঃ গণতন্ত্রের জন্য অশনি সঙ্কেত


শেষ পর্যন্ত ঝুলি থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়ল। কেন্দ্র ও আসাম সরকারের সঙ্গে নিষিদ্ধ বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি সংগঠন কেএলও-র (কামতপুরী লিবারেশন অর্গানাইজেশন) শান্তি আলোচনা কার্যত শুরু হয়ে গেল। চৌঠা ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বিকেলে অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা, দেশান্তরী কেএলও প্রধান জীবন সিংহ, জীবন সিংহের ধর্মপুত্র দিবাকর দেবরাজ সিংহ ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তাদের মধ্যে এক দফা ‘ভার্চুয়াল’ বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে কেএলও প্রধান জীবন সিংহ জানিয়েছেন, তিনি শান্তিচুক্তির জন্য চূড়ান্ত আলোচনায় অংশ নিতে দিল্লি আসতে তৈরি। এই মাসেই নাকি তিনি ভারতে আসতে পারেন।

দিবাকর দেবরাজ সিংহ জানিয়েছেন, শুক্রবার বিকেল ৩টে ৩৮ মিনিটে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তর উদ্যোগে মায়ানমারে থাকা জীবনের সঙ্গে বৈঠক শুরু হয়। স্বরাষ্ট্র দফতরের তরফে ১৯৪৯-এর কোচবিহার সংযুক্তিকরণ চুক্তির ভিত্তিতে আলোচনা ও মীমাংসার আশ্বাস দেওয়া হয় কেএলও-কে। যদিও সেই চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গেরও কয়েকটি জেলার প্রসঙ্গ রয়েছে, কিন্তু এ দিন বাংলার কাউকে এই আলোচনায় আনা হয়নি।

জীবন সিংহও স্পষ্ট জানিয়েছেন, চুক্তি যেহেতু কোচ রাজার সঙ্গে ভারত সরকারের হয়েছিল, তাই শান্তি আলোচনাও সরাসরি কেন্দ্রের সঙ্গেই হবে। শান্তি চুক্তিও হবে ভারত সরকারের সঙ্গেই। জীবনপুত্র দেবরাজ জানান, ‘‘আলোচনা ও চুক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। অতি শীঘ্রই বাবা দিল্লি পৌঁছাবেন। আলোচনা ও চুক্তির পর্বও দ্রুত সম্পন্ন করা হবে।’’ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আলোচনা না করেই সেই রাজ্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ কি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সম্ভব, সেই প্রশ্নও থাকছে।

এই আলোচনায় আত্মসমর্পণ করা কেএলও নেতানেত্রীদের কী ভূমিকা হবে? আলোচনায় কী ভূমিকা হবে আক্রাসু ও অন্যান্য কোচ-রাজবংশী সংগঠনের? আসামের অবিভক্ত গোয়ালপাড়া নিয়ে তৈরি কামতাপুর স্বশাসিত পরিষদের ভবিষ্যতই বা কী হবে?

আসাম সরকারের তরফে জানানো হয়, আলোচনার ভিত্তিতে পরিষদের ভাগ্য নির্ধারণ করা হবে। দেবরাজ জানিয়েছেন, আলোচনায় নেতৃত্ব দেবে কেএলও। অন্য কোনও সংগঠনের সেখানে ভূমিকা নেই। এই প্রক্রিয়ায় বাধা দিলে ফল ভয়ঙ্কর হবে বলেও হুমকি দিয়েছেন তিনি। দেবরাজ বলেন, “বাবাকে যত দ্রুত সম্ভব ফিরিয়ে আনা ও কোচ-কামতাপুর রাজ্য গঠন করাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। তার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।”

কেএলও কয়েক বছর আগে বাংলার উত্তরাঞ্চলে এবং আসামের দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। কেএলও-র দাবি বাংলা, আসাম ও বাংলাদেশের আটটি জেলা নিয়ে পৃথক রাজ্য গড়ে দিতে হবে। এই দাবির পক্ষে প্রথম দিকে কিছু মানুষ জড়ো হলেও কিছুদিনের মধ্যেই কেএলও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কেএলও নেতারা আত্মগোপন করে। কেএলও-কে নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কেএলও নেতা-কর্মীদের অনেকে দেশান্তরী হয়। বাদবাকি সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আত্মসমর্পণ করে সমাজের মুলস্রোতে ফিরে আসে।

আসামের মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সবকটি সংগঠনকে একই ছাতার নীচে আনার উদ্যোগ নিয়েছেন। জানুয়ারি মাসে গুয়াহাটির আমিনগাঁওতে প্রথমবার এক মঞ্চে আলোচনায় আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের আত্মসমর্পণকারী কেএলও-র নেতা-নেত্রীরা মিলিত হয়ে কোচ-রাজবংশী সংগঠনগুলিকে এক মঞ্চে এনে নতুন করে আলোচনা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রাক্তন কেএলও সন্ত্রাসীরাও সেখানে উপস্থিত। আত্মগোপনকারী কেএলও নেতার প্রতিনিধিও সেই বৈঠকে ছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের আগ্রহে এবং আসাম সরকারের উদ্যোগে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আলোচনার টেবিলে বসলেও কোচ ও রাজবংশীরা অনেক মতে বিভক্ত বলে সংবাদমাধ্যমের খবর। সংগঠনগুলি জানিয়েছে, রাজ্য না হলেও অন্তত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল চায় তারা।

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের পর উত্তরবঙ্গের জন্য আলাদা রাজ্যের দাবি তুলেছিলেন আলিপুরদুয়ারের সাংসদ। তিনি আবার এখন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী। কোচবিহারের সাংসদও কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী। তাঁদের মুখে এখন এই বিষয়ে কোনো কথা নেই।

কোচ-রাজবংশী সংগঠনগুলি ও প্রাক্তন কেএলও সন্ত্রাসী এবং আত্মগোপনকারী কেএলও প্রতিনিধিকে এক ছাতার তলায় আনার প্রক্রিয়ার মধ্যে অশুভ ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী একদিকে নিয়মিত স্থানীয় জনজাতির মানুষের বাসস্থান উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন আবার অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের একজোট করার চেষ্টা করে চলেছেন। দেশের ঐক্য ও শান্তির জন্য এই প্রবণতা যথেষ্ট আশঙ্কাজনক।

সরকারের নীতির সমালোচনা করলেই দেশের ছাত্র শিক্ষক সাংবাদিক সমাজকর্মীরা কখনও দেশদ্রোহী বা আর্বান নকশাল কিংবা টুকরে টুকরে গ্যাং ইত্যাদি নামে চিহ্নিত হয়ে যান। কখনো তাঁদের ঠাঁই হয় কারাগারের অন্দরে আবার কখনও নিখোঁজ হয়ে যেতে হয়, পাশাপাশি রাষ্ট্র যখন স্বতপ্রণোদিত হয়ে রাষ্ট্রদ্রোহী বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে আলাপ আলোচনা শুরু করে তখন সেই সব ক্ষমতাসীনদের কী আখ্যা দেওয়া হবে?

বিচ্ছিন্নতাবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া এই ধরনের আচরণের বিরোধিতায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিও আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। তাদের মৌনতায় রাষ্ট্র আরও উজ্জীবিত হয়ে উঠছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ যোগাযোগের খবর সংবাদমাধ্যমও সাধারণভাবে প্রচার করে না। সংবাদমাধ্যম হয় রাষ্ট্রের কাছে মাথা নত করে দিয়েছে অথবা আত্মসম্মান বিকিয়ে দিয়েছে। সবমিলিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়ে দেখা দিয়েছে। এখনও এই ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ না করলে ভবিষ্যতে অনেক ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে।