আরেক রকম ● দশম বর্ষ চতুর্বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

‘প্রতিবেশীদের চোখে ছিল সন্দেহ’

প্রবুদ্ধ বাগচী


আমরা যেদিন আগুনের নদী থেকে
তুলে আনলাম মা-র ভেসে যাওয়া দেহ
সারা গা জ্বলছে, বোন তোর মনে আছে
প্রতিবেশীদের চোখে ছিল সন্দেহ...

‘সন্দেহ’ এই শব্দটার দিকে তাকালেই আমাদের মনে পড়ে যায় জয় গোস্বামীর ‘সৎকার-গাথা’ কবিতার এই চারটে লাইন। খুব নিজেদের মতো করে ভাবতে ইচ্ছে করে দৃশ্যটা। ঝলসে যাওয়া মায়ের শবদেহ নিয়ে ভাইবোনের স্বাভাবিক শবানুগমন। অথচ প্রতিবেশীদের চোখে সন্দেহ। কী সন্দেহ করে তাঁরা? মায়ের মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ, নাকি ওই ভাইবোনের শব বহনের অধিকার নিয়ে? পুরো কবিতাটায় তার নানা আভাস আছে, তবে আপাতত আমরা সেই পথে যাব না।

বরং ওই প্রতিবেশীদের চোখে ঠিকরে ওঠা সন্দেহটুকু নিয়ে ভাবতে বসলে এসে পড়ে আরও এক সন্দেহের গল্প কথা। সে তো আস্ত একটা রাজ্যের মানুষের মনে উঁকিঝুঁকি মারা সন্দেহ। রঘুকুলপত্নী সীতাদেবী যে লঙ্কাপুরীতে অতগুলো দিন কাটিয়ে এলেন - অক্ষত আছে তো তাঁর সতীত্ব? শুধু এই সন্দেহের নিরসনেই রাম নামক এক পৌরাণিক নায়ককে দাঁড়াতে হল এক বিভাজনরেখার ওপর। যার একদিকে তাঁর বিবাহিত স্ত্রী, অন্যদিকে প্রজাসমাজ। প্রতিবেশী শব্দটা পাল্টে কখন যেন হয়ে গেছে প্রজা নামক এক আয়তনহীন সত্ত্বা। আর এই সন্দেহই শেষ পর্যন্ত তৈরি করে দেবে মহাকাব্যের এক ট্রাজিক মুহূর্ত, যখন মাটির কন্যা জানকীকে এসে দাঁড়াতে হবে অগ্নিপরীক্ষার সামনে। রামায়ণের আমলে গণতন্ত্রের বালাই ছিল বলে মনে হয় না, তবু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজার জমাট-বাঁধা সন্দেহের সামনে রাজমহিষীকে যখন আগুনের সামনে নতজানু হতে হয় তখন এই সন্দেহ বিষয়টাই পেয়ে যায় এক মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি। সমাজমনের সন্দেহ একদিকে যেমন শাসকের ব্যক্তিমনকে গ্রাস করে নেয়, তেমনই নিছক একটা সন্দেহ এক নারীর মর্যাদাকে ধ্বস্ত করে দেয় প্রকাশ্যে। তারপর, যতবার আমরা ‘অগ্নিপরীক্ষা’ শব্দটির পাশে এসে দাঁড়াই, তার মধ্যে দেখতে পাই প্রতিবেশীদের সারি সারি সন্দিগ্ধ চোখ। মহাকাব্য তো এমনই হয়। মানুষের চিরকালীন জীবনধারার ওপর সে বিছিয়ে দেয় তার ছায়া। সন্দেহ বিষয়টাই জড়িয়ে যায় আমাদের প্রতিদিনের জীবনের বাঁকে বাঁকে, নতুন নতুনতর মাত্রায়।

আমরা খুঁজে পাই, পুরাকালের সেই অপহৃতা রাজবধূর শারীরিক শুচিতা নিয়ে উঠে আসা আলোড়িত সন্দেহ এখনো বাসা বেঁধে আছে সামাজিক মনে। দূর গ্রামের কোনো নারীকে হয়তো সন্দেহ করা হল, সে বুঝি কোনো ‘অবৈধ’ সম্পর্কে লিপ্ত - জোটবদ্ধ গ্রামবাসী তারপর নিজেরাই তৈরি করে নেয় তার বিহিত। কোথাও বসে পঞ্চায়েতের সালিশী সভা অথবা নিজেদের মতো করে বসানো বিচারসভা। কখনো কেটে নেওয়া হয় সেই নারীর চুল, কখনো বিবস্ত্র করে তাকে ঘোরানো হয় সারা গ্রাম। অথবা জোর করে স্থানীয় কোনো পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় তার। আর যদি তাকে সন্দেহ হয় ‘ডাইনি’ বলে, তাহলে বিচার, প্রমাণ, সালিশী সমস্ত বাতিল। শুধুমাত্র একটি সন্দেহ অনুমোদন দেয় তাকে পিটিয়ে বা পুড়িয়ে মেরে ফেলার। পুড়িয়ে মারতেও অনিবার্য প্রয়োজন আগুন। সন্দেহ থেকে অগ্নিপরীক্ষা নয় আর, একেবারে আগুনে ফেলে মারা। যারা মারে তাঁদের চোখে সুতীব্র সন্দেহ। এবং সংহার। তাঁরাও নিশ্চয়ই কারোর প্রতিবেশী। আর যে মেয়ে আগুনের ভিতর থেকে আকাশের দিকে তুলে ধরতে চাইছে তার আর্ত হাতদুটো - সেও কারো প্রতিবেশী অথবা স্ত্রী অথবা বোন কিংবা মা। এই মা-কেই কি আমরা আগুনের নদী থেকে তুলে আনতে দেখেছি ওই ‘সৎকার-গাথা’ কবিতায়?

এই দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে গেলে আবারও এক মায়ের মুখ। এই গল্পটা এক যুদ্ধক্ষেত্রের। নিছক সন্দেহের বশে কৌরবসেনা রাতের অন্ধকারে হত্যা করেছে তার পুত্রদের। প্রতিবাদে অনশনে বসেছেন পঞ্চপুত্রের জননী। যুদ্ধের প্রান্তরে হত্যার সপক্ষে কোনো যুক্তি সাজাতে হয় না। তবু ক্ষমতার রণাঙ্গনে দাঁড়িয়ে দৃপ্ত দ্রৌপদী জানতে চান, শুধুমাত্র সন্দেহ কেন ভিত্তি হয়ে থাকবে এমন বীভৎসার? সময়ের অনেক পথ পেরিয়ে আধুনিক ভারতের এক যুবতীকে প্রায় একই রকম প্রশ্ন তুলতে দেখব আমরা । সেনাবাহিনীর বিশেষ নিরাপত্তা আইনের ক্ষমতাবলে ভারতীয় আধাসেনা একইভাবে শুধু সন্দেহের বশে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল মণিপুরের কিছু নিরীহ নাগরিকের। এই অনিয়ন্ত্রিত হিংসার বিরুদ্ধে অনশনে বসেছিলেন শর্মিলা চানু। দীর্ঘদিন চলেছিল তাঁর অনশন, সারা বিশ্বে খবর হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। আরও একবার মণিপুরের নিরাপত্তা-বাহিনী সন্দেহের বশে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে তুলে আনল মনোরমা-নাম্নী এক যুবতীকে। তারপর তার মৃতদেহ পাওয়া গেল শহরের প্রান্তে, যে শরীরে ছিল ধর্ষণ ও খুনের স্পষ্ট সাক্ষ্য। সন্দেহনির্ভর এই প্রশাসনকে বেআবরু করতে এবারে মণিপুরের মায়েরা নিজেদের পোষাক খুলে আড়াল নিলেন প্রকান্ড এক ব্যানারের। তাতে লেখা ছিলঃ ইন্ডিয়ান আর্মি, রেপ আস। ডেটলাইন ১৯ জুলাই ২০০৪, কাংলা ফোর্ট, মণিপুর।

এই একই রকমের নানা ঘটনায় ঘুরপাক খেয়েছে কাশ্মীর, দিনের পর দিন বছরের পর বছর। ‘হারিয়ে যাওয়া’ নাগরিকদের সন্ধানে তাঁদের প্রিয়জনেরা তৈরি করেছেন মঞ্চ, এখানে ওখানে সেখানে খুঁজে ফিরেছেন তাঁদের। এর প্রতিটি ‘হারিয়ে যাওয়া’র পেছনে কোনো সন্ত্রাসী অতীত ছিল না, ছিল স্রেফ সন্দেহ আর আগ্রাসন। আজও কাশ্মীর সেই মূল্য দিয়ে চলেছে, দিন তেমন বদলায়নি। বরং আরও দামাল হয়েছে প্রশাসন। সন্দেহের ব্যাসার্ধ বাড়তে বাড়তে এখন প্রতিটি সমাজকর্মী, প্রতিটি প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর সন্দেহের আতস কাচের তলায়। তাঁদের ন্যায্য জামিন বারবার প্রতিহত হয় এমনকি সুউচ্চ ন্যায়ালয়ের দেয়ালেও। অথচ কেউ কেউ তাঁরা অশীতিপর, অশক্ত, সামান্যতম ‘দেশবিরোধিতা’র প্রমাণও সংগ্রহ করা যায় না তাঁদের বিরুদ্ধে - তবু রাষ্ট্রের সন্দেহ তাঁদের পেছু ছাড়ে না। মনে পড়ে, হোয়াইট হাউসের বিপরীত দিকেও একদিন জমায়েত হয়েছিলেন মার্কিন দেশের বিবেকী নাগরিক সমাজ। তাঁরা ধিক্কার দিচ্ছিলেন মার্কিন প্রশাসনকে। কেন না শুধুমাত্র মারণাস্ত্র সঞ্চয় করে রাখার সন্দেহে সেই সময় ইরাকের ওপর নেমে এসেছিল আগ্রাসী মার্কিন হানা। নিরীহ নাগরিকদের প্রতিকারহীন মৃত্যুর মিছিলে সেদিন নেতৃত্ব দিচ্ছিল সন্দেহ। স্রেফ সন্দেহ। আজকের রুশ ইউক্রেন যুদ্ধের পেছনেও কি কোনো সদুত্তর আছে? নিছক সন্দেহ ছাড়া! ক্ষমতার স্বভাবধর্ম সন্দেহ, আর সেই ধর্ম উদযাপনে নির্মিত হয় হিংসা আর নিষ্ঠুরতার মূর্তি।

এইসব ঘটনার কথা ভাবতে গিয়ে হঠাৎ উঁকি মেরে গেল অন্য একটা কাহিনি। প্রতিবেশী নয়, সেটা ছিল সহযাত্রীদের সন্দেহ বৃত্তান্ত। তীর্থ-ফেরত সেই তরণীতে তাঁরা সকলেই ফিরছিলেন স্বগৃহে। আর ছিল এক শিশু, তার মাসি এবং এক বিপ্র। ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ নদীতে অকস্মাৎ যখন নৌকো বেসামাল, প্রাণভয়ে ভীত যাত্রীদের মনে ঘনিয়ে উঠছিল প্রবল সন্দেহ - ‘কে যায় ফিরায়ে লয়ে দেবতার ধন!’। এর পরের ঘটনা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু এমন এক তুলনারহিত নির্মমতার অন্তরালে আবারও সেই সন্দিগ্ধ চোখের করাল দৃষ্টি ও সংস্কারের যুক্তিহীন আঁধার। সবটা মিলিয়ে যদি একটা হননের আগুন হয় তবে আবারও দেখতে পাচ্ছি একটা আগুনের নদী। তার মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে এক শিশুর শরীর - মাসি! মাসি! সূর্য অস্তাচলে যাওয়ার পরে সে নদী এখন নিশ্চল।

তবে সব ছেলেই যে এমন জলে পড়ে তলিয়ে যায়, তা নয়। কিছু ছেলে চলে যায় বনে, আর ফেরে না। সত্তরের দশকে পুলিশ এমনভাবেই সন্দেহের বশে তুলে নিয়ে যেত অনেক তরতাজা যুবককে। সকলেই যে তেমনভাবে সশস্ত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন নয়। কিন্তু তাঁরা অনেকেই আর ফিরতেন না। একটা সময় (২০০৬-১১) রাজ্যের জঙ্গলমহলেও ঘটেছে একই ঘটনা। নিছক ‘মাওবাদী’ সন্দেহের বশে আটক করা হয়েছে অনেক আদিবাসী যুবককে। তারপর কেউ ছাড়া পায় কেউ বা সাজানো মামলায় জেলে আটকে থাকে মাসের পর মাস। আবার বিপরীত দিকে, সেই সত্তর দশক থেকেই কাউকে ‘সন্দেহ’ করা হয়েছে পুলিশের চর হিসেবে, কাউকে মনে করা হয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক দলের এজেন্ট - আর এই সন্দেহের কারণেই খতম করে দেওয়া হয়েছে তাঁদের, কোনো আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই। সত্তর দশকের উত্তরসূরী বলে দাবি করা ‘মাওবাদীরা’ও কোনো বিকল্প উদাহরণ রাখতে পারেননি। শুধু পুলিশের রিভলভারের গুলির শব্দই নয়, গত শতকের সাতের দশকে কান পাতলেই শোনা যাবে পরস্পরকে সন্দেহ-করা রাজনৈতিক কর্মীদের আত্মক্ষয়ী গুলির আওয়াজ। একইভাবে অশান্ত জঙ্গলমহলে নিছক সন্দেহই ঘটিয়ে দিয়েছে সীমাহীন রক্তপাত। আসলে ক্ষমতা তার সন্দেহের পক্ষে কোনো জবাবদিহি করে না - রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনীরাও নয়, রাষ্ট্রবিরোধী সশস্ত্র গেরিলাবাহিনীরাও নয়।

আমাদের মনে পড়তেই পারে, গত শতকের নয়ের দশকের মাঝামাঝি হঠাৎই সারা রাজ্য জুড়ে বেপরোয়া গণধোলাই ও পিটিয়ে মারার ঘটনা বেড়ে গিয়েছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই সমবেত হিংসার উৎস ছিল কোনো তুচ্ছ সন্দেহ। সেই সময় গণহিস্টিরিয়ার মতো এই সন্দেহ-নির্ভর হিংসা নিয়ে একটা গান বেঁধেছিলেন কবীর সুমন। সেই গানে ছিল এমন লাইনঃ ডটপেন দিয়ে খোঁচানো চোখে/ শান্তির হাওয়া গন্ধ শোকে/ গণ পিটুনির আজব গন্ধ/ ক্ষত বিক্ষত ছেলেটার গালে/ পথচারী তার দেশলাই জ্বালে...

কে বলতে পারে, সন্দেহের এমন সব ল্যান্ডমাইন আমরাও পেতে রাখিনি আমাদের ব্যক্তিমনের সদরে, অন্দরে অথবা গোপন সঙ্কীর্ণ গলিপথে?

২.

ধরা যাক, ওথেলো ডেসডিমোনার চেনা গল্পটা। নিজের প্রণয়ী অন্য কারোর প্রতি অনুরক্ত এই তীক্ষ্ণ সন্দেহে ওথেলো শেষ পর্যন্ত হত্যা করে ডেসডিমোনাকে। সন্দেহের সঙ্গে তীব্র অধিকারবোধের সংঘাতই শেষ অবধি হয়ে ওঠে এই হত্যার নির্ণায়ক। পাঁচশো বছর পেরিয়ে আসা এই কাহিনির মধ্যে অবশ্যই লুকোনো ছিল ভাবীকালের মানুষের মনস্তত্ত্ব। ব্যক্তিগত প্রেমের সম্পর্কে এই সন্দেহের টানাপোড়েন আজও সমানভাবে সত্যি। আজকের মানুষের কাছে হত্যা একটা আইন-বিরোধী ঘটনা। তবু খবরের কাগজের আনাচে কানাচে এমন সংবাদ বিরল নয় যেখানে প্রেমিকার প্রতি প্রেমিকের সন্দেহ অথবা উল্টোটা, শেষ অবধি পরিণতি পাচ্ছে হত্যা বা আত্মহত্যায়। বিশেষ করে একেবারে তরুণ বয়সে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে ত্রিকোণ প্রেমের এমন অনেক ঘটনাই আমরা জানি, যেখানে সন্দেহ বারবার ডেকে এনেছে বিপর্যয়। হয়তো একটি ছেলে সন্দেহ করছে তার সঙ্গিনীটিকে তারপর অ্যাসিড বাল্ব ছুঁড়ে দিচ্ছে তার দিকে বা সঙ্গিনী তার আরাধ্য সঙ্গীকে পেতে দুনিয়া থেকে অনায়াসে সরিয়ে দিচ্ছে তার প্রাক্তনকে। যারা এমন করছেন তাঁরা যে জাত অপরাধী এমন মোটেও নয় - শুধুমাত্র সন্দেহ, শুধুমাত্র আহত অধিকারবোধ একটা সুস্থ স্বপ্নকে সরিয়ে দিচ্ছে প্রাণহীন বিষাদে। মাঝে মাঝে মনে হয়, সন্দেহের হাত আমাদের জীবনে সত্যিই কত দীর্ঘ!

দাম্পত্যের ঘেরাটোপে এই সন্দেহই তো বিষবৃক্ষের মতো শুষে নেয় সম্পর্কের জরুরি প্রাণবায়ুটুকু। কত স্বাভাবিক দাম্পত্য ভেঙে যায় নিছক কিছু সন্দেহের ভুল বোঝাবুঝিতে। যদি একটু দৃষ্টি ঘোরাই সমাজতত্ত্বের দিকে, দেখতে পাব, বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনেও এসেছে এমন এক পর্ব যখন আর্থ-সামাজিক পরিবেশ তাঁদের মধ্যে রোপন করে দিয়েছে সন্দেহের বীজ। একান্নবর্তী পরিবারগুলি ভেঙে যখন তৈরি হচ্ছিল অণু-পরিবার, যখন অর্থনৈতিক সংকট ও আর্থিক সুস্থিতির জন্য বাড়ির মেয়েরাও পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেরিয়ে পড়ছিলেন নানা জীবিকায় তখন এই সামাজিক পরিবর্তনের সাপেক্ষে বাঙালি পুরুষরা এক সংকটে ভুগতেন। তাঁদের স্ত্রীরা চাকরি করতে পথে বেরিয়েছেন - না-জানি বাইরে তাঁরা কী করছেন, কাদের সঙ্গে মিশছেন, এইসব মিলিয়ে মিশিয়ে একরকমের সন্দেহ তাঁদের মধ্যে ছেয়ে আসত হেমন্তের কুয়াশার মতো। সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’ ছবিতে তার একটা আভাস আমরা মনে করতে পারি। আবার ‘প্রথম কদমফুল’ ছবিতে দেখি চাকুরিরত স্ত্রী-র সঙ্গে তার প্রাক্তন প্রেমিক ও বর্তমান স্বামীর ধারাবাহিক দূরত্বের নির্মাণ, যার উৎসে ছিল একরকমের সন্দেহ। এক সময়ের আলোড়ন ফেলা ছবি ‘সাত পাকে বাঁধা’তেও পাই দাম্পত্যের দ্বন্দ্ব ও বিশ্বাসের ফাটল, যার মূলে আবারও সেই সন্দেহ। তবে এখানে কোনো জীবিকানির্ভর দ্বন্দ্ব নেই, যেমন নেই সত্যজিতের ‘পিকু’ ছবিতে। বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ককে ঘিরে আধুনিক মনের টানাপোড়েনে এমন সব সন্দেহের মাইলফলক থেকেই যায়।

তবে একটা সময় পর্যন্ত এইসব ক্ষেত্রে দাম্পত্যের পুরুষ সঙ্গীটির সন্দেহ ও সংকটকেই বেশ একতরফা ভাবে সাহিত্যে উপজীব্য করে তোলা হয়েছে। নারীটিরও যে পূর্ণ অধিকার আছে প্রয়োজনে তার সঙ্গীকে সন্দেহ করার ও দরকারে সেই সন্দেহ সোচ্চারে ঘোষণা করার বা প্রয়োজনে দাম্পত্য ছেড়ে বেরিয়ে আসার - এইসব বিষয় লেখালিখির মধ্যে তুলনায় এসেছে কম। সেটা হয়তো সামাজিকভাবে মেয়েদের অবস্থান খানিকটা কোণঠাসা ছিল বলেই। আজ নিশ্চয়ই পরিস্থিতি এতটা খারাপ নয়। ‘পারমিতার একদিন’ ছবিতে পারমিতা চরিত্রটি তাকে ঘিরে স্বামীর সন্দেহের প্রতিবাদে বিচ্ছেদ মেনে নেয়। এমন চরিত্র আরো আছে আমাদের আশেপাশে। এই প্রসঙ্গে, একটা ব্যক্তিগত কৌতূহলের কথা বলতে ইচ্ছে করে। আমাদের রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক পদাবলী সাহিত্যে যে পরকীয়া-প্রেমের জয়গান, সেখানে কী কারণে যেন নারীর প্রতি সন্দেহের অভিমুখ খুব স্পষ্ট নয়। ভরা বরষার গভীর নিশীথে রাধিকা চলেছেন কৃষ্ণ অভিসারে অথচ স্বামী আয়ান ঘোষ কেন সন্দেহ করেন না তার প্রিয়াকে? পদাবলীতে এই বেচারা পুরুষটির মানসিক দ্বন্দ্বের কোনো অভিক্ষেপ একেবারেই আবছা। আর সেদিনের প্রতিবেশীরা? তাঁদের চোখেও কি উধাও হয়ে গেল সন্দেহের চিরকালীন বাষ্প?

প্রতিবেশীদের সন্দেহের কথা যখন আবার এসেই পড়ল তখন তুলে আনা যেতে পারে মৃণাল সেনের ‘কলকাতা-৭১’ ছবির কথা। এই ছবির দ্বিতীয় আখ্যানটি গড়ে উঠেছে আকাল-পীড়িত কলকাতা শহরের এক অভাবী পরিবারকে ঘিরে। সেই পরিবারে একমাত্র রোজগেরে এক অকাল-বিধবা যুবতী, যে ওই পরিবারের বড় মেয়ে। সেই মেয়েটির বাইরে বেরোনো, অসময়ে বাড়ি ফেরা সমস্ত কিছু উসকে দেয় সাত ভাড়াটের বাড়ির প্রতিবেশীদের সন্দেহ। সেই সন্দেহ ফিল্মে তৈরি করে এক সূক্ষ্ম টেনশন। কারণ শহরে তখন আকাল, পেটের দায়ে উল্টেপাল্টে যাচ্ছে সব হিসেবনিকেশ। এই সন্দেহ আরও এক নতুন মাত্রায় ফিরে এল ‘একদিন প্রতিদিন’ ছবিতে। অফিস থেকে রাতে বাড়ি না-ফেরা মেয়েটি আসলে কেন ফিরল না, ছবির একেকটা শট যেন উন্মোচন করেছে সেই বহুমাত্রিক সন্দেহের পাঠ্যক্রম। প্রতিবেশীদের টুকরো টুকরো প্রতিক্রিয়া, শারীরিক মুদ্রা সব মিলিয়ে সে যেন সন্দেহ অনুভূতিটারই এক অনবদ্য চলচ্চিত্রায়ন। ছবির শেষে যখন মেয়েটি বাড়ি ফিরে আসে আর পুঞ্জীভূত প্রতিবেশীদের সঙ্কলিত সন্দেহ যেন ভেসে ভেসে যায় পর্দা জুড়ে - নির্বাক অথচ শান-দেওয়া। আসলে যা তখন বদলে গেছে বিস্ময়ের বুদবুদে। বহুবছর আগে দেশছাড়া মনমোহনের হঠাৎ কলকাতা ফেরার খবরে তার ভাগ্নির পরিবারের ধারাবাহিক সন্দেহ বারবার আছড়ে পড়ে ‘আগন্তুক’ ছবির কাহিনিতে। যিনি আসছেন, তিনি সঠিক মামা, নাকি কোনো জালিয়াত? গোটা ছবি জুড়ে এই টেনশন আর নানা রকম ‘অগ্নিপরীক্ষা’র আয়োজন, যার পরিসমাপ্তিতে পরিচালক আসলে ধাক্কা দিয়ে যান আমাদের এই সন্দেহ আর অবিশ্বাসের ধরনটাকেই। সন্দেহ তখন উত্তীর্ণ হয়ে যায় সন্তাপে আর বদলে যান এক সন্দেহ-দীর্ণ দম্পতি।

তবে এই বিস্তারিত ব্যঞ্জনার বড় মাপের সন্দেহের পাশাপাশি আমাদের পায়ে পায়ে ঘোরে কিছু নিরীহ সন্দেহের অণু-পরমাণু। উঠতি বয়সের ছেলের বাবা সন্দেহ করেন তার ছেলেটা বোধহয় বখে যাচ্ছে! কিম্বা লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট টানতে শিখছে না তো? বা ড্রাগ? হঠাৎ করে মেয়েটার এমন সাজগোজের বহর কেন? ফোনে এতক্ষণ কার সঙ্গে কথা? মেয়ের মায়ের মনে জড়ো হতে থাকে সন্দেহ। কোচিং-এ পড়তে আসা দেবলীনার মা সন্দেহ করেন কৌস্তভের মা-কে, তার ভাবনা স্যারকে ম্যানেজ করে ও বেশি নোট নিয়ে নিল না তো? মা-রাও যে ছেলেদের কীভাবে সন্দেহে বিদ্ধ করেন তার একটা মর্মান্তিক চিত্রায়ন আমরা পেয়েছি কয়েক বছর আগে তৈরি হওয়া ‘ইচ্ছে’ ছবিতে। ছেলের পড়ার টেবিলে বই হাতড়ানো, তার ব্যক্তিগত চিঠি খুলে পড়া এগুলো একটা ছেলেকে (মেয়েকেও বা নয় কেন?) কীভাবে বিপর্যস্ত করে তা আমরা দেখলাম এই ছবিতে। ছেলে বা মেয়ের অনুপস্থিতিতে তার মোবাইলের মেসেজ পড়া বা কল চেক করার প্রবণতাও আসে এক ধরনের দিগভ্রান্ত সন্দেহ থেকে। সেই সঙ্গে অভিভাবক হিসেবে ক্ষমতার একটা একবগগা স্পর্ধাও এখানে বোধহয় সক্রিয়, যে ক্ষমতা সন্দেহ করাটাকেই তার অধিকার বলে মনে করে থাকে। খেয়াল করলে দেখা যায়, উত্তম-সুচিত্রার সেইসব হাউসফুল সিনেমায় ছবি বিশ্বাস বা কমল মিত্র যখন নায়ক বা নায়িকার দাপুটে রাশভারি বাবাদের চরিত্রে অভিনয় করতেন তখনও কিন্তু ঠিক এই ধরনের ব্যবহার আমরা ফিল্মে চিত্রায়িত হতে দেখিনি।

অন্যদিকে কর্পোরেট অফিসের বড় চাকুরেদের সন্দেহ তার সহকর্মীদের। ‘বস’-এর সঙ্গে বেশি মাখামাখি করে কেউ আগে ‘লিফট’ পেয়ে যাবে না তো? আবার ‘পথের পাঁচালী’তে দেখি প্রতিবেশীর অভিযোগে সর্বজয়া সন্দেহ করে বসেন মেয়ে দুর্গাকে, উপলক্ষ নেহাতই একটা পুঁতির মালা। তার জন্য তিরস্কার ও নির্যাতন জোটে দুর্গার কপালে। আমরা ভাবতেই পারি, যদি অকালমৃত্যু না হত দুর্গার তাহলে একদিন ঘর-সংসার হত তার। সেই কল্পিত সংসারে শাশুড়িও হয়তো সন্দেহ করত পুত্রবধূ দুর্গাকে - তাঁদের ছেলের তো কোনো দোষ নেই, তাহলে কেন তিনি এতদিনেও নাতির মুখ দেখতে পেলেন না! এইসব সন্দেহবিদ্ধ দুর্গারাও ছড়িয়ে আছে আমাদের আশেপাশে, আছে ডালপালা মেলা সন্দেহের মিছিল।

সন্দেহ নিয়ে এইসব মনখারাপ আর নিষ্ঠুরতার অধ্যায়গুলো পেরিয়ে এবার বরং আমরা খুঁজে দেখতে পারি অন্য একটা জায়গা। যেখানে সন্দেহ মানে বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দেওয়া। সন্দেহ মানে কিছুটা রোমাঞ্চ আর আনন্দ। অন্যান্য ভাষার মতো বাংলার গোয়েন্দা উপন্যাসগুলোও আমাদের সামনে খুলে ধরে এই ভুবনের জানলা। প্রথম থেকেই সন্দেহের টানটান উপাদান না থাকলে গোয়েন্দা-গল্প জমে না। আর সেই সঙ্গে চাই এমন সব চরিত্র, জটায়ুর বর্ণনায় যা ‘হাইলি সাসপিশাস’। রাজস্থানের গেস্টহাউসে ফেলুদার ঘরের বিছানায় যখন 'ব্রাজিলের বিচ্ছু' এক কাঁকড়া বিছে পাওয়া গেল - সে যেন এক বড় সন্দেহের বিষয়। রাতে দেখা গেল দূরে গেস্ট হাউসের দিকে কেউ টর্চের আলো ফেলে কিছু খুঁজছে - সে কে? বেনারসের ঘোষাল বাড়ির প্রবীণ বড়কর্তা ফেলুদাকে ঘরে ডেকে নিজের সিন্দুক দেখিয়ে বললেনঃ ঘরে যে চোর এসেছিল সে ভদ্রলোক। ঘনিয়ে উঠল ছমছমে সন্দেহের পরিবেশ। ঠিক যেমন চোখে দূরবিন লাগিয়ে ফেলুদা আবিষ্কার করল মছলিবাবার হাতের উল্কিচিহ্ন। আবারও সন্দেহ। একইভাবে, খুনের ঘটনা ঘটে যাওয়া কোনো পরিবারে তদন্ত করতে গিয়ে ব্যোমকেশ দেখতে পায় বইয়ের র্যাকে অ্যানাটমির বইয়ের একটা বিশেষ পাতা মুড়িয়ে রাখা। সন্দেহ। একটা আধপোড়া সিগারেটের টুকরো পাওয়া গেল জানলার নিচে। কিংবা একটা দলা পাকানো কাগজের টুকরো, তাতে রয়েছে কিছু সাংকেতিক চিহ্ন। সন্দেহ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এইসব সন্দেহ এক রকমের রিলিফ। খানিকটা বিনোদন। গোয়েন্দা গল্পের একদম শেষে থাকে সব সন্দেহের উন্মোচন ও নিরসন। আমরা তখন বুক ভরে শ্বাস নিই। উমানাথ ঘোষালের বাবার ঘরে ঢুকে সিন্দুকের দেরাজ টেনে ফেলুনাথ যখন দেখিয়ে দেন ঠিক কীভাবে চুরি করার চেষ্টা হয়েছিল গণেশমূর্তি - ‘সাবাস’ বলে অভিনন্দন জানান সেই বৃদ্ধ। সোনার কেল্লায় ডঃ হাজরার ছদ্মবেশ ধরা ভবানন্দের জারিজুরি ফাঁস হয়ে যায় ‘মগজাস্ত্রের’ কৌশলে। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। তার হারিয়ে ফেলা নেপালি কুকরি ফিরে পেয়ে শিশুর মতো উচ্ছ্বাসে লাফিয়ে ওঠেন লালমোহনবাবুঃ এটা আমার! আমরা হেসে ফেলি।

কিন্তু এখানেই কি শেষ? রাষ্ট্র বা ক্ষমতা কিংবা কোনো ক্ষমতাসীন সরকার যেমন তার নাগরিকদের সন্দেহের জালে জড়িয়ে রাখে ঠিক তেমনি তাঁদের নিজেদের আচরণও কি বিপরীতপক্ষে কখনো কখনো ফাঁদ পেতে রাখে না সন্দেহের? লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে আগেই যখন ঘটে যায় পুলওয়ামার মতো দুর্ঘটনা, যখন সামরিক বাহিনীর ওই কনভয়ের গতিপথ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে থাকে, জিজ্ঞাসা জাগে সেনা বিভাগের ইন্টেলিজেন্স নিয়ে আর পাশে পাশে গাঢ় হতে থাকে ‘দেশপ্রেম’-এর আওয়াজ - আমাদের নাগরিক মনে কি একটুও সন্দেহ জাগে না এই কার্য-কারণ সম্পর্ক নিয়ে? সন্দেহ হয়, তার পরে এতদিন কেটে গেল ওই ঘটনার তো কোনো সুচারু তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ্যে এল না? অন্যদিকে, প্রায় ম্যাজিকের মতো সবার দৃষ্টি এড়িয়ে ঘটে যায় ‘সারজিকাল স্ট্রাইক’-এর মতো কিছু, যাতে নাকি একটি কাকের মৃত্যু হয়েছিল বলে শোনা যায়। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রচার নেয় ভিন্ন এক বুক-ফোলানো সঞ্চারপথ। আমরা কি তাতে একশোভাগ আস্থা রাখতে পারি নাকি গোপন এক সন্দেহে আক্রান্ত হই আমরা? একই সন্দেহ আমাদের বিদ্ধ করে নোটবন্দি নিয়ে, র্যাফায়েল বিমান কেনা নিয়ে। করতেই থাকে। রাষ্ট্রের আচরণে সন্দেহ। সরকারের সিদ্ধান্তে সন্দেহ। ঠিক যেমন, আজও এই রাজ্যের নাগরিকরা জানতে পারেননি সিঙ্গুরে কৃষিজমি দখল করে গাড়ি কারখানা হলে সত্যি কতজনের কর্মসংস্থান হতে পারত? নানা রকম অস্পষ্টতার ভিতর দিয়েই জমে ওঠে এই সন্দেহ। আজ যেমন এই রাজ্যের মাটিতে দাঁড়িয়ে আমরা প্রায় প্রত্যেকেই সন্দেহ বহন করছি ভিতরে ভিতরে - নিয়োগ দুর্নীতির জাল কতদূর ছড়িয়ে গেছে তলায় তলায়? আজ যাদের তালে তাল ঠুকতে দেখছি সরকারের ভাষ্যে, কাল তাঁদের দুয়ারেই কড়া নাড়বে না তো কেন্দ্রীয় এজেন্সির গোয়েন্দারা? সেই সঙ্গে এটাও তো সন্দেহের অঙ্গ যে ঠিক ঠিক তদন্ত হবে তো চূড়ান্ত স্তর অবধি? সবাই উচিত সাজা পাবে তো? হঠাৎ একদিন সব রাতারাতি শান্তিকল্যাণ হয়ে যাবে না তো? সন্দেহ আর আমাদের পেছু ছাড়তে চায় না।

প্রতিবেশী আর নাগরিকের চোখে চোখে ক্রমশ বেড়ে উঠতে থাকে সন্দেহের বিতত এক মহাজগৎ।