আরেক রকম ● দশম বর্ষ চতুর্বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

সাধারণ রঙ্গালয়ের দেড়শ বছরঃ স্মৃতি মাত্র

প্রবালকুমার বসু


তৎকালীন কলকাতার চিৎপুরে ‘ঘড়িওয়ালা বাড়ি’ নামে বিখ্যাত মধুসূদন স্যান্যালের বাড়ির উঠোন মাসিক চল্লিশ টাকা ভাড়ায় ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ নাম নিয়ে একশ পঞ্চাশ বছর আগে ১৮৭২ সালের ৭ই ডিসেম্বর দীনবন্ধু মিত্রের - ‘নীলদর্পণ’ নাটক অভিনয়ের মাধ্যমে টিকিট কেটে যে থিয়েটার প্রচলন, সেটাই সাধারণ রঙ্গালয়ের সূচনাক্ষণ বলে চিহ্নিত নাট্যশালার ইতিহাসে। যার প্রভাব প্রবলভাবে পড়বে পরবর্তী প্রায় একশ বছর বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনে। আমোদ-প্রমোদ বা বিনোদনের ব্যাপারে যাত্রা, পাঁচালি, কবিগান, হাফ আখড়াই ইত্যাদিতে অভ্যস্ত বাঙালি ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয় বিনোদনের অভাব অনুভব করতে শুরু করে, এতদিনের গতানুগতিক দেশীয় আমোদ প্রথা তাদের কাছে মনে হতে থাকল রুচিহীন। এই নব্য ইংরেজি শিক্ষিতদের জন্য প্রয়োজন হল ইংরেজি ধাঁচের বিনোদন, যাতে ইন্ধন জোগালো ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেজ থেকে পাশ করা ছাত্ররা। এর আগে প্রায় আশি বছর, ১৭৯৫ সালের রুশদেশবাসী লেবেদেফের বাংলা নাট্যশালা তৈরির প্রয়াসের সময় থেকে, ধনী বা অভিজাত বাঙালিরা বাংলা নাটক অভিনয়ের জন্য নাট্যশালা প্রবর্তনের কম চেষ্টা করেননি। কিন্তু সেইসব উদ্যোগই ছিল ধনী বা অভিজাত কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত আগ্রহের সুফল। তাঁদের মৃত্যু বা আগ্রহ হারিয়ে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে যার অবলুপ্তি ঘটে। ফলে এইসব নাট্যশালা কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সাধারণের জন্যও এইসব নাট্যশালার অভিনয় উন্মুক্ত ছিল না, কেবলমাত্র আমন্ত্রিতরাই আসতে পারতেন, যাদের বেশীরভাগই ছিলেন উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ইংরেজ সম্প্রদায় অথবা অভিজাত বাঙালিরা। যাঁরা এইসব নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করতেন তাঁদের নাট্যভিনয় বিনোদনের প্রতি প্রীতি ছাড়াও শাসক ইংরেজদের সঙ্গে বন্ধুত্ব বা সম্প্রীতি গড়ে তোলার আগ্রহও কম ছিল না। নাট্যশালার প্রবর্তন বাবু সম্প্রদায়ের কাছে একটা 'স্ট্যাটাস সিম্বল'ও ছিল। শোনা যায় পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ আর তাঁর ভাই ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ 'বেলগাছিয়া নাট্যশালা' প্রবর্তন করে সেই আমলে (১৮৫৮) ‘রত্নাবলী’ নাটক প্রযোজনায় দশ হাজার টাকা খরচ করেছিলেন। ইংরেজদের বোঝার জন্য এই নাটক তাঁরা ইংরেজিতে অনুবাদও করিয়েছিলেন যার দায়িত্ব বর্তেছিল মধুসূদন দত্তের ওপর। এই নাটকের প্রযোজনা দেখে মাইকেল নাটক লিখতে আগ্রহী হন, আমরা ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকটি পাই।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের কিছু আগে থেকে এই যে একের পর এক নাট্যশালার উদ্ভব আবার কিছুদিনের মধ্যে তা হারিয়ে যাওয়ার যে সংস্কৃতির সূত্রপাত, রাজা-রাজরা জমিদার থেকে ক্রমশ অবস্থাপন্ন গৃহস্থকেও যে সংস্কৃতিতে আগ্রহী করেছিল, সেই রকম সময়ে উত্তর কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলের জনা কয়েক যুবকের মনেও নাট্যভিনয়ের ইচ্ছে জাগে, যার ফলশ্রুতি ‘বাগবাজার এ্যামেচার থিয়েটার’। পরে এই নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘শ্যামবাজার নাট্যসমাজ’ রাখা হয়। এই যুবকদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, রাধামাধব কর আর অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফী। এঁদের হাত দিয়েই সাধারণ রঙ্গালয়ের সূচনা।

নিজেদের সেরকম আর্থিক বাহুল্য নেই তাই প্রযোজনায় খরচ কম এমন যে নাটক তারা প্রথমে বেছে নিয়েছিল তা হল দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’। এর চতুর্থ অভিনয়ে দীনবন্ধু মিত্র নিজে দর্শক ছিলেন। এরপর যে নাটকটি তাঁরা বাছেন সেটা হল দীনবন্ধু মিত্রের ‘লীলাবতী’। চাঁদা তুলে এই নাটক প্রযোজিত হয়। এর সুখ্যাতি এত বিস্তৃত হয়েছিল যে অনেককে জায়গা না পেয়ে ফিরে যেতে হয়েছিল।

‘লীলাবতী’র সাফল্যেই নগেন্দ্রনাথের মনে টিকিট বিক্রি করে সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রতিষ্ঠার কথা মাথায় আসে যেখানে সাধারণ মানুষেরা নাটক দেখতে আসতে পারে। অবশ্য এর আগে আহিরীটোলার রাধামাধব হালদার ও যোগীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ‘দি ক্যালকাটা পাবলিক থিয়েটার’ নামে সর্বসাধারণের জন্য একটা নাট্যশালা খোলার প্রচেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তা ফলপ্রসু হয়নি।

শ্যামবাজার নাট্যসমাজের যুবকদের কেউই কিন্তু থিয়েটারের টিকিট বিক্রি করে অভিনয়ের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের কথা ভাবেননি। টিকিট বিক্রির পিছনে তাঁদের অন্য ভাবনা ছিল। থিয়েটার প্রযোজনার জন্য তখন আয়না থেকে চিরুণী সবই কিনতে হত। সামগ্রী ভাড়ায় পাবার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। প্রযোজনার এই ব্যায়ভারের যোগান হত চাঁদার মারফৎ। বারবার চাঁদা চাইতে গেলে পাড়া প্রতিবেশীরা বিরক্ত হতেন। যেহেতু নাটকে অভিনেতাদের মাইনে দেবার ব্যাপার নেই, টিকিট বিক্রির টাকায় অন্তত প্রযোজনার খরচটা মেটানো যাবে আর টিকিট মূল্যের পরিবর্তে আগ্রহী যে কেউ এসে থিয়েটার দেখতে পারবেন। চাঁদা চাইতে গিয়ে কারো বিরক্তির মুখে পড়তে হবে না।

অথচ শুরুটা খুব একটা মসৃণ হয়নি। টিকিট বিক্রি করে থিয়েটার করার জন্য নির্বাচিত হল দীনবন্ধু মিত্রের 'নীলদর্পণ'। দলের নামকরণ প্রস্তাবিত হল ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’। আর এখানেই আপত্তি জানালেন চার বন্ধুর একজন, গিরিশচন্দ্র ঘোষ। পরবর্তী সময়ে গিরিশচন্দ্র নিজেই এই আপত্তির কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন এইভাবে... ‘ন্যাশনাল থিয়েটর নাম দিয়া, ন্যাশনাল থিয়েটর উপযুক্ত সাজ সরঞ্জাম ব্যতীত, সাধারণের সম্মুখে টিকিট বিক্রয় করিয়া অভিনয় করায় আমার অমত ছিল। কারণ একেই তো তখন বাঙালির নাম শুনিয়া ভিন্ন জাতি মুখ বাঁকাইয়া যায়, এরূপ দৈন্য অবস্থায় ন্যাশনাল থিয়েটর দেখিলে কি না বলিবে - এই আমার আপত্তি’। কিন্তু সেই আপত্তি বাকিরা শোনেননি। তাঁদের মত ছিল যেমন সামর্থ্য, তেমনই আয়োজন হবে। ফলে গিরিশচন্দ্রের দলত্যাগ আর তাঁকে বাদ দিয়েই সাধারণ রঙ্গালয়ের সূচনা। টিকিটের মূল্য অনুযায়ী দর্শক আসন ভাগ করা হয়েছিল তিনটে শ্রেণীতে। প্রথম শ্রেণীর জন্য ভাড়া করা চেয়ার, দ্বিতীয় শ্রেণীর জন্য বাঁশের কাঠামোর ওপর পাটাতন বসিয়ে বেঞ্চি আর তৃতীয় শ্রেণীর জন্য দালানের সিঁড়ি ও রোয়াক। প্রথম রজনীতে টিকিট বিক্রি বাবদ আয় হয়েছিল দু'শ টাকা।

'নীলদর্পণ'-এর প্রযোজনা আর অভিনয়ের প্রশংসা সেইসময় সব সংবাদপত্রেই প্রকাশ পেয়েছিল, যা নিশ্চয়ই গিরিশচন্দ্রের নজর এড়ায়নি। ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকায় ১৮৭২-এরই ১৯ ও ২৭শে ডিসেম্বর 'নীলদর্পণ' প্রযোজনা সম্পর্কীয় দুটো চিঠি বেনামে প্রকাশিত হয় যা আগাগোড়াই ছিল বিদ্রুপ আর নিন্দায় ভরা। বেনাম অর্থে একটির প্রেরকের জায়গায় স্বাক্ষর ছিল ‘A Father’ অন্যটির ‘A spectator’, কারো নাম ছিল না। এই দুটো চিঠিরই প্রেরক গিরিশচন্দ্র, এমনটাই মনে করা হয়।

নীলদর্পণ নাটকের দুটো অভিনয় হয়েছিল, যদিও প্রথম ও দ্বিতীয়বার অভিনয়ের মধ্যে ‘জামাই বারিক’ নাটকের অভিনয় হয়। এছাড়া ‘সধবার একাদশী’, ‘নবীন তপস্বিনী’, ‘লীলাবতী’, ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’ নাটকের অভিনয় হয়।

ন্যাশনাল থিয়েটারের সাফল্য গিরিশচন্দ্রকে পুনরায় দলে ফিরে আসতে বাধ্য করে, মাইকেলের ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে তাঁর প্রত্যাবর্তন ঘটে। যদিও নাটকের বিজ্ঞাপনে তাঁর নাম গোপন রাখা হয়েছিল।

এই যে সাধারণ রঙ্গালয়ের সূচনা এর প্রথম পর্বের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ছয় মাস। ১৮৭৩-এর ৮ই মার্চ ‘বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রো’ আর ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’ এই দুটো নাটকের অভিনয় দিয়ে প্রথম পর্বের শেষ হয়। এর কারণ বর্ষা এসে পড়ায় স্যানাল বাড়ির প্রাঙ্গণে জল ঢোকার জন্য অভিনয় করা বন্ধ করে দিতে হয়।

এর পরে পরেই কৃষ্ণচন্দ্র দেবের বাড়িতে 'ওরিয়েন্টাল থিয়েটার' নাম দিয়ে কয়েকটি নাটক অভিনীত হয়। এই সময় কলকাতার বিখ্যাত ছাতুবাবুর (আশুতোষ দেব) দৌহিত্র শরৎচন্দ্র ঘোষ, অনেক বিশিষ্ট জনকে নিয়ে একটা কমিটি তৈরি করে ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ নাম দিয়ে একটা নাট্যালয় স্থাপন করেন। এই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে বিদ্যাসাগর, মাইকেলও ছিলেন। এই প্রথম সাধারণ রঙ্গালয় নিজস্ব নাট্যগৃহ পেল। ১৮৭৩ সালের অগষ্টে মাইকেলের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক অভিনয় দিয়ে বেঙ্গল থিয়েটারের সূচনা। নানান কারণে সাধারণ রঙ্গালয়ের ইতিহাসে বেঙ্গল থিয়েটার গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই প্রথম মাহিলা চরিত্র মেয়েদের দিয়ে অভিনয় করানো হয়। 'দুর্গেশনন্দিনী' নাটকে জগৎ সিংহ-এর ভূমিকায় শরৎচন্দ্র ঘোষ ঘোড়ায় চেপে মঞ্চে উপস্থিত হতেন। ১৯০১ সাল অবধি বেঙ্গল থিয়েটার টিঁকে ছিল।

অন্যের বাড়ি বা প্রাঙ্গন ভাড়া নিয়ে থিয়েটার করার যে অনিশ্চয়তা, পরিবর্তে নিজেরা নাট্যশালা বানাতে পারলে তার স্থায়িত্ব হয়ত বেশী, এমন ধারণা থেকে আর বেঙ্গল থিয়েটারকে দেখে উদ্দীপ্ত হয়ে ধর্মদাস সুর, এখন যেখানে মিনার্ভা থিয়েটার সেখানে 'গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার' নাম দিয়ে নাট্যশালা গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন। প্রথম অভিনয় রাত্রে থিয়েটারে আগুন লাগলেও আরো প্রায় বছর চারেক এই থিয়েটার চলে। এই থিয়েটারেই ইংরেজদের ব্যঙ্গ করে নাটক প্রযোজনা হয় যার ফলস্বরূপ তৈরি হয় Dramatic Performance Control Bill, যা পরে Act of 1876 নামে আইন হয়ে নাট্যশালার স্বাধীনতার খর্ব করে দেয়।

১৮৭৭ সাল নাগাদ গিরিশ ঘোষ গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের ইজারা নিলেন। আর তারপর থেকে তিন দশক বাংলা নাট্যশালার অধীশ্বর হয়ে তিনিই থাকেন। এই পর্বে তিনি বাংলা নাট্যশালাকে লালন করেছেন বলা যায়। তাঁর অভিনয় প্রতিভার পূর্ণ বিকাশও এই সময়ে। তিনি অভিনয়ের জন্য স্বনামে বেনামে নাটক লিখেছেন, নিজে অভিনয় করেছেন, অন্যদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছেন, নাট্যশালা নির্মাণের জন্য নিজের অর্জিত অর্থ অনায়াসে দান করেছেন। কলকাতার বিখ্যাত ধনী গোপাল লাল শীল ‘স্টার’-এর জমি কিনে নিয়ে ‘এমারেল্ড’ থিয়েটার' স্থাপন করেন। গিরিশ ঘোষকে ম্যানেজার করে নিয়ে আসেন কুড়ি হাজার টাকা বোনাস আর মাসিক তিনশ টাকা মাইনেতে। এই টাকার ষোলো হাজার টাকা গিরিশচন্দ্র স্টারের সত্ত্বাধিকারীদের দিয়ে দেন নতুন নাট্যশালা নির্মাণের জন্য। গিরিশ ঘোষের সঙ্গে গোপাল শীলদের শর্ত ছিল আর কোথাও নাটক দিতে পারবেন না। সেই শর্তকে এড়ানোর জন্য বেনামে নাটক লিখতে শুরু করেন গিরিশ, যা 'স্টার'-এ অভিনীত হতে থাকে। সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রসার আর উন্নতির প্রকল্পে গিরিশ ঘোষের অবদানের মতন কোনো দ্বিতীয় উদাহরণ আর হয়নি। এই সময়টা নাট্যশালার ইতিহাসে তাই 'গিরিশ যুগ' বলে চিহ্নিত। অনেক অবস্থাপন্ন বড়লোক বাড়ির ছেলে সেইসময় থিয়েটারে আসেন যেখানে অভিনয়ের চেয়েও প্রাধান্য পেতে থাকে নানান স্থূল গিমিক। একাধিক নাট্যশালা গজিয়ে উঠতে থাকে যাদের আয়ু হত নেহাতই সংক্ষিপ্ত। থিয়েটার লাভজনক ব্যবসা ভেবে অনেক অবাঙালিও এতে লগ্নি করতে আগ্রহী হন, গিরিশ ঘোষের প্রশ্রয়ও পান। যদিও ব্যবসার বাইরে অন্য এক স্পৃহাও এই লগ্নিকারিদের ছিল, তা হল অভিনেত্রীদের আকর্ষণ ও কিছুটা তাদের সহজলভ্যতা। সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দিতে গিয়ে থিয়েটারের অন্যান্য সূক্ষ্ম দিকগুলোর দিকে নজর দেবার সুযোগ গিরিশ পাননি। নিজের অনবধানেই তৈরি করেছিলেন একটা ধাঁচ, লোকজনদের বোঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন যে থিয়েটারও লাভজনক ব্যবসা হতে পারে। সেই সময় নাটক হত দীর্ঘ, কাহিনীর সঙ্গে থাকত উপকাহিনী। সারারাত্রি ব্যাপী অভিনয় হত। নাটকে নাচ আর গানের ছিল আধিক্য, দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সবসময়ই জমকালো পোশাক ব্যবহৃত হত সামঞ্জস্য ছাড়াই। দর্শক আকর্ষণ করতে, ব্যবসায়িক চাহিদা মেটাতে এই ধাঁচ মেনে নিতে হয়েছিল গিরিশ ঘোষকে। এই ধাঁচই ছিল বাংলা থিয়েটারের অভিমুখ যতদিন না শিশিরকুমার ভাদুড়ি এসে তাকে অন্যপথে নিয়ে গেলেন। থিয়েটারে এলো একটা শিক্ষার আবহাওয়া, সার্বিক সমন্বয়। এলো রুচি। শিশিরকুমারের সঙ্গে সঙ্গে আরো কিছু শিক্ষিত মেধাবী মনীষা যেমন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় যুক্ত হলেন থিয়েটরের সঙ্গে, সরাসরি ভাবে না হলেও। যে থিয়েটর ছিল মধ্যবিত্ত সমাজের চোখে বিপথে যাবার রাস্তা, শিশিরকুমার তাকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য করলেন। শিশিরকুমারের আকর্ষণে মঞ্চে এলেন কঙ্কাবতী সাহু, মঞ্চে প্রথম শিক্ষিত গ্রাজুয়েট মহিলা। যা ভবিষ্যতে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের থিয়েটারে যোগদানের পথ প্রশস্ত করবে। থিয়েটারের প্রতি দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেল, দর্শকের চরিত্র বদলে গেল, একটা শিক্ষিত বাতাবরণ তৈরি হল থিয়েটারকে ঘিরে। আজকের যে থিয়েটার মডেলটা আমরা দেখি তা অনেকটাই শিশিরকুমারের অবদান। সাধারণ রঙ্গালয়ের জনক ও কৈশোর উত্তীর্ণ সময় অবধি অভিভাবক যদি গিরিশ ঘোষ হন তাহলে তার যৌবনের সারথি অবশ্যই শিশিরকুমার, যিনি রঙ্গালয়কে দিয়েছিলেন সামাজিক কৌলিন্য। তাঁর সময়টা 'শিশির যুগ' বলেই অভিহিত।

কিন্তু এঁরা একা নন, সাধারণ রঙ্গালয়ে গিরিশ ঘোষ বা শিশিরকুমারের সঙ্গে আরো অন্যান্যরা প্রয়াসী না হলে এর ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটত না। ১৮৮৪ সালে ‘স্টার’ থিয়েটারে বিনোদিনী অভিনীত ‘চৈতন্যলীলা’ অভিনয় দেখতে রামকৃষ্ণদেবের প্রথম নাট্যশালায় আসাও সাধারণ রঙ্গালয়ের সামাজিক স্বীকৃতির জায়গায় এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রতিষ্ঠাতারা কেউই থিয়েটার করে জীবন নির্বাহ বা থিয়েটারকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করার কথা ভাবেননি। থিয়েটার চালানোর খরচ তুলতে আর সর্বসাধারণ যাতে সামান্য অর্থের বিনিময় থিয়েটার দেখতে আসতে পারেন সেই ভাবনা থেকে টিকিট বিক্রি করে সাধারণ রঙ্গালয়ের শুরু। আর এর ভিতরে সুপ্ত ছিল বাবু সংস্কৃতির বিরুদ্ধে মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির আত্মপ্রতিষ্ঠার তাগিদ জনিত এক আদর্শ। কিন্তু এভাবে যে থিয়েটার বেশীদিন চলতে পারে না এই বিষয়টা বুঝেছিলেন গিরিশ ঘোষ। থিয়েটার চালাতে গেলে চাই ব্যবসায়িক বুদ্ধি, যা পূর্বে বুককিপারের চাকরির অভিজ্ঞতা থেকে গিরিশ ঘোষের ছিল। এই প্রয়োজনীয় বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির কাছে গৌণ হয়ে গেল বাকি সবকিছু। থিয়েটারে যে ধাঁচটা তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন সেটা হল ম্যানেজার অ্যাকটরের ধাঁচ। ওঁর ক্ষেত্রে নাট্যকার ম্যানেজার অ্যাকটর। কেননা এক বছরের মধ্যে প্রয়াত হয়েছেন দীনবন্ধু মিত্র আর মধুসূদন দত্ত। লোকজনের থিয়েটার দেখার আগ্রহ বাড়ছে, গজিয়ে উঠছে নাট্যশালা। এমত অবস্থায় নাটকের অভাবে কলম ধরা ছাড়া গিরিশ ঘোষের আর কোনো গত্যন্তর ছিল না। কারণ থিয়েটারকে টিকিয়ে রাখতে হলে চাই নাটক। এইসব করতে গিয়ে থিয়েটরের উৎকর্ষের দিকে নজর দিতে পারেননি গিরিশ। থিয়েটারে উৎকর্ষ এল শিশিরকুমারের হাত ধরে। কিন্তু শিশিরকুমারও সেই একই ধাঁচে আটকা পড়লেন। থিয়েটারের উন্নতি করতে হলে চাই স্বাধীনতা, যা নিজের থিয়েটার ব্যতীত সম্ভব নয়। আর যেই নিজের থিয়েটার হল, অভিনেতা, নির্দেশক হয়ে উঠলেন ব্যবসায়ী। তখনই ব্যবসা এবং শিল্পের মধ্যে এল সূক্ষ্ম সংঘাত। যা একে অপরের পরিপূরক হতে পারত, ক্রমে হয়ে উঠল একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। আর এইখানেই পরাজয় ঘটল দু'পক্ষেরই। থিয়েটার আর ব্যবসার। সাধারণ রঙ্গালয় অবলুপ্তির পিছনে এটাই অন্যতম প্রধান কারণ।

শিশিরকুমার সাধারণ রঙ্গালয় ছেড়ে দেন, বা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন ১৯৫৬ সালে। বাড়ি ভাড়া দিতে পারছিলেন না। ততদিনে গণনাট্য সঙ্ঘ এসে গিয়েছে, শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য প্রমুখ এসে গিয়েছেন, সাধারণ রঙ্গালয়ের অভিমুখ এঁদের হাত ধরে গড়াল অন্যপথে। শিশিরকুমারের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ রঙ্গালয়ের গৌরবের দিন শেষ হলেও আরো প্রায় দু'দশক তা টিকে ছিল। মহেন্দ্র গুপ্ত শেষ অবধি স্টার থিয়েটারে অভিনয় করে গেছেন, উত্তমকুমার অভিনীত 'শ্যামলী' নাটকও হৈ হৈ করে বহুদিন চলেছে। সারকারিনা বা কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ অথবা রঙমহল বা অসীম চক্রবর্তীরা চেষ্টা করেছেন সাধারণ রঙ্গালয়কে বাঁচিয়ে রাখতে, নিয়ে এসেছেন নানান আকর্ষক উপকরণ কিন্তু মূলত আর্থিক সমস্যার জন্য তা খুব বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। লগ্নিকারীরাও ভরসা পায়নি। উৎপল দত্ত বা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়রাও কিছুদিনের জন্য চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু দীর্ঘসময় ধরে তা চলেনি।

দেড়শ বছর পার করে সাধারণ রঙ্গালয় তাই এখন স্মৃতি মাত্র।