আরেক রকম ● দশম বর্ষ চতুর্বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

কলকাতা চিড়িয়াখানার প্রাক ইতিহাস ও রায় বাহাদুর রামব্রহ্ম সান্যাল

গৌরব মুখার্জি


কেন এই লেখা

শীতকালে বিশেষত ছুটির দিনে কলকাতার দ্রষ্টব্য স্থানগুলোর মধ্যে আলিপুর চিড়িয়াখানা একটা বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। আমরা অনেকেই এখনও চিড়িয়াখানা বলতেই একটা স্মৃতিকাতরতায় ডুবে যাই। চিড়িয়াখানা-হোগলার টুপি-কমলালেবু-চিনেবাদাম এ সবই একসূত্রে গাঁথা। শীতের নরম মিঠেকড়া রোদ্দুর গায়ে মেখে বন্ধুবান্ধবদের বা পরিবারের সাথে, কখনও বা একা একাই চিড়িয়াখানা ঘোরার মজাই আলাদা। বিশেষত ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে ঘুরতে ঘুরতে অনেকেরই এখনও তাদের ছোটবেলায় বাবা-মা'র সাথে চিড়িয়াখানা ঘোরার স্মৃতি মনের কোণে উঁকি দেয়। আমরা অনেকেই এখনও শিশু ও কৈশোর বয়সের সেইসব দিনগুলোর কথা মনে করে রোমাঞ্চিত হই।

এই আলিপুর চিড়িয়াখানা গড়ে ওঠার যে ইতিহাস তাও কম রোমাঞ্চকর নয়। তা নিয়ে খুব অল্প সংখ্যক বই বই-বাজারে ও অনলাইনে উপলব্ধ আছে। সেগুলিও আবার সহজলভ্য নয়। অধিকাংশই মুদ্রিত অবস্থায় পাওয়া যায় না বা যন্ত্রস্থ। আর অনলাইনে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে কিছু তথ্য ও তথ্যচিত্রের ভিডিও। যেগুলি উৎসাহী মানুষরা ছাড়া অনেকেই পড়েন না বা দেখেন না। অনুসন্ধিৎসুরা হাতড়ে বেড়ান নানা মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকা কিছু নিবন্ধ ও নথিপত্র। আর সাধারণ মানুষ এ সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানতে পারেন না। সবই রয়ে যায় তাদের নাগালের বাইরে - থেকে যায় অন্তরালে।

আজকের সর্বগ্রাসী ভোগবাদের যুগে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের সীমাহীন লোভ দুনিয়াজুড়ে পরিবেশকে বিপন্ন করে তুলেছে। উল্টোদিকে বহু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ এর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নানা আন্দোলনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে পরিবেশ-সচেতন করার কাজে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। নব-প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীরা এ বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ও দৈনন্দিন জীবনে প্রতিনিয়ত তারা দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় দিয়ে চলেছে। প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্বন্ধে সঠিক তথ্য জানতে তারা যাতে বঞ্চিত না হয়, তা দেখা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সেদিক থেকে এই লেখাটি তাদের উৎসাহদান করবে।

ভারতে ব্রিটিশরাজের সময়ে 'ইণ্ডিয়ান ন্যাচারাল হিস্ট্রি প্রজেক্ট'-এর অংশ হিসেবে ডকুমেন্টেশনের জন্য চিড়িয়াখানা গড়ে তোলা ও তাকে জনপ্রিয় করার নেপথ্যে ব্রিটিশরা ছাড়াও একজন বাঙালির অসামান্য অবদান রয়েছে - তা প্রায় কেউই জানেন না। তাঁকে ছাড়া চিড়িয়াখানার ইতিহাস অসম্পূর্ণ। পরিবেশ ও জীবজগতের প্রতি ভালোবাসায় তিনি তাঁর গোটা জীবনটাই উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর নাম রামব্রহ্ম সান্যাল। সারা বিশ্বে প্রাণিতত্ত্ব চর্চার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান আজও অনস্বীকার্য। তাঁর জীবনকাহিনী একাধারে রোমাঞ্চকর ও অত্যন্ত বেদনাময়। পরিবেশ ও জীবজগতের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ, হাতেকলমে কাজের মাধ্যমে অর্জিত প্রাণিতত্ত্ব সম্বন্ধে অগাধ জ্ঞান, প্রাণিতত্ত্বের বিভিন্ন বিষয়ে জানার আগ্রহ ও বাস্তবে সেগুলির প্রয়োগ - এই গুণগুলিই আজও তাঁকে ও তাঁর রেখে যাওয়া কাজকে অমরত্ব দিয়েছে। কর্মক্ষেত্রে নানা অছিলায় ব্রিটিশদের শোষণের শিকার হয়েও নীরবে কাজের প্রতি তাঁর নিবেদিতপ্রাণ ও বহু বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও কর্তব্যে অবিচল থাকার সদিচ্ছা - পরাধীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের কাছে তাঁকে সম্মান ও শ্রদ্ধার যোগ্য করে তুলেছিল। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশরা তাঁর মেধা ও পরিশ্রমের প্রতি মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছিল।

এছাড়াও তৎকালীন ব্রিটিশরাজ-এর সময়ে সরাসরি যুক্ত না থেকেও তৎকালীন বহু বাঙালি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে সমাজে মাথা তুলে দাঁড়াতে ও গড়ে উঠতে তিনি সহায়তা প্রদান করেছেন।

বাঙালি চিরকালই আত্মবিস্মৃত জাতি। এই আত্মবিস্মরণ ও সংরক্ষণাগারের (archiving) অভাব, অতীতকে জানতে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে আজও এক বড় বাধা। অথচ কোনো ঘটনার প্রেক্ষিত বুঝতে ইতিহাস জানা জরুরি। দুঃখের কথা, আজও রামব্রহ্ম সান্যালকে যথোচিত সম্মান জানাতে কোনো সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যদিও চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে প্রতি বছর রামব্রহ্ম সান্যাল-এর জন্মদিবস নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালিত হয়। সেটাই স্বাভাবিক। মজার ব্যাপার আজও প্রাণিতত্ত্ব বিষয়ে উৎসাহী বহু বিদেশি ছাত্রছাত্রী ও পর্যটক সাত সমুদ্র পার করে কলকাতায় আলিপুর চিড়িয়াখানা দেখতে আসেন। অথচ আমাদের কাছে চিড়িয়াখানা নিছকই ছুটি কাটানোর একটা জায়গা! সারা বিশ্বে প্রাণিতত্ত্ব চর্চার ক্ষেত্রে বাংলার গুরুত্ব অপরিসীম। এই নিবন্ধটির মূল উদ্দেশ্য হলো রামব্রহ্ম সান্যাল-এর জীবন-সংগ্রামের কথা সর্বসমক্ষে আনা আর কোম্পানি আমলে কত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ভারতবর্ষে এশিয়ার প্রথম পশুশালা গড়ে উঠেছিল সে সম্বন্ধে মানুষকে জানতে উৎসাহী করে তোলা।

রামব্রহ্ম সান্যাল ও তাঁর কাজকে জানতে ও বুঝতে গেলে আমাদের ইতিহাসকে দু'ভাগে ভাগ করে দেখতে হবে। প্রথমটি হলো আলিপুরে স্থানান্তরিত হওয়ার আগে চিড়িয়াখানার ইতিহাস (যেটি সতেরো থেকে আঠারো শতকের) আর দ্বিতীয়টি হলো আলিপুরে আসার পরেই সদ্য সেখানে রামব্রহ্ম সান্যাল-এর কাজে যোগ দেবার পর চিড়িয়াখানার বাকি ইতিহাস (যেটি আঠারো থেকে উনিশ শতকের)। রামব্রহ্ম সান্যাল-এর জীবনব্যাপ্তি ছিল ১৮৫৬ থেকে ১৯০৮ সাল। সুতরাং ১৯০৮ সাল অব্দি ঘটনা পরম্পরাই মূলত আমরা এখানে আলোচনা করবো। স্বল্প পরিসরে ইতিহাসের এই বিশাল ব্যাপ্তিকে ধরা সম্ভব নয় বলে মাঝে মাঝে কিছু ঘটনা ও তথ্যের উল্লেখ করব।

ইতিহাস পড়া বা শোনার থেকেও যদি তাকে স্পর্শ করা যায়, তার থেকে রোমাঞ্চকর আর কিছু হতে পারে না। ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখার সেই সুযোগ এখনও কলকাতা ও তার আশপাশের অঞ্চলে কিছুটা হলেও আছে। আমরা প্রতিদিনই সেই অতীতকে সঙ্গে নিয়েই দিন কাটাচ্ছি। জানেন কি এই সর্বগ্রাসী সময়ে এখনও কলকাতার পার্শ্ববর্তী এক অঞ্চলে এমন একটুকরো জায়গা আছে যেখানে ব্রিটিশ আমলের পর আর মানুষের পা পড়েনি? সেখানে এখনও অতীত থমকে আছে! তাহলে আসুন ইতিহাসের সেই চমকপ্রদ গল্পের দুনিয়ায় প্রবেশ করি...

Barrackpore Menagerie, Charles D-Oyly
ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী স্যার চার্লস ডি'ওইলি-র জলরঙে আঁকা ব্যারাকপুর মেনাজেরির ছবি।

এশিয়ার প্রথম ও পৃথিবীর চতুর্থ পশুশালা

গোবিন্দপুর, সুতানুটি ও কলিকাতা - এই তিনটি গ্রাম নিয়ে হুগলি নদীর তীরে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় যে অখ্যাত শহরের পথ চলা শুরু হয়েছিল সে আজ এক তিলোত্তমা মহানগরী। অখ্যাত এই তিনটি গ্রাম থেকে তিলোত্তমা মহানগরীরূপে আত্মপ্রকাশ করতে সে প্রায় তিনশো বছর ধরে অনেক পথ পাড়ি দিয়েছে, যার অনেকটাই আজকে ইতিহাস। সেই ইতিহাসের পথে যেমন আছে অনেক না জানা গল্প কাহিনী, তেমনই আছে অনেক জানা ইতিহাস। সেই গৌরবময় অতীতের অন্যতম সাক্ষীস্বরূপ আলিপুরে অবস্থিত চিড়িয়াখানা তার গৌরবগাথা ঘোষিত করে চলেছে। এই ইতিহাসেরও একটা ইতিহাস আছে।

১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধ জয়ের পর ১৭৬০ সালে 'বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি' (ফোর্ট উইলিয়াম)-এর ব্রিটিশ গভর্নর [১], কমান্ডার-ইন-চিফ রবার্ট ক্লাইভ (Col. Robert Clive) [২] 'বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যান্ট্রি' নামে ভারতীয়দের নিয়ে এক সৈন্যদল প্রতিষ্ঠা করলেন। সৈন্যদল তো তৈরি হলো। এবার এই সৈন্যদলের থাকবার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই উদ্দেশ্যে ১৭৭২ সালে তৎকালীন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর প্রথম ব্যারাকস্ বা ছাউনি নির্মাণের কাজ শুরু হয় কলকাতার উপকণ্ঠে ব্যারাকপুরে। এই ব্যারাকপুর অনেক পরে 'ক্যাণ্টনমেন্ট' শহর হয়।

এরপর ১৭৭৫ সালে রবার্ট ক্লাইভ তাঁর এই ভারতীয় সৈন্যদের কলকাতা থেকে ১৫ মাইল উত্তরে নিয়ে এলেন 'চানক' নামের একটি নিরিবিলি জায়গায়। সেখানেই একটি ছাউনি বা ব্যারাক-এ সেই সৈন্যদলের থাকবার বন্দোবস্ত করলেন। পরবর্তীকালে জনশ্রুতিতে এই 'চানক' হয়ে গেল ব্যারাকপুর - ভারতের অন্যতম প্রাচীন ক্যান্টনমেন্ট বা মিলিটারি ক্যাম্প।

প্রসঙ্গতঃ তথ্যসূত্রে জানা যায়, সর্বপ্রথম আর্থার ওয়েলেসলি (Arthur Wellesley) [৩] (ভারতের পরবর্তী গভর্নর-জেনারেল রিচার্ড ওয়েলেসলির ভাই) কলকাতার নিকটস্থ ব্যারাকপুরে তাঁর প্রস্তাবিত গ্রীষ্মাবাসে 'ভারতীয় প্রাকৃতিক ইতিহাস প্রকল্প'-এর অঙ্গ হিসেবে একটি ছোট পশু উদ্যান গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। যদিও তিনি সেই পরিকল্পনাটির বাস্তব রূপায়ণ দেখে যেতে পারেননি। কোম্পানির নির্দেশে তাঁকে ইংল্যান্ড ফিরে যেতে হয়।


ব্রিটিশ আমলে জনৈক চিত্রশিল্পীর আঁকা রাজভবনের ছবি।

ব্যারাকপুরের ঘটনার ২৩ বছর পর ১৭৯৮ সালে ইংল্যান্ডের ইডেন কলেজ আর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র রিচার্ড ওয়েলেসলি (Richard Wellesley) [৪] ভারতে এলেন বড়লাট (ভারতের গভর্নর-জেনারেল) হয়ে। কলকাতা তখন ব্রিটিশরাজের রাজধানী। এখানে তিনি নিজের থাকার জন্য তৈরি করলেন 'লাট ভবন'। আজ আমরা যাকে 'রাজ ভবন' নামে চিনি।


ভারতে ব্রিটিশরাজের সময়ে তোলা ব্যারাকপুর গভর্নমেন্ট হাউসের ছবি।


ব্যারাকপুর গভর্নমেন্ট হাউস এখন। এর একটি অংশে এখন 'পুলিশ মিউজিয়ম' হয়েছে।

পরবর্তীকালে ১৮০০ সালে তিনি রাজধানীর অনতিদূরে ব্যারাকপুরের গঙ্গাতীরে মূলত গ্রীষ্মকালে থাকার জন্য ১০০৬ বিঘা জমি জুড়ে অস্থায়ীভাবে একটি দোতলা গ্রীষ্মকালীন আবাস (সামার রিট্রিট) বানানো শুরু করলেন। এর সংলগ্ন অংশে একই সাথে তৈরি করা শুরু করলেন বিলিতি ধাঁচের এক বাহারি উদ্যান। সেটির নাম রাখা হলো 'ব্যারাকপুর পার্ক'। বছর তিনেকের মধ্যে সেই পার্কের আয়তন গিয়ে দাঁড়াল প্রায় ১০০০ বিঘা। বর্তমানে যাকে আমরা 'লাট বাগান' বা 'মঙ্গল পান্ডে উদ্যান' নামে চিনি।

লর্ড ওয়েলেসলির পরিকল্পিত এই দোতলা বাড়িটিই ধীরে ধীরে হয়ে উঠলো তাঁর অত্যন্ত প্রিয় 'ব্যারাকপুর গভর্নমেন্ট হাউস'। আর 'ক্যালকাটা গভর্নমেন্ট হাউস' মানে রাজ ভবন থেকে তাঁর এই প্রিয় প্রাসাদে সহজে যাতায়াতের জন্য তিনি শ্যামবাজার থেকে ব্যারাকপুর পর্যন্ত একটি রাস্তা নির্মাণ করলেন। যেটির নাম রাখা হলো 'ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড' (Barrackpore Trunk Road) বা বি. টি. রোড।

এই রিট্রিটের সাথেই 'ইণ্ডিয়ান ন্যাচারাল হিস্ট্রি প্রজেক্ট'-এর অংশ হিসেবে ডকুমেন্টেশনের জন্য একটি মেনাজেরি বা পশু নিদর্শশালাও গড়ে তোলা হয়। সেই উদ্দেশ্যে লর্ড ওয়েলেসলি শুরু করলেন প্রাণী সংগ্রহ আর সেগুলিকে জড়ো করলেন এই মেনাজেরিতে। ভারতবর্ষ ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাঘ, সিংহ, চিতাবাঘ, বনবিড়াল, ভালুক, হাতি, বাইসন, আফ্রিকান গাধা, মাউস হরিণ, ক্যাঙ্গারু, বানর, উটপাখি, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ইত্যাদি এখানে এনে রাখা হলো। নথি থেকে জানা যায়, এখানে গন্ডার ও হরিণের জন্য আলাদা আলাদা পুকুরও ছিল।


ব্যারাকপুর মেনাজেরিতে গন্ডার-পুকুর। ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটি গন্ডার রোদ পোহাচ্ছে।


ব্যারাকপুর মেনাজেরির হাতিশাল।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফ থেকে বিখ্যাত প্রকৃতিবিদ, স্কটিশ চিকিৎসক ও জুলজিস্ট ফ্রান্সিস বুকানন-হ্যামিলটন (Francis Buchanan-Hamilton) [৫] এই চিড়িয়াখানার প্রথম সুপারিনটেন্ডেন্ট নিযুক্ত হন। ফ্রান্সিস বুকানন এই পশুপাখিদের রক্ষণাবেক্ষণেরও ভার নেন। উদ্যান পরিচালনার গুরুদায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি পশুপাখি নিয়ে গবেষণার কাজও শুরু করেন।

এভাবেই কলকাতা থেকে ১৬ মাইল উত্তরে ব্যারাকপুরে এশিয়ার প্রথম ও পৃথিবীর চতুর্থ চিড়িয়াখানা গড়ে উঠলো। তখন অবশ্য 'চিড়িয়াখানা' (Zoo) শব্দটা চালু হয়নি। তখন বলা হতো 'মেনাজেরি' (Menagerie)। ব্যারাকপুরে ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়েছিল এই মেনাজেরি বা পশু নিদর্শশালা। সারা পৃথিবীতে তখন তিনটি মাত্র চিড়িয়াখানা ছিল। প্রথমটি ছিল ভিয়েনায় (যেটি ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়)। দ্বিতীয়টি মাদ্রিদে (যেটি ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়)। আর তৃতীয়টি ছিল প্যারিসে (যেটি তৈরি হয়েছিল ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে)।

আজও বিশ্বের প্রাকৃতিক ইতিহাস বা ন্যাচারাল হিস্ট্রি চর্চার ইতিহাসে ব্যারাকপুরে স্থাপিত প্রথম প্রকৃতি গবেষণার কার্যক্রমের কথা উল্লেখিত হয়। আলোচিত হয় লর্ড ওয়েলেসলির স্থাপিত মেনাজেরির কথাও। কিন্তু আজও কোনো জায়গার নাম কি আর অত সহজে মোছা যায়। ব্যারাকপুর স্টেশন লাগোয়া 'চিড়িয়ামোড়'-এই তো ছিল এই চিড়িয়াখানা! 'চিড়িয়া' নামের উৎপত্তি এই চিড়িয়াখানা থেকেই।

পরবর্তীকালে বিদেশ থেকে বহু গুণী ব্যক্তি এই মেনাজেরি পরিদর্শনে আসেন। প্রখ্যাত চিত্রকর স্যার চার্লস ডি'ওইলি (Sir Charles D'Oyly) [৬] এই পশু উদ্যানের জলরঙে ছবি এঁকেছিলেন এবং বিশিষ্ট ফরাসি উদ্ভিদতত্ত্ববিদ ভিকতর জ্যাকমঁ (Venceslas Victor Jacquemont) [৭] এই উদ্যান পরিদর্শন করেছিলেন বলে জানা যায়।

Samachar Darpan Newspaper

১৮৩০ সালে লর্ড আর্মহাষ্ট-এর (Lord Amherst) [৮] পাওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী জানা যায় এখানে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার সাদা বাঘ, লেপার্ড, ভালুক, তিব্বতী বাইসন, জিরাফ, বেবুন, সাদা বাঁদর ইত্যাদি। ১৮৩১ সালে 'সমাচার দর্পন' পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবর থেকে জানা যায় ব্রিটিশদের নির্মিত এই চিড়িয়াখানা তখনকার বাঙালিদের মনে কেমন ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।

ওদিকে বড়লাটের প্রিয় চিড়িয়াখানা দেখভালের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোষাগার থেকে বিপুল অর্থব্যয় হতে থাকলো। কোম্পানি চালানোই দায় হলো। নথি থেকে জানা যায় ১৮০৪ সাল পর্যন্ত, এই পশুপাখিদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ২,৭৯১ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছিল। সেইসময় সেই অঙ্কটি আর্থিক দিক থেকে বিপুল পরিমানের ছিল।

১৭৯৮ থেকে ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত লর্ড ওয়েলেসলি বাংলার গভর্নর-জেনারেল ছিলেন। ১৮০৫ সালে কোম্পানি লর্ড ওয়েলেসলি ও ফ্রান্সিস বুকানন-কে ইংল্যান্ডে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলো। লর্ড ওয়েলেসলি ইংল্যাণ্ড ফিরে গেলে এই চিড়িয়াখানার রক্ষনাবেক্ষনের অভাব ঘটে এবং ক্রমাবনতি দেখা যায়। এরই সাথে ফ্রান্সিস বুকানন-এর অবর্তমানে ব্যারাকপুরের প্রকৃতি গবেষণার কার্যক্রমও হলো বন্ধ। এমনটা চলতে থাকে আলিপুর চিড়িয়াখানা স্থাপনের আগে পর্যন্ত। অর্থাৎ আজ থেকে ২১৭ বছর আগে 'প্রায় বন্ধ' হবার জোগাড় হয় কলকাতার প্রথম চিড়িয়াখানার। কিন্তু চিড়িয়াখানা উন্মুক্ত থাকলো আরও ৭১ বছর। তবে দিনকে দিন তার অবস্থা হয়ে উঠলো সঙ্গীন।

এরপর লর্ড বেন্টিঙ্ক-এর (Lord William Bentinck) [৯] আমলে চিড়িয়াখানা দেখভালের খরচও কমিয়ে দেওয়া হলো। প্রাণীর সংখ্যাও কমতে শুরু করলো। এই শোচনীয় অবস্থায় লর্ড বেন্টিঙ্ক আবার তখনকার সমাজের মান্যগণ্য ব্যক্তিদের নানান জীবজন্তু উপহারস্বরূপ দিতে শুরু করলেন।

ঠিক এই পরিস্থিতিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্ণর জেনারেল হয়ে ভারতে আসেন লর্ড অকল্যান্ড (Lord Auckland) [১০]। তিনি আর তাঁর দুই বোন এমিলি (Emily Eden) [১১] আর ফ্যানি ইডেন (Fanny Eden) [১২] ব্যারাকপুর চিড়িয়াখানাকে আবার নতুন করে সাজাতে উদ্যোগী হন।

আশ্চর্যজনকভাবে, এরপর ১৮১৭-১৯-এর মধ্যে ওয়ারেন হেস্টিংস (Warren Hastings)-এর [১৩] আমলে নির্মাণ করা হয় একটি নতুন পাখিশালা। এর তিন বছর পর অর্থাৎ ১৮২২ সালে একটি নতুন পশুশালাও নির্মাণ করা হয়। নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে এই পশুশালাটি ১৮৭৭ সাল পর্যন্ত টিঁকে ছিল।

এই অশ্রুত ব্যারাকপুর চিড়িয়াখানার চিহ্ন সম্প্রতি প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অমিতাভ কারকুনের লেখায় পাওয়া গেছে। বর্তমানে ব্যারাকপুর চিড়িয়ামোড়ের অনতিদূরে লাট বাগানে ওয়ারেন হেস্টিংস-এর আমলে নির্মিত চিড়িয়াখানার একটি অংশের ধ্বংসাবশেষ অবশিষ্ট রয়েছে। আজও, একটু অনুসন্ধান করলেই সেখানে এই প্রাচীন চিড়িয়াখানার চিহ্ন পাওয়া যাবে। যদিও জনসাধারণের জন্য সেটি দ্রষ্টব্য নয়। যদি কোনো ইচ্ছুক ব্যক্তি ধ্বংসাবশেষটি দেখতে চান, তাহলে গভর্নর-এর কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি জোগাড় করে জায়গাটি পরিদর্শন করতে পারেন। অনুমতি ব্যতীত কেউ বাগানে প্রবেশ করতে পারবেন না। বাগানের এই অংশটি আজ প্রায়-ঘন গাছপালায় ভরে রয়েছে। এমনকি সকালেও সেখানে আপনার কানে ঝিঁঝিঁর শব্দ আসবে। আপনি সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় ২০০ বছর আগে নির্মিত খাঁচার কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাবেন। গথিক কাঠামোতে তৈরি পাখির একটি এভিয়ারিও দেখতে পাবেন। এটা কি দুর্ভাগ্যজনক নয় যে, কলকাতা থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে এই সুদীর্ঘ বিস্মৃত ইতিহাসের বিক্ষিপ্ত অবশেষ রয়ে গেছে অথচ আমরা কেউই সেটির বিষয়ে জানি না!

Ruins of Barrackpore Menagerie
ব্যারাকপুর মেনাজেরির ধ্বংসাবশেষ।

এর আরও কিছুকাল বাদে ১৮২৮ সালে লন্ডনে স্থাপিত হয় চিড়িয়াখানা। 'জুলজিক্যাল সোসাইটি অফ লন্ডন'-এর প্রতিষ্ঠাতা স্যার টমাস স্ট্যামফোর্ড র্যাফেল (Sir Thomas Stamford Raffles) [১৪] তার আগে দু'বার ব্যারাকপুর চিড়িয়াখানা পরিদর্শন করে গিয়েছিলেন। প্রসঙ্গতঃ জানা যায়, ১৮১০ সালে তিনি এই উদ্যানে এসে টাপির শিকার করেন। মনে করা হয়, এই উদ্যানের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য লন্ডন চিড়িয়াখানা [১৫] কর্তৃপক্ষকেও অণুপ্রাণিত করেছিল।


টাপির।

Natural History Museum
ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ম, লন্ডন।


গ্রান্ট মিউজিয়ম অফ জুলজি এন্ড কম্পারেটিভ অ্যানাটমি, লন্ডন।

আজও আপনি লন্ডনে অবস্থিত প্রাকৃতিক ইতিহাস যাদুঘর (Natural History Museum), প্রাণিবিদ্যা এবং তুলনামূলক শারীরস্থানের যাদুঘর (Grant Museum of Zoology and Comparative Anatomy) ইত্যাদি মিউজিয়ামে ব্যারাকপুরের এই প্রাচীন চিড়িয়াখানা সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক তথ্য পাবেন!

এশিয়ার দ্বিতীয় (ব্যক্তিগত) চিড়িয়াখানার জন্ম

Wazid Ali Shah

ওয়াজেদ আলি শাহ (৩০ জুলাই, ১৮২২ - ১ সেপ্টেম্বর, ১৮৮৭), লক্ষ্ণৌয়ের শেষ নবাব, যিনি কলকাতাকে দিয়েছেন তাঁর শ্রেষ্ঠতম উপহার - বিরিয়ানি; সেই ওয়াজেদ আলি শাহ ১৮৫৬-এর ১১ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর হাতে তাঁর রাজ্যের শাসনভার তুলে দিতে বাধ্য হন এবং ঐ বছরেরই ১৩ মে কলকাতার মেটিয়াবরুজে এসে ঘাঁটি গাড়েন, গড়ে তোলেন 'মিনি লক্ষ্ণৌ'। নবাবী ছেড়ে আসার মুহূর্তে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহের চিড়িয়াখানাটিকেও লক্ষ্ণৌ থেকে কলকাতায় তুলে নিয়ে আসেন এবং মেটিয়াবরুজেই আবার নতুন করে একটি মেনাজেরি গড়ে তোলেন। এই মেনাজেরিতে ছিল বাঘ, সিংহ, চিতা, গণ্ডার এবং অসংখ্য বিষধর সাপ। ১৮৮৭ সালে ওয়াজেদ আলি শাহের মৃত্যুর সাথে সাথে রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে নষ্ট হয়ে যায় তাঁর এই ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানাটি। বস্তুতঃ এটিই ছিল কলকাতা তথা এশিয়ার দ্বিতীয় চিড়িয়াখানা, আলিপুরের ঠিক আগে।

চিড়িয়াখানা স্থাপন নিয়ে টানাপড়েন

বিশ্বের বিভিন্ন শহরে একে একে চিড়িয়াখানা স্থাপিত হতে থাকলে, কলকাতার ব্রিটিশ সম্প্রদায়ও ব্যারাকপুরের পশু উদ্যান তথা মেনাজেরিটিকে একটি 'বিধিবদ্ধ চিড়িয়াখানা'র রূপ দেওয়ার কথা ভাবতে থাকেন। যদিও পরে সেটি আলিপুরে সরিয়ে এনে বিধিবদ্ধ চিড়িয়াখানার রূপ দেওয়া হয়। কিন্তু শুরুতে বার বার চিড়িয়াখানা স্থাপনের পরিকল্পনা নানা কারণে বাধাপ্রাপ্ত হতে থাকে। তার গল্পই এখন বলবো।

ইংরেজ সরকারের হাতে গড়া সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান 'এশিয়াটিক সোসাইটি'র থেকেই জন্ম নিয়েছিল একাধিক সমৃদ্ধশালী প্রতিষ্ঠান, পরবর্তীকালে যার মধ্যে অন্যতম কলকাতার আলিপুরে অবস্থিত এই চিড়িয়াখানা।

১৮৪১ সালের জুলাই মাসে, 'বেঙ্গল এশিয়াটিক সোসাইটি'র যাদুঘরের (Museum) তত্ত্বাবধায়ক (Curator) ডঃ জন ম্যাকক্লেল্যান্ড (Sir John McClelland) [১৬] কলকাতায় চিড়িয়াখানা স্থাপনের পক্ষে সওয়াল করে 'ক্যালকাটা জার্নাল অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি' (Calcutta Journal of Natural History) পত্রিকায় একটি পরিকল্পনার কথা প্রস্তাব আকারে পেশ করেন। যার শিরোনাম ছিল - 'Proposal to form a Zoological Garden in Calcutta'. কিন্তু উল্লিখিত প্রস্তাবটি তখন কারোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। বলা বাহুল্য, প্রাথমিকভাবে তখন অনেকেই সেটিকে গুরুত্ব দেননি।


'ক্যালকাটা জার্নাল অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি'-র ভিতরের একটি পৃষ্ঠা।

১৮৬৭ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি ই. সি. বেইলি (Sir Edward Clive Bayley) [১৭] সোসাইটির বার্ষিক সভায় কলকাতায় একটি চিড়িয়াখানা স্থাপনের কথা তোলেন। এরপর ওই বছরেরই জানুয়ারি মাসে এশিয়াটিক সোসাইটির একটি সভায় তৎকালীন এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি ডাঃ জে. ফেরে (Dr. Joseph Fayrer) [১৮] একটি প্রস্তাব পেশ করেন যার বর্ণনা এশিয়াটিক সোসাইটির পুরনো দলিলের পাতায় পাওয়া যাবে। সেই প্রস্তাবটির সামান্য অংশ এখানে তুলে ধরা হল, “I have the gratification of recording the initiation of a movement among several members of the society and others, for establishing the most useful and instructive of all places of public recreation, a Zoological Garden.” - এই উক্ত প্রস্তাবটির থেকেই বোঝা যায় যে, ডা. ফেরে একটি পশুশালা বা চিড়িয়াখানায় প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। এই পরিকল্পনাটি জনসাধারণের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল, কিন্তু উপযুক্ত জমির অভাবে পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত করা যায়নি। পরের বছর ডঃ ফেরে বিভিন্ন উপসমিতি গঠন করে চিড়িয়াখানা স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যান।

ডঃ ফেরের সেই প্রস্তাবটি কার্যকর করার জন্যে এশিয়াটিক সোসাইটির এক সক্রিয় জার্মান সদস্য কার্ল লুইস স্যুয়েন্ডলার (Carl Louis Schwendler)-কে [১৯] চিড়িয়াখানা স্থাপন করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা (Project Report) পেশ করার অনুরোধ করা হয়। সেই পরিকল্পনা অবশেষে ১৮৭৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে চিড়িয়াখানা স্থাপন করার সাব-কমিটির হাতে এলে চিড়িয়াখানা তৈরির কাজ শুরু হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৮৬৭ সালে ডঃ জোসেফ ফেরে-র দেওয়া চিড়িয়াখানা তৈরির পরিকল্পনাটি ১৮৭৩ সালে স্যুয়েন্ডলার প্রথম উত্থাপন করেছিলেন। সেজন্যই তিনি পরবর্তীকালে 'চিড়িয়াখানার জনক' নামে পরিচিত হন। কিন্তু উপযুক্ত জমির অভাবে পরিকল্পনাটি স্থগিত হয়ে যায়।

১৮৬৭ সাল থেকে ডঃ জোসেফ ফেরে ও পরে মি. কে. এল. সোয়েণ্ডলার-এর ক্রমাগত তদ্বির ও ঠেলা-গুঁতো খেয়ে প্রায় সাত বছর পর ১৮৭৪ সালে তৎকালীন বাংলার লেফটেন্যান্ট-গভর্নর স্যার রিচার্ড টেম্পল (Sir Richard Temple) [২০] কলকাতায় একটি চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠার জন্য উপযুক্ত স্থান খুঁজে বের করতে একটি কমিটি গঠন করেন। এই কমিটি জিরাট ব্রিজ থেকে বেলভেডের বা বেলভেডিয়ার-এ (আজকে যেখানে ন্যাশানাল লাইব্রেরী অবস্থিত) যাওয়ার আলিপুর রোডের দু'পাশের জমি বেছে নেয়। জায়গাটি ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৭৫ সালে বাংলার লেফটেন্যান্ট-গভর্নর দ্বারা অনুমোদিত হয়েছিল। স্যার রিচার্ড টেম্পল ১৮৭৪ থেকে ১৮৭৭ সাল পর্যন্ত বাংলার লেফটেন্যান্ট-গভর্নর ছিলেন। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ২ অক্টোবর ব্রিটিশ সরকার এশিয়াটিক সোসাইটি ও এগ্রি-হর্টিকালচার সোসাইটিকে যৌথভাবে চিড়িয়াখানা স্থাপনের জন্য 'জিরাট বস্তি'র ১৫৬ বিঘা ১৮ কাঠা ৯ ছটাক জমি প্রদান করে। বেলভেডেরার রোডের পশ্চিম দিকের মাঠের শুধুমাত্র একটি অংশে প্রাথমিক নির্মাণকার্যের উদ্দেশ্যে তাৎক্ষণিকভাবে ৫,০০০ টাকা মঞ্জুর করা হয়েছিল।

এরপর ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুলাই 'বেগম বাড়ি' নামের ৪৩ বিঘার সংলগ্ন ভূখণ্ডটিও মূল জমির সাথে যুক্ত করা হয়। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে 'মিলিটারি অরফ্যান স্কুল' (Military Orphan School)-এর ৯৬০x১২০ বর্গফুটের জায়গাটিও অধিগ্রহণ করে এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়। যদিও চিড়িয়াখানার জায়গার অভাব পরবর্তীকালেও প্রকট ছিল।

Alipore Zoo

অবশেষে আলিপুরে স্থাপিত হলো বহু প্রতীক্ষিত চিড়িয়াখানা

বাংলার ছোটলাটের আদেশে ১৮৭৫ খ্রীস্টাব্দের ২ অক্টোবর চিড়িয়াখানা তৈরির জন্য ১৫৬ বিঘা ১৮ কাঠা ৯ ছটাক জমি অধিগ্রহণ করা হয় কলকাতার আলিপুরে। জিরাট ব্রিজের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের অপরিস্কার, জনবহুল, নোংরা বস্তি এলাকা উচ্ছেদ করে ১৮.৮১ হেক্টর অর্থাৎ প্রায় ৪৬.৫ একর জায়গা জুড়ে গড়ে ওঠে আজকের এই আলিপুর চিড়িয়াখানা।

ওদিকে কার্ল লুইস স্যুয়েন্ডলার ছিলেন একজন সম্মানিত গভর্নর যিনি চিড়িয়াখানার মূল ভিত গঠনের জন্য তাঁর নিজের সংগ্রহ থেকে বিভিন্ন পশুপাখি দান করেছিলেন। কার্ল লুইস স্যুয়েন্ডলার, শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের তত্ত্বাবধায়ক ডঃ জর্জ কিং (George King) [২১], এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার এ. এফ. ওয়াটসন (Mr. A. F. Watson) [২২] প্রমূখ বিশিষ্ট ইংরেজ পশুপাখিপ্রেমী ও বিশেষজ্ঞদের সাথে যে বাঙালি যুবক চিড়িয়াখানা তৈরির একেবারে আদিলগ্ন থেকে কাজ করেছিলেন তিনিই হলেন রামব্রহ্ম সান্যাল - যিনি অধিক পরিচিত ছিলেন 'আর. বি. সান্যাল' নামে।

R. B. Sanyal
রায় বাহাদুর রামব্রহ্ম সান্যাল (১৮৫৬-১৯০৮)

ডঃ জর্জ কিং এই চিড়িয়াখানা তৈরির ব্যাপারে ছিলেন ভীষণ আগ্রহী। ডঃ জর্জ কিং, কার্ল লুইস স্যুয়েন্ডলার ও জন এন্ডারসনের মত বিশেষজ্ঞরা রামব্রহ্মের কর্মদক্ষতা ও আন্তরিকতার বিষয়ে যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করতেন।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক, সাংবাদিক, ব্যারিস্টার, লেখক ও প্রশাসক স্যার এইচ. ই. এ. কটন (Sir H. E. A. Cotton) তাঁর “Calcutta Old and New” গ্রন্থে আলিপুর পশুশালা নিয়ে বেশ খানিকটা অংশে আলোচনা করেছেন।

১৮৭৫ সালের ৯ ডিসেম্বর নবনির্মিত ম্যানেজিং কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন লর্ড ব্রাউন (Lord Brown) [২৩] আর সি. ই. বাকল্যান্ড (C. E. Buckland) [২৪] ছিলেন সেক্রেটারি। অধিগৃহীত জমিতে চিড়িয়াখানা তৈরির উদ্দেশ্যের বিষয়ে কার্যনির্বাহী কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় পরের দিন অর্থাৎ ১০ ডিসেম্বর। ওইদিন পাঁচ সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত ম্যানেজিং কমিটি প্রথমবারের মতো মিলিত হয়েছিল। সেখানে আলোচ্য বিষয় ছিল কেমন করে এবং কেন এই চিড়িয়াখানা গড়ে তোলা হবে। চিড়িয়াখানা তৈরির একাধিক উদ্দেশ্য প্রায় এইরকম ছিল -
(১) সমাজের সর্বস্তরের মানুষের জন্য আমোদ-প্রমোদ, কৌতুহল জাগানো ও শিক্ষাদান করবার উদ্দেশ্যে।
(২) জীবজন্তুদের আচার-আচরণের বিষয়ে পর্যবেক্ষণ।
(৩) ভারতীয় গ্রীষ্মপ্রধান জলবায়ুতে জীবজন্তুদের অভ্যস্ত করা, পোষ মানানো ও প্রজনন ঘটানো।
(৪) জীবজন্তুদের আমদানি-রফতানির সূত্রে জীব বিজ্ঞানের উন্নতি ঘটানো।

এইসব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পরিকল্পনা রূপায়ন বা পরিকাঠামো তৈরির কাজ শুরু হয়।

আলিপুর পশুশালায় তৈরি হল পশুপাখিদের নতুন খাঁচা ও ঘর। বাংলার সাবেক গভর্নর জেনারেল আর্থার ওয়েলেসলি অনেক আগেই কলকাতার নিকটস্থ ব্যারাকপুরে ছোটোখাটো যে পশু উদ্যান গড়ে তুলেছিলেন সেখান থেকে বর্তমান গভর্নর জেনারেল লর্ড লিটন-এর আদেশ অনুযায়ী তখন ব্যারাকপুরের লাট বাগানের চিড়িয়াখানায় থাকা অবশিষ্ট পশুপাখিগুলিকে আলিপুর চিড়িয়াখানায় স্থানান্তরিত করার চেষ্টা শুরু হয়। ১৮৭৬ খ্রীস্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে এই কাজ শুরু হয় এবং আগষ্ট মাসে প্রায় ১১টি জন্তু এসে পৌছায়।

প্রথমে এই চিড়িয়াখানার পথ চলা শুরু হয়েছিল ৩৪ জন কর্মচারী নিয়ে যা বর্তমানের বিচারে নিতান্তই কম। নথি থেকে জানা যায়, ১৮৭৬ খ্রীস্টাব্দের মে মাসে একজন বাঙালি ২৫ টাকা বেতনে চিড়িয়াখানার কাজে যোগদান করেন টিকিট সংগ্রাহক হিসেবে, যার নাম নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।


যুবরাজ অ্যালবার্ট

অবশেষে সেই বহু প্রত্যাশিত ক্ষণ এসে উপস্থিত হলো। ১৮৭৫ খ্রীস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর, সোমবার দুপুরে ইংল্যণ্ডের যুবরাজ অ্যালবার্ট কলকাতা চিড়িয়াখানার দ্বারোদঘাটন করেন। তার ঠিক পাঁচ দিন পরে ১৮৭৬ খ্রীস্টাব্দের ১ জানুয়ারি ইংল্যণ্ডের রাজা, প্রিন্স অফ ওয়েলস, সপ্তম এডওয়ার্ড আনুষ্ঠানিকভাবে কলকাতার অভিজাত শহরতলি আলিপুর অঞ্চলে এই চিড়িয়াখানা স্থাপনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করেন। ওই বছরেরই ৬ মে জনসাধারনের জন্য চিড়িয়াখানার দরজা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। নব উদ্বোধীত চিড়িয়াখানা দেখতে প্রচুর দর্শক সমাগম ঘটে।


প্রিন্স অফ ওয়েলস, সপ্তম এডওয়ার্ড


প্রিন্স অফ ওয়েলস-এর কলিকাতায় আগমন।

প্রথমদিকে একটি 'সাম্মানিক ম্যানেজিং কমিটি'র উপর এই চিড়িয়াখানা চালানোর ভার ন্যস্ত ছিল। এই কমিটির সদস্য ছিলেন কার্ল লুইস স্যুয়েন্ডলার ও ডঃ জর্জ কিং।

প্রথমদিকে জে. সি. পারকার এবং জন অ্যান্ডারসন নামে দু'জন ব্রিটিশ পদাধিকারী চিড়িয়াখানার 'ডিরেক্টর' পদে ছিলেন এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এই 'ডিরেক্টর' পদটি তুলে দেওয়া হয়। পরে ১৯৬৫ সাল থেকে এই 'ডিরেক্টর' পদ পুনরায় চালু করা হয়।

১৮৮০ সালে রামব্রহ্ম সান্যালকে ৪০ টাকা মাসিক পারিশ্রমিকের বিনিময়ে 'সুপারিন্টেন্ডেন্ট' (প্রশাসনিক অধিকর্তা) পদে নিয়োগ করা হয়। তখন তিনিই ছিলেন একাধারে অধীক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক।

ক্রমশ ভারতীয় ও ব্রিটিশ অভিজাত ব্যক্তিদের দানে এই চিড়িয়াখানা পুষ্ট হতে থাকে।

প্রথমদিকে চিড়িয়াখানা গঠিত হয়েছিল ভারতীয় রেলওয়ে স্টেশনে বৈদ্যুতিককরণের দায়িত্বপ্রাপ্ত জার্মান ইলেকট্রিশিয়ান কার্ল লুইস সোয়েন্ডলারের ব্যক্তিগত পশু উদ্যানের পশুপাখি নিয়ে। ১৮৮৬ সালের প্রথম দিকে ব্যারাকপুর পার্কের বাদবাকি পশুপাখিগুলিকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে এলে চিড়িয়াখানার আকার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। চিড়িয়াখানায় প্রথম দিকে যে পশুপাখিগুলি ছিল সেগুলি হল - আফ্রিকান বাফেলো, জ্যাঞ্জিবার ভেড়া, গৃহপালিত ভেড়া, চার-শৃঙ্গবিশিষ্ট ভেড়া, সংকর কাশ্মীরি ছাগল, ইন্ডিয়ান আন্টেলোপ, ইন্ডিয়ান গেজেল, সম্বর হরিণ, চিত্রা হরিণ ও প্যারা হরিণ।

আলিপুর চিড়িয়াখানার ইতিহাস 'অদ্বৈত' নামের দৈত্যাকার অ্যালডাব্রা কচ্ছপটিকে ছাড়া অসমাপ্ত থাকবে। সংগৃহীত তথ্য থেকে জানা যায়, অদ্বৈত ফরাসি বিপ্লবের আগে এমনকি মোজার্টেরও আগে জন্মগ্রহণ করেছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মেজর-জেনারেল রবার্ট ক্লাইভ (১৭২৫-১৭৭৪) ব্রিটিশ নাবিকদের কাছ থেকে উপহারস্বরূপ অদ্বৈতকে পান, যারা পূর্ব আফ্রিকার ভারত মহাসাগরে অবস্থিত সেশেলস দ্বীপপুঞ্জ থেকে কচ্ছপটিকে নিয়ে এসেছিল। শুরুতে অদ্বৈত থাকতো ব্যারাকপুরের মেনাজেরিতে। পরে সম্ভবতঃ ১৮৭৫/৭৬ সালে তাকে আলিপুর চিড়িয়াখানায় স্থানান্তরিত করা হয়। অদ্বৈত ২২ মার্চ, ২০০৬-এ ২৫০ বছর বয়সে মারা যায়। মার্কিন সংবাদ সংস্থা সিএনএন অদ্বৈত-র মৃত্যুর খবর ঘোষণা করেছিল।

এছাড়াও জনসাধারণের থেকে প্রাপ্ত উপহারও গৃহীত হতে থাকে।

Charles Darwin

রাজা ওয়াজিদ আলি শাহ-র মেটিয়াবুরজের পশুপাখিগুলিকে আলিপুর চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসা হয়। এই প্রসঙ্গে আরও মজার তথ্য পাওয়া যায়। অনেকেই জানেন না, মেটিয়াবুরজের বাদশা ওয়াজিদ আলি ও বিশ্ববিশ্রুত জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন-এর মধ্যে ছিল গভীর সম্পর্ক!

আগেই বলেছি, কলকাতার মেটিয়াবুরজে অবধের রাজা ওয়াজিদ আলির ছিল বিশাল পশুশালা, রাজার ইন্তেকালের পর যার একাংশ চলে যায় আলিপুর চিড়িয়াখানায়। কলকাতার রাজেন্দ্র মল্লিক আর ব্লিথ সাহেবরা ছিলেন আন্তর্জাতিক স্তরের পশুব্যবসায়ী। ব্লিথ আবার ছিলেন এশিয়াটিক সোসাইটির কর্মকর্তা। জানা যায় ব্লিথের কাছ থেকে ডারউইন নিয়মিত রাজার পশুশালার খবর নিতেন।

ময়মনসিংহের রাজা সুকান্ত আচার্য্যের সম্মানে এখানকার ওপেন এয়ার টাইগার এনক্লোজারটির নামকরণ করা হয় 'ময়মনসিংহ এনক্লোজার'। এছাড়াও মহীশূরের রাজা চতুর্থ কৃষ্ণরাজ ওয়াদিয়ার তাঁর পশু উদ্যান থেকে অনেক পশুপাখি দান করেছিলেন এখানে। আলিপুর চিড়িয়াখানার এনক্লোজারগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। ভারতের আর কোনো চিড়িয়াখানার এত ঐতিহাসিক গুরুত্ব নেই। শুধুমাত্র চিড়িয়াখানার এনক্লোজারগুলি নিয়েই একটা বই লেখা হয়ে যাবে!

Manmathanath Mallick

একটি মজার তথ্য হলো - যদুলাল মল্লিক-এর পুত্র মন্মথনাথ মল্লিক আলিপুর পশুশালা থেকে এক জোড়া জেব্রা এনেছিলেন কলকাতার রাস্তায় তাঁর নিজস্ব জুরিগাড়ি টানার জন্য। তাঁর সংগ্রহে ঘোড়ার আস্তাবল সহ ন'রকমের জুরিগাড়ি ছিল। যদুলাল মল্লিক-এর এক পৌত্র, প্রদ্যুম্ন কুমার মল্লিক-এর ৩৫টি মোটরগাড়ি ছিল। তার মধ্যে ১০টি ছিল রোলস রয়েস।

শুরু থেকেই প্রাণীতত্বের নানা দিক নিয়ে গবেষণায় আলিপুর পশুশালা সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। পরবর্তীকালে সিংহ ও বাঘের ক্রস-ব্রিডিং ঘটিয়ে টাইগন ও লিটিগণ জাতীয় সংকর প্রাণীর প্রজনন করে আলিপুর পশুশালা বিজ্ঞানী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ১৯৭০-এর দশকে চিড়িয়াখানায় দু'টি টাইগনের জন্ম হয় - রুদ্রাণী (জন্ম ১৯৭১) ও রঞ্জিনী (জন্ম ১৯৭৩)। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার ও আফ্রিকান লায়নের সংকরায়নের ফলে এদের জন্ম হয়। আফ্রিকান সিংহের ঔরসে রুদ্রাণী সাতটি সন্তানের জন্ম দেয়। এর ফলে লিটিগণ প্রজাতি সৃষ্টি হয়। এদের মধ্যে কিউবানাকান নামে একটি লিটগন পূর্ণবয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিল। এটি ৫.৫ ফুট (১.৭ মি) লম্বা, ১১.৫ ফুট (৩.৫ মি) চওড়া ও ৮০০ পাউন্ডের বেশি ওজনযুক্ত হয়। ১৯৯১ সালে ১৫ বছর বয়সে এটি মারা যায়। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ এটিকে 'বিশ্বের বৃহত্তম বিগ ক্যাট' হিসেবে দাবি করেছিল। এই সংকর প্রজাতির পুরুষেরা ছিল প্রজননে অক্ষম। এদের অনেকেই জিনগত অস্বাভাবিকতার শিকার হয় এবং অল্প বয়সেই মারা যায়। চিড়িয়াখানার শেষ টাইগন রঞ্জিনী ১৯৯৯ সালে মারা যায়। এটিই ছিল সবচেয়ে বেশি বয়সের টাইগন। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার (তদনীন্তন ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড) এই সংকরায়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলে ১৯৮৫ সালে ভারত সরকার আইন করে চিড়িয়াখানায় সংকর প্রজনন বন্ধ করে দেয়।

বর্তমানে আলিপুর চিড়িয়াখানায় একটি সরীসৃপ ভবন, শিম্পাঞ্জী, হাতি, গণ্ডার, জলহস্তী ও কুমিরের জন্য ওপেন এয়ার এনক্লোজার এবং বাঘ ও সিংহের জন্য ওপেন এয়ার এনক্লোজার রয়েছে। একটি আলাদা শিশুদের চিড়িয়াখানাও রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে জাগুয়ার, শেয়াল, হায়না, গাউর, পাঁচ প্রজাতির হরিণ, রেটিকুলেটেড জিরাফ, ভাল্লুক, নানান প্রজাতির বাঁদর, দুস্প্রাপ্য মারমোসেট বাঁদর, ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় থাকা ম্যাকাও প্রজাতির বৃহদাকার তোতা, কনুর, লোরি ও লোরিকিট, টৌরাকো ও ধনেশ, সোনালি মথুরা, লেডি আমহার্স্ট'স পেজেন্ট ও সোয়াইনহো'স পেজেন্ট। কয়েকটি এমু, ক্যাসাওয়ারি ও অস্ট্রিচ। মোটকথা ১০৮টি প্রজাতির ১২৬৬টি বন্য জীবজন্তুর অফুরন্ত ভাণ্ডার এই আলিপুর পশু সংগ্রহশালা।

Ram Brahma Sanyal Memorial Auditorium
'রামব্রহ্ম সান্যাল স্মৃতি সদন' প্রেক্ষাগৃহ।

আলিপুর চিড়িয়াখানার প্রধান ফটকের বিপরীতদিকে একটি প্রেক্ষাগৃহ রয়েছে, আগে এই প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠান হতো, এই প্রেক্ষাগৃহ আলিপুর চিড়িয়াখানার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রনে রয়েছে, এই প্রেক্ষাগৃহের নাম 'রামব্রহ্ম সান্যাল স্মৃতি সভাকক্ষ'। কিন্তু বহুদিন ধরেই এই প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ পড়ে আছে।

এছাড়াও প্রেক্ষাগৃহের পাশেই আছে একটি অ্যাকোয়ারিয়াম।

আজ প্রায় ১৫৭ বিঘা জমির উপর দাঁড়িয়ে আছে ১৪৬ বছর বয়সের আমাদের চিরপরিচিত কলকাতা চিড়িয়াখানা।


[‘আরেক রকম’ একাদশ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যায় (১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩) প্রবন্ধটির দ্বিতীয় অংশটি প্রকাশিত হয়েছে। পড়তে লিঙ্কে ক্লিক করুন - ‘রায় বাহাদুর রামব্রহ্ম সান্যাল’]

___________________________________

 

 

পাদটীকাঃ

[১] ১৭৭৩ সালের আগে ফোর্ট উইলিয়াম (বেঙ্গল)-এর প্রেসিডেন্সির গভর্নর-জেনারেলকে 'বাংলার গভর্নর' (Governor of Bengal) হিসেবে নামকরণ করা হয়েছিল, যা ১৭৫৭ থেকে ১৭৭২ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল।

[২] ভারতে রবার্ট ক্লাইভ (Col. Robert Clive)-এর মেয়াদকাল ছিল ১৭৫৮ থেকে ১৭৬০ সাল।

[৩] আর্থার ওয়েলেসলি (Arthur Wellesley) ছিলেন ওয়েলিংটনের ১ম ডিউক (1st Duke of Wellington)। পরবর্তীকালে তিনি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী (Prime Minister of the United Kingdom), 'হাউস অফ লর্ডস'-এর নেতা (Leader of the 'House of Lords'), ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ (Commander-in-Chief of the British Army) পদ অলংকৃত করেন।
    কোম্পানি তাঁকে ফিলিপাইনে একটি সংক্ষিপ্ত অভিযানে পাঠানোর আগে, ১৭৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতে এসে কলকাতায় এসে তিনি বেশ কয়েক মাস কাটিয়েছিলেন। পরে নভেম্বর মাসে আবার ভারতে ফিরে এসে তিনি জানতে পারলেন যে তার বড় ভাই রিচার্ড (Richard), তখন লর্ড মর্নিংটন (Lord Mornington) নামে পরিচিত, ভারতের নতুন গভর্নর-জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। ১৭৯৮ সালে, তিনি তার উপাধিটির বানান পরিবর্তন করে 'ওয়েলেসলি' (Wellesley) করেন; তখনও পর্যন্ত তিনি 'ওয়েসলি' (Wesley) নামে পরিচিত ছিলেন, যাকে তাঁর জ্যেষ্ঠ ভাই প্রাচীন এবং সঠিক বানান বলে মনে করতেন।
    ভারতে থাকাকালীন সময়ে ওয়েলেসলি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, মন্তব্য করেছিলেন যে, "আমি ভারতে যতদিন কাজ করেছি ততদিন অপর যে কোনও ব্যক্তি হলে তিনি অন্য কোথাও সেবাপ্রদান করতেন"। ১৮০৪ সালের জুন মাসে তিনি দেশে ফেরার অনুমতির জন্য আবেদন করেন এবং ভারতে তার সেবার পুরস্কার হিসেবে কোম্পানি সেপ্টেম্বর মাসে তাঁকে 'নাইট অফ দ্য বাথ' (Knight of the Bath) উপাধি প্রদান করে। ১৮০৫ সালের মার্চ মাসে ভারতের গভর্নর-জেনারেল হিসাবে তার ভাইয়ের মেয়াদ শেষ হলে, তাঁরা দুই ভাই একসাথে এইচএমএস হোয়ে (HMS Howe) নামক সেগুন-নির্মিত ভারতীয় বাণিজ্যিক জাহাজে ইংল্যান্ডে ফিরে যান। আর্থার, কাকতালীয়ভাবে, তাঁর সমুদ্রযাত্রা চলাকালীন সেন্ট হেলেনার ছোট্ট একটি দ্বীপে থামেন এবং সেই বাড়িটিতে থেকে যান যেখানে নেপোলিয়ন তার পরবর্তী নির্বাসনের সময় থাকতেন।

[৪] ভারতে রিচার্ড ওয়েলেসলি (Richard Wellesley)-র মেয়াদকাল ছিল ১৭৯৮ থেকে ১৮০৫ সাল।

[৫] ফ্রান্সিস বুকানন-হ্যামিলটন (Francis Buchanan-Hamilton | ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৭৬২ - ১৫ জুন ১৮২৯) পরবর্তীতে 'ফ্রান্সিস হ্যামিলটন' নামে অধিক পরিচিত হন। কিন্তু অনেকে তাঁকে 'ফ্রান্সিস বুকানন-হ্যামিলটন' নামেও ডাকতেন। তিনি একজন স্কটিশ চিকিৎসক ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি ভূতত্ত্ববিদ, প্রাণীবিজ্ঞানী (জুলজিস্ট) এবং জীববিজ্ঞানী হিসেবেও ভারতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। ১৮০৫ সালে ভারতবর্ষ থেকে অবসর নেওয়ার তিন বছর পর পর্যন্ত তিনি তাঁর নামে 'হ্যামিলটন' শব্দটি ব্যবহার করেননি।

[৬] স্যার চার্লস ডি'ওইলি (Sir Charles D'Oyly | ১৭৮১-১৮৪৫), ছিলেন একজন ব্রিটিশ সরকারী কর্মকর্তা (British public official) ও চিত্রশিল্পী। তিনি ঢাকায় থাকতেন। ১৭৯৭ থেকে ১৮৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতা, ঢাকা এবং পাটনা ভিত্তিক বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের সদস্য ছিলেন। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সিভিল সার্ভিসের সিনিয়র পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, এছাড়াও তিনি একজন প্রতিভাবান অপেশাদার শিল্পী, কবি এবং প্রকাশক হিসাবে সর্বাধিক পরিচিত। পরবর্তীকালে তিনি ভারতীয় বিষয়বস্তু সম্বলিত খোদাই এবং লিথোগ্রাফ সম্বন্ধে অনেক বই প্রকাশ করেছিলেন।

[৭] ভিকতর জ্যাকমঁ (Venceslas Victor Jacquemont | ১৮০১-১৮৩২) ছিলেন বিশিষ্ট ফরাসি উদ্ভিদতত্ত্ববিদ ও ভূতত্ত্ববিদ যিনি তৎকালে ভারত ভ্রমণের জন্য পরিচিত ছিলেন।

[৮] ভারতে লর্ড আর্মহাষ্ট (Lord Amherst)-এর মেয়াদকাল ছিল ১৮২৩ থেকে ১৮২৮ সাল। তিনি ভারতের গভর্নর-জেনারেল ছিলেন। ১৮২৩ সালে কোম্পানি কর্তৃক গভর্নর-জেনারেল লর্ড হেস্টিংস-এর অপসারণের পর লর্ড আমহার্স্ট-কে নিয়োগ করা হয়। আমহার্স্ট ছিলেন একজন অনভিজ্ঞ গভর্নর যিনি, অন্তত কলকাতায় তাঁর শাসনামলের প্রথম দিকে, স্যার এডওয়ার্ড পেগেটের মতো বাংলার সিনিয়র সামরিক অফিসারদের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ইংল্যান্ডে ফিরে তিনি ১৮৫৭ সালের মার্চ মাসে তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত অবসর জীবনযাপন করেন।

[৯] ভারতে লর্ড বেন্টিঙ্ক (Lord William Bentinck)-এর মেয়াদকাল ছিল ১৮২৮ থেকে ১৮৩৫ সাল।। তাঁর পুরো নাম ছিল লেফটেন্যান্ট জেনারেল লর্ড উইলিয়াম হেনরি ক্যাভেন্ডিশ-বেন্টিঙ্ক (Lieutenant General Lord William Henry Cavendish-Bentinck. ১৭৭৪-১৮৩৯)। ভারতে সামাজিক ও শিক্ষাগত সংস্কারের নেপথ্যে তাঁর উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে সতীদাহ প্রথা রদ করা, মহিলাদেরকে চিতায় উৎসর্গ করা বন্ধ করা, বলিদান হিসাবে শিশুহত্যা দমন করা ইত্যাদি। সেনাবাহিনী এবং কর্মকর্তাদের সাথে পরামর্শের পর লর্ড বেন্টিঙ্ক প্রবল বিরোধিতার মধ্যে ১৮২৯ সালে 'Bengal Sati Regulation' পাশ করেন।


[১০] ভারতে লর্ড অকল্যান্ড (Lord Auckland)-এর মেয়াদকাল ছিল ১৮৩৬ থেকে ১৮৪২। জর্জ ইডেন (১৭৮৪-১৮৪৯), অকল্যান্ডের প্রথম আর্ল (George Eden, 1st Earl of Auckland) ছিলেন। তিনি একাধারে ছিলেন ইংরেজ রাজনীতিবিদ এবং ঔপনিবেশিক প্রশাসক। একজন বিধায়ক হিসেবে, তিনি বিশেষ করে দেশীয় বিদ্যালয়ের উন্নতি এবং ভারতের বাণিজ্যিক শিল্পের প্রসারের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। ১৮৪২ সালে তিনি লর্ড এলেনবোরো (Lord Ellenborough)-কে গভর্নর-জেনারেলশিপ হস্তান্তর করেন এবং পরের বছর ইংল্যান্ডে ফিরে যান।

[১১] এমিলি ইডেন (Emily Eden | ৩ মার্চ ১৭৯৭ - ৫ আগস্ট ১৮৬৯) ছিলেন একজন ইংরেজ কবি এবং ঔপন্যাসিক যিনি উনিশ শতকের প্রথম দিকে সাহেবী জীবনের মজার বিবরণ লিখেছিলেন। তিনি তাঁর ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বিখ্যাত বিবরণ লিখেছেন আর রচনা করেছেন দুটি উপন্যাস। তৎকালীন সমাজে যেগুলির কাটতি ভালোই ছিল। এছাড়াও তিনি ছিলেন একজন দক্ষ অপেশাদার শিল্পী। তাঁর আরেকটি পরিচয় তিনি ছিলেন লর্ড অকল্যান্ড-এর বোন।

[১২] ফ্যানি ইডেন (Fanny Eden)-এর পরিচয় তিনি ছিলেন লর্ড অকল্যান্ড-এর দুই বোনের মধ্যে একজন। কলকাতার 'ইডেন গার্ডেন'-এর নামকরণ তাঁদের নামেই হয়। তাঁরা দুইবোন মিলে বাগানটি দেখাশোনা করতেন যখন এটি ভাইসরয়-এর এস্টেটের অংশ হয়ে ওঠে এবং পরে এটি একটি বিখ্যাত পাবলিক গার্ডেন হয়ে ওঠে, যা ১৮৪০ সালে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
    বাগানের একটি অংশে স্টেডিয়াম গঠন করা হয়। যেখানে ১৮৬৪ সালে প্রথম রঞ্জি ক্রিকেট ম্যাচ খেলা হয়েছিল। বর্তমানে ইডেন গার্ডেন ক্রিকেট স্টেডিয়াম হিসেবে পরিচিত। ইডেন গার্ডেনে একটি প্যাগোডাও রয়েছে, যা দ্বিতীয় বার্মিজ যুদ্ধের পর বার্মার প্রোম থেকে আনা হয়েছিল এবং ১৮৫৬ সালে তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল লর্ড ডালহৌসি (Lord Dalhousie) দ্বারা নির্মিত হয়েছিল।

[১৩] ওয়ারেন হেস্টিংস (Warren Hastings | ১৭৩২-১৮১৮) ছিলেন ভারতের প্রথম গভর্নর-জেনারেল। তিনি ১৭৭৩ থেকে ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত ভারতের গভর্নর-জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এবং রবার্ট ক্লাইভ (Robert Clive) ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপনের জন্য কৃতিত্বপ্রাপ্ত। তিনি একজন উদ্যমী সংগঠক ও সংস্কারক ছিলেন। ১৭৭৯ থেকে ১৭৮৪ সালে তিনি স্থানীয় রাজ্য এবং ফরাসিদের জোটের বিরুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। অবশেষে, সুসংগঠিত ব্রিটিশ পক্ষ নিজেদের দখলে রাখে, অন্যদিকে ফ্রান্স ভারতে প্রভাব হারায়।

[১৪] স্যার থমাস স্ট্যামফোর্ড বিংলে র্যা ফেল (Sir Thomas Stamford Bingley Raffles | ৬ জুলাই ১৭৮১ - ৫ জুলাই ১৮২৬) ছিলেন একজন ব্রিটিশ রাষ্ট্রপতি, ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের লেফটেন্যান্ট-গভর্নর (১৮১১-১৮১৬) এবং বেনকুলেন (Bencoolen)-এর লেফটেন্যান্ট-গভর্নর (১৮১৮-১৮২৪)। আধুনিক সিঙ্গাপুর এবং স্ট্রেইটস সেটেলমেন্ট (Straits Settlements) প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত।

[১৫] ২৭ এপ্রিল, ১৮২৬ লন্ডন চিড়িয়াখানা সর্বপ্রথম জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে এটিকে 'লন্ডন জুলজিক্যাল সোসাইটির গার্ডেন এবং মেনাজেরি' বলা হত। এটি ওই বছরেই প্রতিষ্ঠিত 'জুলজিক্যাল সোসাইটি অফ লন্ডন' (ZSL)-এর অধীনে পরিচালিত হতো। স্যার থমাস স্ট্যামফোর্ড র্যা ফেল ছাড়াও মার্কেস অফ ল্যান্সডাউন (Marquess of Lansdowne), লর্ড অকল্যান্ড (Lord Auckland), স্যার হামফ্রি ডেভি (Sir Humphry Davy), রবার্ট পিল (Robert Peel), জোসেফ সাবিনা (Joseph Sabine), নিকোলাস এলওয়ার্ড ভিগরস (Nicholas Aylward Vigors) প্রমুখরা লন্ডন চিড়িয়াখানার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। ডেসিমাস বার্টন (Decimus Burton - ১৮০০-১৮৮১)-কে চিড়িয়াখানার পশুপাখিদের জন্য ভিত্তি এবং বাসস্থান তৈরি করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল।

[১৬] স্যার জন ম্যাকক্লেল্যান্ড (Sir John McClelland | ১৮০৫-১৮৮৩) ছিলেন একাধারে একজন ব্রিটিশ চিকিৎসক ও প্রকৃতিবিদ। তিনি ভূতত্ত্ব এবং জীববিজ্ঞানেও (জুওলজি এবং বায়োলজি) আগ্রহী ছিলেন। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে কাজ করতেন।
    জন ম্যাকক্লেল্যান্ড ১৮৩৬ সালে ভারতীয় কয়লা শোষণের সম্ভাবনা অন্বেষণ করার জন্য গঠিত 'জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া' (জিএসআই) [Geological Survey of India (GSI)]-এর অগ্রদূত 'কয়লা কমিটির সচিব' (Secretary of the Coal Committee) হিসাবে নিযুক্ত হন। তিনিই প্রথম এই কাজের জন্য পেশাদার ভূতাত্ত্বিক নিয়োগের প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি বন জরিপের সাথেও জড়িত ছিলেন এবং তাঁর প্রতিবেদনগুলিই পরবর্তীকালে কোম্পানিকে ভারতে বন বিভাগ (Forest Department) প্রতিষ্ঠা করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
    তিনি ১৮৪৬ থেকে ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেনের অন্তর্বর্তীকালীন সুপারিনটেনডেন্ট (Interim Superintendent) হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৮৪১ থেকে ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত 'ক্যালকাটা জার্নাল অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি' (Calcutta Journal of Natural History)-র সম্পাদক (Editor) ছিলেন। বুলবুল পর্বত (Hypsipetes mcclellandii)-কে তাঁর নামে নামাঙ্কিত করার মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করা হয়েছে। ম্যাকক্লেল্যান্ড একজন মীনবিদ্যাবিশারদ (Ichthyologist) হিসেবে তাঁর কাজে তিনি বিভিন্ন প্রজাতির মাছের বর্ণনা দিয়েছেন। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল Schistura। পরবর্তীকালে বিষাক্ত সাপের একটি প্রজাতিকে (Sinomicrurus macclellandi, commonly known as MacClelland's coral snake) তাঁর সম্মানে নামকরণ করা হয়েছে।

[১৭] স্যার এডওয়ার্ড ক্লাইভ বেইলি (Sir Edward Clive Bayley | ১৭ অক্টোবর ১৮২১ - ৩০ এপ্রিল ১৮৮৪) ছিলেন একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান অসামরিক কর্মচারী, রাষ্ট্রনায়ক এবং প্রত্নতত্ত্ববিদ। তিনি ১৮৬৩ থেকে ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি-র সভাপতি-র (President) পদ অলংকৃত করেছিলেন।

[১৮] স্যার জোসেফ ফেরে, ১ম ব্যারোনেট (Sir Joseph Fayrer, 1st Baronet | ৬ ডিসেম্বর ১৮২৪ - ২১ মে ১৯০৭) ছিলেন একজন ব্রিটিশ চিকিৎসক যিনি ভারতে সার্জন জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ২৯শে জুন, ১৮৫০ সালে বাংলায় অবস্থিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহকারী সার্জন নিযুক্ত হন এবং তাঁর জীবনের পরবর্তী পঁয়তাল্লিশ বছর তিনি ভারতীয় চিকিৎসা পরিষেবার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাটিয়েছিলেন। তিনি চিকিৎসা, জনস্বাস্থ্যের উপর কাজ এবং বিশেষ করে ভারতে সাপের কামড়ের (সর্পদংশন) চিকিৎসার উপর তার লেখালেখির জন্য বিখ্যাত। ১৮৭২ সালে ইংল্যান্ডে থাকাকালীন স্যার টি. লডার ব্রুনটন (Sir T Lauder Brunton)-এর সাথে সাপের বিষের উপর একাধিক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেন। হিস্টোলজি (Histology)-তে তাঁর অসামান্য অবদান ছিল। তিনি কলেরার উপর সরকারী তদন্তেও জড়িত ছিলেন, যেখানে তিনি কলেরার কারণ হিসাবে জীবাণুর রবার্ট কোচের প্রস্তাবিত ধারণাটি গ্রহণ করেননি। তাঁকে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ১৮৬৮ সালে 'Knights Commander of the Order of the Star of India' (CSI) এবং ১৮৭৬ সালে 'Companions of the Order of the Star of India' (KCSI) সম্মানে ভূষিত করা হয়েছিল। এছাড়াও পরবর্তীকালে তিনি অনেক সম্মান লাভ করেন ও সাম্মানিক পদের অধিকারী হন। ভারতে এসে তিনি কলকাতার মেডিক্যাল কলেজে সার্জারির অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং ১৮৬৭ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁকে 'এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল'-এর সভাপতি করা হয়। ১১ই জানুয়ারী, ১৮৯৬-এ তাঁকে 'ব্যারোনেট' করা হয়েছিল এবং অবসর গ্রহণের সময় তিনি ফালমাউথে বসবাস করতেন, যেখানে ১৯০৭ সালের ২১শে মে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

[১৯] কার্ল লুইস স্যুয়েন্ডলার (Carl Louis Schwendler | ১৮৩৮-১৮৮২) ছিলেন একজন জার্মান বিদ্যুৎবিদ (ইলেকট্রিশিয়ান) এবং দুষ্প্রাপ্য ধাতু (টংস্টেন ভিত্তিক - Tungsten based) দিয়ে তৈরি দ্যুতিময় বাল্ব (ভাস্বর আলো)-এর প্রথম প্রবক্তাদের একজন। তৎকালীন ভারতে ব্রিটিশ সরকারের টেলিগ্রাফ বিভাগে একটি ঊর্ধ্বতন (সিনিয়র) পোস্টমাস্টার পদে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি টেলিগ্রাফের উপর একটি জনপ্রিয় পাঠ্যপুস্তকও প্রকাশ করেছিলেন। তিনি আগ্রা এবং কলকাতার মধ্যে টেলিগ্রাফিক যোগাযোগ স্থাপনে জড়িত ছিলেন নিমজ্জিত তারের সংক্রমণে (transmission of submerged cables) সমস্যা সমাধানের জন্য। ভারতীয় রেল স্টেশনগুলিকে বৈদ্যুতিক বাতি দ্বারা আলোকিত করার সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন করার জন্য রেলওয়ে দ্বারা তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ঔপনিবেশিক কলকাতায় বিদ্যুতায়নে তাঁর অসামান্য অবদান ছিল। শোয়েন্ডলার 'এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল'-এর সদস্য ছিলেন। ১৮৮৩ সালে আলিপুর চিড়িয়াখানা প্রাঙ্গণে শোয়েন্ডলারের একটি স্মৃতিসৌধ (Monument) নির্মাণ করা হয়েছিল।

[২০] স্যার রিচার্ড টেম্পল, ১ম ব্যারোনেট (Sir Richard Temple, 1st Baronet | ৮ মার্চ ১৮২৬ - ১৫ মার্চ ১৯০২) ভারতে একজন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসক ছিলেন। ১৮৭৪ সালে তাঁকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির লেফটেন্যান্ট-গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। স্যার রিচার্ড টেম্পল ১৮৭৪ থেকে ১৮৭৭ সাল পর্যন্ত বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর ছিলেন। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ১৫ মার্চ ১৯০২-এ হ্যাম্পস্টেডে তাঁর বাসভবনে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।


[২১] ডঃ জর্জ কিং (George King | ১২ এপ্রিল ১৮৪০ - ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯০৯) ছিলেন একজন ব্রিটিশ উদ্ভিদবিদ (Botanist), যিনি ১৮৭১ সালে কলকাতার শিবপুরে অবস্থিত রয়্যাল বোটানিকাল গার্ডেন-এর সুপারিনটেন্ডেন্ট (তত্ত্বাবধায়ক) নিযুক্ত হন এবং ১৮৯০ সালে ভারতের উদ্ভিদ জরিপ বিভাগ (Botanical Survey of India)-এর প্রথম পরিচালক নিযুক্ত হন। সিঙ্কোনা চাষে তার কাজের জন্য এবং সমগ্র ভারত জুড়ে ডাক ব্যবস্থার মাধ্যমে কুইনাইন সস্তায় বিতরণের একটি ব্যবস্থা স্থাপনের জন্য তাঁকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।

[২২] মি. এ. এফ. ওয়াটসন (Mr. A. F. Watson) ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের একজন এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার।