আরেক রকম ● দশম বর্ষ চতুর্বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

গীতায় ন্যায়যুদ্ধ অন্যায়যুদ্ধ

রঞ্জন রায়


প্রস্তাবনাঃ

ভারতবর্ষের বৃহত্তর জনসমুদায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এঁদের মূল ধর্মগ্রন্থ বেদ, যদিও হাতে গোণা লোক ছাড়া কেউ বেদ পড়েন না, ভাষাগত কারণে সম্ভবও নয়। তবে আজকাল বাংলা হিন্দি ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় সুলভ অনুবাদ পাওয়া যায়। যাঁরা বেদকে সনাতন অজর অমর এবং ভগবানের মুখনিঃসৃত বলে বিশ্বাস করেন তাঁদের ধর্মাচরণকে এককথায় সনাতন হিন্দুধর্ম আখ্যা দেওয়া হয়।

সনাতন হিন্দু ধর্মের তাত্ত্বিক আশ্রয় হোল তিন প্রস্থান - উপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র এবং গীতা, যাকে একসঙ্গে ‘ত্রয়ী’ বলা হয়। শংকরাচার্য প্রতিষ্ঠিত দশনামী সম্প্রদায়ের সমস্ত সন্ন্যাসীদের অবশ্য পাঠ্য হোল ওই ‘ত্রয়ী’।

এই ত্রয়ীর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সহজলভ্য গ্রন্থ হোল ভগবদগীতা বা সংক্ষেপে ‘গীতা’। এর আকারও ছোট, অষ্টাদশ অধ্যায়ে বিভক্ত বইটিতে রয়েছে মোট ৬৮১ বা গীতামাহাত্ম্য ইত্যাদি মিলিয়ে প্রায় ৭০০ শ্লোক। অন্ততঃ পকেট সংস্করণ গীতা প্রায় সবার বাড়িতে পাওয়া যাবে। শ্রাদ্ধশান্তি বা বিভিন্ন ধার্মিক অনুষ্ঠানে গীতা পাঠের প্রচলন রয়েছে।

বর্তমান সময়ে একটি কথা প্রায়ই শোনা যায় - গীতা বা তার নির্বাচিত অংশ, সমস্ত স্কুলে পাঠ্য করা হোক। উদ্দেশ্য অল্পবয়েসীদের মধ্যে ভারতীয় ঐতিহ্য ও নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়া। বলা হয় গীতার বাণী আমাদের সমাজে আদর্শ আচরণবিধির জন্যে মডেল হবে।

প্রশ্ন ওঠেঃ গীতার মূল্যবোধ বলতে ঠিক কী বোঝায়?

এখানে ওখানে খামচে প্রসঙ্গের উল্লেখ না করে কয়েকটি শ্লোকের কথা বলা হয়। যেমন, ফলের আশা না করে কর্ম করে যাও। অথবা, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের সমাজে গুণ ও কাজের ভিত্তিতে চার বর্ণের সৃষ্টি করেছেন। অথবা, স্বধর্মে নিধন শ্রেয়ঃ, অন্য ধর্ম ভয়াবহ। আর রয়েছে - সব ধর্ম ছেড়ে আমার শরণাগত হও, কোন পাপের ভয় কোর না; আমি আছি।

আজকাল কোথাও সমগ্র গীতার অন্তর্নিহিত ভাবনা নিয়ে একটি সুসংবদ্ধ লেখা চোখে পড়ে না।

এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমি চেষ্টা করছি গীতার মূল থিমে - আত্মীয় পরিজনের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণে পরাঙ্মুখ অর্জুনকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করতে নীতিকথায় - ন্যায় ও অন্যায় যুদ্ধের ফারাকটুকু বোঝার চেষ্টা করা। কারণ, প্রায় প্রতিদিন ভারতের কোথাও না কোথাও স্বঘোষিত ধর্মযোদ্ধাদের হিংসা ও বিদ্বেষে ভরা ঘোষণা চোখে পড়ছে।

ভগবদগীতা কার রচনা?

● মনে হয় গীতা মহাভারতের কাহিনীর উল্লেখ সত্ত্বেও একটি স্বতন্ত্র রচনা। মুখোমুখি কৌরবের একাদশ অক্ষৌহিণী সেনা এবং পাণ্ডবদের সাত অক্ষৌহিণী। রথে বসে ধনুকের টংকার ও দু’পক্ষের শংখধ্বনির মধ্যে যে স্নায়বিক চাপ তার মাঝখানে বসে গম্ভীর মেটাফিজিক্স চর্চা? এগুলো বিভিন্ন সময়ে অনেক কবির সম্মিলিত সংযোজন।

● অশোকের শাসনকালে কিছু ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠীলিপির নিদর্শন পাওয়া যায়, তাতে গীতার কোন উল্লেখ নেই। তবে প্রথম সংস্কৃত ভাষা এবং নাগরী লিপির নিদর্শন দেখা যায় জুনাগড়ের তাম্রলিপিতে, যা খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগে যা চারশতক পরের পতঞ্জলির যোগশাস্ত্রের কথা মনে করায়। মনে হয় শুঙ্গ রাজবংশের (পুষ্যমিত্র শুঙ্গ স্থাপিত) থেকে গুপ্ত বংশের শাসনকালের মধ্যে বিভিন্ন কবির হাতের ছোঁয়ায় বর্তমান রূপ ধরেছে ভগবদগীতা।

গীতার দার্শনিক ভাষ্যের কিছু বৈশিষ্ট্যঃ

গীতা হল আসলে ষড়দর্শনের শেষতম দার্শনিক মত বেদান্ত বা উত্তরমীমাংসার অনুযায়ীদের সৃষ্টি। কারণ ১৮টি অধ্যায়ের প্রত্যেকটি শেষ হচ্ছে ‘‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসু উপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে’’ এই ভণিতা দিয়ে। (বড় হরফ আমার)। ব্রহ্মবিদ্যা বলে দার্শনিক ধারণাটি একান্তভাবে বেদান্তদর্শনের, অন্য কারও নয়।

ষড়দর্শনের মধ্যে গীতায় শুধু সাংখ্য, যোগ ও বেদান্তের কথা রয়েছে। বাদ পড়েছে, ন্যায়, বৈশেষিক ও পূর্বমীমাংসা। বরং বেদবাদরতাঃ শ্লোকে (২/৪২,৪৪) পূর্বমীমাংসা দর্শনের নিন্দা করা হয়েছে।

কারণ, পূর্বমীমাংসা কেবল বেদের যাগযজ্ঞকেই শুরু ও শেষ মনে করে। নিরীশ্বরবাদী পূর্বমীমাংসা দর্শনে ব্রহ্ম বা ঈশ্বর কিছুই নেই। সাংখ্যে ঈশ্বর নেই, রয়েছে অচেতন পুরুষ এবং সক্রিয় প্রকৃতির কথা। গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের নাম সাংখ্য যোগ বটে, কিন্তু তাতে সাংখ্যের মূল চরিত্র বদলে দিয়ে ঈশ্বর ও পরমাত্মা নিয়ে অনেক কথা ঢোকানো হয়েছে।

ফলে যিনি গীতাকে ভারতীয় দর্শন বা অধ্যাত্ম চিন্তার সার বা সমন্বয় বলবেন, ভারতীয় বা বিদেশি পন্ডিত, তার মধ্যে গোঁজামিল থেকেই যাবে।

গীতার তৃতীয় অধ্যায়ে সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে বলা হয়েছে - প্রাণের উদ্ভব অন্ন থেকে, অন্নের উদ্ভব বৃষ্টি থেকে, বৃষ্টির উদ্ভব যজ্ঞের ধোঁয়া থেকে, যজ্ঞের উদ্ভব কর্ম থেকে, কর্মের উদ্ভব ব্রহ্ম থেকে এবং ব্রহ্মের উদ্ভব অক্ষর থেকে (৩/১৪ এবং ৩/১৫)।

আজ আমরা সবাই জানি বৃষ্টির উদ্ভব কীভাবে হয়, অবশ্যই যজ্ঞের ধোঁয়া থেকে নয়। আর ব্রহ্ম যদি অক্ষর থেকে উদ্ভবের পরিণাম তাহলে তিনি নিত্য সর্বোগতং স্থানু অচলোহং সনাতনঃ হতে পারেন না। কারণ উনি নিশ্চিত ভাবে একটি নির্ধারিত সময়ে একটি তত্ত্ব (অক্ষর) থেকে উদ্ভূত হচ্ছেন, তাহলে অমনই এক সময়ে তাঁর বিনাশ অবশ্যম্ভাবী।

মহাত্মা গান্ধীর গুজরাতিতে লেখা ‘অনাসক্তি যোগ’ ভাষ্যটি সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত বাংলায় ‘গান্ধীভাষ্য’ নামে অনুবাদ করেছেন। গান্ধীজি আবার তাঁর অহিংসার সঙ্গে গীতার হিংসাকে জোর করে মেলাতে চেষ্টা করেছেন। বলছেন - গীতার হিংসা প্রতীকী, আসল শারীরিক হিংসা নয়। কিন্তু মূল পাঠে প্রথম, দ্বিতীয় এবং একাদশ অধ্যায় পড়লে বোঝা যায় - ওটা গান্ধীজির বৃথা চেষ্টা। তেলে জলে মেশেনি।

বরং সমগ্র গীতা জুড়ে রয়েছে ক্ষাত্রধর্ম এবং হিংসার ঔচিত্য, তার জয়গান। খেয়াল করা দরকার যে শ্রীকৃষ্ণ নিজেও ক্ষত্রিয় রাজপুরুষ।

গীতায় মনুসংহিতার জাতিবাদের প্রচন্ড প্রভাব। আধুনিক ব্যাখ্যাকারেরা জোর করে মেলাতে গিয়ে শুধু ওই একটা শ্লোকের কথা বলেন - চাতুর্বণং ময়া সৃষ্ট গুণকর্মবিভাগশঃ। ওঁরা উল্লেখ করেন না ‘‘স্বনুষ্ঠিতাৎ পরধর্মাৎ বিগুণঃ স্বধর্ম শ্রেয়ান। 
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ, পরোধর্মো ভয়াবহঃ,’’ (৩/৩৫)

অর্থাৎ অন্যধর্মের (জাতির) নির্দিষ্ট কর্ম ভালভাবে করার চেয়ে নিজের নিজের জাতিধর্মের অনুরূপ কর্ম খারাপভাবে করাই শ্রেয়স্কর। নিজ জাতের অনুযায়ী কর্ম করতে গিয়ে মরে যাওয়া ভাল। নীচু জাত নীচুতেই থাকবে, দক্ষতার জোরে উপরে উঠতে পারবে না, (১৮/৪১-৪৪)।

উপরের সমস্ত টীকা/ব্যাখ্যা ভক্তের দৃষ্টিতে, যেখানে গীতা হচ্ছে শ্রীভগবানের মুখনিঃসৃত বাণী। তা নিয়ে বিচার চলে না। শুধু মুগ্ধ হতে হয়, শুধু মেনে চলতে হয়।

বাংলাসাহিত্যের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘পারাপার’ উপন্যাসে একটি চরিত্র বিমানের সন্দর্ভে বলেছেন যে গীতা হোল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কাব্য! গীতার বেশিরভাগটাই অনুষ্টুপ এবং অল্প একটু অংশ ত্রিষ্টুপ ছন্দে লেখা। কিন্তু কাব্যগুণ? ভিন্নরুচির্হিঃ লোকাঃ।

গীতার মূল বক্তব্যঃ

ভগবদগীতায় দুটো স্তর রয়েছে। একটা মহাভারত নামক মহাকাব্যের কাহিনীর অংশ, অন্যটি দার্শনিক সমন্বয় এবং কৃষ্ণ কাল্টের জয়গান।

গীতা শুরুই হচ্ছে ধৃতরাষ্ট্রের সঞ্জয়কে প্রশ্নটি দিয়ে ‘‘ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ।’’ অর্থাৎ, রচনাকার প্রথমেই কুরুক্ষেত্রকে ধর্মক্ষেত্র মেনে নিয়েছেন।

তাই কাহিনীর মূল থীম হল কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আরম্ভের সময় ধনুর্বাণ ত্যাগ করে গালে হাত দিয়ে রথে বসা অর্জুনকে বুঝিয়ে সুজিয়ে যুদ্ধে রাজি করানো। কারণ অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে মুখোমুখি আচার্য, পিতামহ, মাতুল, শ্বশুর, শালা, পুত্র, পৌত্র ও ভ্রাতাদের দেখে যুদ্ধ করতে চাইলেন না।

‘‘আচার্যাঃ পিতরঃ পুত্রাস্তথৈব চ পিতামহাঃ।
মাতুলাঃ শ্বশুরাঃ পৌত্রাঃ শালাঃ সম্বন্ধিনস্তথা।।’’ (১/৩৩)

বিষণ্ন অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন - স্বজনহত্যা করে বিজয়ী হতে চাই না, রাজ্যসুখও চাই না, এতে কোন মঙ্গল হবে না।

‘‘ন চ শ্রেয়োনুপশ্যামি হত্বা স্বজনমাহবে।
ন কাঙ্ক্ষে বিজয়ং কৃষ্ণ ন চ রাজ্যং সুখানি চ।।’’ (১/৩১)

কারণ, যাঁদের নিয়ে রাজ্য এবং সুখভোগ করার কথা ভাবি, এখন তাদেরই হত্যা করতে হবে?

‘‘কিং নো রাজ্যেন গোবিন্দ, কিং ভোগৈর্জীবিতেন বা।
যেষামর্থে কাঙ্ক্ষিতং নো রাজ্যং ভোগাঃ সুখানি চ।।’’ (১/৩২)

এখানে অর্জুন এই যুদ্ধকে অন্যায় ভাবছেন মূলতঃ প্রাচীন গোষ্ঠীসমাজের কিনশিপ মূল্যবোধের প্রেক্ষিতে।

কিন্তু দুর্যোধন আদি কৌরব তো অন্যায় ভাবে ছল করে পাণ্ডবদের রাজ্য কেড়ে নিয়ে ওদের বনবাসে পাঠিয়েছে, দ্রৌপদীকে অপমান করেছে। তাহলে ওই অন্যায়ের প্রতিকারে এই যুদ্ধ কি ন্যায়যুদ্ধ নয়?

অর্জুন বলছেন, পৃথিবীর কথা ছাড়ুন, আমাকে ত্রিলোকের রাজা করলেও আমি এদের মারতে পারব না। (১/৩৪)

ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের বধ করে কি সুখ পাব? ‘‘এই সকল আততায়ীকে হত্যা করিলে আমাদিগকে পাপ আশ্রয় করিবে।’’ (১/৩৫) [জগদীশ্বরানন্দের টীকা]

অতএব দুর্যোধনাদি ও তাহাদের বান্ধবগণকে হত্যা করা উচিত নয়। স্বজনকে হত্যা করে আমরা কী করে সুখী হব? (১/৩৬)

মানছি, ওরা রাজ্যলোভে অভিভূত হয়ে কুলক্ষয়জনিত দোষ এবং মিত্রদ্রোহজনিত পাপ দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু ‘‘হে জনার্দন! বংশনাশজনিত দোষ উপলব্ধি করিয়াও আমরা এই পাপ হইতে নিবৃত্ত হইবার উপায় জানিব না কেন?’’ (১/৩৭-৩৮)।

আমি এর প্রতিকার জানি না, অস্ত্রত্যাগ করলাম। এখন কৌরবরা আমাকে বধ করলেই অধিকতর কল্যাণ হবে। (১/৪৫)

অর্থাৎ, অর্জুন একটি অন্যায়ের প্রতিকার হিসেবে অন্য একটি অন্যায়ের আশ্রয় নেওয়াকে যুক্তিযুক্ত মনে করছেন না। প্রতিশোধ, বদলা এসবের চেয়ে সার্বিক নরহত্যা এবং লোকক্ষয় ও কত নারী বিধবা হবে, অনাথ হবে - সেইটি তাঁর কাছে বৃহত্তর নৈতিক প্রশ্ন।

তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে (দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে) যুদ্ধ করার জন্য বোঝাতে শুরু করলেন।

কৃষ্ণের যুক্তিগুলিঃ

ধর্মযুদ্ধের পক্ষেকৃষ্ণের নৈতিকতার আধার বর্ণাশ্রম ধর্ম।যে মানুষ যে কুলে বা জাতিতে জন্মেছে, সে যদি সেই জাতের জন্য নির্ধারিত আচরণ মেনে চলে, তাহলেই ধর্মরক্ষা হয়, ন্যায় হয়। তাই উনি বলছেনঃ
‘‘হে অর্জুন, আর্যগণের অযোগ্য, স্বর্গগতির প্রতিবন্ধক এই মোহ এই ক্লীবভাব এই কাপুরুষতা তোমায় মানায় না। এসব দুর্বলতা ছেড়ে শত্রু সংহারে নেমে পড়।’’ (২/২-৩)

‘‘ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ নৈতৎ ত্বযুপপদ্যতে।
ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ।।’’

অর্জুন মানতে পারছেন না। বলছেন ভীষ্ম-দ্রোণের মত গুরুজনদের হত্যা করে বেঁচে থাকার চেয়ে ভিক্ষে করে খাব - সেও ভাল। (২/৪-৫)।

তখন কৃষ্ণ এই যুদ্ধকে ন্যায়োচিত সিদ্ধ করতে তাঁকে দুটো যুক্তি দিলেন।

এক, হত্যা বলতে কী বোঝায়? শরীরের ধ্বংস। কিন্তু দেহ তো অনিত্য, একমাত্র আত্মাই অবিনাশী। তাকে অস্ত্র ছেদ করতে পারে না, আগুন পোড়াতে পারে না, হাওয়া শুকোতে পারে না ইত্যাদি (২/২৩)।

‘‘নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ।
ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ।।’’

এভাবে দেখলে যে মারে আর যে মরে দুজনেই অবিনশ্বর আত্মা রূপে থেকে যাবে। অর্থাৎ কেউ আসলে মরে না। মৃত্যু দৈহিক বিকার মাত্র। শরীর নষ্ট হলেও আত্মা নষ্ট হয় না। আত্মা কেউকে মারে না, নিজেও মরে না। কেবল জামাকাপড় পাল্টানোর মত দেহ বদলায়। তাহলে কেন আফশোস? কেন শোক করা? (২.১১- ১৭-১৯)।

‘‘ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিৎ,
নায়ং ভূত্বাভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যং শ্বাশ্বতোয়ং পুরাণো,
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।।’’ (২/২০)

আর যদি তুমি আত্মাকে অবিনশ্বর মনে না কর, যদি ধরে নাও যে প্রত্যেক আত্মা স্বতন্ত্র, দেহের সঙ্গে জন্মায় ও মরে তাহলেও অনুশোচনা উচিত নয়। (২/২৬)।

‘‘কারণ, জাত ব্যক্তির মৃত্যু নিশ্চিত এবং স্বীয় কর্মানুসারে মৃত ব্যক্তির পুনর্জন্ম অবশ্যম্ভাবী।’’

‘‘জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ।
তস্মাদপরিহার্যের্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি।।’’ (২/২৭)।

অর্থাৎ, শ্রীকৃষ্ণ এখানে জন্মমৃত্যুকে গুরুত্বহীন, ট্রিভিয়ালাইজ, করে যুদ্ধে অবশ্যম্ভাবী নরহত্যা জনিত পাপবোধ থেকে অর্জুনকে মুক্ত করে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে উচিত ঠাউরিয়েছেন। বলা যায়, এক অর্থে এই ন্যায়যুদ্ধ/অন্যায় যুদ্ধ ডিকোটমিকেই বিতর্কের বা বিবেচনার বাইরে করে দিচ্ছেন।

অর্জুন ঠিক সান্ত্বনা পাচ্ছেন না।

তখন কৃষ্ণ ফের চলে এলেন বর্ণাশ্রমভিত্তিক ‘ধর্মযুদ্ধ’কে ন্যায়যুদ্ধের পর্যায়বাচী করতে।

উনি বলছেন, এক, কোন প্রাণীর দেহনাশে শোক কর না; কারণ তার দেহে অবস্থিত আত্মা সদা অবধ্য।

আর স্বধর্মের কথা ভাবলেই তোমার ভয় কেটে যাবে। কারণ, ধর্মসঙ্গত যুদ্ধঅপেক্ষা ক্ষত্রিয়ের পক্ষে মঙ্গলকর আর কিছুই নাই। (২/৩১)

হে পার্থ, এই প্রকার ধর্মযুদ্ধ হচ্ছে অনায়াস স্বর্গদ্বারের মত। শুধু ভাগ্যবান ক্ষত্রিয়ারাই এই সুযোগ পায়। (২/৩২)

আর এই ধর্মযুদ্ধ না করলে তুমি স্বীয় ক্ষত্রিয়ধর্ম ও কীর্তি পরিত্যাগ হেতু ‘প্রত্যবায়’ (পাপের) ভাগী হবে। সবাই ছি ছি করবে। ‘সম্মানিত ব্যক্তির পক্ষে অখ্যাতি মৃত্যু অপেক্ষাও অধিকতর দুঃখদায়ক।’ (২/৩৪)

কর্ণ ও ওর সঙ্গের যোদ্ধারা তোমাকে ভীতু ভাববে। সম্মান হারাবে, শত্রুরা অকথা-কুকথা বলবে; এর চেয়ে বেশি দুঃখের আর কী হতে পারে? (২/৩৬)।

আর এই যুদ্ধে মরে গেলে তুমি স্বর্গে যাবে; জয়ী হলে রাজ্য ভোগ করবে। অতএব, যুদ্ধের জন্যে দৃঢ় সংকল্প হয়ে লেগে পড়।

‘‘হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম্।
তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ।।’’ (২/৩৭)

তুমি ক্ষত্রিয়; ধর্মযুদ্ধই তোমার স্বধর্ম। সুতরাং ‘‘তুমি সুখে অনুরাগ ও দুঃখে দ্বেষ না করিয়া এবং লাভ ও ক্ষতি, জয় পরাজয় তুল্য জ্ঞান করিয়া ধর্মযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। এইরূপ করিলে গুরুজনাদি-বধজনিত পাপ তোমার হইবে না।’’

‘‘সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ।
ততো যুদ্ধায় যুজ্যস্ব নৈবং পাপমবাপ্স্যসি।।’’ (২/৩৮)

এবার কৃষ্ণ অর্জুনকে পাপের থেকেও মুক্তি দিলেন। সোজাসুজি বললেন - তোমার অধিকার শুধু কর্ম করায়, ফলপ্রাপ্তিতে নয়। অতএব কোন কাজের ফল কী হবে (পাপপুণ্য) এসব নিয়ে ভাবতে নেই। নিষ্কাম হয়ে কর্ম কর। ফলপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা থেকেই আসক্তি জন্মায়, বন্ধনের কারণ হয়।

‘‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।’’ (২/৪৭)

‘‘তুমি ভগবানের উদ্দেশে অনাসক্ত হইয়া বর্ণাশ্রমোচিত সর্ব কর্ম কর।’’ (৩/৯)। অর্থাৎ ক্ষত্রিয় তার জন্মসিদ্ধ কর্তব্য/আচরণ যুদ্ধ করলে কোন পাপ হয় না।

এরপর ১২টি অধ্যায় জুড়ে রয়েছে কিছু বৈদান্তিক ও অন্য দার্শনিক তত্ত্ব নিয়ে কৃষ্ণের উপদেশ। কিন্তু সামনে যে একাদশ অক্ষৌহিণী কৌরব সেনা দাঁড়িয়ে রয়েছে , দু’পক্ষের রণশংখ একে অন্যকে চ্যালেঞ্জ করে বেজে উঠছে - সে নিয়ে কোনও কথা নেই।

ইতিমধ্যে অর্জুনকে বিশ্বরূপ দর্শন করিয়ে যথেষ্ট ভয় দেখানো হয়েছে। (১১শ অধ্যায়)। অর্জুন দেখছেন ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণ-দুর্যোধন সবাই শ্রীকৃষ্ণের জ্বলন্ত মুখগহ্বরে প্রবেশ করে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে দাঁতের ফাঁকে মাংসের টুকরোর মত আটকে আছে।

‘‘বক্ত্রাণি তে ত্বরমাণা বিশন্তি, দংষ্ট্রাকরালানি ভয়ানকানি।
কেচিদ্বিলগ্না দশনান্তরেষু, সংদৃশ্যন্তে চূর্ণিতৈরুত্তমাঙ্গৈঃ।।’’

এবার ভীত অর্জুনকে প্রবোধ দিয়ে কৃষ্ণ বোঝাচ্ছেন যে - আমি লোকক্ষয়কারী মহাকাল। তুমি না মারলেও এরা সবাই মরবে। তুমি শত্রুদের বধ করে যশস্বী হয়ে রাজ্য ভোগ কর।

দ্রোণ, ভীষ্ম, জয়দ্রথ, কর্ণ সবাই এর মধ্যেই আমার হাতে মারা পড়েছে। কাজেই তুমি মৃতদের মারবে।

ফলে তোমার কোন দায়িত্ব নেই, তুমি নিমিত্ত মাত্র। ভয় না পেয়ে যুদ্ধ কর, নিশ্চয়ই বিজয়ী হবে। (১১/৩২-৩৩-৩৪)

‘‘তস্মাৎ ত্বমুত্তিষ্ঠ যশো লভস্ব, জিত্বা শত্রূন্ ভুঙ্ক্ষ রাজ্যং সমৃদ্ধম্।
ময়ৈবৈতে নিহতাঃ পূর্বমেব, নিমিত্তমাত্রং ভব সব্যসাচিন্।।’’ (১১/৩৩)

শেষ অধ্যায়ে আবার উনি ফিরে গেলেন বর্ণাশ্রমের যুক্তিতে, ‘‘মানুষ নিজ নিজ বর্ণ ও আশ্রমের কর্মে নিরত হইয়া জ্ঞাননিষ্ঠাযোগ্যতানুসার সিদ্ধিলাভ করে।’’

‘‘স্বে স্বে কর্মণ্যভিরতঃ সংসিদ্ধিং লভতে নরঃ।
স্বকর্মনিরতঃ সিদ্ধিং যথা বিন্দতি তচ্ছৃণু।।’’ (১৮/৪৫)

কিন্তু, ‘‘স্বীয় বর্ণ ও আশ্রমবিহিত ধর্ম অঙ্গহীনভাবে অনুষ্ঠিত পরধর্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। কারণ, স্বভাবনিয়ত* কর্ম করিলে মানুষ পাপভাগী হয় না।’’

‘‘শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।
স্বভাবনিয়তং কর্ম কুর্বন্নাপ্নোতি কিল্বিষম্।।’’ (১৮/৪৭)

* স্বভাবনিয়ত=স্বভাবজাত (গীতা ১৮/৪২-৪৪)। স্বামী জগদীশ্বরানন্দের টীকা (শ্রীমদ্ভগবদগীতা, পৃঃ ৩৮৯)।

এখানে দুটো জিনিস স্পষ্ট। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধকে ন্যায় যুদ্ধ প্রতিপাদিত করতে শ্রীকৃষ্ণ গীতাতে কোন নীতিশাস্ত্রের সিদ্ধান্তকে আশ্রয় করেন নি। বরং তাঁর যুক্তি মূলতঃ একটাই -
ক্ষাত্রধর্ম পালন করলে ক্ষত্রিয়ের নরসংহারের পাপ হয় না। এখানে মনুসংহিতায় কথিত চতুর্বর্ণের আচরণবিধিকে হুবহু সমর্থন করা হয়েছে গীতার অন্তিম অধ্যায় (১৮তম) মোক্ষযোগে। দেখাই যাচ্ছে গীতা (১৮/৪৭) শ্লোকে জাতপাত এবং তার গুণকে জন্মজাত বলছেন, দক্ষতাজনিত যুক্তিকে খণ্ডন করছেন।

আর শেষ অধ্যায়ে (১৮শ, মোক্ষযোগ) আরও ধমক দিচ্ছেনঃ
যদি তুমি পাণ্ডিত্যের অভিমানে আমার কথা না শোন, তাহা হইলে তুমি পুরুষার্থের অযোগ্য হইবে। (১৮/৫৮)

ভাবছ, যুদ্ধ করবে না? ওটা তোমার অহংকারজনিত ভ্রম। তোমার ক্ষত্রিয় স্বভাবই তোমাকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করাবে। (১৮/৫৯)।

শেষে ছাড়লেন মোক্ষম তিরঃ
‘‘সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।’’ (১৮/৬৬)

সকল ধর্মের অনুষ্ঠান ছেড়ে একমাত্র আমার শরণাগত হও। আমি তোমাকে সব রকম পাপের থেকে মুক্ত করব, খামোখা শোক কর না।

ব্যস্ অর্জুন বললেন - আমি আপনার উপদেশ শুনে মোহমুক্ত হলাম, অজ্ঞান নষ্ট হয়েছে। এখন আপনার কথামত কাজ করব। (১৮/৭৩)

সোজা কথায়, সমগ্র গীতায় কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে ন্যায় যুদ্ধ বলতে শ্রীকৃষ্ণ জাতিধর্ম পালন এবং আমি বলছি তাই - এছাড়া আর কোন নীতি ও যুক্তির কথা বলেননি।

এ’ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ কী বলেছেন?

‘পারস্যে’ ভ্রমণকাহিনীতে রবীন্দ্রনাথ গীতার নীতিবোধকে স্পষ্ট বিদ্রূপে বিঁধছেন - ‘‘গীতায় প্রচারিত তত্ত্বোপদেশও এইরকম একটি উড়োজাহাজ - অর্জুনের কৃপাকাতর মনকে সে এমন দূরলোকে নিয়ে গেল - যেখানে মারেই-বা কে, মরেই-বা কে, কেই-বা আপন কেই-বা পর। বাস্তবকে আবৃত করার এমন অনেক তত্ত্বনির্মিত উড়োজাহাজ মানুষের অস্ত্রশালায় আছে, মানুষের সাম্রাজ্যনীতিতে, সমাজনীতিতে, ধর্মনীতিতে । সেখান থেকে যাদের উপর মার নামে তাদের সম্বন্ধে সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে এই যে, ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।’’ (পারস্যে, পৃঃ ৫)।

ষোড়শ শতাব্দীতে মধ্যযুগের চার্চ আশ্রিত স্কোলাস্টিক দর্শনের বিপরীতে ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসী ফরাসী দার্শনিক রনে দেকার্তে বলেছিলেন - সবকিছুকেই প্রশ্ন করে বাজিয়ে নিয়ে তারপর বিশ্বাস করা উচিত; এমনকি ঈশ্বরকেও যুক্তিসিদ্ধ হতে হবে। সেখান থেকেই ইউরোপিয় দর্শনে আধুনিকতার সূত্রপাত।

আমার আকাঙ্ক্ষা আজ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে ধর্মচর্চা ও ধর্মদর্শনের গ্রন্থগুলো আরও যুক্তিসিদ্ধ হোক, আরও জীবনমুখী হোক। আর সমস্যার সমাধান হিসেবে হত্যার ঔচিত্য নিয়ে প্রশ্ন উঠুক, নায়যুদ্ধ অন্যায়যুদ্ধের সংজ্ঞা এবং প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আরও সনিষ্ঠ আলোচনা হোক।