আরেক রকম ● দশম বর্ষ চতুর্বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

সাগর সঙ্গমে নতুন দ্বীপের সন্ধানে

গৌতম লাহিড়ী




পদ্মানদীর মাঝির কুবের ও কপিলার হোসেন মিঞার ময়না দ্বীপে ঘর বসানো নিয়ে দ্বিধা ছিল। আজ হলে দ্বিধা থাকতো না। সাগরের বুকে অসংখ্য চর গজিয়ে উঠেছে। সেগুলো এখন দ্বীপান্তর নয়। এখানে শত শত কুবের কপিলা সুখে শান্তিতে বাস করছে। দেখে এলাম।

রাঙ্গাবালি। চরমন্তাজ। আরও কত অজানা চর। সূর্য সোনা রঙ ছড়ায়। তাই সোনার চর। বঙ্গোপসাগরের কূল হারানো দিগন্তের শেষ ভুখন্ডে এক নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে দক্ষিণ প্রান্তে। পদ্মা-মেঘনা-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রর আলিঙ্গন। এক একটা চরের সৌন্দর্য একেক রকম। জনপদ-জঙ্গল-প্রাণীর বৈচিত্র।

চরমন্তাজে শহিদুল-লিপি বেগমদের মতো শ’দুয়েক পরিবার। এঁরা মত্তা সম্প্রদায়ের মৎস্যজীবি। এঁদের জন্ম থেকে মৃত্যু বিবাহ - সন্তান প্রসব সবই নৌকার মধ্যে। চরের স্থলজমিতে বাসস্থান নেই। এসব চরের অনেকগুলোতেই রাঙ্গামাটি থেকে কৃষ্ণকায় বালুকা বেলার কুমারী সৈকত। কোথাও ঝাউবনে বাতাস বয় ঝিঁঝিঁর সুরে। ম্যানগ্রোভের-জঙ্গল। সৈকতে লাল কাঁকড়ার মিছিল। এখানে সুর্যোদয় ও সুর্যাস্ত অবলোকন করার বিরল অভিজ্ঞতা। সমুদ্রগর্ভ থেকে উদয় হয় সুর্য। অস্ত যায় সাগরগর্ভে। তাই তো এদের বলা হয় সমুদ্র তনয়া। প্রকৃতির এমন সৌন্দর্যের সম্ভার গুপ্তধনের মতোই আবিষ্কার। আচমকা ভীড় করবে বুনো মোষ, চিত্রা হরিণ। ভালুকও। মাছরাঙ্গা, পেলিক্যানদের সংসার এখানেই। আবার এখানেই বনমোরগ-বনবিড়ালের সহাবস্থান। বুনো শিয়াল, বুনো ময়ুরের পেখম এক অভিনব পটভূমি তৈরি করেছে। বকের সারি। উত্তাল সমুদ্রের মধ্যে একফালি নিসর্গ।

মাছধরাদের চরগুলির মধ্যে একমাত্র চর কুকরি-মুকরিতেই রয়েছে অভয়ারণ্য। সুন্দরী-কেওড়ার সুবাসের মধ্যে পথ হারানো ম্যানগ্রোভ জঙ্গল। বিশাল সুন্দরবনের অপরপ্রান্ত, যা এখনও লোকচক্ষুর অন্তরালে। ছ’ মাইল লম্বা, ছ’ মাইল চওড়ার চর আচমকা শেষ হয়েছে মেঘনার মোহনায়। নিকটবর্তী নগরী বরিশাল। দূরত্ব ১৩০ কিলোমিটার। যাতায়াত কেবলমাত্র মাছ ধরার ট্রলারে। অথবা স্পীড বোটে। বুনো কুকুর - মেকু জাতের ইঁদুরের বাস ছিল বলে নাম কুকুর মুকরি। বাঁশ-বেত নারকোল গাছের সারি বাংলার প্রতীক হয়ে রয়েছে এই প্রত্যন্ত প্রান্তে। জঙ্গলের মধ্যে খাঁড়ি। সুন্দরবনের প্রতিলিপি।

চরগুলিতে যোগাযোগের মাধ্যম নেই। বড় জেলা বলতে পটুয়াখালি। তার অধীনে রাঙ্গামাটির রাঙ্গাবালি চর। পুরো চরটাই উপজেলা। ছালিতবুনিয়া ও আগুনমুখা নদী বৃত্তাকারে ঘিরে রেখেছে চরকে। বর্মার রাখাইন প্রদেশ থেকে একসময়ে রাখাইন জনগোষ্ঠী চলে এসেছিল এখানে। ধীরে ধীরে বাংলাদেশের ধীবর জাতির লোকেরা আশ্রয় নেয় এই চরে। রাখাইনরা চাষাবাদ করলেও মূলত ‘রাখাইন’ নামে এক জনপ্রিয় সুরার উৎপাদক। ডাবের জলের সঙ্গে মেশানো সুরা স্বাদেও উপাদেয়। বাংলাদেশে মদ নিষিদ্ধ হলেও এখানে রাখাইন মদিরার স্বাদ লোকপ্রিয়। স্বাস্থ্যকর পানীয় বটেও। এখন জনপদ জমজমাট। পটুয়াখালি থেকে নদীপথে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে ত্রিশ হাজারের বেশি মানুষের বসবাস। তরমুজের ক্ষেত। নদীতে মাছ ধরা প্রধান উপজীব্য। নদী ও সমুদ্র মোহনায় পাওয়া যাবে ইলিশের জাল। এখানকার সুস্বাদু ইলিশ অন্য কোথাও মিলবে না।

রাঙ্গাবালি থেকে স্পীডবোটে চর হেয়ার। কেন এমন নাম কেউ জানেন না। কোনো এক হেয়ার সাহেব এখানে এসেছিলেন বোধ হয়। কালো বালুকা বেলার সৈকতে ঝাউবন। নির্জন। জনবিহীন। নিরিবিলি বিশ্রামের সুবর্ণ সুযোগ। শিরশির শীতল বাতাসের সঙ্গে সূর্যের মিঠেকড়া আলোর এক অনাবিল আনন্দ। সমুদ্রের উপরিভাগের চর ছাড়া এখানে রয়েছে হিমালয় থেকে বহে আসা বালুকণার ডুবন্ত চর। সতর্কতা তাই। জোয়ারের সময়ে যে বিশাল জলরাশি মন পুলকিত করবে, ভাঁটার সময়ে সেইসব ডুবন্ত চর মাথা তুলে উঠে স্পীড বোটের গতি রূদ্ধ করে দেবে। একবার সময়ের হিসাবের গোলমাল হলে চরেই আটকে যেতে হয়। জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করা ভিন্ন পথ নেই। শুশুকের বাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

রাঙ্গাবালির চরমন্তাজে নদীর জলের গভীরতা রয়েছে বলে এই প্রথম চালু হল রাতভর যাত্রার লঞ্চ সার্ভিস। ঢাকা সদরঘাট থেকে রাঙ্গাবালি। বুড়িগঙ্গা থেকে ধলেশ্বরী-শীতলক্ষ্যা-মেঘনা হয়ে পদ্মা। তারপর বহু উপনদী পেরিয়ে রাঙ্গাবালি। কুয়াকাটায় লঞ্চের বিলাসিতা উপভোগ করাও এক অভিজ্ঞতা। মিলবে লালকাঁকড়া, ভাজা-ইলিশ, খাসি-রাজহাঁস। অসংখ্য নদীর মাছ। নাম না জানা। স্বাদে অতুলনীয়।

পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে গজিয়ে ওঠা চরগুলিতে একবার পৌঁছলে নিঝুম দ্বীপ, পাখির চর, বুড়ির চর আরও কত কী খুঁজে পাওয়া যায়। ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা মীমাংসা হওয়ার পর এখানে এখন বসতি স্থাপনের মহাযজ্ঞ শুরু হয়েছে। সমুদ্র ও নদীর নীচ দিয়ে কেবল্ মাধ্যমে বিদ্যুতের লাইন পৌঁছেছে জনবসতি এলাকায়। বাড়ি তৈরি করছে শেখ হাসিনা সরকার। স্কুল-হাসপাতাল তৈরি হয়েছে। ইন্টারনেট পরিষেবাও রয়েছে। শুরু হয়েছে সমুদ্রের নোনা জল রুখতে বাঁধ দেওয়ার কাজ। ঢাকা-চট্টগ্রাম-কুমিল্লা- কক্সবাজারের বাইরে এক নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠছে সমুদ্রের মধ্যে।

ঢাকা থেকে নদীপথে পটুয়াখালি পর্যন্ত যোগাযোগ রয়েছে। বরিশাল শহরের মধ্য-দক্ষিণ প্রান্তে নদী ঘোরা পটুয়াখালির এক উপজেলা রাঙ্গাবালি। ৫০ কিলোমিটার দুরে। এটি আসলে বঙ্গোপসাগরে মিশে যাওয়ার মুখেই আগুনমুখা ও চলিতাবুনিয়া নদীর উপরে চরভূমি। আয়তনে ৪৭০ বর্গ কিলোমিটার। কত জনবসতি? লক্ষাধিক। ২০১২ সালে শেখ হাসিনা সরকার এই চরভুমিকে উপজেলা ঘোষণা করে। দুরে রয়েছে চরশুঁটকি। এখানে মাছ শুকানো হয়। চাষাবাদ হয়। হয় সবজি। সুস্বাদু ফল। তরমুজ। গলদা চিংড়ি। সুস্বাদু ইলিশ ধরা হয় এখানেই। এমন জনপদ তৈরি হয়েছে বলেই এখানকার স্থানীয় সাংবাদিকরা গড়ে তুলেছেন রাঙ্গাবালি প্রেস ক্লাব।

এঁদেরই আমন্ত্রণে ঘুরে এলাম কয়েকদিন। এই রাঙ্গাবালির সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হলো লঞ্চের মাধ্যমে। এখন সরাসরি এখানকার মানুষ উৎপাদিত পণ্য ঢাকায় পাঠাতে পারেন। এতদিন ২৫ কিলোমিটার দূরের গলাচিপা দ্বীপ হয়ে পণ্য পাঠাতে হত। এখানে সমুদ্র নদী একাকার। তাই ঢেউ উত্তাল। উত্তাল নদী পেরিয়ে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।

রাঙ্গাবালি বাংলাদেশের শেষ জনবসতি পূর্ণ ভূখন্ড। এরপর বঙ্গোপসাগর। এখান থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে সোনার চর। এখানে একই জায়গা থেকে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখা যায়। এখানে এখনও জনবসতি গড়ে ওঠেনি। ঝাউবনের সারি এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি করেছে। গোধুলির আলোয় দ্বীপটি হয়ে ওঠে স্বর্ণদ্বীপ।

রাঙ্গাবালির পশ্চিমে চর কুকুর-মুকরি। বাংলাদেশের সবথেকে বৃহত্তম দ্বীপ ভোলা জেলায় অবস্থিত অভয়ারণ্য। ভোলা থেকে দূরত্ব ১২০ কিলোমিটার। বঙ্গোপসাগরের উপকন্ঠে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর মোহনায় কয়েকশো বছর আগে জেগে ওঠা চর কুকতি-মুকরির বনভূমি। এই বনে রয়েছে ১৫ হাজারের বেশি চিত্রা হরিণ। রয়েছে পেলিক্যান, লালকাঁকড়া (সুস্বাদু), বুনো মহিষ, বানর, বনবিড়াল, উদবিড়াল, শিয়াল, বনমোরগ এমনকি ভালুকও। মোট ২৫ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে ৪০ হাজার হেক্টর জমির উপর ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। গোটা জনবসতি ভেসে গিয়েছিল। এখন নিবিড় ম্যানগ্রোভ জঙ্গল ঘুর্ণি ঝড়কে রূখে দিতে পারে। এই কারণে সদ্য হয়ে যাওয়া সিত্ৰাং ঘুর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি আগের তুলনায় অনেক কম হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা হ্রাস করতে পারে বলে ঢাকায় মানুষজন নিরাপদে বাস করতে পারেন। পদ্মা নদীর মাঝির চরিত্ররা এখানে ১৯৩০ সালে থেকে বাস করতে শুরু করেন।

বাংলাদেশে ৪ কোটি মানুষ উপকূলবর্তী এলাকায় বসবাস করেন। এঁদেরকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ঘুর্ণিঝড় থেকে রক্ষা করা এখন সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ। পরিবেশ রক্ষা এবং একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া থেকে জনপদ রক্ষা করার এক বিশাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে এইসব দ্বীপ ও চরের বাসিন্দাদের জন্য। এক নতুন বাংলাদেশ ভূখন্ড তৈরি হচ্ছে বলার অর্থ সমুদ্র মোহনাব্যাপী চর গড়ে ওঠা। এক আর্ন্তজাতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতিদিন হিমালয় থেকে উৎপন্ন গঙ্গা-পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার জলে ভেসে আসে একশো কোটি টনের বালুকণা। সেসব জমতে থাকে মোহনায়। তাতেই গড়ে ওঠে চরভূমি। ক্রমাগত বালুকণা এসে পড়ায় চরগুলির স্থায়িত্ব বেড়ে গিয়েছে। ওই গবেষণায় দাবি করা হয়েছে গত ত্রিশ বছরে গড়ে প্রতি বছর কুড়ি বর্গ কিলোমিটার স্থলভূমি গড়ে উঠছে সমুদ্র মোহনায়। এরই এক সফল বাস্তবায়ন হয়েছে ভাসান চরে। এখানে এক লক্ষেরও বেশি রোহিংগা উদ্বাস্তুদের বাসস্থান গড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। ভাসান চরের সাফল্যের ভিত্তিতে চরগুলিতে আরও জনপদ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যা একদিন শহরের জনবসতি লাঘব করতে পারে। মনে হয় এক গুপ্তধনের আবিষ্কার হয়েছে।

গত তিন দশকে প্রায় ছশো বর্গ কিলোমিটার নতুন স্থলভূমি যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্রে। সহজভাবে বললে, দক্ষিণ এশিয়ার মলদ্বীপের দ্বিগুণ ভুখন্ড যুক্ত হয়েছে। এখানকার জমি অত্যন্ত উর্বরা বলে সবুজায়ন হয়েছে সহজে। ছাতার মতো রক্ষা করছে বৃক্ষরাশি। সমুদ্রের ঢেউ বা ঘুর্ণিঝড় থেকে রক্ষা পাচ্ছে দ্বীপসমুহ। হিমালয় থেকে বহে আসা বিশাল উপহারের সৌভাগ্য লাভ করছে বাংলাদেশ। অচিরেই অতিপরিচিত বাংলাভূমির বাইরে যে নতুন বাংলার জন্ম হতে চলেছে, ‘দেখে এলেম তারে’।