আরেক রকম ● দশম বর্ষ ত্রয়োবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২২ ● ১৬-২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

নিঃশব্দ প্রতিবাদ

মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়


নৈঃশব্দ উলঙ্গ হ'য়ে ধেই ধেই নৃত্য করে।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ইরানের বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে বলে একটিও লাথি মারার আগে, ইরানের খেলোয়াড়রা এমন শক্তিশালী সংবাদ তৈরি করেছেন যে, সেই খেলার হারজিতের খবর হারিয়ে গেছে। অনেক বড় খবর হয়ে উঠেছে ফুটবলারদের গানে গলা না মেলানো। ১৪ই নভেম্বর কিক-অফের আগে খলিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামের চারপাশে ইরানের জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর সময়ে দেশের প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে সংহতি প্রদর্শন করতে খেলোয়াড়রা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে একটা শব্দও উচ্চারণ না করে নীরবে দাঁড়িয়েছিলেন।

ইরানের শাসক খেলোয়াড়দের প্রতি খুবই প্রতিকূল আচরণ করবে এতো জানাই আছে। ওই দেশের জনপ্রিয়তম খেলা হল ফুটবল। সেই জনপ্রিয় খেলার জনপ্রিয়তম ফুটবলার ও কোচ আলি করিমি বিক্ষোভকারীদের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করার জন্য আগেই কর্তৃপক্ষের সমালোচনা ও প্রতিহংসার মুখে পড়েছেন। করিমি এই বছর ইরান সরকারের বিরুদ্ধে মাসা আমিনির হত্যার পরে যে বিক্ষোভ চলছে তাকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছিলেন। তিনি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেছিলেন যে, এমনকি পবিত্র জলও আমিনির মৃত্যুর এই অপমানকে ধুয়ে ফেলতে পারে না। ইনস্টাগ্রাম প্লাটফর্মে তার ১ কোটি ৩০ লক্ষ অনুসরণকারী আছেন। সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি, আলি করিমি ইরানিদেরকে দেশে ইন্টারনেট সেন্সরশিপ এড়িয়ে যাবার উপায় বাতলে দিয়েছিলেন। রাষ্ট্র তার জবাব দিয়েছে; দুবাইতে থাকাকালীন তার অনুপস্থিতিতে ‘দাঙ্গাকে উৎসাহিত করার’ জন্য শাসক তাকে অভিযুক্ত করেছে এবং লাভাসনে তার বাড়ি দখল করে নিয়েছে। আর্মব্যান্ড পরে প্রতিবাদ করা দরকার, তবে অগণতান্ত্রিক, সহিংস শাসকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে খেলার মাঠে নিঃশব্দ প্রতিবাদ করতে শুধু সাহস নয়, লাগে আত্মবিশ্বাস।

যখন ফুটবলাররা নিঃশব্দ প্রতিবাদ করছিলেন, তখন দর্শকরা অবশ্য চিৎকার করে স্লোগান দিয়েছেন। গ্যালারিতে তখন উঠেছিল উত্তাল ধ্বনি ‘জিন, জিয়ান, আজাদি’ মানে ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’। এটি আসলে জনপ্রিয় রাজনৈতিক কুর্দি স্লোগান যা কুর্দিদের স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক কনফেডারেলিস্ট আন্দোলনে ব্যবহৃত হয়। এই বছর সেপ্টেম্বর মাসে মাসা আমিনীকে কবর দেবার সময়ে এই স্লোগান দেওয়া শুরু হয়েছিল। দ্রুত ‘জিন, জিয়ান, আজাদি’ ইরানের স্বাধীনতাকামী সমস্ত মহিলাদের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে স্টেডিয়ামে চিৎকার করে কারোকে ‘বে-শরাফ’ অর্থাৎ ‘অসম্মানজনক’ বলতে শোনা গেছে, কারোকে দেখা গেছে কাঁদতে।

খেলোয়াড়রা মাঠে করেছেন নিঃশব্দ প্রতিবাদ, তার ঢেউ উঠেছে গ্যালারিতে সশব্দ স্লোগানে।

১৯৭৯-এর আগে দেশে নারীদের অন্তত এরকম অবস্থা ছিল না, তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো ঠিক করতেন মাথা ঢাকবেন কিনা। ঐ সময়ে আয়াতোল্লা খোমেইনীর আগমনের পরে ইরানের নয় বছরের শিশু থেকে কিশোরী, মহিলাদের আবশ্যিকভাবে মাথা ঢেকে রাখতে হয়। বিপ্লবোত্তর সময়ে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে, দেশের জবরদস্তি হিজাব পরার আইনের প্রতিবাদে বহু আন্দোলন হয়েছে, বহু তরুণ-তরুণীর জীবন কেটেছে কারাগারে। রাস্তা হয়েছে রক্তাক্ত। এভাবেই চলেছে বিগত কয়েক দশক ধরে। শুধু তার তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে শেষ দুই মাসে।

২২ বছর বয়সী মাসা আমিনীর পুলিশের কারাগারে মৃত্যুর পর থেকে ইরান উত্তাল হয়ে উঠেছে। প্রতিবাদে, প্রতিরোধে ক্রমাগত ভয় ভেঙেছে। হাজার হাজার নারী পুরুষ একত্রিতভাবে প্রতিবাদ করছেন, মিছিল করছেন, প্রকাশ্যে হিজাব খুলে দিচ্ছেন, চুল দিয়ে পতাকা বেঁধেছেন। প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে, বিচারের নামে হবে প্রহসন, হবে জেল, চলবে চাবুক। হচ্ছেও তাই। ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী সমস্ত প্রতিবাদের সহিংস জবাব দিয়েছে। স্বাধীন প্রতিবেদনের অভাবের কারণে সংখ্যা যাচাই করা কঠিন হলেও, মানবাধিকার কর্মীরা বলেছেন যে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে এখনও পর্যন্ত ৪০০ জনেরও বেশি বিক্ষোভকারী নিহত এবং ১৬,৮০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, ‘জাতীয় সংগীত নিয়ে রাজনীতি করা কি উচিত’? উত্তর আসে প্রতিবাদীদের থেকে, ‘খেলোয়াড়রা সারা বিশ্বের ইরানিদের বলতে চেয়েছেন আমাদের হৃদয় আছে দেশের নারী এবং তরুণদের সঙ্গে। খেলোয়াড়রা আছেন জনগণের সঙ্গে, শাসকের সঙ্গে নয়।’

বিপ্লব থেকে দূরে থাকার জন্য, প্রতিবাদ না করার জন্য তাদের ওপরে ছিল প্রচণ্ড চাপ। ইরানের ফুটবলাররা জেনেশুনে, এই নিঃশব্দ প্রতিবাদ করলেন। ফুটবলাররা বিশ্বকাপের গ্রুপ গেমগুলিতে জাতীয় সঙ্গীত না গাইলে কঠোর প্রতিশোধের মুখোমুখি হতে পারেন। কয়েকদিন আগেই দেশে আরেক জনপ্রিয় ও প্রতিবাদী খেলোয়াড়কে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দেশে ইতিমধ্যেই রাজনীতিবিদরা বলেছে যে, কারোকে তাদের জাতীয় সংগীতকে অপমান করতে দেবে না।

দেশের পুরুষ আইকনরা পুরুষতন্ত্রের বিরোধিতা করেছেন, জীবন বাজি নিয়ে নারীদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। সেখানে নারীরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে লড়াই করে যাচ্ছেন! পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে! পুরুষদের হাত ধরে। নিজের মাথা নিজে ঢাকবার অথবা না ঢাকবার অধিকারের জন্য।

ধর্ম যখন বিজ্ঞানকে বলে রাস্তা ছাড়ো!’ বিজ্ঞান কি রাস্তা ছেড়ে দেয়?

কেউ কারোকে রাস্তা ছেড়ে দেয় না, যতদিন এই পৃথিবীতে গান থাকে, গানের মানুষ থাকে, স্বপ্ন থাকে...

ইরানের খেলোয়াড়দের শ্রদ্ধা।

শুধু জুলুশের নয়, তোমরা হলে হাতে হাত ধরার আইকন, ভরসার আইকন, চিরকালের আইকন।