আরেক রকম ● দশম বর্ষ ত্রয়োবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২২ ● ১৬-২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯
প্রবন্ধ
সঞ্জয় উবাচ
বালি দ্বীপে বলীয়ান
মহারাজ, এই নভেম্বরের মাঝামাঝি বালি দ্বীপে বসেছিল এক মহাসম্মেলন। জি-২০ শীর্ষনেতাদের বৈঠক। সারা পৃথিবীর তাবড়ো তাবড়ো নেতা-নেত্রীরা, বস্তুত রাষ্ট্রপ্রধানেরা, সেখানে সমবেত হয়েছিলেন। ঠিক যেন সমবেতা মিত্রবান্ধবঃ।
দ্যাখ সঞ্জয়, তোমাদের একালের কূটনৈতিক পরিভাষা আমাদের কাছে মোটেই সহজবোধ্য নয়। জি-২০ কাকে বলে একটু যদি খুলে বল তাহলে আমার পক্ষে সহজে বোধগম্য হবে।
জি-২০ মানে গ্রুপ অব্ টোয়েন্টি। বিশ্বের উন্নত এবং উন্নয়নের পথে বেশ খানিকটা এগিয়ে-আসা কুড়িটা দেশ নিয়ে গঠিত হয়েছে এই গোষ্ঠী। মোটামুটি ধনী কুড়িটা দেশের এই জোটের নাম জি-২০।
ধনী দেশ মানে সেসব দেশের অধিবাসীরা কি সবাই বড়োলোক?
না মহারাজ, সেসব দেশের সব মানুষ বড়োলোক নন, তবে অনেকে অবশ্যই বড়োলোক। এখানে ধনী অর্থে ওই দেশগুলি প্রচুর পরিমাণে দ্রব্যাদি উৎপাদন করে। একালের পরিভাষায় যাকে বলা হয় জিডিপি, অর্থাৎ দেশের আভ্যন্তরিক মোট উৎপাদন। একালে অবশ্য উৎপাদন বলতে শুধু দ্রব্যের উৎপাদন বোঝায় না, বিবিধ সেবা-পরিষেবাকেও তার মধ্যে গণ্য করা হয়।
তাহলে বলা যায় এই জি-২০ গোষ্ঠী মানে বিশ্বের সেরা উৎপাদনকারীদের একটা সংঘ।
সংঘ যদি ঠিক নাও বলেন মঞ্চ তো বটেই। আর সেরা মানে কতটা সেরা তার একটা হিসেব হল যে, সারা বিশ্বের মোট উৎপাদনের ৯০ শতাংশ এই জি-২০ গোষ্ঠীর হাতে। মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৮০ শতাংশ এই গোষ্ঠীর অন্তর্গত আর পৃথিবীর জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ। পৃথিবীর মোট ভূ-পরিধির ষাট শতাংশ ব্যাপী এই দেশগুলির অবস্থান।
তাহলে তো বলতে হবে এই জি-২০ গোষ্ঠীই কার্যত বর্তমান পৃথিবীর সঞ্চালক। যা কিছু ঘটে এই দেশগুলিই তবে তার নায়ক।
এক অর্থে তাই মহারাজ।
আর আমাদের ভারত তার একজন মুখ্য সদস্য?
হ্যাঁ মহারাজ, আপনার সাধের ধর্মরাজ্য আজ তার নিজ অধিকারে এই অত্যন্ত প্রভাবশালী দেশগোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য। আমাদের প্রধানমন্ত্রী মনে করেন শুধু অন্যতম সদস্য না, এক প্রধান সদস্য। সেই মর্মে প্রচারকর্মেও তিনি কখনো ক্লান্ত হন না।
দ্যাখ সঞ্জয়, ঘটনার নায়ক হতে কার না ভালো লাগে। মঞ্চের সব আলো নিজের উপরে এসে পড়ছে, প্রয়োজনে তা নিজের উপরে টেনে নিচ্ছি এবং নিতে পারছি, অন্তত পারছি বলে ভাবছি, এর তো একটা নেশা আছে।
এসবই ঠিক কথা মহারাজ। কিন্তু আপনাকে অকপটে সব সংবাদ জানানো আমার কর্তব্য তাই নিবেদন করছি। আপনি যে নেশার কথা বললেন সেই নেশার পিছনে আমরা যখন ছুটছি তখন নেহাতই কিছু প্রশ্ন আমার বাক্যের পরিধির মধ্যে আসছে না, আর তাই তা আপনার ধর্মরাজ্যের প্রজাদেরও গোচরে আসতে পারছে না।
দেখুন মহারাজ, আপনি সরাসরি নিখুঁতভাবে শনাক্ত করেছেন যে এই জি-২০ ভুক্ত রাষ্ট্রসমূহ নিজেদেরকে প্রবল পরাক্রান্ত মনে করে। সংঘবদ্ধভাবে তো করেই, অন্তর্গত দেশের প্রত্যেকেই, প্রধান দেশগুলি তো বটেই, নিজেদের মনে করে কী এক দুর্জয় বলে বলীয়ান। আমাদের ধর্মরাজ্যের কর্ণধারও, আপনি জানেন মহারাজ, তার ব্যতিক্রম নন।
তোমার কথার ধরন থেকে মনে হচ্ছে তুমি ধর্মরাজ্যের কথায় মনের গোপনে কোথাও সংশয় পোষণ কর। যদি তাই হয়, তাহলে সে কথা আমাকে নির্ভয়ে জানাও সঞ্জয়। আমারও তো রাজ্যের প্রকৃত চরিত্র ও অবস্থান বিষয়ে অবহিত থাকা দরকার।
আপনি জানেন মহারাজ, একালে শুধু মুখের কথায় চিঁড়ে ভেজে না। শুধু আমার বিশ্বাসের জোরে এখন আর কোনো কথা কাউকে বিশ্বাস করানো যায় না। তাই এখনকার সব কথার সমর্থনে বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যান পেশ করার রেওয়াজ চালু আছে। আর নানা বিষয়ে পরিসংখ্যানও বর্তমানকালে সহজলভ্য। আমি আপনাকে এইসব নীরস পাটীগণিত আর ধারাপাতে ভারাক্রান্ত করতে চাই না মহারাজ। সংক্ষেপে আপনাকে বলি, দেশের উৎপাদন ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যে জিডিপি-র কথা বললাম, সেই নিরিখে দেখুন ভারত কিরকম দুর্বল জায়গায় অবস্থান করছে। ভারতের মাথাপিছু জাতীয় আয় বর্তমানে ৮,২৯৩ মার্কিন ডলার। এই অঙ্কটা ক্রয়ক্ষমতার সমতাসাধন করার পরে সংশোধিত অঙ্ক। একই পরিমাণ উৎপাদিত বস্তু (দ্রব্য বা সেবা) বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন দামে বাজারে কাটে বলে দামের সমতাসাধন না করতে পারলে কতটা উৎপাদন কে করল তার ঠিকমতো আন্দাজ পাওয়া যায় না। আমরা তো সেই আন্দাজটাই পেতে চাই। সেই উদ্দেশ্যেই আমাদের জিডিপি-র হিসেব কষা। সেইজন্যে দেশে দেশে তুলনা করতে গেলে দামের ভিন্নতার জন্য জিডিপি অঙ্ক সংশোধন করে নিতে হয়। সেই সংশোধিত অঙ্কে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি-র পরিমাণ যেখানে ৮,২৯৩ মার্কিন ডলার, সেখানে ধনী দেশ বলে পরিচিত দু-একটি দেশের অঙ্ক এইরকমঃ কানাডা-৫৭,৮২৭, চীন-২১,২৯১, ফ্রান্স-৫৬,২০০, জার্মানি-৬৩,৮৩৬, ইউকে-৫৫,৮৬৩, ইউএসএ-৭৫,১৮০ মার্কিন ডলার।
আমি অন্ধ মানুষ, সঞ্জয়। তুমি আজ আমার দৃষ্টি খুলে দিলে। আমার ধর্মরাজ্যের অবস্থা আমি শুধু শুনে শুনে আন্দাজ করি। আমি তো নিজের চোখে কিছু দেখতে পাই না। তাই আজ আমি সম্পূর্ণভাবে তোমার দৃষ্টিনির্ভর। আমি প্রত্যেক মাসের শেষ রবিবারে উদ্গ্রীব হয়ে থাকি সঞ্জয়। আমার প্রধান অমাত্যের মনের কথা শোনার জন্য।
হ্যাঁ মহারাজ। দেশবাসী অনেকেই হয়তো তাই থাকেন। অনেকেই হয়তো চোখ বন্ধ করে শুধু মন-কী-বাতের জন্য কান খুলে রাখেন। যদিও আড়ালে কেউ কেউ এ ব্যাপারটাকে মনে বাত ধরেছে, এমন ইঙ্গিতও করে থাকেন। চোখ খোলা রাখলে আরো দু-একটা জিনিস হয়তো চোখে পড়বে, মহারাজ।
যেমন? বলো, আমি তোমার চোখেই দেখে নেব। শুধু ওই জিডিপি-র হিসাবে কিছু বোঝা যায় না বলে অধুনা আরো এক সূচক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তার নাম মানব উন্নয়ন সূচক। মানুষের সমাজ জীবনটা চলছে কেমন তার খানিক আন্দাজ পাবার জন্য এই সূচকের চল। মহারাজ শুনে কিছু আনন্দ পেতে পারেন, এই সূচকটি চালু করার পিছনে আপনার প্রসারিত ধর্মরাজ্যের দু-জন ব্যক্তির নাম জড়িয়ে আছে। তাঁদের চিন্তাভাবনা পরিশ্রম ও উদ্যমের জন্যই আজ এই সূচক বিশ্বমঞ্চে সাধারণভাবে গৃহীত হয়েছে।
আমি কৌতূহলী হয়ে পড়ছি, সঞ্জয়। আধুনিক কালের অনেক খবর আমি আর রাখতে পারি না তা জানি। তাই বলে এমন একটা খবর থেকেও আমি পিছিয়ে থাকব তা হয় না। তুমি আমাকে শীঘ্র বলো কে সেই দু-জন বিশিষ্ট ব্যক্তি, সম্ভব হলে আমি তাঁদের পুরষ্কৃত করব।
মহারাজ, অধুনা যে দেশের নাম পাকিস্তান, একদিন আপনারই ধর্মরাজ্যের অন্তর্গত যে-অঞ্চলে সিন্ধু সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল, একজন সেই পাকিস্তানের নাগরিক। নাম মহবুব-উল হক। অধুনা প্রয়াত। অন্যজন অমর্ত্য সেন, নোবেল স্মৃতি পুরস্কারে ভূষিত।
এত সব কথার কিছুই আমি জানতে পারিনি, সঞ্জয়। আমার এই অজ্ঞানতায় আমি আজ সত্যিই অনুতপ্ত।
অনুতাপ করবেন না, মহারাজ। আধুনিক বিশ্ব ঘটনাবহুল। নানাবিধ তথ্য প্রযুক্তির দৌলতে সেইসব ঘটনা থেকে উৎসারিত বিচিত্র তথ্যসম্ভারে মেদিনী ও নভোচর আজ আক্ষরিক অর্থে রীতিমতো কম্পিত। আপনি বৃদ্ধ, আপনার পক্ষে এর তাল রাখা কঠিন, মহারাজ। প্রশিক্ষিত যুবক-যুবতীরাই হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু এই মানব উন্নয়ন সূচকের নিরিখে আমাদের এই ধর্মরাজ্যের অবস্থান কেমন তা আপনার কোনো আন্দাজ আছে, মহারাজ?
না। তুমি তো বুঝতেই পারছ সঞ্জয়। এইসব আধুনিক পরিসংখ্যানে আজও আমি কৃতবিদ্য হতে পারিনি।
ভারতের মানব উন্নয়নের সূচকের মান দশমিক ৬৩৩। এই সূচকের সর্বোচ্চ মান হতে পারে ১। তাই ১-এর যত কাছাকাছি থাকা যাবে মানব উন্নয়নের বিচারে সে দেশের অবস্থা তত ভালো। জি২০-র অন্তর্ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে ভারতের এই দশমিক ৬৩৩ মান সবচেয়ে কম। মানব উন্নয়নে যারা উপরের দিকে তাদের সকলেরই সূচক মান দশমিক ৯০০-র উপরে। অস্ট্রেলিয়া (৯৫১), কানাডা (৯৩৬), ইউ কে (৯২৯), জাপান (৯২৫), দক্ষিণ কোরিয়া (৯২৫), ইউ এস এ (৯২১)। যাদের সূচক মান কমের দিকে তার মধ্যে আছে চীন (৭৬৮), ব্রাজিল (৭৬৪), মেক্সিকো (৭৫৮), দক্ষিণ আফ্রিকা (৭১৩), ইন্দোনেশিয়া (৭০৫)। ভারত সবার নীচে, মহারাজ।
এ কী নিদারুণ কথা শোনাচ্ছ, সঞ্জয়। এই যে দু-বেলা শুনতে পাই আমাদের এগিয়ে যাবার নিনাদবাণী। বিশ্বের এক আসন্ন শক্তিধর রাষ্ট্র আমরা।
আমার কাজ মহারাজের কাছে প্রতিবেদন পেশ করা। আমি আমার সাধ্যমতো সেই কাজ করে চলেছি। আমাদের ক্ষমতার আস্ফালন মিথ্যে নয়, মহারাজ। তেমনি আমাদের ‘উন্নতি’ যে মানব উন্নয়নকে মূলত পাশ কাটিয়ে চলেছে, সে কথাটাও অসার কথা নয়, মহারাজ। আর মানবাধিকারের ধারণা তো এরও বাইরে। গৌতম নওলখার কোনো সংবাদ কি আপনার কানে গেছে, মহারাজ?
আজকাল মনেও রাখতে পারি না সব ঠিকমতো। তবে গৌতম নওলখা, এরকম নাম, আমার কিছু মনে পড়ছে না, সঞ্জয়।
[সৌরীন ভট্টাচার্য]