আরেক রকম ● দশম বর্ষ ত্রয়োবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২২ ● ১৬-২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯

সমসাময়িক

রাষ্ট্র ও বিজ্ঞান


আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে! গোটা দেশ আনন্দিত যে দেশের অন্যতম স্বীকৃত বিজ্ঞান গবেষণা সংস্থা ‘সিএসআইআর’-এর বিজ্ঞানীরা সদলবলে অযোধ্যার নির্মীয়মাণ রামমন্দির পরিদর্শন করে, যত্ন সহকারে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছেন ২০২৪ সালে কীভাবে রামনবমীর দিন সূর্যের প্রথম আলো এসে ‘রামলালার’ মূর্তির উপর পড়বে। সমগ্র দেশবাসী এতদিন যাবৎ এই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। ২০২৪ সালে দেশবাসীর জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান এই অনুসন্ধানের উপর নির্ভর করেছিল। তাই তো দেশের সমস্ত সংবাদপত্রে এই খবর ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। তবে এখনো অবধি সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের যে দেশের সর্বোচ্চ খেতাবগুলি দিয়ে দেওয়ার দাবী বিজেপির নেতা-নেত্রীদের থেকে আসেনি তাতে খানিক দীর্ঘশ্বাস ফেলার অবকাশ ঘটেছে বটে। এ দেশে জনস্বাস্থ্যের কোন সমস্যা নেই, অনাহারের-অর্ধাহারের সমস্যা নেই, আর্থিক সক্ষমতার কোন সমস্যা নেই, আছে কেবল ধর্মের সমস্যা, সংখ্যালঘুর দ্বারা সংখ্যাগুরুর নিপীড়িত হওয়ার আশঙ্কা, পৌরাণিক ইতিহাস বিস্মৃত হওয়ার আশঙ্কা। তাই তো মাঠে নেমেছেন দেশের সেরা বিজ্ঞানীদের দল, দেশের ধর্মীয় সংখ্যাগুরুদের সরকারি প্রতিভূর পূজাকে কীভাবে আরও মহিমান্বিত করা যায় তার ব্যবস্থাপনায়।

এসব কাণ্ডে স্বাভাবিকভাবেই দেশের এক অংশের মানুষ, যারা মনে করেন যুক্তিবাদের প্রসার ঘটুক, সে প্রক্রিয়ায় দেশের সরকার সদর্থক ভূমিকা নিক তারা কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়েছেন এবং খানিক প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। যদিও এসব দেশদ্রোহী কাজকর্মে কেন্দ্রের মহামহিম ও তার পারিষদেরা খুব একটা বিচলিত নন। তারা তাদের লক্ষ্যে অবিচল। আর এই মুষ্টিমেয় কিছু বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের অর্বাচীন চেঁচামেচিতে এই বিরাট দেশের, তার শত কোটি জনতার কীই বা আসে যায়। কিন্তু কিছু ব্রাত্যজনের এই মাথাব্যথার আদৌ কোন কারণ আছে কি? পরামর্শদাতা বিজ্ঞানীরা কী এমন করেছেন? তাঁরা সরকারের নির্দেশ মেনে সেখানে গেছেন এবং তাঁদের উন্নত মেধা প্রয়োগ করে 'রামলালার' নির্মীয়মান মন্দিরের পুরোহিত ও আনুষঙ্গিক লোকজনকে বুঝিয়ে এসেছেন যে মন্দিরের জানলা, দরজা কোথায় কীভাবে বসাতে হবে যাতে ২০২৪ সালে রামনবমীর দিন সূর্যের আলো 'রামলালার' গায়ে এসে পড়ে। ব্যাপার হল, পাড়ার রাজমিস্ত্রীও নিজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এরকম দরজা জানালা বানাতে পারেন যাতে সূর্যের আলো একটা নির্দিষ্ট অংশে বছরের এক সময় এসে পড়ে। তাহলে দেশের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানীদের কেন ডাকতে হল। এর পেছনে যুক্তি হল যে রামনবমী কেবল সূর্যের অবস্থান নয়, সাথে চাঁদের অবস্থান দিয়েও ঠিক হয়। ফলে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট দিনে এই তিথি আসে না। ফলে দিনের তারতম্যে সূর্যের অবস্থান একটু সরে যায়। তাই সূর্যের আলো একটি নির্দিষ্ট জায়গায় তিথি অনুযায়ী ফেলতে গেলে জানলা দরজার অবস্থানের সাথে বাড়তি কিছু আয়না রাখতে হবে। সেই আয়না পর্যাপ্তভাবে কাত করে দিলে সূর্যের আলো যে কোনো দিনই একটি নির্দিষ্ট জায়গায় এসে পড়বে। এতদূর এসে কোনো বেয়াদব পাঠক ভাবতেই পারেন যে এতো ব্যবহারিক জ্ঞান থেকে যে কোনো দক্ষ কারিগরও হিসাবগুলো করে ফেলতে পারে। তাহলে এভাবে ফলাও করে, দেশের উচ্চ বেতনপ্রাপ্ত সরকারি বিজ্ঞানীদের নিয়ে গিয়ে এই কান্ড ঘটানো হল কেন?

এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে দুটি ঘটনায়, এক কেন্দ্রের সরকার তার সংবিধান স্বীকৃত দায়িত্ব বিস্মৃত হয়েছে এবং দুই, বর্তমানকালে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় একদল কর্মী, বিজ্ঞানী, শিক্ষক পালিত হচ্ছেন যারা এইসব অসাংবিধানিক কাজের বাস্তবায়ন করছেন নিজেদের রাজনৈতিক অথবা ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে। প্রথম যে কথাটি দেশের যে কোন সৎ নাগরিকের তোলা উচিত তা হল, কীভাবে এদেশের নির্বাচিত সরকার একটি বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাত এবং তোষণ চালাতে পারে? আমাদের দেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের চোখে সব মানুষ সমান। তার জাতি, ধর্ম ও ভাষাগত পরিচয় গৌণ। কোনো মানুষ তার ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মাচরণ করবেন কি না, বা করলে কোন ধর্মের সাথে যুক্ত হবেন তা তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দ কি হবে - রাষ্ট্র সেখানে মাথা গলাবে না। বরং দেশের সরকার সর্বদাই বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবাদের প্রসারে ব্রতী হবে। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই এ দেশে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সিএসআইআর, ডিআরডিও ইত্যাদি স্বায়ত্ত্বশাসিত গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলা হয়। কিন্তু আজকে এটা চরম হতাশার যে এই সংস্থাগুলির স্বায়ত্ত্বশাসন এক ধরনের তামাশায় পরিণত হয়েছে। যেহেতু এই সংস্থাগুলির বার্ষিক ব্যয়বরাদ্দ কেন্দ্রের সরকারি কোষাগার থেকে হয়, ফলে দেশের সরকারের মাথায় বসে থাকা রাজনৈতিক নেতারা এই সংস্থাগুলিকে তাদের প্রতিপালিত বলে মনে করেন। একথা তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার যে এই সংস্থাগুলির জন্য যে কোষাগারের অর্থ ব্যয় হয়, তা সরকারি কোষাগারের অর্থ, রাজনৈতিক দলের নিজস্ব অর্থ নয়। দেশের আপামর মানুষের পরিশ্রম ও করের টাকায় গড়ে ওঠে এই কোষাগার। ফলে এই সরকারি স্বায়ত্ত্বশাষিত সংস্থাগুলির যদি কোন দায়বদ্ধতা থেকে থাকে, তা কেবল দেশের আপামর জনতার কাছে। তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে আরও সুন্দর ও উপভোগ্য করে তোলার লক্ষ্যেই এই সংস্থার বিজ্ঞানীদের উৎসর্গ থাকার কথা।

কিন্তু অত্যন্ত হতাশার কথা যে, বিজেপি সরকারের শাসনকালে এই সংস্থাগুলিতে প্রয়োজনীয় গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ ক্রমেই কমছে। ২০১৫-১৮ এই সময়ে গবেষণা সংস্থাগুলির বরাদ্দ অর্থ সংখ্যাগত বিচারে ছিল সর্বাধিক। তারপর ২০১৮-২১ সালে এই বরাদ্দ কমে, এমনকি বৃদ্ধির হার ঋণাত্মকও হয়ে যায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে। তারপর ২০২১-২৩ সালে এই বরাদ্দ ২০১৮-২১-এর বিচারে ১৯% বাড়লেও মূল্যমানে তা ২০১৫-১৮-র তুলনায় কম। এর ওপর যদি মুদ্রার অবমূল্যায়নকে যুক্ত করা হয় তাহলে প্রকৃত বিচারে সরকারি গবেষণা সংস্থাগুলোর জন্য বরাদ্দ আদতে কমেছে লাগাতার। আবার বিস্ময়করভাবে দেখা গেছে বিজেপি সরকারের আমলে ২০১৭ সালে 'পঞ্চগব্য' নিয়ে গবেষণার জন্য কেন্দ্রীয় বাজেটে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল। অথচ সেই বছরই ভারতের 'চন্দ্রযান প্রকল্প' ব্যর্থ হয় কারণ অত্যন্ত সীমিত ব্যয়ে সেই প্রকল্প রূপায়ন করতে হয়েছিল আইএসআরও-র বিজ্ঞানীদের। ফলে একদিকে বিজেপির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের সরকার বিজ্ঞানের নামে অপবিজ্ঞান প্রচার করতে কোষাগারের অর্থ ব্যয় করছে, অন্যদিকে দেশের মানুষের স্বার্থে ব্যবহৃত হতে পারে এমন গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ সঙ্কুচিত করে চলেছে। আর এর উপর যুক্ত হয়েছে সরকারের রাজনৈতিক অভিসন্ধি। ইতিহাস, বিজ্ঞানের এক বিকল্প ভাষ্য তৈরি করতে মরিয়া আজকের কেন্দ্রীয় সরকার, যেখানে বস্তুনিষ্ঠা নেই, যুক্তিবাদ নেই, পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের গুরুত্ব নেই। আছে কেবল প্রবাদ, গল্পকথা ও অতীত অভিজ্ঞতা বিবর্জিত এক সংস্কৃসতি গড়ে তোলার ইচ্ছা।

আর এই কাজে যোগ্য সঙ্গত করছেন এই প্রতিষ্ঠানের কর্মী, বিজ্ঞানী, শিক্ষক ও শিক্ষাবিদদের একাংশ। তারা সরকারের এই নির্দেশনামাগুলি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলছেন, সহকর্মীদের মানতে বাধ্য করছেন এমনকি কেউ প্রশ্ন তুললে তাঁদের শাস্তিবিধানের ব্যবস্থা অবধি করছেন। এরা এসব অবশ্য করেন সংস্থার শৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাতে। যদিও এই প্রশ্ন তোলাই যায়, শৃঙ্খলা রক্ষার নামে কি তারা যে কোনো নির্দেশই মেনে নেবেন? তা যদি না হয়, তাহলে তারা বিজ্ঞানের নামে এই অপবিজ্ঞান, কুসংস্কারের প্রচার মেনে নিচ্ছেন হয় নিজেদের রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে অথবা শাসকের সুনজরে থাকতে। হয়ত তারা বিস্মৃত হয়েছেন ফ্রাঞ্জ হেরবার-এর কথা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে স্বাগত জানিয়েছিলেন যে কয়জন জার্মানির বিজ্ঞানী তিনি তাদের অন্যতম। তার সেদিনের অবস্থানের পিছনে তিনি দেশভক্তি, আনুগত্য ও শৃঙ্খলার যুক্তি দিয়েছিলেন, কিন্তু গোটা দুনিয়া তাকে মনে রেখেছে মানব হত্যার কারিগর হিসাবে। আমাদের দেশের অনুগত বিজ্ঞানীকুল যত দ্রুত এই কথা বোঝেন ততই দেশের ও দশের মঙ্গল।

আশার কথা হল, এখনো এদেশে কিছু মানুষ রয়েছেন যারা বিরোধিতায় সোচ্চার হয়েছেন। কেন্দ্রের সরকারি গবেষণা সংস্থাগুলির এই অপব্যবহার নিয়ে মুখর হচ্ছেন। সংগঠিত প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু তাঁদের সংখ্যা সীমিত এবং রাষ্ট্রীয় শাসনযন্ত্রের সাথে একা একা তাঁদের লড়ে ওঠা মুশকিল। তাই এগিয়ে আসতে হবে গোটা দেশের যুক্তিবাদী মানুষদের এবং রাজনৈতিক দলগুলিকে যারা যুক্তিবাদী রাজনীতির চর্চা করেন। দেশের জনগণের এই প্রতিবাদে সামিল হওয়া আশু প্রয়োজন। যদি দেশের বিজ্ঞান আন্দোলনই না বাঁচে, তাহলে এদেশের কোটি কোটি নিরন্ন মানুষের সমস্যার বৈজ্ঞানিক সমাধানও সম্ভব নয়।