আরেক রকম ● দশম বর্ষ ত্রয়োবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২২ ● ১৬-২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯
সম্পাদকীয়
গুজরাটে শান্তিকল্যাণ!
"পেটের কাছে উঁচিয়ে আছো ছুরি
কাজেই এখন স্বাধীনমতো ঘুরি
এখন সবই শান্ত, সবই ভালো।"
অমিত শাহ নিশ্চিত শঙ্খ ঘোষের কবিতা পড়েননি। পড়ে থাকলে মৃত কবির লাইনগুলির সত্যতা এতটা নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন না দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। গুজরাটে নির্বাচনী প্রচারে অমিত শাহ শোনালেন এক আশ্চর্য তত্ত্ব। বিজেপি-র আমলে, ২০০২ সালের পরে, গুজরাটে স্থায়ী শান্তি নামিয়ে আনা হয়েছে। যারা নাকি আগে দাঙ্গা করত, তাদের হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপি সরকার। অতএব, ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ’। কোনো দাঙ্গা নেই, হাঙ্গামা নেই, যেই প্রতিশ্রুত ‘আচ্ছে দিন’-এর কথা বিজেপি নেতারা বলে থাকেন তা বিগত কুড়ি বছর ধরে গুজরাটে বিরাজমান। অতএব, হে গুজরাটের জনগণ আবারো বিজেপি-কে ভোট দিন, তা না হলেই যেই স্থায়ী শান্তি স্থাপন করা হয়েছে গুজরাটে তা ভঙ্গ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
২০০২ সাল। নরেন্দ্র মোদীর শাসনাধীন গুজরাটে ভয়াবহ মুসলমান বিরোধী দাঙ্গা সংঘটিত হয়। এই দাঙ্গায় ১০০০-এর অধিক মানুষের প্রাণ যায়। পুলিশ ও প্রশাসনকে সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় করে রেখে নরেন্দ্র মোদী সরকার নিউটনের তৃতীয় সূত্রের অছিলায় গুজরাটে ভয়াবহ মুসলমান বিরোধী দাঙ্গা সংঘটিত করতে দেয়। এহসান জাফরির মতন প্রাক্তন সাংসদকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়, অসংখ্যা নারীকে ধর্ষণ করা হয়, পেট চিরে ভ্রূণ হত্যার মতন পাশবিক ঘটনা ঘটানো হয় হিন্দুত্ববাদীদের গুণ্ডাদের দ্বারা। নরেন্দ্র মোদী এই দাঙ্গা পরবর্তী নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হন। বলা যেতে পারে যে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যে দীর্ঘ পথ মোদী যাত্রা করেছেন, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক হল ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা।
আজ ২০ বছর পরে নরেন্দ্র মোদীর বিশ্বস্ত সাথী অমিত শাহ সেই ২০০২ সালের প্রসঙ্গ কেন তুলছেন? এর একটি সহজবোধ্য উত্তর ইতিমধ্যেই মিডিয়াতে পাওয়া যাচ্ছে। বলা হচ্ছে যে আবারো সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং জিগিরের সাহায্যে বিজেপি গুজরাটে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাইছে। আবারো সাধারণ গুজরাট নিবাসীর মনে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ জন্মানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, তাদের আতঙ্কিত করে ভোট নেওয়ার চেষ্টায় রত হয়েছেন অমিত শাহ। কথাটি ভুল না হলেও, অসম্পূর্ণ।
ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বাচনভঙ্গীর দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রথমত, মিথ্যাচার ফ্যাসিবাদী রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু শুধু মিথ্যাচার দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার প্রচার করা সম্ভব নয়। তাই দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি হল ‘ডগ হুইসলিং’। কুকুরের বাঁশী যেমন শুধুমাত্র কুকুর ব্যতিরেকে অন্য কেউ শুনতে পারে না, তেমনি ফ্যাসিবাদী রাজনীতিবিদরা তাদের সদস্য-সমর্থকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য এমন কথা বলেন যা আপাতদৃষ্টিতে সমস্যাজনক মনে না হলেও, তার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না। বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক যে জনসমর্থন তাদের রয়েছে, সেই অংশের মানুষের কাছে বার্তাটি খুবই পরিষ্কার।
অমিত শাহের বক্তব্য ফ্যাসিবাদী বাচনভঙ্গীর ‘ডগ হইসলিং’-এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে অমিত শাহ দাঙ্গাবাজদের ঠাণ্ডা করে দিয়েছেন বলে কৃতিত্ব নিচ্ছেন। কিন্তু যাদের ন্যূনতম রাজনৈতিক জ্ঞান রয়েছে, তারা বুঝতে পারবেন যে অমিত শাহ আসলে ২০০২ সালে মুসলমানদের ঠাণ্ডা করে দেওয়া হয়েছে এই বার্তাটিই দিতে চাইছেন। ২০ বছর পরে সার্থকভাবে এই ঠাণ্ডা করে দেওয়ার কৃতিত্ব দাবি করে ভোট চাইছেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
এইখানেই সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে। নরেন্দ্র মোদী ভারতে ‘ডগ হুইসিলিং’-এর একজন প্রবক্তা বলা যেতে পারে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মোদী বলেন তিনি মর্মাহত। গাড়ির নিচে কুকুরের বাচ্চারা চাপা পড়ে মারা গেলেও কষ্ট হয়, আর গুজরাটে মৃত্যু ঘটেছে মানুষের। আবারো, আপাতদৃষ্টিতে তিনি বোঝাতে চাইছেন তিনি কত সংবেদনশীল। কিন্তু আসলে তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের কোন চোখে দেখেন তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবু, ২০১৪ সালে ‘তেড়ে মেরে ডাণ্ডা’ করার জন্য মোদী স্থায়ী শান্তি এসে গেছে বলে দাবি করেননি এবং তার জন্য ভোট চাননি। কারণ তখন তার ‘বিকাশ পুরুষ’-এর ভেক ধরে নির্বাচনে অবতীর্ণ হওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল।
বর্তমানে আর সেই বাধ্যবাধকতা নেই। ২০১৯ সালের নির্বাচনের পরে একের পর এক হিন্দুত্ববাদী এজেণ্ডাকে চরিতার্থ করা হয়েছে - রামমন্দির, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ, নাগরিকত্ব আইন - সবই বাস্তবায়িত। দেশে বিজেপি প্রায় একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। মানুষ তবু তাদের ভোট দিয়ে চলেছেন, একের পর এক নির্বাচনে তারা জয়ী হচ্ছে। এমতাবস্থায় তাদের সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আর ঢাক ঢাক গুড় গুড় করার প্রয়োজনীয়তা নেই। অতএব ২০১৪ সালে মোদীর আপাত সংবেদনশীলতার মুখোশ খুলে ফেলে অমিত শাহ সরাসরি ২০০২ সালে তাদের কৃতিত্বের জন্য ভোট চাইছেন। সেই কৃতিত্বটি কী, তা তাদের সমর্থক এবং বিরোধী উভয়েরই বুঝতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বিগত বহু দশক ধরে গুজরাটে বিজেপি সরকার চালিয়েছে। অথচ নির্বাচনের প্রাক্কালে দুই দশক আগের দাঙ্গার কথা মানুষকে তাদের স্মরণ করাতে হচ্ছে। এই হিংস্র রাজনীতিই বিজেপি তথা আরএসএস-এর বৈশিষ্ট্য।
এই দানবীয় রাজনীতি শুধু অতীতের দিকে তাকিয়ে হচ্ছে না। বিজেপি-র নির্বাচনী ইস্তেহারে লেখা হয়েছে যে ক্ষমতায় এলে তারা 'উগ্রবাদ বিরোধী বিভাগ' গঠন করবে (Anti-Radicalization Cell)। এমনকি গুজরাটের জন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আইন সেখানে প্রবর্তিত করা হবে বলে ইস্তেহারে বলা হয়েছে। একদিকে বিজেপি বড় গলায় ‘গুজরাট মডেল’-এর কথা বলে থাকে যা নাকি গোটা দেশের অর্থব্যবস্থার জন্য আদর্শ স্বরূপ। কিন্তু শুধুমাত্র বিকাশের নামে ভোট চাওয়ায় তারা বিশ্বাসী নয়। এর প্রধান কারণ এই যে বিগত ৮ বছরে নরেন্দ্র মোদী সরকারের জমানায় আর্থিক প্রগতির নিরিখে বলার মতন বিশেষ কোনো কথা বিজেপি-র নেই। অতএব, তাদের ফিরতেই হয় তাদের হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আশ্রয়ে। এই হিন্দুত্ববাদী এবং নব-উদারবাদী আখ্যানের বিপ্রতীপে বিরোধী শিবির এখন অবধি দেশের মানুষকে নতুন কোনো আন্দোলন নির্ভর বিকল্প পথ দেখাতে পারেনি। প্রগতিশীল শিবির এখনও সেই বিকল্পের অপেক্ষায় রয়েছে।