আরেক রকম ● দশম বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২২ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

বিকল্প বিচার ব্যবস্থার সন্ধানে

অশোক সরকার


এক বন্ধু জিগ্যেস করেছিল, “আমি একটা মামলা করব - সম্পত্তির মামলা - ফয়সালা হতে কতদিন লাগবে বলতে পারিস?” তাকে সহজ কথায় গবেট ছাড়া কি বলব! এটা কি ট্রেন না এয়ারপ্লেন যে কোথা থেকে কখন ছাড়বে, কখন কোথায় দাঁড়াবে, আর গন্তব্যে কখন পৌঁছবে আগে থেকেই লেখা আছে, এবং তা মেনেই চলা হয়! মামলা কি সেই নিয়মে চলে নাকি। মামলা করলে কবে তা আদালতে উঠবে, কতবার শুনানি হবে, আর কবে ফয়সালা হবে, জ্যোতিষীও বলতে পারবে না।

“তাহলে কে বলতে পারবে?” বন্ধু ছাড়ার পাত্র নয়। বললাম, কে বলতে পারবে জানি না, তবে কি বলা যায় তা কিছুটা জানি। যেমন এই মুহূর্তে, সারা দেশে জেলা ও তার নিচের স্তরের আদালতগুলিতে ৪ কোটি ২৭ লক্ষের বেশি মামলা ঝুলে আছে। পশ্চিমবঙ্গে এই সংখ্যা ২৬ লক্ষ ৭৬ হাজার, যার মধ্যে ৫ লক্ষ মামলা ৩ থেকে ৫ বছরের পুরনো, ৬ লক্ষ মামলা ৫ থেকে ১০ বছরের পুরনো, ৪ লক্ষ মামলা ১০-২০ বছরের পুরনো। এইসব মামলাগুলির মধ্যে তিন ভাগেরও বেশি হল ফৌজদারি মামলা, এক ভাগ মত দেওয়ানি মামলা। শুনে বন্ধু একটু আশান্বিত, বলে “ও তাহলে আমারটা যেহেতু দেওয়ানি মামলা, তাহলে তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি হবে”। তথ্য কিন্তু ঠিক তা বলে না। শতকরা হিসাবে দেখলে, ঝুলে থাকা দেওয়ানি মামলা আর ফৌজদারি মামলার বাৎসরিক খতিয়ান প্রায় একই ধরনের। শুধু তাই নয়, গত মাসে (অক্টোবর ২০২২) এই রাজ্যের সমস্ত জেলা ও তার নিচের স্তরের আদালতগুলিতে ৭১ হাজার মামলা দায়ের হয়েছে, ফয়সালা হয়েছে ৫২ হাজার মামলা। অর্থাৎ ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যা শুধুই বাড়ছে। এইসব শুনে বন্ধু একটু দমে গেল। এবার তার বাস্তব প্রশ্ন, “৩ বছরের মধ্যে কত মামলা নিস্পতি হয়েছে বলতে পারিস” তথ্য বলছে ৫৯ ভাগ মামলা, আরও ১৯ ভাগ মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে, কাজেই “তুই ধরে নিতে পারিস, গড়ে সাড়ে তিন থেকে ৪ বছরের মধ্যে তোর মামলার নিষ্পত্তি হয়ে যাবে”।

বন্ধু হতাশ হয়ে ফোন ছেড়ে দিল। আর আমি ভাবতে বসলাম। মামলা ঝুলে থাকে শুধু কি জজের সংখ্যা পর্যাপ্ত নয় বলে? সাধারণত সেটাই সবাই মনে করে। সারা দেশের হিসাবে প্রতি এক লাখ জনসংখ্যায় সব রকম আদালত মিলিয়ে দুই জন জজ আছেন বলে জানা যাচ্ছে। ২০২০-র হিসাব অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে জেলা ও তার নিচের স্তরের আদালতগুলিতে জজের শুণ্যপদের পরিমাণ শতকরা দশ ভাগেরও কম। তুলনায় হাইকোর্টে জজের শুণ্যপদ প্রায় ৫০ ভাগ। সাম্প্রতিককালে এই নিয়ে জন পরিসরে যত আলোচনা হয়েছে, তাতে মামলা ঝুলে থাকার জন্য শুণ্যপদকেই দায়ী করা হয়।

কিন্তু সত্যিই কি তাই? সব জেলায় কি জনসংখ্যার একই অনুপাতে মামলা হয়? দক্ষিণ ২৪ পরগনা-র জনসংখ্যা ২০১১-র সেন্সাস অনুযায়ী ৮১ লাখ, মামলার সংখ্যা ৩ লক্ষ ৮৫ হাজার, মানে প্রতি লাখ জনসংখ্যায় ৪৭৫৩টি মামলা আদালতে আছে। অন্যদিকে মুর্শিদাবাদের জনসংখ্যা ৭১ লাখ, প্রতি লাখ জনসংখ্যায় ২৬৬৬টি মামলা আছে আদালতে, বীরভূমে ৩৫ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে একই হিসেবে আছে লাখে ১৮১১টি মামলা, পূর্ব বর্ধমানে ৪৮ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে লাখে ১৫৬১টি। মুল কথাটা এই যে সব জেলায় জনসংখ্যার অনুপাত অনুযায়ী মামলার সংখ্যা সমান নয়। জটিলতা আরও আছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ২৫ ভাগ মামলা ৫-১০ বছর ঝুলছে, আর ২০ ভাগ মামলা ১০-২০ বছর ঝুলছে, সেখানে মুর্শিদাবাদে ২৮ ভাগ মামলা ৫ থেকে ১০ বছর ঝুলছে আর মাত্র ১১ ভাগ মামলা ১০-২০ বছর ঝুলছে, পূর্ব বর্ধমানে গেলে দেখতে পাব মাত্র ৮ ভাগ মামলা ১০ থেকে ২০ বছর ঝুলছে। অর্থাৎ কোন জেলায় কোন হারে মামলার নিষ্পত্তি হয়, তাও এক রকম নয়।

এই ছবিটা শুধু পশ্চিমবঙ্গের নয়, সারা দেশের। 'ন্যাশনাল জুডিশিয়াল ডাটা গ্রিড' নামে একটি তথ্য ভাণ্ডার আছে, যেখানে সব রাজ্যের কোথায় কত মামলা ঝুলে আছে, কি ধরনের মামলা কি কারণে ঝুলে আছে, কত মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে, কত মামলা দায়ের হচ্ছে, সব একসঙ্গে দেখতে পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায় সব রাজ্যেরই কিছু জেলায় জনংখ্যার অনুপাতে মামলার সংখ্যা অনেক বেশি, কোনও জেলায় বেশ কম। দীর্ঘ সময় ধরে ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যাও জেলায় জেলায় অনেক আলাদা। ল-কমিশন এই বিষয়টা বুঝতে পেরেছিল, এবং তাদের সুপারিশ ছিল, যে মামলার নিষ্পত্তির হার ও জনসংখ্যার অনুপাতে মামলার সংখ্যা হিসেব করে জজের প্রয়োজন নির্ধারণ করতে হবে। কোন সরকারই এইদিকে এগোয়নি।

বিচার ব্যবস্থার সার্থকতার একটা মাপকাঠি হল তৎপরতা, যার পরিচিত অন্য নাম 'justice delayed is justice denied'. এতক্ষণ যা কথা হল তার সবটাই তৎপরতা সংক্রান্ত। তৎপরতার কারণেই আদালতের পাশাপাশি ট্রাইবুন্যাল আছে, আছে লোক আদালত, ক্রেতা সুরক্ষা আদালত, ফাস্ট-ট্রাক আদালত। কিন্তু তৎপরতাই বিচারের একমাত্র মাপকাঠি নয়। আরও দুটি মাপকাঠি আছে। ন্যায়বিচারের দ্বার কি সবার কাছে খোলা? আর ন্যায়বিচারের খরচা কি সবার আয়ত্তে? খাতায় কলমে ন্যায়বিচারের দ্বার সবার জন্যই খোলা কিন্তু সবাই জানি আসলে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণে এই দ্বার উন্মুক্ত নয়, সেইজন্যই নানা জেলায় জনসংখ্যার তুলনায় মামলার সংখ্যায় এত হেরফের হয়ে থাকে। ২০১৫-২০১৬ সালে ২৪টি রাজ্যে, ১৭০টি জেলায় ৯৩০০-র বেশি উত্তরদাতাদের নিয়ে ‘Access to Justice’ বিষয়ে একটা সার্ভে হয়েছিল। তাতে দেখা যাচ্ছে মামলাকারীদের মধ্যে মাত্র ১৫% মহিলা, ১১% দলিত, ৩% আদিবাসী। ৫০% মামলাকারী দশ ক্লাস বা তার চেয়ে বেশি পড়েছেন। প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত পড়েছেন বা আদৌ কোন স্কুলে যাননি, এমন মানুষের সংখ্যা ২৮%।

ওই সার্ভেতে বিচারের খরচার কথাও এসেছে, দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন একজন অভিযুক্তের খরচা যাছে ১,২০০ থেকে ১,৫০০ টাকার মত যার মধ্যে আদালতের খরচা, আর তার নিজের রোজগারের ক্ষতি - দুইই আছে। একটু কম খরচা হচ্ছে মামলাকারীর, কিন্তু দুই পক্ষ মিলিয়ে দৈনিক ২১০০ টাকা মত খরচা হয়। যাদের রোজগার বার্ষিক এক লাখ টাকার কম তারা একটি মামলা নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত ১০,০০০ টাকা, এক থেকে তিন লাখ টাকা আয়কারিদের একটি মামলার নিষ্পত্তির জন্য ১৬,০০০ টাকা মত খরচা হচ্ছে। স্বাভাবিক, যে বেশিরভাগ মানুষের পক্ষেই তা সম্ভব নয়।

এই প্রসঙ্গে বিকল্প বিচার ব্যবস্থার কথা ওঠে। বিকল্প বিচার ব্যবস্থার মুল উদ্দেশ্য হল, বিচারের দ্বার প্রশস্ত করা, বিচার ত্বরান্বিত করা, বিচারের খরচা সাধারণ মানুষের আয়ত্তের মধ্যে রাখা এবং সেই সঙ্গে সুবিচারের পদ্ধতি-প্রক্রিয়া উন্মুক্ত রাখা। এই চারটি মূল উদ্দেশ্য মাথায় রাখলে দুটি বিকল্প ব্যবস্থা যথেষ্টই সফল হয়েছে এবং সফল হবার সম্ভাবনা রাখে কিন্তু জন পরিসরে তা নিয়ে আলোচনা হয় না।

তার একটা হল বিহারের ২০০৬-এর ন্যায় পঞ্চায়েত আইনের বলে তৈরি গ্রাম কাছারি। গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানের মত, একজন গ্রাম কাছারির সরপঞ্চ নির্বাচিত হন, একই সঙ্গে নির্বাচিত হন কয়েকজন পঞ্চ। বিহারে ৮৪৬৩টি গ্রাম কাছারি আছে। নির্বাচিত গ্রাম কাছারিকে সহায়তা করতে একজন সরকার প্রদত্ত ন্যায়মিত্র আছে, যিনি আইন পাস। এই গ্রাম কাছারি ব্যবস্থা মূলত ছোটোখাটো মামলার জন্য নির্ধারিত। দিওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা - দুইই বিচার করতে পারে, করেও। ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে ভারতীয় দণ্ডবিধির কয়েকটি ধারা-র মামলাই গ্রাম কাছারি নিষ্পত্তি করতে পারে। এই কাছারিতে উকিল লাগে না, বাদী-বিবাদী সরাসরি বিচারকের সঙ্গে কথা বলে। গ্রাম কাছারিগুলি কেমন কাজ করছে, তাই নিয়ে খুবই কম গবেষণা হয়েছে। সম্প্রতি সঠিকভাবে নির্বাচিত ১৫টি জেলার একটি করে, মোট ১৫টি গ্রাম কাছারি-র কাজকর্ম বিশ্লেষণ করেছেন একটি সংস্থা, যাঁদের রিপোর্ট অবাক করে দেবার মত। রাজ্য সরকারের পঞ্চায়েতি রাজ বিভাগের রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৬ থেকে ২০২১-এর মধ্যে ৬৬২৩ গ্রাম কাছারিতে ২.২৩ লক্ষ মামলা হয়েছে, এবং তার মধ্যে ২.০৫ লক্ষ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। ন্যায় পঞ্চায়েত আইনে লেখাই আছে যে ৬ সপ্তাহের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি করতে হবে। যে ১৫টি গ্রাম কাছারি বিশদে দেখা হয়েছে সেখানে ৬ থেকে ৮ সপ্তাহের মধ্যে ৯০ ভাগ মামলাগুলির নিষ্পত্তি হচ্ছে। প্রতিটি গ্রাম কাছারি এই পাঁচ বছরে ১০০-১৫০টি দেওয়ানি মামলা ও ১৫০-২৫০টি ফৌজদারি মামলা হাতে পেয়েছে। অন্য আদালতের মতই এখানেও পারস্পরিক বোঝাপড়ায় নিষ্পত্তি আর ট্রায়াল করে নিষ্পত্তি - দু'রকম ব্যবস্থাই আছে। দেখা যাচ্ছে মাত্র ১০-১২ ভাগ মামলা ট্রায়ালে যাচ্ছে বাকি পারস্পরিক বোঝাপড়ায় নিষ্পত্তি হয়েছে। গবেষকরা দেখেছেন গ্রাম কাছারিতে প্রতিটি মামলার পুরো রেকর্ড আছে, বাদী-বিবাদীর সওয়াল যতটা সম্ভব তাদের বয়ানে লেখা আছে। মামলা করতে ১০০ টাকা খরচা হবার কথা সে জায়গায় অনেক সময়ই ২০০ টাকা খরচা হচ্ছে। কখনো ২৫০ টাকাও, তবে সাধারণত তার বেশি নয়।

বিচার ব্যবস্থার তৎপরতা, বিচারের দ্বার, ও বিচারের খরচা - ওই তিনটি বিষয়েই বিহারের ন্যায় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা একটি বিশেষ নজির রাখতে পেরেছে। তাই বলে এর দুর্বলতা কি নেই? অবশ্যই আছে। প্রায় ১/৩ ভাগ ন্যায়মিত্র পদ খালি আছে। গত আট বছরে গ্রাম কাছারির প্রধান (সরপঞ্চ), উপ সরপঞ্চ নির্বাচন হয়নি, অর্ধেকের বেশি গ্রাম কাছারি-র নিজস্ব অফিস নেই। সরপঞ্চ, সচিব, ন্যায়মিত্ররা যে সামান্য ভাতা পান, তা ঠিক সময়ে পান না। তাঁদের প্রশিক্ষণ সেই কবে একবার হয়েছিল, তারপর আর হয়নি। গ্রাম কাছারিতে কেস ফি, পেনাল্টি ইত্যাদি বাবদ যে টাকা জমা পড়ে, তা সরকারের কোষাগারে চলে যায়, সেই টাকা-র একটুও গ্রাম কাছারি খরচা করতে পারে না। ১৫টি গ্রাম কাছারি-র মধ্যেই এমন একটা দুটো উদাহরণ পাওয়া গেছে যেখানে সরপঞ্চ প্রায় অকেজো হয়ে গেছেন ফলে সেখানে মামলার সংখ্যা খুবই কম।

ন্যায়মিত্রের অভাবটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিচারের গুনমান চারটি মাপকাঠিতে দেখা যায়। এক, মামলার মূল বিষয়টির সুস্পষ্ট লিখিত বয়ান, দুই, বিচারের সম্ভাব্য ফলাফল কি হতে পারে তার বয়ান, তিন, মামলার নিষ্পত্তি হলে সেই অর্ডারের সুস্পষ্ট বয়ান, এবং চার, অর্ডারের সঙ্গে অর্ডারের পিছনের যুক্তিগুলির সুস্পষ্ট রেকর্ড। গবেষকরা দেখেছেন যেখানে ন্যায়মিত্র আছে সেখানে এই চারটি দিকই বেশ উন্নত, যেখানে ন্যায়মিত্র নেই, সেখানে প্রথম ও দ্বিতীয়টা বেশ দুর্বল, কিন্তু অর্ডারের বয়ান যথেষ্টই সুস্পষ্ট, তবে কিছু কারণ ব্যাখ্যা সুস্পষ্ট নয়। কিন্তু গ্রামে কথা বলে গবেষকরা দেখেছেন যে সাধারণ মানুষ গ্রাম কাছারি ব্যবস্থায় যথেষ্টই সন্তুষ্ট, যদিও ন্যায়মিত্রের অভাবের কথা তাঁরাও তুলে ধরেছেন।

বিহার ছেড়ে অন্য রাজ্যের দিকে তাকালে দেখব প্রায় ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে ৮টি রাজ্যে প্রায় ১০০টি জেলায় প্রায় ৪২,০০০-এর বেশি গ্রাম নিয়ে অন্য একটি বিকল্প বিচার ব্যবস্থা ব্লক স্তরে কাজ করে চলেছে, যার নাম নারী আদালত। নারী আদালত প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়েছিল গুজরাতের ভদোদরায় ১৯৯৫ সালে, কিন্তু তার পরে গুজরাত, কর্ণাটক, উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ ও অন্যান্য কিছু রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময়ে বয়স্ক শিক্ষার প্রতি সরকারের নজর ছিল, সেই সূত্রে প্রথমে তিনটি, পরে মোট ৮টি রাজ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে মহিলা সমাখ্যা নামক একটি গ্রামীণ মহিলা শিক্ষা ও সশক্তিকরণ কর্মসূচি রূপায়িত হয়েছিল। নারী আদালত সেই কর্মসূচির অঙ্গ ছিল। ২০১৫ সালে এই কর্মসূচি বন্ধ করে দেওয়া হয়, কিন্তু নারী আদালত এখনো দিব্যি চলছে।

বিহারের গ্রাম কাছারির মত আইনের ভিত্তি নারী আদালতের নেই, কিন্তু আইনের ভিত্তি না থাকলেও একটা ব্যবস্থা যখন জনহিতের কাজে লাগে তখন তার সামাজিক ভিত্তি তৈরি হতে বাধ্য। মহিলা সমাখ্যার সাংগঠনিক সামর্থ্যে ব্লক স্তরে যে মহিলা সংগঠনগুলি গড়ে ওঠে, তার অঙ্গ হিসেবে কিছু মহিলাকে বেছে নিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে আইনের ধারনায় ও প্রয়োগে প্রশিক্ষিত করে তোলা হয়। তাঁদের প্রায় এক বছর ধরে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। মূলত মহিলাদের প্রতি যে সব অন্যায় গ্রাম জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ - যেমন গার্হস্থ হিংসা, পণ হিংসা, জোর করে কমবয়সী মেয়েদের বিয়ে দেওয়া, সন্তান-জন্ম না দিতে পারলে ঘর থেকে বের করে দেওয়া, সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা ও অন্যান্য অনেক ধরণের অভিযোগের নিষ্পত্তি করার ব্যবস্থা আছে এই নারী আদালতের আওতায়। গ্রামীণ মহিলাদের কাছে এই আদালতগুলি শুধু সুবিচার নয়, একটা সহায় ব্যবস্থার মত।

গ্রাম কাছারির সঙ্গে নারী আদালত ব্যবস্থার কয়েকটি মিল আছে, যেমন নারী আদালতে শুধু একবার ফি দিতে হয় ৩০০ টাকা। বাদী ও বিবাদী পক্ষ আদালতের সামনে সরাসরি কথা বলে, উকিল লাগে না। অভিযোগের নিষ্পত্তি হয় কয়েক সপ্তাহের মধ্যে। তফাতও আছে। যেমন কোন মহিলা এসে নারী আদালতে অভিযোগ জানাতেই পারেন, বিবাদী পক্ষ সেই অভিযোগে কান দেবেন কেন? নারী আদালতের সব ‘বিচারক’ই গ্রামীণ নারী, গ্রাম সমাজের পুরুষতান্ত্রিক শক্তি তাঁদের মানবেন কেন? যে সমাজের বিধি হল হল ‘ঘরের কথা ঘরেই থাকবে, বাইরে বেরবে না’, সেই সমাজে কোন মহিলা ঘরের কথা নারী আদালতে নিয়ে গেছেন সেটাই তো অপরাধ যোগ্য, আসল অপরাধ সেখানে ঢাকা পড়ে যায়।

নারী আদালতের প্রতি সামাজিক আস্থা ও সমীহ তৈরি করা সহজ কাজ ছিল না। মহিলা সমাখ্যার সাংগঠনিক শক্তিকে তাই মাঠে নামতে হয়েছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে পাঁচ থেকে ছয় বছর লেগেছে, এই সামাজিক শক্তি অর্জন করতে। যেখানে জেলা ও ব্লক স্তরের সরকারি ও পুলিশি ব্যবস্থার সহায়তা পাওয়া গেছে সেখানে কাজটা সহজ হয়েছে। ক্রমশ দেখা গেছে পুরুষেরাও তাঁদের অভিযোগ নিয়ে আসতে শুরু করেছেন নারী আদালতে। তাঁরা দেখেছেন, নারী আদালতগুলিতে সরাসরি কথা বলা যায়, উকিলের খরচা, আদালতের নিয়মিত খরচা এড়ানো যায়, এবং মোটামুটিভাবে সু-মীমাংসায় পৌঁছানো যায়। আদর্শ ন্যায়বিচারের গ্যারান্টি তো কোন আদালতই দেয় না, তার বদলে গ্রহণযোগ্য মীমাংসাই বিধেয়।

নারী আদালতের কাজের ধারা মোটামুটিভাবে সব জেলাতেই একই রকম। এঁরা মাসে দুটো দিন ১৪ আর ১৫ তারিখ বসেন অভিযোগ শুনতে, তা নথিবদ্ধ করতে। আর ২৯ ও ৩০ তারিখ বসেন শুনানিতে। তার মাঝখানে নারী আদালতের সদস্যরা অভিযোগকারিণীর ও অভিযুক্ত-র বাড়ি যান, অভিযোগ সম্পর্কে অনুসন্ধান করেন, অভিযুক্তকে শমন দেন। যদি অভিযুক্ত নারী আদালতকে অবজ্ঞা করেন, তাহলে ব্লক স্তরের আধিকারিক, গ্রাম পঞ্চায়তের প্রধান, বা পুলিশের সাহায্যে তাঁকে শমন মানতে বাধ্য করা হয়। তাতেও না হলে, গ্রামে গিয়ে খোলা আদালত বসে।

বিহারের গ্রাম কাছারি-র তুলনায় নারী আদালত নিয়ে কিছু ভাল গবেষণা ও লেখালেখি হয়েছে। সেগুলি থেকে একটা কথা পরিষ্কার - গ্রামীণ মহিলাদের কাছে নারী আদালতের মূল্য অপরিসীম, কারণ তা একই সঙ্গে মহিলাদের সাহস যোগায়, সহায়তা যোগায়, এবং সুবিচারের ব্যবস্থা করে। মহিলা সমাখ্যা কর্মসূচি বন্ধ হয়ে গেলেও নারী আদালত যেখানে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সেখানে আপন শক্তিতেই চলছে এটাই প্রমাণ করে, মহিলাদের কাছে তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

তৃতীয় যে উদাহরণ এখানে দিতে চলেছি, তাকে বিকল্প বিচার ব্যবস্থা না বলে মুল বিচার ব্যবস্থাকেই তৃণমুল স্তরে নিয়ে যাবার চেষ্টা বলা উচিত। ২০০৮ সালে লোকসভায় গ্রাম ন্যায়ালয় আইন পাশ হয়। সেই আইন অনুযায়ী সব রাজ্যেই পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে একটা গ্রাম ন্যায়ালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলা আছে। সেটি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি যোজনাও আছে, যার নাম গ্রাম ন্যায়ালয় যোজনা। আজ পর্যন্ত ১০টি রাজ্যে ২৬৪টি ব্লকে ন্যায়ালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে, যার মধ্যে শুধু সংখ্যার বিচারে রাজস্থান মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশেই আছে মোট ১৮৫টা। পশ্চিমবঙ্গে এই ব্যবস্থা এখনো চালু হয়নি। এই ন্যায়ালয়গুলিতে ফার্স্ট ক্লাস জুডিশিয়াল মাজিস্ট্রেটের স্তরের একজন জজ আছেন, যাকে হাইকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে রাজ্য সরকার নিয়োগ করেন। গ্রাম ন্যায়ালয়গুলি প্রতিষ্ঠাও হয় হাইকোর্টের সঙ্গে রাজ্য সরকারের পরামর্শে, তবে রাজ্য সরকারকেই উদ্যোগ নিয়ে হয়। এখানে মামলা-মোকদ্দমা উকিল দিয়েই হয়। বাদী-বিবাদী - দু'পক্ষকেই উকিল নিয়োগ করতে হয়। অর্থাৎ সবদিক থেকেই এটি মুল স্রোতের বিচার ব্যবস্থার একটি তৃণস্তরীয় রূপ।

দেশব্যাপী মামলা মোকদ্দমার যে তথ্যভাণ্ডার আছে, তাতে দেখা যাচ্ছে আজ পর্যন্ত, মোট ১৮,৯০০ দেওয়ানি মামলা এসেছে এই আদালতগুলিতে কিন্তু দুঃখের বিষয় তার মধ্যে ১৮,২২৬টি মামলা ঝুলে আছে, আর মোট ১,৭৫,০০০টি ফৌজদারি মামলার মধ্যে ১,৬৮,০০০টি মামলা ঝুলে আছে! এই সহজ তথ্য থেকে একটা মুল বিষয় আবার প্রমাণ হয়, বর্তমান বিচার ব্যবস্থার গঠনতন্ত্রের মধ্যে ন্যায়বিচারের চারটে মূল লক্ষ্য - বিচারের অবারিত দ্বার, বিচারের খরচা সাধ্যের মধ্যে রাখা, বিচারের তৎপরতা ও আদর্শ ন্যায় বিচার সম্ভব নয়।


তথ্যসূত্রঃ

১) এই তথ্যগুলি 'নাশান্যাল জুডিশিয়াল ডাটা গ্রিড' থেকে নেওয়া।
২) https://prsindia.org/theprsblog/understanding-vacancies-in-the-indian-judiciary
৩) https://www.livemint.com/opinion/columns/judicial-delays-and-the-need-for-intervention-at-the-district-level-11653237233189.html
এই লেখায় দেশের কোন জেলায় কত মামলা ঝুলে আছে তার একটা সুন্দর ম্যাপ পাওয়া যায়।
৪) file:///Users/ashoksircar/Desktop/Daksh-access-to-justice-survey.pdf pages 6, 14, 15
৫) উপরের তথ্যগুলি সিগমা ফাউন্ডেশন কলকাতা পরিচালিত ২০২২-র বিহার গ্রাম কাছারি স্টাডি থেকে গৃহীত।
৬) Indian journal of Social Work, Volume 77, Issue-1, 2016, Manju Agarwal and Kakul Hai, “Women Courts: An alternative justice system for women”; “Women Initiated Community Led responses to Domestic Violence: Summary of Three Studies,” ICRW, India 2002; https://dashboard.doj.gov.in/gn/operational_gram_nyayalaya