আরেক রকম ● দশম বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২২ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯

সমসাময়িক

ব্রাজিলে নতুন বসন্ত


হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে জিতে তৃতীয়বারের জন্য ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট হলেন লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা। এই নির্বাচনে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো পান ৪৯.১ শতাংশ ভোট। এদিকে জয়ী লুলা পান ৫০.৯ শতাংশ ভোট। ব্রাজিলে এই প্রথম কোনও প্রার্থী প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন নির্বাচনে হেরে গেলেন। এর আগে ২০০৩ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন লুলা। ২০২২ সালে তিনি নির্বাচনে জিতে শুধুমাত্র ঘুরেই দাঁড়ালেন না বরং দেশের সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচিত হলেন।

চিলিতে গ্যাব্রিয়েল বরিক, কলম্বিয়াতে গুস্তাভো পেত্রো, হন্ডুরাসে জিওমারা ক্যাস্ত্রো, ভেনিজুয়েলাতে নিকোলাস মাদুউরো, বলিভিয়াতে লুইস আরসে, আর্জেন্টিনায় আলবার্তো ফার্নান্দেজ, পেরুতে ইউনিয়ন লিডার পেদ্রো কাস্তিলোর পর লুলা দা সিলভার হাত ধরে ব্রাজিলেও বামপন্থী সরকার আসা এটাই প্রমাণ করে যে নতুন যেই মিলেনিয়াল ল্যাটিনোরা ক্ষুধা, দারিদ্র, ফ্যাসিজম, ড্রাগস, অসমতা, নির্যাতন, ইউরোপিয়ান আর আমেরিকান কর্পোরেশন দ্বারা নিজেদের মাটি, ঘর, বন আর নদীর ধ্বংস হওয়া দেখতে দেখতে বড় হয়েছেন, তাঁরা লাল বেছে নিচ্ছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। বামে এই মোড় নেয়াটা বেঁচে থাকার তাগিদে, অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, অবশ্যই পরিবর্তনের আশায়। যদিও এই হুড়মুড় করে বামেদের দেশে দেশে ক্ষমতায় আসা, যাকে বলা হচ্ছে 'পিঙ্ক টাইড' এবং যার ফলে লাতিন আমেরিকার ৯০ শতাংশ অঞ্চল এখন বামেদের দখলে, এটা নতুন নয়। প্রথমবার পিঙ্ক টাইড এসেছিলো ইভো মোরালেস, হুগো শ্যাভেজ, রাফায়েল কোরেয়া, মিশেল বাসলেদের ল্যাটিন জয় করা মাধ্যমে। লুলা দা সিলভা এই অরিজিনাল পিঙ্ক টাইডের নেতাদেরই একজন। তাঁর প্রত্যাবর্তন দেখিয়ে দিল, এভাবেও ফিরে আসা যায়!

কট্টর দক্ষিণপন্থী বলসোনারোর এই হার ব্রাজিলকে স্বস্তি দেবে সন্দেহ নেই, আর সমগ্র লাতিন আমেরিকা জুড়ে লেফট ব্লক নির্মাণের দিকেও এক ধাপ এগিয়ে যাবে, যা নয়া উপনিবেশ ও মার্কিনি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটা বিশাল অগ্রগতি। তাই বহু বছর ধরে সাম্রাজ্যবাদীরা প্রায় জ্যান্ত কবরই দিতে চেয়েছিল লুলাকে। তাঁর কণ্ঠরোধ রোধ করে, দুর্নীতির অভিযোগে জেলে ঢুকিয়ে (যা প্রমাণ করা যায়নি), লুলার দলের বহু কর্মী-সমর্থককে চোরাগোপ্তা খুন করে ইয়াংকি সাম্রাজ্যবাদ তাদের পোষা পুতুল বলসেনারোর মাধ্যমে নিজেদের ঘাঁটি শক্ত করতে চেয়েছিল। তারই সূত্র ধরে গত কয়েক দশকে আমরা দেখেছি পুঁজিবাদ ও এক নব্য সাম্রাজ্যবাদের চোখরাঙানি! বাড়ছে বেকারত্ব, মধ্যযুগীয় ভৃত্য-মনিব সম্পর্ক এবং ধর্ম-বর্ণের উপর ভিত্তি করে বিষ ছড়ানো। পরিবেশকে খামখেয়ালি ভাবে ব্যবহার করেছেন বিশ্বের ক্ষমতাবানরা। এই সময় ব্রাজিলে লুলার প্রত্যাবর্তন, ও তার সঙ্গে প্রায় সমগ্র একটা মহাদেশে শ্রমজীবী মানুষের হয়ে লড়াই করতে চাওয়া বামপন্থীদের ফিরে আসা কি তৃতীয় বিশ্বকে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে। কারণ মনে রাখতে হবে লুলা যে সময়ে ক্ষমতায় ফিরছেন, তখন ব্রাজিলের ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ তীব্র মাত্রার অনাহারে ভুগছে, আর দারিদ্র্য সীমার মধ্যে আছে দেশটির ১০ কোটি মানুষ। বলসোনারোর নেওয়া কট্টর ডানপন্থী নীতিমালাগুলো বিশেষ করে, আমাজন বন সংক্রান্ত নীতি ব্রাজিলকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।

ব্রাজিলকে একসময় প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হতো। গত দুই দশকের বেশির ভাগ সময়জুড়ে, বিশেষত লুলার শাসনকালে, আদিবাসীদের ভূমি সংরক্ষণ, অবৈধভাবে বন উজাড়কারীদের ধরপাকড়, কী পরিমাণ বনাঞ্চল ধ্বংস হচ্ছে তা আরও বেশি করে পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি নীতি গ্রহণ করতে দেখা গিয়েছিল। এসব পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে বন ও জঙ্গলa ধ্বংসের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছিল তখন। কিন্তু ২০১৯ সালের শুরুর দিকে জইর বলসোনারো ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ক্রমাগত আমাজন জঙ্গল ধ্বংসের হার বাড়তে দেখা গেছে। বলসোনারো ব্রাজিলের পরিবেশের সুরক্ষাজনিত পদক্ষেপগুলো কমিয়ে ফেলেন, বিজ্ঞান ও পরিবেশগত সংস্থাগুলোতে খরচ কমিয়ে দেন, পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের বরখাস্ত করেন এবং আদিবাসীদের ভূমির অধিকার কাড়বার উদ্যোগ নেন। গত বছর আমাজন জঙ্গলের প্রায় ১০ লাখ হেক্টর এলাকা আগুনে পুড়ে গেছে। সেপ্টেম্বরে বনে আগুনের মাত্রা এতটাই বেড়েছিল যা এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবু হাত গুটিয়ে রেখেছিল সরকার। তিন বছরে আমাজন জঙ্গলের ৩৪ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা উজাড় হয়েছে।

এমন সময়ই প্রথমবারের মতো ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন লুলা। ২০০৪ সালেও পরিবেশ বিপর্যয়ের ধারাবাহিকতা দেখা গিয়েছিল। লুলা শক্ত হাতে তা দমন করেন। তিনি এবারের নির্বাচনী প্রচারের কেন্দ্রেও রেখেছিলেন আমাজনের সুরক্ষাকে। এর আগে প্রেসিডেণ্ট থাকা অবস্থায় আমাজনকে রক্ষা করতে লুলা প্রচুর সদর্থক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। বস্তুত পরিবেশরক্ষার আন্দোলন যে বাম গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও অধিকার লড়াইয়ের প্রথম সারিতে থাকবে তা দেখিয়েছিলেন লুলা। কাজেই তাঁর এই জয় শুধুমাত্র দক্ষিণপন্থার পশ্চাদপসরণ অথবা লেফট ব্লকের বিজয়সূচকই নয়, জলবায়ু রক্ষার আন্দোলন, আদিবাসীদের অধিকার ইত্যাদি প্রশ্নে এক বড় দিকচিহ্নও বটে। এ বিজয় তথাকথিত এককেন্দ্রীক, সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর, কর্পোরেট স্বার্থের বিপরীতে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, পরিবেশ রক্ষা, লাতিন আমেরিকাসহ বিশ্বের শোষিত-নিপীড়িত মানুষের সংগ্রামকে সাহস যোগাবে, উৎসাহিত করবে।