আরেক রকম ● দশম বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২২ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯

সমসাময়িক

মাতৃভাষা সমীক্ষা


ভারতের রেজিস্ট্রার জেনারেল এবং সেন্সাস কমিশনারের দপ্তরের উদ্যোগে দেশের ৫৭৬টি ভাষার ক্ষেত্র ভিডিওগ্রাফ সহ দেশের মাতৃভাষা সমীক্ষা (Mother Tongue Survey of India) সম্পন্ন করা হয়েছে। "দেশের প্রতিটি মাতৃভাষার যথার্থ উচ্চারণ, কথা বলার শৈলী ইত্যাদি সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করার জন্য, জাতীয় তথ্যবিজ্ঞান কেন্দ্রে (এনআইসি) একটি ওয়েব-আর্কাইভ স্থাপন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে" বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ২০২১-২২-এর সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে৷ প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, রেজিস্ট্রার জেনারেল এবং সেন্সাস কমিশনারের দপ্তর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সংস্থা। প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতের মাতৃভাষা সমীক্ষা হল এমন একটি প্রকল্প যা মাতৃভাষাগুলির সমীক্ষা করে ভাষাগত বৈশিষ্ট্যগুলিও নথিভুক্ত করে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে এনআইসি এবং ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (এনএফডিসি) অডিও-ভিডিও ফাইলে সমীক্ষার আওতায় থাকা মাতৃভাষার ভাষাগত তথ্য নথিভুক্ত এবং সংরক্ষণ করবে। মাতৃভাষার ভিডিও-গ্রাফ করা বিখ্যাত ব্যক্তিদের বক্তৃতাও এনআইসি-র ওয়েব পোর্টালে আপলোড করা হবে।

২০১১-র ভাষাগত আদমশুমারির তথ্যের বিশ্লেষণ অনুসারে, ভারতে প্রায় ১৯ হাজার ৫৬৯টি ভাষা ও উপভাষা মাতৃভাষা হিসাবে অভিহিত। ভারতের রেজিস্ট্রার জেনারেল এবং সেন্সাস কমিশনারের দপ্তরে ভাষাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সম্পাদনা-বিশ্লেষণ করে ১৯ হাজার ৫৬৯টি ভাষা ও উপভাষাকে ১২১টি মাতৃভাষা গোষ্ঠী গড়ে তোলা হয়েছে।

২০১১-র ভাষাগত আদমশুমারি অনুসারে, হিন্দি হল সবচেয়ে ব্যাপকভাবে কথ্য মাতৃভাষা। ৫২ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ বা জনসংখ্যার ৪৩.৬ শতাংশ হিন্দিকে মাতৃভাষা হিসাবে স্বীকার করেছে। পরবর্তী সর্বোচ্চ হল বাংলা, যা ৯ কোটি ৭০লক্ষ মানুষের মাতৃভাষা এবং জনসংখ্যার ৮ শতাংশ।

১৮৭২-এর প্রথম আদমশুমারির পর প্রতি দশ বছরে ভারতে জনগণনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০২১-এ ষোড়শ আদমশুমারির কথা ছিল। কিন্তু কোভিড - ১৯ মহামারীর প্রাদুর্ভাবের কারণে তা স্থগিত করা হয়। দক্ষ প্রক্রিয়াকরণ এবং ডেটা দ্রুত প্রকাশ নিশ্চিত করতে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বলেছে যে এবার কিছু নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল ডেটা প্রক্রিয়াকরণ এবং ভূ-স্থানিক প্রযুক্তির ব্যবহার। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রাক্ আদমশুমারি ম্যাপিং কার্যক্রম যেমন প্রশাসনিক ইউনিটগুলিকে দেখায় এমন মানচিত্র তৈরি এবং আপডেট করা হবে। আদমশুমারির ফলাফল ওয়েব-ভিত্তিক ইন্টার-অ্যাক্টিভ মানচিত্রের মাধ্যমে প্রচার করা হবে।

২০১১-এর আদমশুমারির পর থেকে ২০১৯-এর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে যে অধিক্ষেত্রগত পরিবর্তনগুলি ঘটেছে তা জিও-রেফারেন্সড ডাটাবেসে আপডেট করা হয়েছে এবং ৬ লক্ষেরও বেশি মানচিত্র (জেলা/মহকুমা/ব্লক) তৈরি করে ইন্টারনেটে আপলোড করা হয়েছে।

২০১৮-য় সালে প্রকাশিত ২০১১-র ভাষাগত আদমশুমারির তথ্য অনুসারে ভারতে ১৯ হাজার ৫৬৯টিরও বেশি ভাষা বা উপভাষা মাতৃভাষা হিসেবে কথিত হয়। রেজিস্ট্রার জেনারেল এবং সেন্সাস কমিশনারের মতে যেহেতু একটি পরিবার রক্তের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তি বা অসম্পর্কিত ব্যক্তিদের বা উভয়ের মিশ্রণ নিয়ে গঠিত হতে পারে, তাই সমীক্ষার সময় পরিবারের প্রত্যেককে তার মাতৃভাষা সম্পর্কে প্রশ্ন করা প্রয়োজন। নিঃসন্দেহে এই প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ কারণ একটি পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মাতৃভাষা একই হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এগুলি পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের জন্য আলাদা হতে পারে। ২০১১-র আদমশুমারির মাতৃভাষা সমীক্ষা অনুসারে দেশের ৯৬.৭১ শতাংশ মানুষ সংবিধান স্বীকৃত ২২টি ভাষার মধ্যে একটিকে নিজের মাতৃভাষা হিসেবে উল্লেখ করেছে। বাদবাকি ৩.২৯ শতাংশ মানুষ যে ৫৫৪টি ভাষাকে নিজের মাতৃভাষা হিসেবে জানিয়েছেন সেই ভাষাগুলিতে হাজার দশেক বা তার সামান্য বেশি সংখ্যক মানুষ কথা বলেন।

সংবিধানের অষ্টম তফসিলে ২২টি ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়া আছে। অর্থাৎ সংবিধান স্বীকৃত প্রতিটি ভাষারই সমান মর্যাদা। অসমীয়া, বাংলা, গুজরাটি, হিন্দি, কন্নড়, কাশ্মীরি, কোঙ্কনি, মালয়ালম, মণিপুরি, মারাঠি, নেপালি, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, সংস্কৃত, সিন্ধি, তামিল, তেলেগু, উর্দু, বোড়ো, সাঁওতালি, মৈথিলী এবং ডোগরি। এই ভাষার মধ্যে, ১৪টি প্রাথমিকভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ১৯৬৭-তে সিন্ধি ভাষা যোগ করা হয়। তারপরে আরও তিনটি ভাষা যেমন, কোঙ্কানি, মণিপুরি এবং নেপালি ১৯৯২-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে, ২০০৪-এ বোড়ো, ডোগরি, মৈথিলি এবং সাঁওতালি যোগ করা হয়।

সংবিধানে নির্দিষ্ট কোনো ভাষাকে 'জাতীয় ভাষা' হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। তবে, অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাক্ট ১৯৬৩ অনুযায়ী, সংসদ সহ কেন্দ্রীয় সরকারের কাজে হিন্দি ভাষা প্রচলিত।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এই বার্ষিক প্রতিবেদন আপাতদৃষ্টিতে যে কোনো সরকারি নথির থেকে আলাদা নয়। জন সমীক্ষা করে সংগৃহিত তথ্যের বিশ্লেষণ সম্পৃক্ত বিস্তারিত বিবরণ। কিন্তু ১৯ হাজার ৫৬৯টি ভাষা ও উপভাষাকে ১২১টি মাতৃভাষা গোষ্ঠীতে গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট চিন্তার উপাদান রয়েছে। উত্তর ও মধ্য ভারতের রাজ্যগুলির বাসিন্দাদের সকলের মাতৃভাষা হিন্দি নয়। হরিয়ানভি, রাজস্থালি, বুন্দেলখন্ডি, গারোয়ালি ইত্যাদি ভাষার বর্ণমালা হিন্দি হলেও তাদের ব্যাকরণ ও প্রয়োগবিধি এক নয়। জনসংখ্যার বিচারে সংখ্যাটা কম নয়। কিন্তু মাতৃভাষা গোষ্ঠী গড়ে তোলায় সেই ভাষাগুলির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সুযোগ নেই। একমাত্র হিন্দি ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাকে মাতৃভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়। ফলে হিন্দি ভাষাকে মাতৃভাষার মর্যাদা দেওয়া মানুষের সংখ্যা অনায়াসে অনেক বেশি হয়ে গেছে। এর ফলে হিন্দির আধিপত্য বিস্তারের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান তত্ত্ব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মাতৃভাষা সমীক্ষার সামান্য অবদান ভবিষ্যতে ভাষাগত সমস্যা সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করা হতে পারে।