আরেক রকম ● দশম বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২২ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯

সম্পাদকীয়

দুয়ারে আশঙ্কা


জনসমক্ষে তিনি কম আসেন। বেশি কথা বলায় তাঁর আগ্রহ না থাকলেও তিনি সোজাসাপ্টা কথা বলেন। তাঁর মন্তব্যে কোনো ধোঁয়াশা নেই। নিজের দাবিতে তিনি অবিচল। কোচবিহার নামের পৃথক রাজ্য নিদেনপক্ষে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল স্থাপন তাঁর লক্ষ্য। এবং এই বিষয়ে তিনি স্থিরপ্রতিজ্ঞ। তিনি অনন্ত রায় ওরফে স্বঘোষিত অনন্ত 'মহারাজ'।

তবুও কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদলগুলি তাঁর সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দেশের অমিত পরাক্রমশালী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুয়াহাটিতে রাত কাটিয়ে সকাল সকাল হেলিকপ্টার চড়ে বঙ্গাইগাঁও পৌঁছে গাড়িতে চড়ে চলে যান আসামের চিরাং জেলার প্রান্তিক গ্রাম সতিবরগাঁও। আলোচনা ও প্রাতঃরাশ সেরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিদায় নেওয়ার পর অনন্ত 'মহারাজ' কথা প্রসঙ্গে সেদিন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন যে হঠাৎ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরসূচি নির্ধারিত হয়নি। ২০২১-এর জানুয়ারিতে তিনি দিল্লি গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তখনই উনি মহারাজের কিছু কিছু দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়ে নাকি সম্মতি দিয়েছিলেন। সেইদিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখ চিরাং জেলার সতিবরগাঁও গ্রামে এসে বিস্তারিত কথা বলবেন। দিল্লিতে কথা হয়ে যাওয়ার পরেও শুধুমাত্র প্রাতঃরাশ সহযোগে মাত্র আধ ঘণ্টার আলোচনার জন্য এত পরিশ্রম? এত অর্থ ও সময় বিনিয়োগ?

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও পিছিয়ে নেই। অনন্ত 'মহারাজ' আয়োজিত চিলা রায়ের ৫১২তম জন্মবার্ষিকী উদযাপনের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীকে বিশেষ অতিথি হিসেবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেই মঞ্চ থেকেও আলাদা রাজ্যের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। রাজ্য সরকার আয়োজিত বিজয়া সম্মিলনীর অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির আসন অলঙ্কৃত করেছিলেন অনন্ত 'মহারাজ' ও দার্জিলিং-এর বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতৃবৃন্দ। ভাইফোঁটাতেও 'মহারাজে'র জন্য উপহার পাঠিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। আবার পাল্টা অনন্ত 'মহারাজ' মুখ্যমন্ত্রীকে উপহার পাঠিয়ে তাঁর বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কোচবিহার শহরের রাসমেলায় পুরসভার পক্ষ থেকেও অনন্ত 'মহারাজ'কে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ করা হয়। এবং তিনি উপস্থিত ছিলেন।

রাসমেলার অনুষ্ঠানের দিনকয়েক আগে (৩ নভেম্বর) কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রীর বাড়িতে গিয়েছিলেন 'অনন্ত মহারাজ'। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে অনন্ত বলেন, ‘‘পৃথক রাজ্য হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।’’ যদিও পৃথক রাজ্যের বিষয়ে কোনও মন্তব্যই করেননি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘অনন্ত মহারাজের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। এই বৈঠক ছিল "সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ"। বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রীর দীর্ঘদিনের সম্পর্কের প্রসঙ্গে রাজ্যের শাসকদলের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।

এই শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকেই কোচবিহার জেলাকে পশ্চিমবঙ্গের থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা রাজ্য গড়ে তোলার দাবি নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ‘গ্রেটার কোচবিহার পিপলস্ অ্যাসোসিয়েশন’ (জিসিপিএ) বা চলতি কথায় গ্রেটার। সংগঠনের মূল দাবি, ১৯৪৯ সালে কোচবিহারের ভারতভুক্তির সময় যে চুক্তি হয়েছিল সেটা নাকি মানা হয়নি। ভারত সরকার কোচবিহারকে জেলা করে রেখেছে। কোচবিহারকে আলাদা রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার দাবিতে তিনি অবিচল। শুধু কোচবিহার জেলা নয়, নরনারায়ণ রাজা থাকাকালীন রাজ্যের যে আয়তন ছিল, সেটাই ফেরাতে চায় জিসিপিএ। সংগঠনের দাবি অনুযায়ী, উত্তরবঙ্গের করতোয়া নদী থেকে আসামের বেশ কিছু অংশ নিয়ে গ্রেটার কোচবিহারের দাবিদার তারা। সব মিলিয়ে আসাম, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের তো বটেই বাংলাদেশেরও দুটি জেলা নিয়ে 'নতুন রাজ্য' তৈরির দাবি নিয়ে গ্রেটার যাত্রা শুরু করেছিল।

স্বঘোষিত 'মহারাজ' অনন্ত রায় গ্রেটারের অন্যতম নেতা। অন্য শীর্ষ নেতা বংশীবদন বর্মণ এখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রাজবংশী অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষ। আপাততঃ রাজনীতি থেকে অনেক দূরে তাঁর অবস্থান। 'মহারাজ' অনন্ত কিন্তু সক্রিয়।

গ্রেটারের নেতা অনন্ত রায় স্বঘোষিত ‘মহারাজ’ কোচবিহার শহরের কাছেই চকচকা গ্রামে একটি রাজবাড়িও বানিয়েছিলেন। তাঁর আয়ের উৎস অজ্ঞাত। একটা সময় পর্যন্ত রাজকীয় জীবনযাত্রায় তিনি অভ্যস্ত ছিলেন। অনন্তের অধীনে ‘নারায়ণী সেনা’ নামে পৃথক বাহিনী রয়েছে বলে খবর পায় পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন। সেই বাহিনী ২০১৬ সালের ২৮ অগস্ট (কোচবিহারের ভারতভুক্তি হওয়ার তারিখ) অনন্তকে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়ার পরিকল্পনা করলে তাতে বাধা দেয় রাজ্য সরকার। ‘নারায়ণী সেনা’কে সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী (বিএসএফ) প্রশিক্ষণ দেয় বলেও অভিযোগ করা হয়। যদিও সে অভিযোগ বরাবরই নাকচ করেছে বিএসএফ। অনন্ত রায়ের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়। ফলে ২০২০-র অগস্ট মাসের পর থেকে অনন্ত 'মহারাজ' আর সেখানে থাকতে পারেন না। নানা অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য সেই সময় পুলিশ রাজবাড়িতে হানা দিলে তিনি সপরিবারে পালিয়ে যান। তারপর থেকে আসামের চিরাং জেলার সতিবরগাঁও গ্রামে তাঁর বসবাস। তখন থেকেই সাধারণের সঙ্গে যোগাযোগ একেবারে বন্ধ। অর্থাৎ আইনের ভাষায় অনন্ত 'মহারাজ' একজন ফেরার ব্যক্তি।

কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদল তাঁকে এত প্রশ্রয় দেওয়ার কারণ স্বচ্ছ নয়। একজন ফেরারি ব্যক্তিকে রীতিমতো তোয়াজ করার বিষয়ে দুই পক্ষের প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা চলছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিলেও জনৈক বিচ্ছিন্নতাবাদীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন। এমন আচরণ রহস্যজনক।

কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে অনন্ত 'মহারাজে'র দাবিদাওয়া নিয়ে এখনও পর্যন্ত সরকারি ভাবে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। কেন্দ্রের শাসকদলের স্থানীয় নেতাদের একাংশ পশ্চিমবঙ্গের বিভাজনের বিষয়ে মুখর। আবার তাদের রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরের নেতৃত্ব নীরব। অনন্ত 'মহারাজ' মাঝেমধ্যেই দাবি করেন যে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। সরকারের তরফে এ বিষয়ে কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিলিগুড়ি হয়ে সুকনা গিয়ে যখন সরকারি সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন তখন অনন্ত 'মহারাজ' তাঁর সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা করেছিলেন বলে সংবাদ প্রচারিত হয়। কাজেই কেন্দ্রীয় সরকার ও শাসকদলের আচরণও সন্দেহজনক।

দৈনন্দিন জীবনের হাজারো একটা সমস্যায় জর্জরিত রাজ্যবাসী হয়তো এই ভয়ঙ্কর বিপদের দিকে নজর দেওয়ার অবকাশ পাচ্ছে না। আর যাঁরা বিষয়টি নিয়ে অবহিত তাঁদের অনেকে মনে করছেন রাজ্য সরকারের অনুমোদন ব্যতিরেকে রাজ্য ভাগের সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে একতরফাভাবে নেওয়া সম্ভব নয়। তাঁরা বোধ হয় ভুলে গেছেন ২০১৯-এ সংসদে সংখ্যাধিক্যের সুবাদে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে ভেঙে তিনটে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছিল। তেমন কিছু ঘটে গেলে তখন হয়তো সেইসব প্রাজ্ঞ মানুষেরা নির্লিপ্ত হয়ে মন্তব্য করবেন 'কোচবিহার' নামের একটি নতুন রাজ্য (বা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল) তৈরি হয়েছে। টাকার দাম কমে যাওয়ার প্রসঙ্গে যেমন দেশের অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ডলারের দাম বেড়েছে, টাকার দাম কমেনি - ঠিক তেমনই আর কী!

এ এক ভয়ঙ্কর প্রবণতা। বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমের নৈর্ব্যক্তিক আচরণ লক্ষণীয়। এই পরিসরে কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক আরও বেশি করে বিচ্ছিন্নতাবাদের সঙ্গে সমঝোতার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। এখনই এই বিপজ্জনক প্রবণতার বিরুদ্ধে সমস্ত গণতান্ত্রিক মানুষের ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়ানো প্রয়োজন। আর সময় নষ্ট করার মতো সময় নেই। এখন দুয়ারে রাজ্য ভাগের আশঙ্কা। বিচ্ছিন্নতাবাদকে অবিলম্বে বিনাশ করার প্রত্যয় নিয়ে দেশ এবং রাজ্যকে রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করতে এই পরিস্থিতিতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষতঃ বামপন্থীদের আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করা দরকার। সমস্ত গণতান্ত্রিক মানুষকে একযোগে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে এসে রাজ্যভাগের ষড়যন্ত্রকে সমূলে বিনাশ করতেই হবে।