আরেক রকম ● দশম বর্ষ একবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২২ ● ১৬-৩০ কার্তিক, ১৪২৯

প্রবন্ধ

একটি জোলো কাহিনি

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী


সোমবার এল।

তথ্যপ্রযুক্তি সংখ্যায় কাজ করা এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘উইকএন্ডটা কেমন কাটলো রে?’

উত্তর এসেছিল, ‘বিন্দাস ভাই। একেবারে জোলো।’

আমি বললাম, ‘এ আবার কি কথা হল? বিন্দাস আর জোলো এক বেঞ্চে বসে কি করে?’

বন্ধু বলল, ‘তুই টিউবলাইট। জোলোর মানে তোর অধরাই রয়ে গেল। গুগুল ঘাঁট। তা হলে এই উদ্ভট প্রশ্ন তুই করবি না আর।’ বলল, ‘তুই ব্যাকওয়ার্ড। সারাজীবনই তাই রয়ে গেলি।’

গুগলদেবতার কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘বল তো হে, কাকে বলে জোলো?’ শুধোলাম, ‘জোলো উইকএন্ড হলে মুখে হাসি আসে কি করে?’ নেটদুনিয়ার সর্বজ্ঞানী ঈশ্বর বললেন, ‘ওহে মূর্খ! জোলো মানে জলে ধুয়ে যাওয়া নয়। এর মানে হল, জয় অফ লেটিং গো (JOLO)।’ জানলাম, এর আবার অন্য মানে আছে একটা। তাকে বলে, জোমো (JOMO)। এর মানে হল, জয় অফ মিসিং আউট। যাক যা গেছে তা যাক। সারার্থ হল, বাইরের দুনিয়ায় ঘটছে কি, তা নিয়ে ভাবার দরকার নেই কোনও।

সামাজিক মাধ্যমে আমরা যে পোস্ট দিই, তা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করার মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। লাইকপ্রিয়, কমেন্টপ্রিয় মানুষরা জানেনই না, তাঁদের ডিজিটাল দুনিয়ার অনুরাগীদের সংখ্যা ক্রমশ আসছে কমিয়া। সে দিন গিয়াছে, যখন পোষ্ট করা মাত্রই লোকেরা চেয়ে থাকতেন লাইক পাওয়ার আশায়। কমেন্ট গুনতেন চাতকপাখির মতো। সমীক্ষা বলছে, কোনও পোস্ট লাইক আর কমেন্টে স্নান করা মানেই তা ভাইরাল নয়। পোস্টের মধ্যে কি আছে, যাচাই করার আসল মাপকাঠি সেটাই। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফোমো (FOMO) থেকে বেড়ে চলছে জোলোর সংখ্যা।

ফোমো মানে কি? এই শব্দটি অবশ্য ইতিমধ্যেই বহুলচর্চিত। ফিয়ার অফ মিসিং আউট। সামাজিক মাধ্যমে আঠার মতো সেঁটে থাকেন যাঁরা, তাঁরা এর মানে বুঝবেন হাড়ে হাড়ে। আমার এক পঞ্চাশোর্ধ্ব আত্মীয়, তিন ঘণ্টার জটিল অপারেশনের পরে জ্ঞান ফেরা মাত্র প্রশ্ন করেছিলেন, ‘মোবাইলটা পাওয়া যাবে?’ সিস্টার বললেন, ‘এত বড় ধকল গেল শরীরে। এখন মোবাইল নিয়ে আপনি করবেনই বা কি?’ ভদ্রলোক নাকি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এতগুলো ঘন্টা ফেসবুক না দেখতে পারলে আমার মনের উপরেও তো বিরাট ধকল যাবে। তার বেলা? মোবাইলটা জোগাড় করে দিন। এখনই দিন।’

মোবাইলের দিকে চোখ রেখে পাঁচমাথার মোড় পেরোচ্ছেন এমন মানুষও আমরা দেখি প্রতিদিন। যে সামাজিক মাধ্যমের জন্য সর্বস্ব দিয়েছি, তার দেওয়ালের একটি পোস্টও যেন আমার চোখ এড়িয়ে না যায়, তা নিয়ে আমরা অঙ্গীকার করেছি স্বতঃপ্রণোদিতভাবে। কিছুক্ষণ অন্যদের পোস্ট ঘাঁটলেই নিজের থেকে কিছু সৃষ্টি করার উদগ্র বাসনা জাগে। ফলে অকারণে পোস্টাই। সাইবার দুনিয়ার এক বিশেষজ্ঞকে বলতে শুনেছিলাম, ‘সারাদিনে যে কয়েক হাজার কোটি পোস্ট হয় বাইনারি দেওয়ালে, তার মধ্যে দরকারি পোস্টের পরিমাণ আণুবীক্ষনিক। ওইটুকু বাদ দিলে বাকি সব ফালতু। আর এই ফালতুকে হারিয়ে ফেলার ভয় নিয়েই আমাদের চিন্তার অন্ত নেই।’ ফিয়ার অফ মিসিং আউট।

তবে বেশ কয়েক বছর ধরে মোবাইলের দিকে ক্রমাগত ঝুঁকে পড়ার পরে কিছু মানুষ বুঝতে পারছেন, জীবন মানে শুধুই স্ক্রিন নয়। উপেক্ষাতেই আনন্দ। গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে অ্যামিউজমেন্ট পার্কে গিয়ে ছবি পোস্ট করেছে বন্ধু? করুক গে। সদ্য কেনা গাড়িকে চুমু খেতে খেতে সহকর্মীর সেলফি হঠাৎ উড়ে এল মোবাইলে? বয়ে গেল, তুমি চুমু খাও। তাতে আমার কি! বাহারি রেস্তোঁরায় বসে ছোটপিসির টুয়েলভে পড়া মেয়ে ছবি পাঠালো ক্যাপশনসহ, ‘পিৎজা!! ইউ আর মাই রকিং বয়ফ্রেন্ড। লাভ ইউ।' জোলো দুনিয়ায় গা ডোবানো লোকেরা আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাস নয়নে বলছেন, ‘লাভাক। তাতে আমার বয়েই গেলো।’

এই বয়ে যাওয়ার বিষয়টা বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন নেটদুনিয়ার একটা বড় অংশের লোকজন। মনোবিদরা বলছেন, সপ্তাহে দুটো দিন জোলোপ্রেমী হলেও ওই দুটো দিন তাঁরা কার্যত ভালো থাকছেন। মোবাইলটা দূরে সরিয়ে রেখে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে তাঁরা বলছেন, আছি আমি হাস্যমুখে, দুঃখ আমার নাই। দেরি করে হলেও তাঁরা উপলব্ধি করেছেন, দুঃখ আসলে লুকিয়ে রয়েছে ওই মোবাইলে, কিংবা ল্যাপটপের পর্দার ওপারে।

জোলোভাব মাথা উঁচু করে জ্বলতে থাকায় মুখে হাসি ফুটেছে চিকিৎসকদেরও। তাঁদের আশা, নেটদুনিয়ার বাসিন্দাদের মধ্যে এর ফলে সার্বিকভাবে মানসিক অস্বস্তি কমবে। আর কে না জানে, স্ট্রেস এবং অ্যাংজাইটি উলু দিয়ে অন্য নানা রোগ ও মনের বিকার ডেকে আনে। সামাজিক মাধ্যম কিংবা হোয়াটসআয়াপ এর গ্রুপ থেকে সামান্য বিরতি আপাতভাবে আমাদের বন্ধুহীন করে দেয়। কিন্তু ওইটুকু সময়ে খুলে যেতে পারে নিজেকে নতুন করে পাওয়ার মস্ত এক সুযোগ। মনোবিদদের আর্জি, এমন সুযোগ হেলায় হারাবেন না। তাঁরা পরামর্শ দিচ্ছেন, কিছুই করতে ইচ্ছে না করলে সপ্তাহান্তে প্রাণভরে ঘুমোন। তবে প্রাণাধিক প্রিয় গ্যাজেটগুলো যেন সেই সময়ে এরোপ্লেন মোডে থাকে।

একটি বহুজাতিকের এক পরিচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট এ সম্পর্কে আমায় কয়েকটি কথা বলেছিলেন সম্প্রতি, আত্মোপলব্ধি মিশিয়ে। কথাগুলো মনে দাগ কেটে রয়েছে এখনও। এত সহজভাবে ফোমো আর জোলো আমাকে এর আগে বুঝিয়ে দেননি কেউ। উনি বলছিলেন, ‘ধরে নাও আমার পঁচিশ লাখের গাড়ি নিয়ে আমি চললাম মন্দারমনি। পাশ দিয়ে হুশ করে যে গাড়িটা বেরিয়ে গেল, তার দাম এক কোটি দশ লক্ষ। ফুরফুরে মেজাজে হাইওয়ের স্নিগ্ধ হাওয়া খাওয়ার সুখের বারোটা বেজে গেল নিমেষে। ড্রাইভারকে বললাম, ওই এক কোটি দশকে ফলো করো। আমার হাত ততক্ষণে চলে গিয়েছে গুগলে। জেনে নিতে শুরু করে দিয়েছি ওই মূল্যবান গাড়ির আরও নানা ফিচার যা আমার এই টিনের বাক্সের গাড়িতে নেই। এই হল গিয়ে ফোমো। মুষড়ে পড়লাম। আর যদি ওই কোটি টাকার গাড়িকে সাইড দিয়ে, যা বাবা যা বলে আমি ফের মন দিতাম প্রকৃতির দিকে, তা হলে সেটাই হতো জোলো।’ এক নাগাড়ে এতটা বলে একটু থেমেছিলেন ভদ্রলোক। তারপরে একটা লাইন যোগ করেছিলেন। ‘জোলোভাব মানুষকে স্নিগ্ধতা দেয়। উচ্চাশার যে কোনও শেষ নেই ভাই।’

আন্তর্জালের বিভিন্ন প্রবন্ধ নিবন্ধ বলছে, ফোমোর উপকারিতা যে কার্যত শূন্য, তা মনে করলে আবার ভুল হবে। এ বড় অদ্ভুত এক সমীকরণ। বন্ধুর নয়া সম্পত্তি দেখে ঈর্ষা করার বদলে বন্ধুকে ছোঁয়ার আশায় কেউ যদি কাজে আরও আদা-জল খেয়ে লেগে পড়েন, তা হলে আখেরে তাঁরই মঙ্গল। ফোমো এক্ষেত্রে তাঁকে আরও এগিয়ে যাওয়ার স্পৃহা যোগাবে। পোস্টটি এড়িয়ে গেলে হয়ত তাঁর মনের মধ্যে এই বাসনা জাগত না। তবে এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল শিবিরের মানুষদের একটা বড় অংশ আবার মনে করেন, এমন ‘কর্মযোগী’ মানুষের সংখ্যা হাল আমলে হাতে গোনা। অন্যের পোস্ট নিংড়ে নিয়ে জীবনে এগনোর বদলে বেশিরভাগ মানুষই যা আঁকড়ে ধরেন, তা হল অবসাদ। এর ফলে তাঁরা প্রেশার ও সুগার বাড়ান সমগোত্রীয় অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। খিটখিটে হয়ে ওঠেন আগের থেকে অনেক বেশি। বিগড়ে যায় পরিবারের শান্তি। ফলে ভাল ভাবে বাঁচতে গেলে চোখ বন্ধ করে বেঁচে থাকাই শ্রেয়।’

অনেকে রেগে গিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে পারেন, ‘এমন আবার হয় নাকি? তা হলে যে পিছিয়ে পড়তে হয়।’ এর উত্তরও নিজের মতো করে গড়ে নিতে হবে আমাদের। আজকের দুনিয়ায় যেখানে সামাজিক মাধ্যমে অ্যাক্টিভিটিই আমাদের আসল পরিচয়, সেখানে চোখ বন্ধ করার ইচ্ছে থাকলেও হয়তো অনেক সময় তার উপায় থাকে না। আমাদের জীবনদর্শন ও রোজনামচার যে ক্যানভাস, তাতে তুলির কটা দাগে ফোমো আঁকব আর কতটা রং দেব জোলোকে, তা দিনের শেষে ঠিক করতে হবে আমাদেরই। জোলোর পরিধি বাড়বে যত, জীবনটা আদতে নিজের হবে আরও।

স্বরচিত সেই ক্যানভাসের দিকে চোখ রাখলে আমাদের যেন তৃপ্তি হয়। এটুকুই।