আরেক রকম ● দশম বর্ষ একবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২২ ● ১৬-৩০ কার্তিক, ১৪২৯

সমসাময়িক

বউবাজারে (মেট্রো) বিপর্যয়


কলকাতার টালিগঞ্জ-দমদম লাইনে সাফল্যের সঙ্গে মেট্রো চলাচল শুরু করার পর বোঝা যায় যে গণপরিবহনের ক্ষেত্রে মেট্রোর ভূমিকা অনবদ্য। দিল্লি মেট্রোর প্রথম পর্যায়ের সাফল্য ধারণাটিকে আরও সম্পৃক্ত করে। এই দুই দৃষ্টান্ত সামনে রেখে নীতি নির্ধারকরা স্থির করলেন যে পূবের বিধাননগর থেকে কলকাতার পশ্চিম সীমানার হুগলি নদী পেরিয়ে হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত একটা নতুন মেট্রো লাইন সংস্থাপন করা যেতে পারে। শুরু হল প্রকল্পের খসড়া প্রণয়ন। প্রকল্পের রূপরেখা নিয়ে একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনার পর ভারত সরকার ২০০৮-এর ৩০শে জুলাই প্রকল্পটিকে নীতিগতভাবে অনুমোদন (in principle approval) দেয়।

কলকাতার পূর্ব-পশ্চিম সংযোগকারী নতুন মেট্রো, যা পরে 'ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো' নামে পরিচিতি পায়, নির্মাণের জন্য ভারত ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যৌথ উদ্যোগে ২০০৮-এ গঠিত হল 'কলকাতা মেট্রো রেল করপোরেশন লিমিটেড' সংক্ষেপে কেএমআরসি। দুই সরকারই কেএমআরসি-র ৫০ শতাংশের অংশীদার। দিল্লি মেট্রো ও সেই সময় নির্মীয়মান দেশের অন্যান্য শহরের মেট্রো নির্মাণ ও পরিচালনা এমন যৌথ উদ্যোগেই কাজ করছে।

অতঃপর শুরু হয় প্রকল্পের বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন। অনেক কাটাছেঁড়ার পর প্রকল্পের বিস্তারিত নথি নিয়ে ভারত সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকসমূহ ও প্ল্যানিং কমিশনের সঙ্গে কেএমআরসি-র দীর্ঘ আলোচনায় দেখা যায় যে, বিধাননগর থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত যাত্রাপথে কোনো অসুবিধা নেই। মূলতঃ ভূ-তলের উপর থাম গড়ে তার উপরে লাইন বিছানো হবে। প্রয়োজনে লাইন ভূ-গর্ভের ভেতরে প্রবেশ করবে। শিয়ালদহ থেকে বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট বরাবর বি বি ডি বাগ পর্যন্ত ভূ-তলের উপর থাম গড়ে তার উপরে লাইন বিছানোর প্রস্তাব ছিল। অতঃপর বি বি ডি বাগ থেকে ডান দিকে ঘুরে ব্র্যাবোর্ন রোড ধরে একেবারে হুগলি নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত হবে কেএমআরসি-র লাইন। এই পর্যন্ত ভারত সরকারের সঙ্গে কেএমআরসি-র কোনো মতান্তর ছিল না। গোল বাধলো এর পর। প্রস্তাবিত নকশায় দেখা যায় যে, নদী পেরিয়েই হাওড়া স্টেশনে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর যাত্রাপথ শেষ হবে। ভারত সরকারের আধিকারিকদের প্রশ্ন ছিল নদীর তলদেশের ৫০ মিটার গভীরে স্থাপিত লাইন ধরে চলা ট্রেন সরাসরি হাওড়া স্টেশনে কীভাবে উঠবে? পরিভাষায় বলতে গেলে বলা যায় মোটামুটি ৯০ ডিগ্রী কোণ করে উঠতে হবে। অর্থাৎ মেট্রোর রেককে একেবারে খাড়া হয়ে উঠতে হবে। বাস্তবে তা সম্ভব নয়। কাজেই প্রকল্প সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়। পরে সংশোধিত প্রস্তাবে হাওড়া ময়দানে প্রান্তিক স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়।

ইতিমধ্যে ২০০৯-এর ২২শে ফেব্রুয়ারি কেএমআরসি-র ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর শিল্যান্যাস হয়ে গেছে। কিছুদিন বাদে ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পর ভারত সরকারের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এল বিরাট পরিবর্তন। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী তখন সদ্য রেল মন্ত্রকের দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন। প্রথমেই ঘোষণা করলেন যে কেএমআরসি-তে রাজ্য সরকারের থাকার দরকার নেই। কাজেই কেএমআরসি-র সম্পূর্ণ মালিকানা রেল মন্ত্রক নিজের কাঁধে তুলে নিল। সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম পর্ব নিয়ে তখন রাজ্য সরকার এমনিতেই ব্যতিব্যস্ত বলে বিষয়টি বেশি দূর গড়ায়নি।

কেএমআরসি রেল মন্ত্রকের কাছে চলে যাওয়ার পর হঠাৎ করেই বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের যাত্রাপথ ভূ-তলের পরিবর্তে ভূ-গর্ভে চলে গেল। প্রকল্পের খরচ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সকলেই এড়িয়ে গেলেন। একই সঙ্গে বেড়ে গেল প্রকল্প নির্মাণের সময়সীমা। সকলেরই যেন একটা গয়ংগচ্ছ ভাব। রেলমন্ত্রীর সঙ্গে কোনো বিতর্কে জড়িয়ে যেতে কেউ বোধ হয় তখন রাজি ছিলেন না।

বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট ধরে মেট্রোর যাত্রাপথের প্রস্তাবে প্রথম থেকেই স্থানীয় বাসিন্দাদের একটা ক্ষীণ আপত্তি ছিল। সঙ্কীর্ণ রাস্তার উপর দিয়ে মেট্রো চলাচল করলে রাস্তার দু' পাশের বাড়িগুলিতে ঝাঁকুনি লাগবে - এই ধারণা থেকেই আশঙ্কার জন্ম। দিল্লি মেট্রোর যাত্রাপথের সঙ্গে সামান্য পরিচয় থাকলে এমন ধারণা দূর হয়ে যেত। পরবর্তী সময়ে নির্মিত হায়দ্রাবাদ, লক্ষ্ণৌ, জয়পুর মেট্রোর কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল। কারণ ওই শহরগুলিতে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার মধ্যে দিয়ে থামের উপর বসানো লাইন দিয়ে দিনরাত ঝমঝম করে মেট্রো দিব্যি চলাচল করছে। ভূ-গর্ভে লাইন পাতার প্রস্তাব প্রকাশিত হওয়ার পর সেই আপত্তির মাত্রা বেড়ে গেল। পরিবেশ কর্মীদের একটা অংশও এই সুযোগে নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করতে উদ্যোগী হয়ে পড়ে। সংবাদমাধ্যমও সক্রিয় হয়ে আপত্তি জানাতে থাকে। ফলে সমগ্র যাত্রাপথের অন্যান্য অংশের কাজ সুষ্ঠু ভাবে এগিয়ে যেতে থাকলেও বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের কাজ ব্যাহত হয়।

এরপর তো সামগ্রিক পট পরিবর্তন। ২০১১-য় ভারত সরকারের রেলমন্ত্রী হয়ে গেলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ঘোষণা করলেন যে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো শিয়ালদহ থেকে এসপ্ল্যানেড হয়ে বি বি ডি বাগ যাবে। পুরোনো পরিকল্পনা পুরোপুরি পরিহার করা হল। নতুন যাত্রাপথের কোনো সমীক্ষা হয়েছিল কি? হয়ে থাকলেও প্রকাশিত হয়নি। ২০১১-য় তাঁর এমন দাপট যে সদ্য ছেড়ে আসা রেল মন্ত্রক তথা ভারত সরকার নিঃশব্দে এহেন একতরফা স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিল। প্রযুক্তিবিদ, পরিকল্পনা বিশারদ, প্রশাসক থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো মন্ত্রী এই বিষয়ে মন্তব্য করেননি। চায়ের দোকানের আড্ডা হোক বা টিভির তরজায় এই পরিবর্তন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছিল কি? বিরোধী দলের প্রতিবাদ শোনার তখন কারও সময় নেই। সকলেই তখন রাজ্যের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন নিয়ে গভীর গবেষণায় সোচ্চার। বিশ্ব থেকে মহাবিশ্বের সমস্ত বিষয়ে যারা মতামত জ্ঞাপনে সদাব্যস্ত তাদের একবারের জন্যও মনে পড়লো না যে প্রস্তাবিত নতুন যাত্রাপথের পূর্ব দিকে এককালে বহে যেত ঐতিহাসিক মারহাট্টা ডিচ্ নামের এক প্রশস্ত খাল, যা বুজিয়ে পরে গড়ে ওঠে সার্কুলার রোড বা এখনকার আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড। আর দক্ষিণে ছিল হুগলি নদী ও বিদ্যাধরী নদীর সংযোগকারী এক বহতা খাল, যা পরবর্তী সময়ে বুজিয়ে দিয়ে তৈরি হয় ক্রিক রো। এছাড়া পুরো এলাকায় ছিল একাধিক বৃহৎ জলাশয়, যার মধ্যে বৃহত্তম ছিল ওয়েলিংটন স্কোয়ার। নাম পরিবর্তন করে সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার হওয়ার আগেই সেই জলাশয় বুজিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সবমিলিয়ে পুরো এলাকাটি ছিল এককথায় নাবা জমি। এমন জমিতে বাড়িঘর আগেও হত এখনও হয়। দেশের রাজধানী শহরের প্রশাসনিক কেন্দ্রের কাছাকাছি বলে স্বভাবতই শুরুর দিন থেকেই এই এলাকার বাণিজ্যিক আকর্ষণও কম নয়। ফলে কলকাতার অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এখানে জনঘনত্ব অনেক বেশি।

ভূমির চরিত্র যথাযথ ভাবে বিবেচনা করার সুযোগ থাকলে নিশ্চয়ই এই যাত্রাপথের প্রস্তাব পরিত্যক্ত হতে পারতো। কিন্তু স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে কে-ই বা স্বেচ্ছায় নিজের বিপদ ডেকে আনতে চায়! ফলাফল শিয়ালদহ থেকে এসপ্ল্যানেড যাত্রাপথে বিশেষতঃ বউবাজার সংলগ্ন এলাকায় সুড়ঙ্গ করতে গিয়ে বারেবারেই বিপর্যয় নেমে আসছে। কখনও বাড়ি ভেঙে পড়ছে আবার কখনও প্রাচীন বাড়িগুলিতে ফাটল ধরছে। বাসিন্দারা প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। এখানকার ব্যবসায়ীরা যাঁরা প্রধানতঃ সোনা-রুপোর কারবারী, আতঙ্কগ্রস্ত। তাঁদের আরও বেশি চিন্তার কারণ দোকান সংলগ্ন গহনা নির্মাণের কারখানা। গহনা তৈরির জন্য নানারকম রাসায়নিক পদার্থের প্রয়োজন হয়। দোকান বা কারখানা ভেঙে পড়লে সেইসব রাসায়নিক পদার্থ ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়ে বিপদের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সবমিলিয়ে বউবাজার এলাকায় মেট্রো নির্মাণকাজে ধারাবাহিক বিপর্যয়ের ফলে মানুষের মাথার উপরের ছাদ থেকে শুরু করে রুটিরুজি সবই আজ বিপন্ন।

প্রতিবার দুর্ঘটনা ঘটার পর বিধ্বস্ত এলাকায় হাজির হন কেএমআরসি-র অধিকারিকবৃন্দ। বিপন্নদের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করে কোনোরকমে অস্থায়ী আবাসনের আয়োজন করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন মেয়র-কাউন্সিলর থেকে শুরু করে সাংসদ-বিধায়ক। তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটাতে বিপন্নদের হাতে নগদ টাকাও দেওয়া হয়। দেওয়া হয় ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত হয় একটা তদন্ত কমিটি। ব্যাস, ওই পর্যন্তই। স্থায়ী পুনর্বাসন ও এলাকার পুনর্গঠনের কোনো পরিকল্পনা নেই। অদূর ভবিষ্যতে মেট্রো চলাচল শুরু হওয়ার পর বাদবাকি বাড়িঘরের উপর কী প্রভাব পড়তে পারে তা নিয়ে আগাম কোনো সামগ্রিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে না। এমনকি বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট নিয়ে কোনও চর্চা হয় কিনা তা-ও বলা মুশকিল।

বার বার বিপর্যয়ের ফলে সমগ্র প্রকল্পের খরচ বেড়ে গেছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। অবিশ্যি ক্ষতিগ্রস্তদের সাময়িক আশ্রয়ের বন্দোবস্ত বাবদ খরচ অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচাপাতির হিসেব এই ২ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ধরা হয়নি। ২০২১-এর ৩০শে জুন কাজ শেষ হবে ধরে নিয়ে প্রকল্পের জন্যে প্রাথমিক খরচ ৮ হাজার ৭৪২ ধার্য করা হয়েছিল। প্রথম দুটি বিপর্যয়ের পর হিসেবনিকেশ করে দেখা যায় প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হলে ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা দরকার। তখনই স্থির হয় যে, ২০২৩-র নভেম্বর মাসে কাজ শেষ হয়ে যাবে। এখন তৃতীয় বিপর্যয়ের পর প্রকল্পের খরচ বেড়ে কোথায় পৌঁছাবে তা এখনও হিসেব করা হয়নি। একই সঙ্গে নির্ধারণ করা হয়নি শেষ পর্যন্ত ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো কবে নাগাদ চালু করা যাবে।

ভুক্তভোগীরা নিজেদের নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। অজানা ভবিষ্যতের কথা ভাবতে ভাবতে কখনও পুরসভা কখনও আবার কেএমআরসি-র দুয়ারে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকা ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা করা তাদের পক্ষে এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। আর এই ভয়াবহ পরিণতির জন্য যাঁর স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত ৯৯ শতাংশ দায়ী তিনি আগের দুই বিপর্যয়ের সময়ের মতো এবারও সম্পূর্ণ নীরব। বাদবাকি ১ শতাংশের দায়ভার রাজ্যের নাগরিকদের বহন করতেই হবে। কারণ তারা যথাসময়ে এই স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়নি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে কিন্তু সকলকেই জবাবদিহি করতে হবে।