আরেক রকম ● দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২২ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪২৮

ফিরে দেখা

সম্পাদকীয়

মিহির ভট্টাচার্য


এক রকম দুনিয়ার জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি, সংসার ও কাজকর্ম করেছি, তারপর নানারকম গতানুগতিক ও আত্মিক অভিজ্ঞতার বুনোটের মধ্য দিয়ে বয়স বেড়েছে৷ আমরা সকলেই হরেক রকম দুনিয়াতে বাস করি - পারিবারিক সামাজিক রাজনৈতিক পেশাগত ভাষাগত লিঙ্গগত জাতিগত৷ কিন্তু গত বিশ-ত্রিশ বছরে কেমন যেন মনে হচ্ছে যে এই সব উপাদানে গড়া চেনা জগতের বিবিধ ছাঁদ আমূল বদলে গেছে৷ এখন আরেক রকম বিশ্বে বেঁচে আছি, কিন্তু তার ধরন-ধারণ ঠিক ধাতস্থ হয়নি৷ বুড়োর চোখে এই নতুন জগৎকে কেমন লাগে তার চোখা দু-একটা উদাহরণ পেশ করছি৷ একপেশে হবার দায় মেনে নিতেই হবে৷ আগের কালের সব কিছুই ভাল ছিল, একালের সব কিছু খারাপ - এমন বিটকেল সুবচন আরো অনেক ঘষাবুলির মতো বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউ এখানে লাগালে আশ্চর্য হবো না৷

তেরোই আগস্ট, দু’হাজার এগারো৷ শান্তিনিকেতনের উপকণ্ঠে প্রান্তিক স্টেশনের গায়ে সনতের ভাতের হোটেল আমরা বুড়ো-বুড়ি খেতে বসেছি৷ প্রান্তিক উপনগরীতে আমাদের বাড়ি আছে, সেখানে এলে আমরা কখনো রান্না করি, কখনো বাইরে খাবার খাই৷ আজ সাত-আট মিনিট হেঁটে সনতের দোকানে গিয়ে খেয়ে আসব ঠিক হয়েছিল৷ সনৎ অধিকারী রাস্তার ধারে দোকান ফেঁদেছে - আরো অনেক দখলদারের মতো - নিকোনো মাটির মেঝে, পাকা দেয়াল, এসবেটসের ছাউনি৷ চারপাশে আরো অনেক দোকান, গত দশ-পনেরো বছরের মধ্যে রাস্তার ধারের জায়গা দখল করে সেগুলো গড়ে উঠেছে৷ এই ছবি এখন শহরে-গ্রামে অতি পরিচিত৷ নয়া-উদারবাদী আর্থিক ব্যবস্থার কল্যাণে এখন আর কাজের সৃষ্টি হয় না, কৃষিক্ষেত্রও মুমূর্ষু, কাজেই অসংগঠিত পরিষেবাই গরিব মানুষের শেষ উপায়৷ হকারি, দোকানদারি, রিকশা-চালানো, বাড়ির-কাজ - এ-জাতীয় জীবিকাতেই মিলিত হয়েছে নিম্নবিত্ত অজস্র মানুষ৷ এদেরই সমগোত্র লোকজন এইসব দোকানে আসে, সকাল-বিকেল আড্ডা বসে, নিছক জাগতিক ব্যাপার ছাড়াও অনেক উচ্চাঙ্গের আলোচনা হয়৷ পারিবারিক ব্যবসায় বাড়ির লোকদের শ্রম ছাড়া চলে না, কাজেই স্ত্রী-পুরুষে সবাই কাজ করে, ঘরকন্না আর কাজকর্ম মিলেমিশে চলে৷

রাস্তার একদিকে সনতের সিঙাড়া-কচুরি-মিষ্টির দোকান, অন্যদিকে ভাতের হোটেল৷ সেখানে দুটি টেবিলের দু’পাশে বেঞ্চি পাতা, মাথার উপরে পাখা আছে, দিব্যি বসে খাবার বন্দোবস্ত৷ একটা বেজে গেছে, খিদে পেয়েছে৷ সনতের ভাই শিবু ভাল রাঁধে, সে শালপাতার থালায় ভাত-ডাল-আলুভাতে-পুঁইঘন্ট আর লেবু-কাঁচালংকা-পেঁয়াজ দিয়ে গেছে, খাওয়া শুরু করেছি, এরপর আলুপোস্ত কাতলা মাছের ঝাল আর টমেটোর চাটনি আসবে, অন্যদিকে মন নেই, এমন সময় পাশের টেবিল থেকে যন্ত্রের কল্যাণে কানে এল মামুলি তালিমহীন মোলায়েম গলার ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’৷

গানের কথাায় একটু পরে আসবো, খাবারের প্রসঙ্গটা সেরেনি৷ প্রান্তিক হলো গ্রাম আর শহরের, গরিব আর বড়লোকের, মধ্যবর্তী স্থানে৷ জায়গাটা শান্তিনিকেতনের সম্ভ্রান্ত পল্লীগুলোর তফাতে, আবার বোলপুরের মফস্বলি সাধারণ্য থেকে দূরে। অন্যদিকে কলকাতার সৌখিন বড়লোকেরা আসে কালেভদ্রে, মূলত উৎসবের মরশুমে৷ তখন ভাল-মন্দ খাবারের ডাক পড়ে৷ বাঙালির রান্না-খাওয়া অবশ্য মূলত বাড়িতেই হয়, পুঞ্জিত পাক-প্রণালীর বিচিত্র প্রসার মহিলাদের হাতেই সম্পন্ন হয়েছে৷ গরিবের খাওয়া অবশ্যই বাড়িতে সস্তা পড়ে, মেয়েদের গার্হস্থ্য শ্রম দিয়ে আয়ের ঘাটতি খানিকটা মেটানো হয়৷ কাজেই দোকানের খাবার-দাবার সাধারণ চাকুরে-হাুটুরে লোকেদের জন্যই বানানো হয়৷ ভাতের কথা বলেছি, দোকানভেদে তার দামের তফাৎ হয়৷ টিফিনের মধ্যে জনপ্রিয় হচ্ছে এক ঠোঙা মুড়ির উপরে একবাটি গরম ঘুগনি, আর আছে তেলেভাজা, মামলেট, সিঙাড়া ইত্যাদি৷ কয়েক রকম ছানার মিষ্টি পাওয়া যায়৷ সকালে সনতের বিখ্যাত কচুরি ভাজা হয়, ডালের কারির সঙ্গে খাওয়া হয়৷ রাতে অতিরিক্ত হয় রুটি-তড়কা বা রুটি-সবজি৷ বহুদিন ধরে সারা দেশে বাড়ির বাইরে সাধারণ মানুষের খাবারের এই রকম ব্যবস্থা চালু আছে৷ প্রান্তিকে আমাদের মতো কচ্চিৎ-দৃষ্ট বাবু-বিবিদের জন্যও সংস্থান আছে৷ বললেই মাংস রান্না হবে৷ একটু দূরে তাপস রীতিমতো রেস্তরাঁ খুলেছে, সেখানে সর্বভারতীয় অর্থাৎ পাঞ্জাবি তামসিক স্টাইলের হরেক রকম খাবার পাওয়া যাবে৷ সাধারণ মানুষের সামর্থ্য যুগভেদে বিশেষ বদলায় না, সম্প্রতি নিম্নগামীও বটে, কাজেই এই খাবারের জগতটা চিরকালের চেনা লোকের জানা উপাদানে পরিচিত প্রণালীতে রচিত৷ যে দুনিয়ার কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেই দুনিয়ার ক্রমায়ত একটি ভগ্নাংশ হচ্ছে আমাদের প্রান্তিকের খাওয়া-দাওয়া৷

কিন্তু আমরা যে-বর্গের অন্তর্গত, অর্থাৎ উচ্চ-মধ্যবিত্ত, তাদের ভোজন-বিলাস এখন একেবারে বৈপ্লবিক মোড় নিয়েছে৷ বাড়িতেও নানা রকম গ্যাজেটের  কল্যাণে আর সৌখিন উপাদানের বাহুল্যে বিচিত্র রান্নাবান্না হচ্ছে, সুখাদ্যের সংজ্ঞাই বদলে গেছে৷ কিন্তু আসল পরিবর্তন হয়েছে বাইরে খাওয়ার সংস্কৃতিতে৷ কলকাতা শহরে তো বটেই, মফস্বলেও অজস্র রেস্তরাঁ খোলা হয়েছে, নানা দেশের আজব খাওয়া এখন দু’পা বাড়ালেই সহজলভ্য৷ হাতে টাকা থাকলে মানুষে তো বিলাসিতার সন্ধান করবেই৷ বাড়ি-গাড়ি-গ্যাজেট, পোশাক-প্রসাধন-অলঙ্কার, নৃত্য-গীত-পার্টি, শিক্ষা-অনুষ্ঠান-ভ্রমণ - সব কিছুতেই সম্পন্নদের এক রকম ব্যবস্থা, গরিব-গুর্বোদের আরেক রকম৷ পান-ভোজনের সংস্থানেও সেটা একেবারে প্রকট৷ কলকাতায় এই মাগগির বাজারেও ফুটপাথে কুড়ি টাকায় ভরপেট খাওয়া যায়, মাছ নিলে তিরিশ টাকা৷ আর পার্ক স্ট্রিটে সৌখিন পান-ভোজনে জনপ্রতি পাঁচশো থেকে পাঁচ হাজারের ধাক্কা৷ রুচির ভিন্নতা এবং বিত্তবানের বিলাসবাহুল্য বাজারের সুবিধা করে দিয়েছে, সুযোগসন্ধানীরা হাজির করছে নিত্যনতুন আহার্য্যের এবং পানীয়ের সম্ভার৷ এই বৈচিত্রের পাশাপাশি আবার একই বাজারের নিয়মে চলছে অন্য রকম সমীকরণ৷ একটা নির্দিষ্ট বর্গের ছেলেমেয়েদের কোক-পেপসি-চিপস ছাড়া চলে না, প্রিয়তম খাদ্য হচ্ছে বার্গার-পিৎজা; বাড়িতেও দু’মিনিটে নুডলস ব্যস্ত মায়েদের আশীর্বাদস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এইসব স্বাস্থ্যনাশক দুষ্টখাদ্য কিন্তু সস্তা নয়৷ বিজ্ঞাপনের মহিমায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম গিলে চলেছে বাজারজাত মহার্ঘ মারীর বীজ৷ উচ্চবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্তের এই নতুন গতে এখন জোরে চলছে এক ধরনের ঔদরিক অনুশাসন - একদিকে বৈচিত্র্যের সন্ধান আর অন্যদিকে সমীকরণের সংস্থান। টিভি-র বিজ্ঞাপনে নতুন প্রজন্মের নর্তন-কুর্দনের সঙ্গে বাজারি খাদ্য-পানীয়ের সুসম্পর্ক দেখে অনেকে পুলকিত হয়৷

সংগীতের ব্যাপার দিয়ে শুরু করেছিলাম, এবারে সেখানে ফেরা যেতে পারে৷ গানবাজনায় ঘষাবুলি বা ক্লিশের উৎপত্তিতে বাজারি প্রযুক্তির অপরিহার্য ভূমিকা নিয়ে একালে সংশয়ের অবকাশ নেই৷ যে ভদ্রসন্তানটি প্রস্তুতি ছাড়াই বহুপরিচিত গান অক্লেশে গেয়ে দেয় তাকে শ্রোতার সামনে আসতে হচ্ছে না, গাওয়ার সময় হোঁচট খেলেও ডিজিটাল যন্ত্রের দাক্ষিণ্যে জোড়াতালি দিয়ে গানের উৎপাদন হয়ে যাচ্ছে৷ একজন শব্দগ্রাহকের কাছে শুনলাম যে বাজে-গাওয়া বলে এখন আর কিছু হতে পারে না, নিতান্ত আসুরিক আওয়াজও ডিজিটাল প্রযুক্তির কৃপায় নরম সুরে গাওয়া সংগীত হিসেবে পরিবেশিত হয়৷ অবশ্য শ্রোতার সামনেও এনাদের নির্বিকার অর্কেস্ট্রা-নির্ভর গায়ন এখন সর্বতোভদ্র ৷ রেকর্ডিং-এর প্রথম যুগে কিন্তু পরিবেশন ছিল একেবারেই চিরাগত প্রথানুগ, কেবল রেকর্ডিং-এর সাধ্যসীমা বজায় রাখতে হত৷ উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ তিন মিনিট বেয়াল্লিশ সেকেন্ডে জয়জয়ন্তীর বন্দিশ রেকর্ড করেছিলেন, উস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ ঐ রকম গণ্ডির মধ্যেই গেয়েছিলেন মালকোষ, দুজনেই কিন্তু শাস্ত্র এবং ঘরানার অনুশাসনের মধ্যে ছিলেন৷ এঁদের এবং আরো অনেক দিকপাল গাইয়ে-বাজিয়ের তিন-মিনিট রেকর্ডিং ছিল বলেই সে-আমলের সাংগীতিক উৎকর্ষের কিঞ্চিৎ ধারণা আমরা এখনো পাই; মাপে-খাটো গান-বাজনা গুণে খাজা ছিল না৷ অমলা দাশ, সাহানা দেবী, কনক দাশ, মালতী ঘোষাল, রাজেশ্বরী দত্ত যেমন তালিম পেয়েছিলেন তেমন গায়কী স্টুডিওর মাইক্রোফোনের সামনেও অনুসরণ করতেন৷ পরেকার অনেক শিল্পীও এই ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হননি৷ সেই আমলে বাণিজ্যিক কারণে পরিবেশিত সংগীত জড়মাধ্যমে যন্ত্রের সহায়তায় অনুধারণ করে রাখা হত বটে, কিন্তু পরিবেশনের নিয়মাবলির উপর মাধ্যমের দাবি তেমন প্রকট হয়নি৷ আধুনিক গানও আসরের ঢঙে ধীরে-সুস্থে গাওয়া হত৷

আস্তে আস্তে তারপর রেকর্ডিং-এর সৌকর্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশনেও পরিবর্তন আসতে থাকে৷ এখন থেকে বছর ত্রিশ-চল্লিশ আগে থেকে উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তের হাতে অঢেল পয়সা আসার ফলে সংগীতের বাজার বহুগুণে স্ফীত হল, এই বর্গের রুচিও আন্তর্জাতিক সমীকরণে বিন্যস্ত হল৷ পাশ্চাত্যের আধুনিক পরিবেশনে গাইয়ে-বাজিয়েকে জাঁকজমকের সঙ্গে অভিনয়ে অবতীর্ণ হতে হয়, আলোকসম্পাত এবং অর্কেস্ট্রার চড়া অনুষঙ্গে নর্তক-কুর্দন সহ গায়ে-গতরে খেটে-খুটে ‘শো’ সাজাতে হয়, এবং সেটা সহজেই সাম্প্রতিক কালের মিউজিক ভিডিওতে রূপান্তরিত করা যায়৷ কিন্তু আমাদের ঘরানায় শিল্পীর একক পরিবেশন এতটাই সম্মুখবর্তী ছিল যে নিছক রেকর্ডারে এবং ক্যামেরায় ধরে রাখা ছাড়া আর বিশেষ কিছু সম্ভবপর বলে মনে হত না৷ আজকাল অবশ্য ঢং-টাই পালটেছে৷ রেকর্ডিং-এর জন্য বিশেষ স্বরক্ষেপ আর টিভি-ভিডিওর জন্য সাজ-গোজ, অভিনয় ইত্যাদি এখন একেবারেই আবশ্যিক৷ পাশ্চাত্য ব্যবস্থার অর্থবল পেশীবল মনোবল এমনই বিপুল যে তার সাংস্কৃতিক অভ্যাসও এখন সব জায়গায় স্বাভাবিক বলে রপ্ত হয়ে গেছে৷ সেইভাবেই পাশ্চাত্যের অনুসরণে আমাদের অনেক আধুনিকেরাও ছলা-কলা ঠমক-ঠমকের ব্যবহার অতঃপর অনিবারণীয় মনে করে বিশ্বায়িত ধরনে সামিল হয়েছে৷ বিশেষ করে মিডিয়ার কৃৎকৌশল এখন এমন স্তরে পৌঁছে গেছে যে মানুষের নিজস্ব উচ্চারণ এবং চেহারা ভেঙে-চুরে অন্য রকম বানিয়ে সেটাকেই স্বাভাবিক বলে চালানো শুধু সম্ভবই নয়, দরকারি বলেই মনে করা হয়৷ কাজেই ভিডিও-যুগে বার্তা আর মাধ্যমের একীভূত সত্তা গান-বানাবার ধারণাই পাল্টে দিয়েছে৷ যন্ত্র-ধারিত এবং মিডিয়া-প্রসারিত শ্রাব্যবস্তুর জ্যান্ত অনুকরণই বরং এখন সংস্কৃতির পুরোনো নিয়মকে উল্টো-মুণ্ডু করে ছেড়েছে৷ ‘লাইভ’ পরিবেশনে টিভি-র ঢং আকচার চলছে৷ আবার টিভিতে দেখা যায় প্রসাধিতা সুবেশিনী গদগদভাবে নিজের রেকর্ড-করা গানে ঠোঁট মিলিয়ে গানের অভিনয় করে যাচ্ছে৷ অজস্র টিভি চ্যানেল, এফএম রেডিও, সিডি-ডিভিডি এখন বাজারের মনোযোগ কাড়ার জন্য হামলে পড়েছে৷ শিল্পীর সংখ্যাও বেড়ে গেছে অনেক গুণ৷ মিডিয়া-নির্ধারিত অভিকৃতি বা simulation বিষয়ে আলোচনার অবসর নেই; আপাতত প্রশ্ন তোলা যায় যে বাজারি প্রাচুর্য্যের এমতাবস্থায় রবীন্দ্রসংগীতের ঘষাবুলি উৎপাদন ঠেকাবে কে এবং কেন?

শব্দ-বিশ্ব এবং কথা বিশ্বের অতিকায় আয়তনে অজস্র ঘষাবুলি তো থাকবেই৷ কোটি কোটি ছাপার অক্ষরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উচ্চারণের বাহুল্য এখন জীবনযাপনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে৷ পুঁজিবাদের উদ্ভাবনী তৎপরতায় জোগানের দিক থেকেই অনেক সময় বাজারের বিস্তার ঘটে। টেলিফোন বিশেষ করে মোবাইলের বেতার-বাহিত যোগাযোগ চালু হবার আগে কে ভেবেছিল যে দূরভাষী কথাবার্তার এত দরকার আছে? শব্দ এবং দৃশ্যের যে জোগানের ব্যবস্থা স্বতঃস্ফূর্তভাবে, অর্থাৎ বাজারের দাক্ষিণ্যে, বহুগুণ বেড়ে গেছে, তার চাহিদার সঙ্গে তাল রেখে তৈরি হয়েছে অতীতে অবরুদ্ধ এষণার বিপুল অভিব্যক্তি, স্ফীতকায় হয়েছে রচিত জনরুচির বাজার৷ গানের জোগান আছে বলেই এখন গানের আকাঙ্ক্ষা আগেকার পরিমিতি ছাড়িয়ে যাচ্ছে, অন্য অনেক কিছুর চাইতে মানুষ বেশি বেশি গান চাইছে৷ নীরবতা সাম্প্রতিক দুনিয়ার অভিপ্রেত নয়, নিভৃত সংলাপও বেতারির তরঙ্গে বহুজনশ্রুত৷ কাজেই উচ্চণ্ড সংগীতের রমরমা এই জগতের সর্বত্র বিদ্যমান৷ চাহিদা বেড়ে চলেছে বাজারের স্বার্থে৷ এটা আসলে মুক্তপুঁজি-চালিত নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির সুফল৷ বাজার ভোগ্যপণ্যে ভরিয়ে দাও, সীমিত সংখ্যক বড়লোককে আরো সংগতি দাও, গরিবকে নিংড়ে নাও, ভোগবাদী লক্ষ্যকে সর্বজনীন করো, ব্যস, সমাজ নিজের মতো গড়গড়িয়ে চলবে৷ সংগীত নামক পণ্যও এই নিয়মে গায়ে-গতরে বেড়ে বেড়ে অতিকায় হয়ে উঠেছে; সবচেয়ে সহজ, সবচেয়ে চটুল, সবচেয়ে চড়া আওয়াজ এখন অস্থির অনির্দেশ্য গড্ডলিক মান্যরুচির প্রকৃষ্ট বিনোদন৷ নিশ্চেষ্ট উপভোগ, মননহীন আমোদ হয়ে উঠেছে সম্পন্ন ভোক্তার বেহেস্ত-বিকল্প৷

রবীন্দ্র-সংগীত বা অন্য ধ্রুপদী গানবাজনা - যার উপভোগের জন্য নিজেকে একটু তৈরি করে নিতে হয় - এই বাজারি ব্যবস্থার মধ্যেই যে একটু জায়গা করে নিতে পারছে এবং উদ্দিষ্ট শ্রোতার কাছে পৌঁছচ্ছে সেটা বড়ো বাজারের মধ্যে ছোট বাজারের সংস্থানের কল্যাণে৷ যে নির্মিত রুচি এতকাল ধরে টিঁকে আছে সেটাকে উৎখাত করা বাজারের অভিপ্রেত নয়৷ মুনাফা হল ভগবান৷ ‘নিশ মার্কেট’ নেহাৎ ফেলনা নয়৷ কাজেই নানান ধরনের ক্যাসেট এবং সিডি বাজারে বিকোচ্ছে, টিভিতে হরদম অনুষ্ঠান হচ্ছে, মোবাইলে গান ভরা যাচ্ছে, চবিবশ ঘন্টা এফএম রেডিও চলছে৷ টিভি কেনার সংগতি থাকলে অন্য কাজ বা অন্য বিনোদন বা অন্য সম্পর্কের চেয়ে বোকা-বাক্সের সান্নিধ্য অনেক বেশি আদর পাচ্ছে৷ কানে-গানের-কল-লাগানো যন্ত্র-মুহ্য তরুণ প্রজন্ম তো এখন নগরে নগরে পরিদৃশ্যের আবশ্যিক অংশ৷ কাজেই গানের চাহিদা বেড়েছে বহুগুণ আর বাজারের চাহিদার কারণে এখন অনেক অনেক ‘আর্টিস্ট’ বেশি বেশি করে ‘চান্স’ পাচ্ছে৷ রকমারী সংগীতের সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীতের বাজারও এখন বিস্ফারিত৷ কেবল গায়নের ঢং অন্যান্য চটুল ধারার কাছাকাছি চলে এসেছে, উত্তর-আধুনিক ‘ফিউজন’ চলছে উদ্দাম উৎসাহে৷ কপিরাইট চলে যাবার পর তো আজকাল শ’য়ে শ’য়ে গাইয়ে বাজারে নেমে পড়েছে৷ অন্যান্য গান-বাজনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রকমারি গলায় এবং বিচিত্র ঢঙে সুরে-বেসুরে রবীন্দ্রনাথ হুুজুরে হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন৷

আগের তুলনায় এটা আরেক রকম গানের গৎ৷ পাঠক চেষ্টা করলে জীবনযাপনের অন্যান্য দিকেও - বিশেষ করে শিক্ষা সংস্কৃতি এবং বিনোদনের ধারাতে - এই নতুন বিশ্বের সন্ধান পাবেন৷

এবার আরেক রকম গানবাজনা আর তার সামাজিক অনুষঙ্গের কথা বলি৷

রবিবার বাইশে জানুয়ারি, দু’হাজার বারো৷ শান্তিনিকেতন থেকে কুড়ি-পঁচিশ কিলোমিটার দূরত্বে ধান্যসরা গ্রামে আদিবাসী-সংস্কৃতি এবং লোক-সংস্কৃতি উৎসব হচ্ছে৷ গ্রামবাংলায় এটা হামেশাই হয়, শ’য়ে শ’য়ে হাজারে হাজারে মানুষ সমবেত হয়, সারাদিন সারারাত উৎসব চলে৷ দুপুরবেলা সবাই মিলে মাঠের ঘাসের উপর বসে শালপাতার থালায় একপেট ভাত-ডাল-ছ্যাঁচড়া-মাছের ঝোল-চাটনি খেয়ে নিল, তারপর শুরু হল বাদ্যভাণ্ড আর জগঝম্পের কানফাটানো আওয়াজ৷ যন্ত্রীদের যেমন উৎসব, তেমনি আমোদ শ্রোতাদের৷ তারপর নাচ-গান-নাটক ইত্যাদির সম্ভার নিয়ে দূরদূরান্তের নানান দল পালা করে সাজাতে লাগল প্রদর্শনের ডালি৷ এখনো জীবন্ত আছে এই লোকসংস্কৃতির ধারাগুলি, সিনেমা-টিভি-র চাইতে বেশি আদৃত, সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষই এগুলো বানায়, সাধারণ মানুষই অংশ নেয় এর লালন-পালন-গ্রহণ-বর্ধন-পরিমার্জন-পরিবর্তনের৷

আরেক রকম দুনিয়ার বিনোদনের কথা বললাম৷ গ্রামীণ রোমান্টিকতার খপ্পরে পড়েছি কিনা তার বিচার পাঠকের হাতে ছেড়ে দিলাম৷