আরেক রকম ● দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২২ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪২৮

ফিরে দেখা

সম্পাদকীয়

কুমার রানা


যে বাংলা আমার মুদ্রিত বাক্‌চর্চার প্রধান অবলম্বন, সোজা স্বাভাবিকভাবে আমার আয়ত্তে আসেনি৷ উড়িষ্যা সীমান্তবর্তী সুবর্ণরেখা-বিভাজিত যে ভূখণ্ডে আমার জন্ম ও বড় হওয়া, সেখানে বাংলার সঙ্গে পরিচয় অক্ষর মারফৎ - স্বরে অ, স্বরে আ - মা'র হাত ধরে৷ আমি সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছি - মা স্বাক্ষর ছিলেন; ইস্কুলে পাঠাবার সঙ্গতি ছিল৷ কিন্তু, ঠিক একটা বাড়ি পরেই যদি জন্মাতাম? বই না, ইস্কুল না, জন্মাবার আগেই আমার জন্য নির্দিষ্ট হয়ে থাকত বিদ্যাশিক্ষার নিশ্চিত অনধিকার৷ জন্মের ছাড়পত্র পেতে হত সারাজীবন প্রভুকুলের খিদমতে লেগে থাকার অলিখিত হলফনামা দিয়ে৷ ঘুম ভাঙতো অন্নচিন্তায়, ঘুম আসতো নিরন্নতায়৷ প্রাইমারি ইস্কুলে ভর্তি হওয়া আটকাতো না; কিন্তু সংখ্যা বলে, সেখানে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত না পৌঁছানোর সম্ভাবনা ছিল নিশ্চয়তর৷ আমার মা হতেন অক্ষরহীনা, আমার ভাষা হত ভারতের সমৃদ্ধতম ভাষাগুলির মধ্যে একটি - সাঁওতালি, কিন্তু আমার শিক্ষক সেটাকে বলতেন 'ঠার' - অর্থ ইশারা, ইঙ্গিত - শ্রমজীবীদের আবার ভাষাসমৃদ্ধি থাকে নাকি? তিনি আমাকে দেখতেন অতি বিচিত্র এক প্রাণী হিসেবে, যার লেখাপড়া করতে আসাটা দুঃসাহস৷ এবং বাংলা ভাষাটা আমার শেখা হত না৷

বাংলাটা কি সত্যিই শিখেছি? না, সম্ভবত বাকি জীবনটাও ভাষা শিখতে শিখতে কাটাতে হবে৷ যত দিন যাচ্ছে, মুদ্রিত বাংলা রচনাভাণ্ডারের সঙ্গে সঙ্গে অমুদ্রিত মৌখিক বাক্‌সম্ভারের পরিচয় বাড়ছে, ততই বিস্মিত হচ্ছি৷ কী অসামান্য সব সৃষ্টি! চর্চার কী প্রভূত বহুত্ব, সামান্য জিনিসের অসামান্য উপস্থাপনা, অ-সাধারণ বিষয়কে সাধারণের নাগালে নিয়ে আসার কী উদ্যমী প্রয়াস!

এ এমন এক খনি যা শেষ হবার নয় - যতই তুলতে থাকি, তার সম্ভার যেন ততোধিক বেড়ে ওঠে৷ কিন্তু, যে মুহূর্তে পুরনো সিন্দুকটা বন্ধ করে টাটকা দিনের মুখোমুখি হই, কেমন যেন এক অনালোক ঘিরে ধরে৷ এমন এক ব্যাপার উত্তরাধিকারের যথার্থ মর্যাদা তো তার উত্তরণে, নতুন নতুন সংযোজন-প্রস্থানে৷ ভাষা থিতু হতে পারে না, কিন্তু অ-স্থিতির অর্থ তো দিগ্‌ভ্রান্ত দৌড়ে বেড়ানো নয়৷ সুস্থির চিন্তায় তার যে বহমানতা, সেটাই তো তার সমৃদ্ধি৷ লিপিচর্চার গৎ এখন অনেক সুস্থিত, গতানুগতিক নানা অস্থিরতা থেকে সুরক্ষিত কিন্তু চিন্তার সঙ্গে তার যোগটা কি অম্লান থাকছে?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি পুরনো সিন্দুকে আর বাংলার প্রান্তে প্রান্তে, নানান অলিন্দে, অঙ্গনে৷ দেখার চেষ্টা করি, ঠিক কী

ভাবে সে সিন্দুকটা গড়ে উঠেছিল, কী কী সে আহরণ করেছিল, কোথা থেকে পেল সে তার রসদ৷ এমন নয় যে, সে খনির সবাই রত্নময়; অনেক ঝুটো জিনিসও ছিল - সেগুলো ক্ষয়ে গেছে কালের নিয়মে৷ কিন্তু যেগুলো থেকে গেছে, সেগুলো খাঁটি হয়ে উঠেছে লৌকিক রসায়নে৷ গোটা সমাজটার সঙ্গে ক্রিয়াবিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তার গড়ে ওঠা - গ্রাম মিশেছে শহরে, জেলেপাড়ার রাস্তা চণ্ডীমণ্ডপ বোষ্টমদের আঙ্গিনা ছাড়িয়ে মিশেছে মসজিদের চকে, বাগদি বাড়ির উঠোনে ভাত ফোটার কলবল শব্দ উঠে এসেছে লেখকের কলমের ডগায়৷

তার মানে এই নয় যে, সমাজ খুবই বিভাজন-নিরপেক্ষ ছিল৷ শ্রেণি ছিল, জাতি ছিল; নিপীড়ন ও বঞ্চনা, ক্ষুধা ও অনাহার মৃত্যু-র সঙ্গে সঙ্গে কত কত বৈষম্য ও অবিচার ছিল৷ কিন্তু, ভাষা এগুলোকে উপেক্ষা না করে, এদের বেদনা ও প্রতিবাদ, ক্রোধ ও বিদ্রোহকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে উঠছিল৷ সে ভাষা যেমন নিজের অবয়বে বৈচিত্র্য আনছিল, তেমনি অবিচার, অন্যায্যতা, সুযোগ-বঞ্চনার বিপক্ষে নিজেকে প্রস্তুত করে তুলছিল৷ সমাজের তীব্র অন্তদ্বর্ন্দ্ব প্রতিভাত হচ্ছিল ভাষায়৷

কলমের এই শক্তি ও বৈচিত্রের উৎস কী? প্রসারের দিক দিয়ে দেখলে সমাজের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ অক্ষরের অধিকারী ছিলেন; মুদ্রিত বাক্‌চর্চার অনুশীলন ছিল সীমিত৷ তবুও যে এই বাংলায় ভাষা একা বিশেষ উৎকর্ষ অর্জন করেছিল, তার পিছনে পশ্চিমী আলোকায়নের ছটা যে খুবই ছিল তাতে সন্দেহ নেই৷ কিন্তু এটা কোনও কাজেই আসত না, যদি না বাংলায় ভিন্ন ভিন্ন বিন্দুগুলোর মধ্যে একটা সংযোগ গড়ে উঠত, ভাষা নানান ভূগোল, জনসমুদয়, সংস্কৃতি থেকে দু'হাতে আহরণ করে আত্মীভূত করত৷ এই গ্রহণ প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে যোগ হয় শ্রেণিসংঘাত আন্দোলনের, যা বুদ্ধিকে করে পরিণত ও তীক্ষ্ণ, মনকে করে সহমর্মী ও উদার৷

সমস্যা অবশ্যই ছিল, সহমর্মিতার পাশাপাশি বিভাজনটাও জারি ছিল - একা অভিভাবক 'আমরা' তৈরি হল, যেটা 'ওদের' প্রতিপালক, তাদের যাবতীয় চিন্তাভাবনার ঠিকাদার৷ দারিদ্রের অসহায় বাংলা নিজেই নিজের দুর্দশার অবসান ঘটাবে, এই চিন্তার জায়গায় ঠাঁই পেল 'ওদের' জন্য করে দেওয়ার কল্যাণবোধ৷ কিন্তু এ-সমস্যা দূর হওয়ার সুযোগ ছিল; সম্ভাব্যতা ছিল জোরালো সংহতির৷ সুযোগ ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাংলার যে প্রতিচ্ছবি বাংলার রচয়িতা ও চিন্তানুশীলকদের কলম ও আলোচনায় বৃহত্তর এক বাংলার ভাষা হয়ে গড়ে উঠছিল, সেখান থেকে একটা মহাপ্রস্থানের৷ সে প্রস্থানে ছোট ছোট বাংলা নিজেই নিজেকে প্রকাশিত করতে পারত - বাউড়ি, মাহাত, রাজবংশী, মুসলমান, সাঁওতাল নিজেই নিজের কথা বলতে পারত; চা-বাগান, চর, সুন্দরবন, লালমাটি, পশ্চিমবাংলার নানান প্রান্ত নিজ নিজ অধিবাসীদের রচনা-বৈভবে বিকশিত হয়ে উঠতে পারত৷

সেটা তো হলই না, উল্টে, বিভাজনটা যেন অনতিক্রম্য হয়ে উঠতে লাগল৷ এর একটা কারণ অবশ্যই এই যে, অর্জিত উৎকর্ষের হাত ধরাধরি করে পরিমাণের বিস্তার ঘটল না - আজও ব্যাপক মানুষ অক্ষরবঞ্চিত৷ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে অর্জিত উৎকর্ষকে পরিবর্তিত উত্তরকালে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য যে ওয়াকিবহাল আদান-প্রদান ও চর্চার প্রয়োজন ছিল, সেটা খণ্ডিত থেকে গেল৷ পারস্পরিক অংশভাগিতার কোনও ধারণাই গড়ে উঠল না৷ অন্যদিকে সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের জাড্য থেকে জন্ম নিল আপাতদৃষ্ট এক দ্বন্দ্বহীন সুস্থিতি৷ অ-স্রোত থেকে শৈবালের জন্মঃ শৈবাল থেকে অস্বচ্ছতা ও চিন্তার অপুষ্টি৷

তা হলে? এই পরাজয়ের বোধেই কি আমাদের জীবনযাপন, জীবনাবসান? 'আরেক রকম' ভাবে ভাবতে গিয়ে ঠেকে যাই - বাস্তবত এটা পরাজয়? জয়-পরাজয়ের নির্ণায়ক কোনও যুদ্ধ কি হয়েছে? না কি শুধু সমর্পণের, স্বেচ্ছায় যুদ্ধবন্দী হওয়ার আকুলি-বিকুলি? কোথাও কি কোনও উদ্‌যোগ নেই? পুরনো সিন্দুক হাতড়ে দেখি, এই চিন্তাদ্বৈধ বরাবরই ছিল - কিন্তু সেই সঙ্গে সেখান থেকে বেরোনোর পথ খোঁজাও ছিল৷ ঘরের বাইরে ভাঙাচোরা পথে চোখে পড়ে, রুগ্‌ণতাই সার সত্য নয়৷ নানাখানে, নানাভাবে দৃষ্টিহীন রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাইরে বাংলার লোকরা খুঁজে চলেছে এক গণ-রাজনীতির পথ-ঘাট৷ গোটা বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে আছে অজস্র সিন্দুক ভরে তোলার মতো বিপুল সম্ভার৷

সেটা এমনি এমনি হবে না - তার জন্য হিসাব চোকাতে হবে; অংশগুলো ঠিক ঠিক ভাগ করে দিতে হবে - বৃহত্তর বাংলার যে সুযোগ-বঞ্চনাকে স্বঘোষিত 'অভিভাবক' বাংলা নিজের নিরাপত্তার বেষ্টনী করে এসেছে, তাকেও এ হিসাবটা বুঝতে হবে যে, এ বঞ্চনার শিকার সে নিজেও; তাৎক্ষণিক লাভের বিনিময়ে সে দীর্ঘস্থায়ী অর্জনটাকেই বিসর্জন দিয়েছে৷ যে বালিকা মুখে মুখে রবীন্দ্রনাথের কবিতা সাঁওতালিতে তর্জমা করে ফেলে, সুযোগের অভাবে সে হয়ে যায় মেঝেন মুনিষ৷ যে বালক দেওয়ালে আমের কুশি দিয়ে ফুটিয়ে তোলে মুক্তির অসামান্য চিত্রকৃতি, তাকে বাঁধা পড়তে হয় শ্রমশোষণের অনড় খুঁটিতে৷ নানা ছোট ছোট বাংলায় বিপুল বৃহত্বগুলোকে স্বীকার না করার যে মূঢ় অহমিকা নাগরিক ভদ্রলোকত্বের সমার্থক হয়ে উঠেছে, তাকে পরাহত না করে নৈরাশ্যমুক্তির অন্য উপায় আছে বলে মনে হয় না৷ আরবি মূল থেকে আসা 'রকম' কথাটার আরও দুটো অর্থ আছে - অংশ এবং হিসাবের খাত৷ আমার কাছে 'আরেক রকম' আর একটা অংশের, আর একটা হিসাব মেটানোর সংঘর্ষে যোগ দেওয়া৷ সহায় পুরোনো সিন্দুক, সাহস বিস্তীর্ণ বাংলার অন্য কণ্ঠস্বর - এক মহত্তর ভাষা৷