আরেক রকম ● দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২২ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪২৮

ফিরে দেখা

সম্পাদকীয়

কৌশিক সেন


বাঁশবেড়িয়ার একটি অস্থায়ী মঞ্চে বিসর্জন নাটকটি অভিনয় করতে গেছি৷ মনে প্রবল আশঙ্কা, যদিও বাঁশবেড়িয়ার এই 'নাট্য উৎসব'টি যথেষ্ট জনপ্রিয়৷

রবীন্দ্রনাথের এই জটিল নাটকটি দর্শকের মনে রেখাপাত করতে পারবে তো? সার্ধশতবর্ষের হিড়িকে হয়তো আয়োজকরা এই নাটকটিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, ওখানকার দর্শকরা প্রস্তুত তো? পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়ও সেদিন সঙ্গে আছেন৷ তাই আমরা - অভিনেতা-অভিনেত্রীরা - যারপরনাই উৎকন্ঠায় রয়েছি৷ দ্বিতীয় ঘন্টাধ্বনির পর হঠাৎই আয়োজকদের পক্ষ থেকে যে ঘোষণাটি করা হলো, তা শুনে তো আমাদের হাত-পা হিম হবার জোগাড়... ঘোষক মহা উৎসাহে বলছেনঃ ''বাচ্চারা সবাই চুপটি করে চটের উপর বসে পড়ো - এক্ষুনি নাটক শুরু হবে - কেউ কোনো কথা বলবে না... আবার বলছি...''।

বলে কী? বাচ্চারা চুপটি করে বসে গালে হাত দিয়ে বিসর্জন দেখবে...?

বলতে-বলতেই কচি-কাঁচাদের কলধবনিতে মুখরিত হয়ে উঠল প্যান্ডেল, কলরব সমস্তই জায়গা দখল করা নিয়েঃ ঐ মিহি গলায় সুতীব্র বাদানুবাদ -‌ কখনো পিছনের দিকে চেয়ারে বসে থাকা বাবা-মা'দের উদ্দেশে সোচ্চার বায়নাঃ 'মা - জল খাবো'... 'বাবা - হিসু পেয়েছে'... 'মা, দাদা কান মুলে দিলো'... ইত্যাদি, ইত্যাদি৷ এইসব কিছুর মাঝে রঘুপতি-জয়সিংহ-গোবিন্দ মাণিক্যের সংলাপ, তাদের আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন-ভালোবাসা-বিশ্বাস-ভক্তি নিছকই 'মায়া' বলে মনে হতে থাকল৷ মনে হলো কোনোরকমে 'সংলাপগুলি' উগরে দিয়ে পালিয়ে আসব৷

অবশেষে 'তৃতীয় ঘন্টা'... overcure বেজে উঠল, বিসর্জন শুরু হলো, না কি শুরু হলো আমাদের অহমিকার বিসর্জন? চটের উপর বসে থাকা কচি মুখগুলো স্থির, অচঞ্চল, তীব্র কৌতূহলে তারা টানটান৷ মাঝে-মাঝে তারা কথা বলছে, কিন্তু নিজেরাই নিজেদের শাসন করে চুপ করিয়ে দিচ্ছেঃ প্রায় শ'খানেক বাচ্চা কী এক অমোঘ আকর্ষণে দেখছে-শুনছে দুই বিপরীত মতবাদের সংঘর্ষের কাহিনী৷

শ্রেষ্ঠ চমকটি তখনো আসেনি, এলো শেষ দৃশ্যে৷ জয়সিংহের মৃত্যুর পর রঘুপতিরূপী গৌতম হালদার তাঁর নিজস্ব ভাবনা অনুযায়ী মন্দিরের চাতাল দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যান৷ এই physical acting-এর নানান ব্যাখ্যা হওয়া সম্ভব, নানানরকম ভাবে দর্শকরা এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছেন৷ সেই সন্ধ্য্যায় বাঁশবেড়িয়ার ওই প্যান্ডেলের ভিতর, ডিসেম্বর মাসের ঠান্ডায়, বাচ্চারা রঘুপতির ওই গড়িয়ে পড়া দেখে উচ্চকন্ঠে হেসে উঠেছিলো৷ আমার মনে হয়েছিলো ওটি ছিলো একটি অত্যন্ত সঠিক ও অমোঘ প্রতিক্রিয়া, গোটা নাটকজুড়ে রঘুপতি নানান ছলে-বলে-কৌশলে যে রক্তপাতকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে, সেই হিংসানল যখন জয়সিংহকে তার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে যায় চিরকালের জন্য, তখন রঘুপতির যে 'পতন' - যে 'শোক' - তা 'বড়োদের' কাছে এক রকম মানে তৈরি করে, এক রকম প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়৷ 'শিশুরা' 'আরেক রকম' ভাবে তাদের ধিক্কার জানায়, তাদের হাসি হয়ে ওঠে রঘুপতির প্রতি তাদের তীব্র ব্যঙ্গের প্রকাশ৷

'ম্যাকবেথ' নাটকের দ্বিতীয় অভিনয়ের শেষে ক্লাস ফাইভের একটি ছেলে আমাকে তার নিজের হাতে আঁকা একটি ছবি তুলে দিলো৷ প্রথম দুটি অভিনয় সে দেখেছে, তারপর সে এঁকেছে ম্যাকবেথকে... জানালার ধারে একাকী - নিঃসঙ্গ ম্যাকবেথ, মুখের রেখায় স্পষ্ট অপরাধবোধ, দূরে দেখা যাচ্ছে অস্পষ্ট তিন ডাকিনীকে...

আর একটি শিশু, ক্লাস সিক্স-এ পড়ে, নাটক শেষে সাজঘরে এসে আমার কানে-কানে খুব গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করল - "ম্যাকবেথ নাটকের ভাষাটা পাল্টেছো - না? - ঠিক করেছো৷"

ওই 'ঠিক করেছো'র মধ্যে এমন একটা স্থিরতা ছিলো যা আমার কাছে 'আরেক রকম' সু-বাতাস বহন করে আনলো৷ প্রতিদিনই 'আরেক রকম'-এর আশায় আমার ঘুম ভাঙে, রোজই ভাবি আজ অথবা কাল আমাদের দেশ ও রাজ্যের নেতা-নেত্রীরা 'আরেক রকম' কথা বলবেন, মিথ্যে বলব না, বলেনও তাই৷ তবু সেই 'আরেক রকম'-এর রংচঙে বাণী কোথায় যেন মুহুর্তে মিলিয়ে যায়, আমি দেখি যাদবপুর থানার কাছে সিগন্যালে আমার কাচ তুলে দেওয়া গাড়ির জানালার পাশে কালি মুখে এক শিশু ঢোল বাজায়, অন্যজন পিচের রাস্তায় গনগনে গরমে ছোট্ট শরীর বাঁকিয়ে-চুরিয়ে কসরৎ দেখায় - 'আরেক রকম ভাবে' বেঁচে থাকার কসরৎ৷

তবু আমি তো পারি না 'আরেক রকম' পন্থা অবলম্বন করে ওদের নিয়ে গিয়ে 'নাটক' দেখাতে৷ দেখাতে পারলে ওরাও হয়তো প্রকাশ করতে পারত 'আরেক রকম' অনুভূতি অন্য শিশুদের মতো৷ 'লাল' আলো 'সবুজ' হয় - আমার গাড়ি হুশ্‌ করে বেরিয়ে যায়৷

'আরেক রকম'-এর খোঁজ চলতেই থাকে - অধরা থাকবে জেনেও...

বলতে ভুলে গিয়েছিলামঃ মাঝে-মাঝে কিছু নির্মল আনন্দদায়ক 'আরেক রকম' বাণীও শোনা যায় - যেমন কিছুদিন আগে শুনিয়েছেন মাননীয় শ্রী গিরীশ কারনাড - 'রবীন্দ্রনাথ মামুলি নাট্যকার ছিলেন' - মন্দ কী? 'আরেক রকম' তো হলো!