আরেক রকম ● দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২২ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪২৮

ফিরে দেখা

সম্পাদকীয়

গৌরী চট্টোপাধ্যায়


আজ এটা রূপকথার মতোই শোনাবে - একালের রূপকথা৷ দেশ তখনও স্বাধীন হয়নি৷ ভারত তথা বাংলা সাংবাদিকতার জনক হিসাবে খ্যাত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ঠিক করলেন যে নির্বাচন লড়বেন, তাও আবার হিন্দু মহাসভার হয়ে৷ যদিও তিনি চিরকাল নিজেকে নির্দল বলে জাহির করেছেন, নিষ্ঠার সঙ্গে রাজনৈতিক সতীত্ব বজায় রেখেছেন তাঁর বিভিন্ন পত্রিকায়৷

সেই সময়, রামানন্দ 'প্রবাসী' ও 'মডার্ন রিভিউ' ছাড়াও আরও একটি কাগজের প্রকাশক ছিলেন - হিন্দি দৈনিক 'বিশাল ভারত'৷ সেটির সম্পাদক ছিলেন রামানন্দের স্নেহভাজন বানারসীদাশ চর্তুবেদী৷ দুজনেই এতকাল বিশ্বাস করে এসেছেন যে সাংবাদিকতা আর রাজনীতি তেল আর জলের মতো, মিশ খায় না, এক করা উচিতও নয়৷

স্বভাবতই, রামানন্দের এই ভোলবদলে বানারসীদাশ যারপরনাই ক্ষুব্ধ ও আহত হলেন৷ আজ হলে তিনি নিশ্চই কর্তার ইচ্ছায় কর্ম বলে নিজের চরকায় তেল দিতেন৷ কিন্তু তখনও সাংবাদিকতা নিতান্তই চাকুরীজীবী হয়ে ওঠেননি৷ বানারসীদাশ তখনই তাঁর মণিবের এই হঠকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একটি জ্বালাময়ী সম্পাদকীয় লিখে ফেললেন এবং পরদিনের কাগজে তা ছেপেও দিলেন৷ তবে তাঁরও মনে হয়েছিল, কর্মচারীর এত বাড় ভালো নয়, তাই শুধু সম্পাদকীয় লিখেই ক্ষান্ত হলেন না, সেই সঙ্গে একটি ইস্তফাপত্রও লিখে রাখলেন৷ রাত পোহালেই জমা দেবেন মালিকের হাতে৷

পরের দিন দফতরে এসেই চিঠি হাতে মালিকের ঘরের দিকে যাবেন, এমন সময় রামনন্দ নিজেও একা চিঠি হাতে বানারসীদাশের দিকে এগিয়ে এলেন৷ ওটা নিশ্চই তাঁর বরখাস্তপত্র ধরে নিয়ে বাণারসীদাশ চেষ্টা করলেন নিজের পদত্যাগপত্রটি আগে প্রদান করতে৷ বলা বাহুল্য, মালিকের ইচ্ছাই জিতল৷ কিন্তু রামানন্দের চিঠিতে নেই কোনও ভৎর্সনা, নেই কোনোও সমালোচনা৷ তাঁর চিঠি 'সম্পাদক সমীপেষু' বিভাগে ছাপার জন্য, বাণারসীদাশের সম্পাদকীয়ের প্রত্যুত্তরে তিনি নিজের সিদ্ধান্তের কার্যকারণ ব্যাখ্যা করেছেন মাত্র৷

সেই রামানন্দও নেই, নেই সেই রামরাজত্বও৷ যদিও মিডিয়ার আজ কী না রমরমা৷ শুধু বাংলাতেই প্রায় নিত্যনতুন পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে, নতুন নতুন খবরের চ্যানেল চালু হচ্ছে, বিয়ের বাজারে সাংবাদিকদের আজকাল কদর দারুণ৷ নয় কোটি বাঙালির ৭৭ শতাংশ সাক্ষর, পত্র-পত্রিকার চাহিদা বেড়েই চলেছে৷

বণিকসভা ফিকি'র সম্প্রতি প্রকাশিত একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, আর বছর দুয়েকের মধ্যে বাংলা ভাষার কাগজ ম্যাগাজিনের ব্যবসা নাকি ৮০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে৷ এখনই, আনন্দবাজার পত্রিকা ও বর্তমান, বাংলা ভাষার প্রধান দুই দৈনিকের বিক্রি ইংরাজী প্রথম দু'টি সংবাদপত্র টেলিগ্রাফ ও টাইমস্‌ অফ ইন্ডিয়া-র চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি৷

তবে সাংবাদপত্রের এই সুদিন মানে সাংবাদিকতারও সুদিন, এমন কথা বোধহয় কেউ বলবেন না৷ বরং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা এক নয়, তা বুঝতে আইনস্টাইন হতে হয় না৷ অঙ্কটা খুবই সহজ৷ যত বেশি পাঠক, তত বেশি অর্থ৷ আর আর্থিক লোভের জন্যই তো কাগজ বার করা৷ তাই পাঠক পাওয়ার জন্য যা যা প্রয়োন তা করতেই হবে৷ গোটা বিশ্বে লক্ষ্মীর উপাসনাই সংবাদ জগতের একমাত্র লক্ষ্য৷ বিলেতে তার ফলে যদি নিখোঁজ বালিকার পরিবারের মনে মিথ্যা আশা জাগে বা একজন সেবিকা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন, দেশে তা রূপ নেয় অর্ধ-নগ্ন অভিনেত্রীর পায়ের কাছে নমাজ পড়ায় রত পাক ক্রিকেটারের ভুয়ো ছবিতে৷

মালিকানায় রকমফের অবশ্যই আছে কিন্তু সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তার কোনও তারতম্য নেই৷ যেমন, কোনও কোনও সংবাদ প্রতিষ্ঠান সোজাসুজি খবর বেচেই খায়৷ তারা লাভ-ক্ষতি হিসাব করে বিজ্ঞাপনের বহর মেপে৷ পশ্চিমবঙ্গে, বাংলা কাগজের ৭৩ শতাংশ আয় আসে বিজ্ঞাপন থেকে, ইংরাজী কাগজের সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৬ শতাংশ৷ তাই একাধারে সম্পাদকীয়তে ফেরেব্বাজ জ্যোতিষীদের বিরুদ্ধে বিষোদগার ও রাহুর দশা কাটাতে গ্রহরত্নের বিজ্ঞাপন দেখতে পাওয়া মোটেও বিরল দৃষ্টান্ত নয়৷

আবার কোনও কোনও গোষ্ঠী সাংবাদিক পোষে তাদের অন্য ব্যবসার স্বার্থে৷ সম্প্রতি এই বঙ্গে বেশ কিছু চিটফান্ডের মালিক (ডজনখানের তো বটেই, গোনা চলছে) রাতারাতি নতুন নতুন কাগজ-ম্যাগাজিন বের করে, টিভি চ্যানেল কিনে, নিজেদের নব্য মিডিয়া মোগলে রূপান্তরিত করে ফেলেছেন৷ তাঁরা সকলেই 'কালীঘাটের মুখে হাসি ফোটাতে' উদগ্রীব হলেও, সেটাই তাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে না৷ শাসকদলকে খুশি রাখার জন্য নানা রাস্তা খোলা আছে, মিডিয়ার দৈনন্দিন হ্যাপা না পোহালেও চলে৷ কিন্তু রথীমহারথীদের সঙ্গে দহরম-মহরমের ফলে আমজনতার কাছে এই ভুঁইফোঁড় 'গ্রুপ অফ কোম্পানি'-দের বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চই বাড়ে৷ ফলে তাদের চিটফান্ড বলুন, প্রোমোটারি বলুন, কৃষিজাত শিল্প বলুন, সব ব্যবসাই মিডিয়া লক্ষ্মীর ছোঁয়া পায়৷

তবে সাংবাদিকতা বলতে সব মালিকদেরই একই রা৷ বিক্রির জন্য খবর, খবরের জন্য বিক্রি নয়৷ লোকে যা 'খায়' তাই খবর, সেটাই উপভোগ্য করে পরিবেশন করা উচিত৷ সমাজের ভালোর জন্য পাঠককে জোর করে চিরতার জল খাওয়ানো মিডিয়ার দায়িত্ব নয়৷

সময়ের সঙ্গে চলতে গিয়ে সাংবাদিকরাও এই নির্মম সত্য মেনে নিয়েই চাকরি করছেন, বদলে পাচ্ছেন নানা ললিপপঃ মাস গেলে মোটা মাইনে, টলিউড-বলিউডের তারকাদের সঙ্গে ওঠাবসা, রাজ্যসভার সদস্য হওয়ার সুযোগ৷ প্রয়াত কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলতেন, 'ঐ দেখ, নির্ভীক রিপোর্টার, মুখেন মারিতং জগৎ, কিন্তু মালিকের ঘরে যদি দেখ, ভিজে বেড়ালটি, স্পিককি নট।' মজার কথা, এই সাংবাদিকরাই কিন্তু মন্ত্রীদের কাছে আমলাদের আত্মসমর্পণের কড়া সমালোচনা করতে ছাড়েন না৷

আসলে, বাঘা বাঘা রিপোর্টারের কাছেও ব্যবসায়িক সাফল্য ও গুণগত মান সমার্থক হয়ে গেছেঃ ভালো তাই বিক্রি বেশি, না হলে লোকে নিত না৷ সত্যি বলতে কী, আত্মমর্যাদা রক্ষার খাতিরেও সাংবাদিকদের পক্ষে অন্য কিছু ভাবা আর অসম্ভব৷

কিন্তু সব নিয়মেরই ব্যতিক্রম হয়৷ তাহলে অন্য রকম সাংবাদিকতা, আরেক রকম ম্যাগাজিনই বা হবে না কেন? যেখানে বিশ্বাসের জায়গা আছে, নির্ভয়ে নিজের মত প্রকাশের সুযোগ আছে, পাঠকের সীমিত মনঃসংযোগের ক্ষমতা সত্ত্বেও বড় লেখা ছাপার সাহস আছে, দুর্বোধ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছে আছে, কাউকে বেদীচ্যুত করতে পিছপা নয়...৷

হওয়ার কথা ছিল 'অন্য রকম', হয়ে গেল 'আরেক রকম'৷ আক্ষরিক অর্থেই৷ সম্পাদকমণ্ডলী চেয়েছিল এই পত্রিকার নাম হোক 'অন্য রকম', কিন্তু হল না৷ কেউ একজন ইতিমধ্যেই ওই নামটি দখল করে বসে আছেন৷ অর্থাৎ আরও কেউ কেউ অন্য রকম ভাবনা ভাবছেন৷ তাই হাতে এল 'আরেক রকম'৷ তা বেশ বেশ৷ খোয়াব দেখাল আরেক রকমের সাংবাদিকতার৷ নতুন রকম না-ও হতে পারে (রামানন্দ-বাণারসীদাশের যুগে ফিরে গেলেই বা মন্দ কী?), জনগণের ভূরিভোজ হবে না বোধহয়, আরেক রকমের লেখার লোক পাওয়া যাবে তো? তবু, বাঁধা গত থেকে বেরিয়ে আসার সময় ও সুযোগ হয়েছে৷ আশায় মন ভরে উঠল৷