আরেক রকম ● দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২২ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪২৮
প্রবন্ধ
সাধারণ কৃষকদের অসাধারণ লড়াইয়ের কাহিনি
গৌতম হোড়
জায়গাটা এখন খালি। সারি সারি তাবু নেই। সার দিয়ে দাঁড় করানো ট্রাক্টর নেই। যে ট্রাক্টরের উপর খড় বিছিয়ে রাখা থাকত। খড়ের উপর কম্বল। তার উপর বসে পাঞ্জাব, হরিয়ানা থেকে আসা বয়স্ক কৃষক। মুখের চামড়া কুঁচকে অনেক ভাঁজ ফেলেছে। সেই ভাঁজের আড়ালে থেকে গেছে অনেক লড়াইয়ের কাহিনি। তবে এতদিন সেই লড়াইয়ের জায়গা ছিল চষা খেত, ফসলের মন্ডি, ঋণদাতার প্রাঙ্গনে। এবার সেই লড়াইয়ের জায়গা আলাদা, বিষয় আলাদা, প্রতিপক্ষ আলাদা।
এ এক অন্য লড়াই, যেখানে প্রতিপক্ষ প্রবল প্রতাপান্বিত। এই লড়াইয়ে জায়গা হলো দিল্লির সীমানার সড়ক। সিঙ্ঘু সীমানায় সেই রাস্তায় গড়ে ওঠা আস্ত একটা শহর। যেখানে দাঁতে দাঁত চেপে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় মাটি কামড়ে পড়ে থেকে ওই বলিরেখাসমৃদ্ধ অভিজ্ঞ থেকে যুবক-যুবতী লড়াকু মানুষগুলির অদম্য জেদকে সঙ্গী করে লড়লেন একেবারে নিখাদ গান্ধীবাদী পথে।
সিঙ্ঘু সীমানায় প্রথম যাওয়ার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। একটু ঘুরে দেখেই মনে হচ্ছিল, এমনভাবেও আন্দোলন করা যায়। সেই সঙ্গে একটা প্রশ্নের বারবার মনের মধ্যে ঘোরাফেরা। কতদিন এই ভাবে আন্দোলন করা যায়, করা সম্ভব, বিশেষ করে প্রতিপক্ষ যেখানে নরেন্দ্র মোদী সরকার? আর কৃষকরা তো কোনও একটি সংগঠনের সদস্য নয়। ৩৫টি ছোট-বড় কৃষক সংগঠনের অনুগামী। অতীতে তো অনেকবারই দেখা গেছে, কিছুদিন পর এই ধরনের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়। ঐক্যে ভাঙন ধরে। সরকার যেখানে অনড়, ক্ষমতাসীন দল যখন বিরূপ, সেখানে এই ভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়াটা আজকের পরিস্থিতিতে কঠিন, সত্যিই কঠিন।
৩৬ বছরের সাংবাদিক জীবনে কম বিক্ষোভ তো দেখিনি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, সিঙ্ঘু সীমান্তে দেখা বিক্ষোভের চাল-চরিত্র-চেহারা এতটাই আলাদা, এতটা অন্যরকম যে চমকে উঠতে হয়। মনে হয়, এ বিক্ষোভ কোথায়, এ তো কার্নিভাল। আবার তারপর মনে হয়, এরকমভাবেও বিক্ষোভ দেখানো যায়। ট্রাক্টরের উপরে বসে থাকা বৃদ্ধ বলছেন, যাই হোক না কেন, ফিরে যাব না। এখানেই পড়ে থাকব। শান্তিপূর্ণ পথে দাবি জানাব, তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন বাতিল করতেই হবে। কতদিন থাকবেন? জবাব হলো, যতদিন দাবি না মানা হচ্ছে। এখনও চোখের সামনে ভাসছে ছোট একট মিছিল। পতাকা বহন করে স্লোগান দিতে দিতে সেই অস্থায়ী জনপদ ঘুরছেন নারীরা।
লঙ্গরের জায়গা থেকে ডাকাডাকি করছেন এক সর্দারজি। ছাঁচ খেয়ে যাওয়ার অনুরোধ। পুরি-সবজিও আছে। আছে হালুয়াও। পকোড়া ভাজা হচ্ছে। ফলের রসের টেট্রাপ্যাক আসছে। আসছে জল। যার ইচ্ছে, তিনি খাচ্ছেন। মনে পড়ে যাচ্ছিল, দিল্লির বিখ্যাত এইমস হাসপাতালের সামনে লঙ্গর বিতরণকারী এক সর্দারজির কথা। তিনি ও তাঁর সংগঠন কখনো এইমস, কখনো অন্য কোনো হাসপাতালের সামনে রোগীর আত্মীয়দের, গরিব মানুষের হাতে খাবার তুলে দেন। তিনি বলেছিলেন, পাঞ্জাবিরা আর কিছু করতে পারুক না পারুক, লঙ্গর দিতে পারে। সারাজীবন ধরে তো এই কাজই করে আসছি। সিঙ্ঘু সীমানায় দাঁড়িয়ে সে কথা আবার হৃদয়ঙ্গম করতে অসুবিধা হলো না।
এটা সত্যিই আলাদা বিক্ষোভ। এখানে কৃষকদের খেতের ফসল রান্না হচ্ছে। লঙ্গর আছে। ফলে দিনভর খাওয়া-দাওয়ার কোনও চিন্তা নেই। অন্য কারো কাছে হাত পেতে নয়। নিজেদের লঙ্গরের ঐতিহ্য ধরে রেখে, নিজেদের খাবারের ব্যবস্থা নিজেরা করে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন তারা। এমনকী সরকারের সঙ্গে যখন আলোচনা করেছেন কৃষক নেতারা, তখন নিজেদের খাবার নিয়ে গেছেন। বিজ্ঞান ভবনে ঝাঁ চকচকে মেঝেয় বসে, নিজেদের রুটি-সবজি খেয়েছেন। সরকারের দেয়া খাবার খাননি। এটাও ইতিহাস। অন্নদাতারা অন্যের নয়, নিজের অন্নেই ভরসা রাখেন।
একটা দিকে আছে প্রতিবাদের মঞ্চ। সেখানে ভাষণ হচ্ছে। কিছু মানুষ বসে আছেন। শুনছেন। কেউ কেউ তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছেন। আর সেই চত্বরের বাইরে রয়েছে একটা সাবধানবানী, বাজারি মিডিয়া থেকে সাবধান। যারা কৃষকদের কথা বলছে না, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই। ফলে কৃষকরা একটা লড়াই লড়েননি। তাদের বিক্ষোভ ও কৃষি আইন বাতিল করার দাবি নিয়ে লড়াইয়ের পরতে পরতে থেকে গেছে আরও অনেক লড়ায়ের কাহিনি। মিডিয়ার বিরুদ্ধে, নেতাদের বিরুদ্ধে, নেতার ছেলেদের বিরুদ্ধে, তাদের পিষে ফেলা গাড়ির বিরুদ্ধে, তাদের থামানোর জন্য, বিভেদ তৈরির জন্য নিরন্তর চেষ্টার বিরুদ্ধে এবং দিল্লির ভয়ংকর আবহাওয়ার বিরুদ্ধে। গরমে প্রায় ৪৭-৪৮ ডিগ্রির তীব্র দহনে বিপর্যস্ত হয়ে এবং শীতে তিন-চার ডিগ্রি তাপমাত্রায় জমে যেতে যেতে তারা লড়াই করে গেছেন।
কারা লড়াই করছেন? বড়, ছোট, মাঝারি কৃষকরা। তারা নিজের টাকায় রাস্তার ধারে আরও সিস্টেম লাগিয়ে পরিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা নিজেরা করছেন। ওয়াশিং মেশিন এনে নিজেদের জামা-কাপড় কাচার ব্যবস্থা করেছেন। পাতিয়ালা থেকে চিকিৎসক তাঁবু খটিয়ে বসে পড়েছেন। বিনা পয়সায় চিকিৎসা করেছেন। তৈরি হয়ে গেছে মিনি হাসপাতাল। এমনকী একটা লাইব্রেরিও খোলা হয়ে গেছে। যেখানে শোভা পাচছে রবীন্দ্রনাথ থেকে প্রেমচন্দ, ভগৎ সিং থেকে পাঞ্জাবের ইতিহাস, গল্প, উপন্যাস প্রবন্ধের বই। লাইব্রেরি চত্বরে গদির উপর বসে বই পড়তে কোনো পয়সা লাগেনি। বই নিয়ে গেলে জমা রাখা হয়েছে সামান্য সিকিউরিটি ডিপোজিট। বই ফেরত দিলে সেই টাকাও ফেরত। কোনো বিক্ষোভে লাইব্রেরি থাকার কথা ভূ-ভারতে কেউ কখনও শুনেছেন বা দেখছেন কি? আমি তো অন্তত দেখিনি।
বাঙালিরা অনেক গর্ব করে বলে না, তাদেরটা হলো কালচার, বাকিদের এগ্রিকালচার। তা সেই এগ্রিকালচারের ভিতরে থাকা কালচারের ধাক্কায় বাঙলির গর্ব কুপোকাৎ হতে বাধ্য। চিৎকার নেই, ঝগড়া নেই, অন্যকে থমিয়ে গায়ের জোরে নিজের মতপ্রতিষ্ঠা নেই, জঙ্গিপনা নেই, কুৎসিত কথার ফুলঝুড়ি নেই, আছে শুধু লক্ষ্যপূরণের দৃঢ়তা। যতজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা সকলেই বলেছেন, নেতারা যতদিন বলবেন, ততদিন থাকব। আর হেরে ফিরব না। দুটো দাবিই যে এমন অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাবে কে ভেবেছিল? স্বীকার করত বাধা নেই, এই অন্য ধারার আন্দোলন দেখার পরেও প্রথম প্রথম মনে হয়েছিল, কতদিন আর টানতে পারবেন তারা? ছ-মাস, আটমাস, এক বছর? তারপর দাবি আদায় করতে না পেরে লড়ইয়ের ময়দান ছেড়ে তারা আবার ফিরে যাবেন নিজের গ্রামে। যে ট্রাক্টর ছিল লড়াইয়ের হাতিয়ার, সেই ট্রাক্টর দিয়ে চলবে রুটিরুজির লড়াই।বাস্তবে তা হয়নি।
সিঙ্ঘুর সেই অস্থায়ী জনপদে বসত বাজার। জ্যাকেট, কমদামী অলংকার, ব্যাগ বা ঘরের সামগ্রী। বিকিকিনিও চলছে। দরদামও। মাদারি কা খেল নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন যায়াবররা। সবমিলিয়ে একটা উৎসব। কিন্তু সেই উৎসব তো বহিরঙ্গে, অন্তরে ছিল অদম্য জেদ, হার না মানার মনোভাব। যে কোনো কৃষকের কাছে বসলেই টের পাওয়া যেত, তাদের সেই জেদ। তাদের কাছে, এটা বেঁচে থাকার লড়াই। তাদের ভবিষ্যতের জন্য লড়াই। সেজন্য এই লড়াইয়ের ময়দান থেকে চলে যাওয়ার কোনও পশ্ন নেই।
বদলে গেল ছবি
প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেবেন। রাতে নয় সকালে। এই ঘোষণার পর জল্পনা শুরু হলো, বিষয় কী হতে পারে। সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে দশের কাছে ক্ষমা চেয়ে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন বাতিল করবে সরকার। হঠাৎ এই ঘোষণা। ততদিনে পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় অনেক গ্রামে কৃষকরা নেতা-মন্ত্রীদের ঢোক বন্ধ করে দিয়েছেন। উত্তর প্রদেশে চলন্ত গাড়ি পিষে দিয়ে গেছে কৃষকদের। অভিযুক্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ছেলে। উত্তর প্রদেশ জুড়ে কৃষকদের ক্ষোভ তুঙ্গে। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, উ্ত্তরাখণ্ড এমনকী মধ্যপ্রদেশে সরকারের উপর ক্ষুব্ধ কৃষকরা। ফলে অশণি সঙ্কেত দেখতে পেয়ে গিয়েছিলেন বিজেপি-র শীর্ষ নেতৃত্ব। তাই ক্ষমা চেয়ে আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা।
প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই গাজিপুর সীমানায়। সেই ট্রাক্টর আছে, তাঁবু আছে, লঙ্গর আছে, আছেন মাসের পর মাস ধরে আন্দোলন করে যাওয়া কৃষকরা। তারা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা শুনেছেন। শোনার পর চোয়াল যেন আরও শক্ত হয়েছে। তাদের শরীরের ভাষা বলছে, আমরাও পারি। আর তাঁরা মুখে বলছেন, তাহলে আমরাই ঠিক। আমাদের দাবি ঠিক। সেক্ষেত্রে দবি মানতে এতদিন কেন দেরি হলো? কেন এতজন কৃষককে প্রাণ দিতে হলো?
তখনও জয়ের চওড়া হাসি তাদের মধ্যে নেই। কেন? প্রশ্নটা করতেই ঝটিতি জবাব, ‘‘দাঁড়ান, আগে সংসদে আইন প্রত্যাহার করা হোক। আমাদের এমএসপি বা ন্যূনতম সংগ্রহমূল্য নিয়ে দাবি মানুক সরকার। কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করা হোক। তারপর তো চওড়া হাসি দেখবেন।‘‘
যখন পৌঁছেছিলাম, তখন সেখানে কৃষকের সংখ্যা কম। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করল। লাড্ডুর বাক্স এল। কিঞ্চিত উচ্ছ্বাস দেখা দিতে থাকল। কিন্তু ১৫ মাস ধরে লড়াইয়ের পর জয়ের আনন্দ সেটা নয়।
সেই আনন্দটা এল পরে। সরকারের লিখিত প্রতিশ্রুতির পর। তখন হলো বিজয়োৎসব। ফিরে যাওয়ার সময়। হেলিকপ্টার থেকে ফুল ছড়ানো হলো। সব কাঠামো খুলে ট্রাকে তুলে বাড়ির পথে চললেন কৃষকরা। রাস্তার দুপাশ জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ ফুল ছুঁড়লেন তাঁদের দিকে।
সিঙ্ঘু সীমানায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ৩২ বছর বয়সী মনজিৎ সিং উজ্জ্বল হলুদ রংয়ের বাস নিয়ে তৈরি ছিলেন। বাসের গায়ে লাল, সবুজ, বেগুনি বেলুন লাগানো। শেষ ট্রিপ দেওয়ার জন্য। তিনি পাঞ্জাবে বিনা পয়সায় কৃষকদের নিয়ে যচ্ছেন। ৫২টা ট্রিপ দিয়েছেন। তিনি এই কাজটা সেবা হিসাবে নিয়েছেন। জীবনে কখনো এত সেবা করেননি তিনি।
আপাতত লড়াই শেষ। ঐতিহাসিক লড়াই। জিতে ফিরছেন কৃষকরা। আর মনে করিয়ে দিয়েছেন আরেকটা মন্ত্রের কথা। যে মন্ত্র শিখিয়েছিলেন গুজরাতের পোরবন্দরের খাটো ধুতি ও চাদর গায়ে এক মানুষ। যার এক ডাকে আসমুদ্র হিমাচলের সাধারণ মানুষ নেমে পড়তেন রাস্তায়। লাঠি চলত, গুলিতে প্রাণ যেত। কিন্তু অহিংসাকে হাতিয়ার করে, সঙ্কল্পের দৃঢ়তাকে সঙ্গী করে ন্যায্য দাবি আদায়ের লড়াই করতেন তাঁরা।
কৃষকদের এই আন্দোলনে সেরকম কোনও একজন মানুষ ছিলেন না। কিন্তু ওই মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর পথ ধরে হাজার হাজার সাধারণ কৃষক ১৫ মাস ধরে অসাধারণ হয়ে উঠে জিততে পেরেছেন।
পুনশচঃ একটা বিষয় উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে। তা হলো, ৩৫টি কৃষক সংগঠনের নেতাদের এক হয়ে ১৫ মাস ধরে এই লড়াই চালিয়ে যাওয়া। শত প্রলোভনেও তারা বিচ্যূত হননি। এটাও কম কথা নয়।