আরেক রকম ● দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২২ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

বিজেপির মিশন কাশ্মীর

শেখর দাশ


২০১৪-র জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভার ভোটে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) হাঁক ছাড়ল মিশন - ৪৪+। অর্থাৎ ওই রাজ্যের বিধানসভা ভোটে ৪৪টার বেশি আসন জিতে একক গরিষ্ঠতায় সরকার গড়া। সেই ১৯৪৭ থেকেই জম্মু-কাশ্মীর রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ - জন সঙ্ঘ - বিজেপি - বিশ্ব হিন্দু পরিষদের চোখের বালি আবার নয়নের মণি! ভারতের পরিষদীয় ক্ষমতা অর্জন করতে এবং ধরে রাখতে সঙ্ঘ পরিবারের সবথেকে জবরদস্ত হাতিয়ার জম্মু-কাশ্মীর। ওই রাজ্যটি হাতে থাকলে বিজেপি দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একঢিলে অনেক পাখি মারতে পারে। কিন্তু ’১৪-র ভোট তাদের সুখ-স্বপ্ন পূরণ করল না।

তখনকার জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভায় মোট আসন ছিল ৮৭টি - কাশ্মীরে ৪৬, জম্মুতে ৩৭ এবং লাদাখে ৪। বিজেপি পায় ২৫টা। স্বপ্নের ৪৪+ থেকে বহুদূর! ফলে বাধ্য হয় শত্রু পিপলস’ ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি)-র সাথে কোয়ালিশন করতে। তাদের আসন ছিল ২৮। ২০১৫-র ১লা মার্চ বিজেপি-র সমর্থন নিয়ে পিডিপি-র মুফতি মহম্মদ সঈদ মুখ্যমন্ত্রী হলেন। ২০১৬-তে মুফতি মহম্মদ মারা গেলেন। ওই বছর ৪ঠা মার্চ মুফতি-কন্যা মেহবুবা মুফতি বিজেপি-র সমর্থন নিয়েই আবার মুখ্যমন্ত্রী হলেন। কিন্তু ওই প্রেমবন্ধন যে বেশি দিন টিকবে না তা’ বুঝতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতিষ ডিগ্রির প্রয়োজন ছিল না। সকলের অনুমানকে সত্যি ক’রে বিজেপি ২০১৮-র জুন মাসে মেহবুবা মুফতি সরকারকে ফেলে দিল। শেষ হল পিডিপি-বিজেপি মধুচন্দ্রিমা।

শুরু হল কাশ্মীর দখলের নতুন চক্রান্ত।

১৯৪৭-এর ২৬ অক্টোবর বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে কাশ্মীরকে ভারতের সাথে যুক্ত করা হয়। ওই বিশেষ শর্তে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের একটি আইনকে ভারত সরকার মান্যতা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ওই আইনে মহারাজ হরি সিং জম্মু-কাশ্মীরে অ-কাশ্মীরিদের জমি কেনা এবং চাকরি করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। অ-কাশ্মীরিরা তখন থেকেই সেখানে স্থায়ী নাগরিকত্বের অধিকার পেতেন না। আমরা জানি, ১৯৪৭-এ হরি সিং-কে দেওয়া প্রতিশ্রুতিরই ফল সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫-এ ধারা।

আর এস এস চিরকালই ওই দুই ধারার বিরোধী। জম্মু-কাশ্মীর হাইকোর্টে ওই আইন বাতিলের জন্য তারা দাবীও জানিয়েছিল। কিন্তু হাইকোর্ট তাদের নিরাশ করে। সুপ্রিমকোর্টও হাইকোর্টের সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানায়। সাময়িকভাবে সঙ্ঘ পরিবার পিছু হটে। কিন্তু লোকসভায় নিষ্ঠুর সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়ে নরেন্দ্র মোদী নিজেই সুপ্রিম কোর্ট! নিজেই সংবিধান! ফলে মোদী-শাহ ২০১৯-এর ৫ আগস্ট ওই দুই আইন বাতিল করে দিলেন।

২০১৪-র বিধানসভায় বিজেপি ২৫টা আসন পেয়েছিল মোট প্রদত্ত ভোটের ২৩% পেয়ে। কিন্তু মুসলিম প্রধান কাশ্মীর অংশে পেয়েছিল মাত্র ২.২%! অর্থাৎ জম্মু-কাশ্মীরকে দখল করতে হলে ভূস্বর্গকে কব্জা করা জরুরী। আর সেই উদ্দেশ্যেই সেখানকার জনবিন্যাসকে ঘেঁটে দেওয়া খুব প্রয়োজন।

৩৫-এ ধারা বাতিল ক’রে দিয়ে তামাম ভারতের সামনে কাশ্মীরকে উন্মুক্ত ক’রে দেওয়া হল। এখন যে কেউ  সেখানে জমি কিনতে পারবেন। যে কেউ সেখানকার স্থায়ীবাসিন্দা হতে পারবেন। আর স্থায়ীবাসিন্দা হলেই ভোটার। এই সুযোগটা প্রথমেই নিতে চাইবেন কাশ্মীরের প্রায় ৩০ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক। তামাম ভারতের গড় মজুরির তুলনায় জম্মু-কাশ্মীরে মজুরির হার ১.৪৩% বেশি। উত্তরপ্রদেশের তুলনায় ১.৫% এবং বিহারের তুলনায় ১.৬৪% বেশি। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়েও ওই লক্ষ লক্ষ মানুষ ওই রাজ্যে বাস করছেন বিশ/তিরিশ বছর। যাদের বেশিরভাগই হিন্দিভাষী মানুষ। দেশের(রাজ্যর)সাথে তাদের যোগাযোগ খুবই ক্ষীণ। সরকারী খরচেই ঘরবাড়ি ক’রে দেওয়া হবে। ঠিক প্যালেস্তাইনে যেমন চলছে! জম্মু-কাশ্মীরে এখন মোট জনসংখ্যা দেড় কোটি সেখানে ৩০ লাখ অনুগত ভোটার যুক্ত ক’রে বিজেপি কাশ্মীরের মুসলিম আধিপত্যে আঘাত হানতে চাইছে! শুধু পরিযায়ীরাই নন, বিজেপি ভোটার বানাতে চলেছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদেরও। সেই ১৯৪৭-এ কয়েক হাজার হিন্দু এবং শিখ জম্মু-কাশ্মীরে পালিয়ে আসেন। তাঁদের বর্তমান সংখ্যা সরকারী হিসেবে ২০ থেকে ২৫ হাজার। আর এস এস বলছে ৫ লাখ। অর্থাৎ সরকারী হিসেবের ২৫ হাজার উদ্বাস্তুকে ভোটার বানানো হবে। পাশাপাশি আরও কয়েক লাখ মানুষকে অন্য কোনোখান থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ওইরাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা ক’রে দেওয়া হবে। এই দেশে গরীব মানুষের দল পোকার মতো কিলবিল ক’রে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। লোভ দেখিয়ে কাজ না হলে অন্যপথে তাঁদের কব্জায় আনা হবে! ১৯৭৫-এ পাঞ্জাব থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল দলিতদের। সরকারী হিসেবে তাঁদের সংখ্যা ১০ হাজার। তাঁরাও হিন্দু ভোটারের সংখ্যা বাড়াবেন। এছাড়া রয়েছেন গোর্খা। এবং আরও অনেকে। জম্মু-কাশ্মীরে বহিরাগত যেসব শিক্ষার্থী ৭ বছর পড়াশুনো করেছেন এবং দশম বা দ্বাদশ শ্রেণী উত্তীর্ণ হয়েছেন তাঁরা ওই রাজ্যের স্থায়ীবাসিন্দা হতে পারবেন। আবার যেসব কেন্দ্র-সরকারী বা সর্বভারতীয় কোনো সংস্থার কর্মী ওইরাজ্যে  মোট ১০ বছর কাজ করেছেন তাঁদের ছেলে-মেয়েরাও স্থায়ীবাসিন্দা হওয়ার আবেদন জানাতে পারবেন। এমন আরও অনেক পথ-পদ্ধতিতে চলছে হিন্দু ভোটারের সংখ্যা বাড়ানোর কৌশল। বিজেপি অনুগত ব্যবসায়ী বা সরকারী কর্মীদের জন্য বিশেষ ‘প্যাকেজ’ থাকছে। এরই পাশাপাশি চলছে বিধানসভার আসনের পুনর্বিন্যাস। সেই বিন্যাস অনুযায়ী আগামী বিধানসভা ভোটে জম্মু অংশের আসনসংখ্যা ৬টি বেড়ে হবে ৪৩ আর কাশ্মীর অংশে মাত্র ১টি বেড়ে হবে ৪৭! অর্থাৎ আসনসংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের প্রায় সমান ক’রে দেওয়া হচ্ছে সংখ্যালঘু জম্মুকে! অথচ কাশ্মীরে আসন পিছু ভোটারসংখ্যা ১ লাখ ৪৬ হাজার, কিন্তু জম্মুতে ১ লাখ ২৫ হাজার! অর্থাৎ জম্মুর হারে ভোটার বিন্যাস হলেই কাশ্মীরে আরও কিছু আসন বেড়ে যেতে পারতো। তা’ হবেনা। কারণ, কাশ্মীরের আসন বাড়লেই বিজেপি-র ভয়। যদি এবার ২.২-এর নীচে নেমে যায়! তাই...।

অথচ আসন পুনর্বিন্যাস ২০২৬ পর্যন্ত স্থগিত রেখে জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভায় বিল পাস হয়েছে। তামাম ভারতের লোকসভার আসনও ওইসময় পুনর্বিন্যাস হওয়ার কথা। কিন্তু সেসব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। আর গণতন্ত্রকে মান্যতা দেওয়ার কোনো আগ্রহ বিজেপি-র কোনদিনই নেই। তাদের লক্ষ্য মিশন-কাশ্মীর।