আরেক রকম ● দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২২ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪২৮
প্রবন্ধ
রাজবংশীদের নিয়ে নোংরা খেলা
সুখবিলাস বর্মা
দুই বাংলার উত্তরভাগ, অসমের পশ্চিমভাগের বিস্তৃত ভূভাগের আদি জনগোষ্ঠীর পরিচয় ছিল দেশী মানুষ নামে। তাদের মুখের ভাষার নাম ছিল দেশী ভাষা। এই জনগোষ্ঠীর সামাজিক নৃতাত্ত্বিক পরিচয় জানতে ইংরেজ সরকারের উদ্যোগে বহু প্রশাসক নৃতত্ত্ববিদ গবেষণামূলক কাজ করেছেন। সেইসব গবেষণা কাজের ফলে উঠে এসেছে নানা অভিমত। কেউ বলেছেন রাজবংশীরা মঙ্গলয়েড, কেউ বলেছেন এঁরা দ্রাবিড়, কারও মতে আর্য-দ্রাবিড়-মঙ্গলয়েড মিশ্রিত এক গোষ্ঠী। কিন্তু সবাই একমত যে অন্য অনেকের মতো এই নৃগোষ্ঠীও স্থানীয় আদি বাসিন্দার স্তর থেকে সাংস্কৃতিক বিবর্তনের বা সংস্কৃতায়নের (sanskritisation) মধ্য দিয়ে পরিচিতি লাভ করে 'কোচ' নামে। কোচ থেকে আরও সংস্কৃত অর্থাৎ হিন্দুকৃত হয়ে এঁরা পরিচিত হন রাজবংশী নামে। এইসব গবেষক প্রশাসকদের অন্যতম ছিলেন Buchanon Hamilton (1812), B. H. Hodgson (1849), E. T. Dalton (1872), H. Beverley (1872), H. B. Rowney (1872), W. W. Hunter (1876), H. F. J. T. Megayer (1890), O. Donnel (1891), H. S. Risley (1891), E. A. Gait (1901), G. A. Grierson (1904) এবং O. Malley (1911). Imperial Gazetteer of India (1908)-ও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এঁদের সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে আচার্য সুনীতি কুমার চটোপাধ্যায়ের নাম। এইসব প্রতিবেদন থেকে উঠে এসেছে একটি বড় বিতর্ক - রাজবংশী ও কোচ কি অভিন্ন? মনে রাখা প্রয়োজন যে মূলত এই বিতর্ক থেকেই ১৮৯১ সালে দানা বেধেছিল ক্ষত্রিয় আন্দোলন।
১৮৯১ সালে লোকগণনার প্রাক্কালে এই জনগোষ্ঠী জাতির ঘরে 'কোচ' লেখার আদেশের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে 'রংপুর ব্রাত্য-ক্ষত্রিয় জাতির উন্নতি বিধায়নি সভা'। আন্দোলনের মূল দাবি - রাজবংশী ও কোচ পৃথক জাতি এবং রাজবংশীরা ব্রাত্য-ক্ষত্রিয়। তাই জাতির ঘরে 'ব্রাত্য-ক্ষত্রিয়' লিখতে হবে। রংপুর ধর্মসভার সভাপতি পণ্ডিত যাদবেশ্বর তর্করত্ন বিভিন্ন শাস্ত্র আলোচনা করে রংপুর জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে জানান যে কোচ ও রাজবংশী পৃথক জাতি এবং রাজবংশীরা ব্রাত্য-ক্ষত্রিয়। এই মতামতের উপর ভিত্তি করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ১৮৯১-এর ১৭ই ফেব্রুয়ারির আদেশ কিন্তু কার্যকরী হয়নি। ১৯০১ ও ১৯১১ লোকগণনায় একই ঘটনা ঘটে। ইতিমধ্যে নেতৃত্বে আসেন রায়সাহেব পঞ্চানন বর্মা। ১৯১০ এ তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে 'ক্ষত্রিয় সমিতি'। আন্দোলন তীব্র হয় এবং অনেক আলোচনা বিতর্ক বিশ্লেষণ ইত্যাদির পর জাতির ঘরে 'রাজবংশী' নাম গৃহীত হয়।
ভাষার ক্ষেত্রে অনুসৃত হয় একই নীতি। 'দেশী মানসির ভাষা আছিল দেশী ভাষা'। দেশী স্থানে রাজবংশী, অর্থাৎ ভাষার নামও রাজবংশী। ভাষার ক্ষেত্রে 'রাজবংশী' নামকে গ্রহণ ও স্বীকৃতি আরও যুক্তিযুক্ত হয় ১৯০৪ সালে জি.এ. গ্রীয়ার্সন-এর Linguistic Survey of India-র প্রতিবেদন প্রকাশের ফলে। গ্রীয়ার্সন-এর Linguistic Survey of India হল ভাষা নিয়ে ক্ষেত্র সমীক্ষা থেকে উঠে আসা তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন। বৃটিশ সরকার তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছিল সারা ভারতবর্ষের নানা ভাষা গোষ্ঠীর পরিচয় নিয়ে সমীক্ষার জন্য। তাঁর সমীক্ষার প্রতিবেদন রয়েছে ১৯টি খন্ডে, কোনো কোনো খন্ডে একাধিক ভাগ। সেই কারণে ভারতের যে কোনো ভাষা গোষ্ঠীর ভাষাতত্ত্বের আলোচনা শুরু হয় গ্রীয়ার্সনকে দিয়ে। ক্ষেত্র সমীক্ষার ভিত্তিতে 'রাজবংশী' নিয়ে রিপোর্টে কি লিখেছেন গ্রীয়ারর্সন? লিখেছেন - It is spoken in the following districts - Rangpur, Jalpaiguri, the tarai of the Darjeeling district, the Native State of Cooch Behar, together with the portion of Goalpara in Assam, already mentioned. ...We thus find that the Rajbanshi dialect is spoken by the following number of people: Grand Total 35,09,171. এলাকার ভাষার নাম 'রাজবংশী' সেই তথ্য ক্ষেত্র সমীক্ষা থেকে বেরিয়ে এসেছে - গ্রীয়ার্সন এই নাম চাপিয়ে দেননি। গ্রীয়ার্সনের সার্ভে ভিত্তিক তথ্য তাই সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, নির্মলেন্দু ভৌমিক, নির্মল দাস, গিরিজা শংকর রায়, সত্যেন বর্মন, দীপক রায় প্রমুখ সবাই মেনে নিয়েছেন। সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের মতে Linguistic Survey of India 179 languages and 544 dialects এর উপর সমীক্ষা করেছে। These figures are staggering indeed for any single country or state claiming to be a Nation. ক্ষেত্র সমীক্ষা থেকে উঠে আসা ভাষার নাম 'রাজবংশী' গ্রহণ করে গ্রীয়ার্সন প্রতিবেদনে এই ভাষা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন নানা উদাহরণ সহযোগে। তাঁর সুপারিশকৃত এই নাম গ্রহণ করেছেন দেশি-বিদেশি ভাষাবিদ, নৃতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক, লেখক সাহিত্যিক এবং রাজবংশী জনগোষ্ঠীর সর্বস্তরের মানুষ। কিন্তু রাজবংশী জনগোষ্ঠীর কতিপয় পণ্ডিতন্মন্য মানুষ গ্রীয়ার্সনের ক্ষেত্র সমীক্ষা থেকে উঠে আসা অভিমতকে মান্যতা দান করতে চান না। তাঁদের মতে এই ভাষার নাম রাজবংশী নয়, কামতাপুরী। এবং এই দাবীর পেছনে তাদের যুক্তি - রকমারি আবোল তাবোল। তাঁদের প্রধান যুক্তি যে এই নাম পরিবর্তন প্রয়োজন, কারণ রাজবংশী হল জাতিগত নাম এবং জাতিগত ভাষার নাম সমীচীন নয়। এক্ষেত্রে অবশ্যই প্রশ্ন ওঠে, 'দেশী' মানুষের ভাষা যদি 'দেশী' হতে পারে, বোড়োদের ভাষা যদি বোড়ো, নেপালীদের ভাষা যদি নেপালী, মনিপুরীদের ভাষা মনিপুরী, ওড়িয়াদের ভাষা ওড়িয়া, মারাঠীদের ভাষা যদি মারাঠী, পাঞ্জাবী, সিন্ধি যদি ভাষার নাম হতে পারে তবে রাজবংশীদের ভাষা রাজবংশী হতে অসুবিধা কোথায়? তাছাড়া ঔচিত্য সমীচিনতার প্রশ্ন এখানে অবান্তর। মাঠে (ক্ষেত্রে, জনপদে) যা আছে তাই উঠে এসেছে সমীক্ষায়। সমগ্র অঞ্চলের মানুষ প্রকাশ করেছে তাদের মুখের ভাষার নাম রাজবংশী। রাজবংশী ভাষাকে কামতাপুরী দাবী করার পেছনে ইতিহাস কি সেটা জানা প্রয়োজন।
ইতিহাস বলছে, এই দাবী কামতাপুর পৃথক রাজ্যের দাবীর সঙ্গে যুক্ত। উত্তরবঙ্গের মানুষ, বিশেষ করে রাজবংশী জনগোষ্ঠী কলকাতা কেন্দ্রিক রাজ্য প্রশাসনের কাছ থেকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার; এই জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক উন্নয়ন সব দিক থেকে পিছিয়ে - সব দিক থেকে তাঁরা বঞ্চিত, নিপীড়িত ইত্যাদি বিষয়ের উপর নানা অভিযোগ অনুযোগ নিয়ে এবং তার সমাধান কল্পে ১৯৬৯ সালে পঞ্চানন মল্লিক, জগদানন্দ রায়, হরিপদ রায় প্রমুখ রাজবংশী বিদ্বজনের নেতৃত্বে শুরু হয় উত্তরখণ্ড আন্দোলন। বছর দশেক পর একই অভিযোগের ভিত্তিতে ১৯৭৭-এ উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের নরেন দাস, বিজয় বর্মণ, রঞ্জনা রায়, কৃষ্ণ রায় প্রমুখ কতিপয় ছাত্র শুরু করেন উতজাস (উত্তরবঙ্গ তপশিলি জাতি ও আদিবাসী স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন)। কিন্তু সঠিক নেতৃত্বের অভাবে এবং উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জনগোষ্ঠীর সমর্থনের অভাবে সেসব আন্দোলন কিছুদিন পরেই মুখ থুবড়ে পড়ে। ১৯৯৬-এ উত্তরখণ্ড আন্দোলন থেকে বেরিয়ে অতুল রায়, নিখিল রায় প্রমুখ কতিপয় নেতা শুরু করেন কামতাপুর আন্দোলন, গঠিত হয় 'কামতাপুর পিপলস পার্টি'। সব আন্দোলনের মূল বিষয় - রাজবংশী জনগোষ্ঠীর উপর কলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালির চাপিয়ে দেওয়া বঞ্চনা। সেই সময়ে অসমে সংগঠিত আসু, আমসু, বোড়ো আন্দোলনের প্রভাবে কামতাপুরী আন্দোলনের একটি জঙ্গি মুখের সৃষ্টি হয় কে এল ও (কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন) নামে।
ইতিমধ্যে ১৯৯২ সালে কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ হাই স্কুলের সংস্কৃত শিক্ষক শ্রী ধর্মনারায়ণ বর্মা প্রকাশ করলেন A STEP OF KAMTA BIHARI LANGUAGE. এই পুস্তকে 'কামতাবিহারী' কথাটি শুধু বইয়ের নামকরণে ব্যবহার করে বাদবাকি সব জায়গায় তিনি এই ভাষাকে 'কামতাপুরী' বলে চালিয়েছেন এবং এই বিস্তৃত জনপদকে বলেছেন কামতাপুর। ধর্মনারায়ণ বর্মার প্রণীত তত্ত্ব হল যে '১২৫০ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বত এই জায়গাটির নাম কামরূপ আছিল। ১২৫০ খ্রীষ্টাব্দত রাজা পৃথু কামতাপুরত রাজধানী সারেয়া আনেন। সেলা থাকি এই রাজধানীর নাম হয় কামতাপুর রাজ্য'। তাঁর তত্ত্বের ভিত্তিতে কামতাপুর আন্দোলনকে ভাষা আন্দোলনের রূপ দেওয়ার চেষ্টা । কামতাপুরীকে বাংলা ভাষা থেকে পৃথক ইত্যাদি বলার চেষ্টা । পরবর্তীতে তাঁর সেই তত্ত্ব যে ভুল তথ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত সেটা স্বীকার করে নিয়ে ধর্মনারায়ন বর্মা বলেছেন যে কামতাপুর নয়, কামরূপের রাজা পৃথু, নাসিরুদ্দিন মামুদের সংগে যুদ্ধে ১২২৮ খ্রীষ্টাব্দে মারা যান; সুতরাং 'রাজধানীর নাম হয় কামতাপুর রাজ্য' এবং কামতাপুরের ভাষা কামতাপুরী এই তথ্য ও তত্ত্ব মিথ্যা। অথচ এই অসত্য তথ্যকে সম্বল করে ধর্মনারায়ণবাবু মানুষকে বিভ্রান্ত করে চলেছেন। ১৪১৮ বঙ্গাব্দে/২০১১ খ্রিস্টাব্দে তাঁদের 'রায়ডাক' পত্রিকায় ধর্মনারায়ণ বর্মা আবার ভুল তথ্যের ভিত্তিতে লিখেছেন, '১২৫৫ খ্রীষ্টাব্দের পর এই কামরূপের নাম হয় কামতাপুর। মহারাজ নরনারায়নের সময় অবিভক্ত আসাম ও অবিভক্ত উত্তরবঙ্গ ছিল কামতাপুর রাজ্য।' কামতাপুর নিয়ে ধর্মনারায়ণবাবুর একই মিথ্যাচারের পুনরাবৃত্তি। আবার তিনি বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের এক সন্ধ্যায় 'রায়ডাক' পত্রিকার অনুষ্ঠানে ঘোষণা করলেন, - এখন থেকে এই ভাষার নাম হল 'কামতাপুরী'। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজির অধ্যাপক গিরীন্দ্রনারায়ণ বাবুর বক্তব্য - 'এরই মধ্যে এক রাজনীতিতে তৈরী হল 'Rajbanshi Bhasa Academy' ২০১২ সালে। ...আবার আর এক রাজনীতিতে এই ২০১৭তে প্রস্তাব এল ভাষার নাম কামতাপুরী হিসাবে। 'কামতাপুরী একাডেমি' তৈরি হল। উতজাস আন্দোলন ও কামতাপুরী তত্ত্বের আর এক নেতা নরেন দাস বলছেন - রাজবংশী শব্দটি কালিকাপুরাণ, ভ্রামরীতন্ত্রের দ্বিতীয় ভাগ, বিষ্ণুপুরাণের চতুর্থ ভাগ, কামতেশ্বরী কুলকারিকা, হ্যামিলটন বুকানন ও জর্জ আব্রাহাম গ্রীয়ার্সনের লেখাতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ গ্রীয়ার্সনের ক্ষেত্র সমীক্ষা থেকে উঠে আসা 'রাজবংশী' শব্দটি বহু প্রাচীন এবং কমপক্ষে বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ কাল থেকে তা জনপ্রিয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও নরেনবাবু এই ভাষাকে 'কামতাপুরী' নাম দিতে বদ্ধপরিকর।
ধর্মনারায়ণ বর্মা নাম দিয়ে দিয়েছেন, গিরীন্দ্রনারায়ণ বলছেন ভাষার নাম কামতাপুরী হিসাবে প্রস্তাব এল ২০১৭-তে, কামতাপুরী ভাষা সাহিত্য পরিষদ এবং নরেন দাস বলছেন - নামকরণ করতে হবে। মোট কথা বর্তমান অবস্থা যাইই থাকুক না কেন, কামতাপুরী নামকরণ করতেই হবে। কামতাপুরী দাবীদারদের সকলের যুক্তিই মোটামুটি একইরকম, কারণ সবাই ধর্মনারায়ন বাবুর মিথ্যা তত্ত্বে বিশ্বাসী। 'কামতাপুরী ভাষা সাহিত্য পরিষদ' প্রকাশিত 'ভাষার নাম কামতাপুরী - প্রসঙ্গ, পরিপ্রেক্ষিত, বিতর্ক ও পর্যালোচনা' পুস্তিকাতেও তাঁরা এভাবেই তাঁদের যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের বিভ্রান্তি দূর করার উদ্দেশ্যে বাধ্য হয়ে আমি 'তথ্যের আলোকে রাজবংশী ভাষা' শীর্ষক ক্ষুদ্র পুস্তিকায় প্রকৃত তথ্য তুলে ধরি। তার পর থেকে মহামান্যগণ চুপ, কারণ তাঁদের সমস্ত মিথ্যা প্রকাশ পেয়ে গেছে। আসলে কামতাপুরী কথাটার মধ্যে রাজনীতিই বেশি, ভাষাতত্ত্ব নয় সেটা প্রকাশিত হয়েছে।
উল্লেখ্য যে Census Report-এর কোনও তালিকাতেই 'কামতাপুরী' নাম নেই। 'রাজবংশী' নাম কিন্তু সেখানে আছে। ২৫শে এপ্রিল, ২০১৭ তারিখে কামতাপুর পিপলস্ পার্টির কোচবিহার রাস মেলার সভায় মমতা ব্যানার্জী ঘোষণা করেন - 'রাজবংশী থাকবে, কামতাপুরীও থাকবে' অর্থাৎ রাজবংশী ও কামতাপুরী আলাদা ভাষা।
ভাষার নাম 'রাজবংশী' এই সত্যটি কমপক্ষে একশো বছর ধরে এলাকায় চলে আসছে। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ সেই ভাষাকে নিছক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নতুন নামকরণ করতে চাইছেন। কামতাপুর রাজ্য চাই, তাই কামতাপুরী ভাষার দাবী। একটা ভাষার নতুন করে নামকরণের অধিকার তাদেরকে কে দিল এই প্রশ্নের উত্তর তাঁদের জানা নেই। বিধানসভা, লোকসভার নির্বাচনে কেপিপি এই আন্দোলনের মূল এলাকাতে কখনো ২-৩ শতাংশের বেশী ভোট পায়নি। ২০১৬-র বিধানসভার নির্বাচনে তো কেপিপি নেই। ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে এই পার্টি এখন তৃণমূল কংগ্রেসের অঙ্গ। কে.এল.ও. নেত্রী মিতালী রায় তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক ছিলেন, কেপিপি-র নয়। গত জুন মাসে প্রয়াত কেপিপি প্রধান অতুল রায় তাঁর জীবন সায়াহ্নে হঠকারি আন্দোলন ছেড়ে দিয়ে বাস্তবমুখী হয়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন।
কিন্তু এখানেই তাঁরা থেমে থাকেননি; কামতাপুরীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব তাঁরা দিয়েছেন শ্রীমতি মমতা ব্যানার্জীর উপর। এই দায়িত্বভার পাওয়ার পর শ্রীমতি ব্যানার্জী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ নীতিতে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির পূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছেন। কোনও রাজ্যের অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে সংবিধানের ধারাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে তিনি কামতাপুরীকে অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজের স্বীকৃতি দিয়ে আইন পাশ করেছেন, বিরোধীদের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও। শুধু তাই নয়, Amendment এর মাধ্যমে আরও এক ধাপ এগিয়ে আইন পাশ করলেন যে কামতাপুরী (অস্তিত্ববিহীন) ও রাজবংশী দুটি আলাদা ভাষা। Official Language সংক্রান্ত Article 347 এর বিধান হল - Special provision relating to language spoken by a section of population of a State: On a demand being made in that behalf the President may, if he is satisfied that substantial proportion of the population of the State desire the use of any language, spoken by them to be recognized by that state, direct that such language shall also be officially recognized throughout that State or any part thereof for such purpose as he may specify. বাস্তবে যে নামে কোনও কথ্য ভাষা নেই, Census-এর কোনও তালিকাতেই যে নাম নেই, তাকে Official Language-এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী রাজবংশী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির পবিত্র উদ্দেশ্যে।
আমরা যতদূর জানি, কামতাপুরীদের দাবী রাজবংশী নামের পরিবর্তে কামতাপুরী নাম। তাঁরা কখনো দাবী করেননি যে কামতাপুরী রাজবংশী থেকে আলাদা। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি সেই মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করার পূর্ণ ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। এ ব্যাপারে তিনি বহুদূর পর্যন্ত এগিয়েছেন। ২৮.০২.২০১৮ তারিখে বিধানসভায় Official Language Bill-এর জবাবী ভাষণে বলেছেন যে রাজবংশী ও কামতাপুরী যে পৃথক ভাষা এই তথ্য তিনি পেয়েছেন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ থেকে। অধ্যাপক ভাদুড়ি আমাদের এই ভাষা সম্পর্কে তেমন ওয়াকিবহাল নন, কিন্তু কমিটির রাজবংশী ভাষাভাষী সদস্যরাও কি এই মত গ্রহণ করেছেন যে রাজবংশী ও কামতাপুরী দুটি আলাদা ভাষা? অত্যন্ত স্পষ্ট যে সরকারী কিছু সুবিধার লোভে নিজেদের স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে এঁরা মমতা ব্যানার্জীর রাজবংশী জনগোষ্ঠীকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করার অনুপ্রেরণা ও মিশনে মদত জুগিয়েছেন। উল্লেখ্য যে এই রিপোর্ট পেশ করার পরেই অধ্যাপক ভাদুড়ি পদত্যাগ করেন। দাল মে কুছ কালা হ্যায়। তবে মমতাজী এখানেই থেমে নেই। আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে প্রকাশ যে রাজ্য সরকার উত্তরবঙ্গের ৩০০টি প্রাইমারী স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত রাজবংশী ও কামতাপুরী ভাষায় পঠনপাঠন শুরু করতে চলেছেন। আর পঠন পাঠনের জন্য বইও ছাপানো হয়ে গেছে। অর্থাৎ রাজবংশী জনগোষ্ঠীর সর্বনাশের সমস্ত ব্যবস্থা পাকা।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে বিগত শতাব্দীর শেষ দশকের কথা, কামতাপুর আন্দোলনের তীব্রতায় চরম বিশৃঙ্খলার সময়ের কথা। সেই সময়ে আন্দোলনের অন্যতম দাবী ছিল প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে রাজবংশী ভাষার প্রচলন করা। আন্দোলনের তীব্রতায় বিরক্ত হয়ে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট রাজবংশী নেতা ও মন্ত্রী দীনেশ চন্দ্র ডাকুয়ার কাছে প্রস্তাব রেখেছিলেন,- কামতাপুরীরা যখন প্রাথমিক শিক্ষায় রাজবংশী ভাষা চাইছে, আমরা তা দিয়ে দিই। দীনেশবাবু রাজি না হয়ে বলেছিলেন যে এই ব্যবস্থা নিলে রাজবংশী জনগোষ্ঠীর সর্বনাশ হবে। বর্তমানে দেশের যা অবস্থা তাতে বাংলা ভাষা/বাংলা মাধ্যমে শিক্ষাই পর্যাপ্ত নয়, ইংরাজী মাধ্যমে লেখাপড়া না শিখলে কোথাও থই পাওয়া যায় না। তেমন পরিস্থিতিতে নতুন কোনো ভাষায় লেখাপড়া করলে তাদের ভবিষ্যৎ কি হবে? এর ফলে এই জনগোষ্ঠী এগিয়ে যাবে না, পিছিয়ে পড়বে। জ্যোতিবাবু যুক্তি মেনে নিয়েছেন। বছর কয়েক আগে জলপাইগুড়িতে নর্থ-ইস্ট কাউন্সিল-এর সভায় যখন এই যুক্তি দিয়ে বক্তব্য রাখি, বামফ্রণ্ট সরকারের প্রাথমিক স্তরে ইংরাজী তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের কুফল উল্লেখ করি, তখন শুধু ভাবাবেগ প্রকাশ ছাড়া কামতাপুরীওয়ালারা আর কিছু বলতে পারেননি।
মমতাজী যদি তাঁর দলের প্রবীণ রাজবংশী নেতাদের পরামর্শ চাইতেন, তবে একই প্রতিক্রিয়া পেতেন তিনি। আর একথা জানেন বলেই তিনি এ বিষয়ে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত রাজবংশী একাডেমির মত না চেয়ে একজন অ-রাজবংশী অ-ভাষাবিদের নেতৃত্বে কমিটি গড়েছিলেন। উদ্দেশ্য, এই জনগোষ্ঠীর মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়া।