আরেক রকম ● দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২২ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

জনস্বাস্থ্যের ইউটোপিয়া, ডিসটোপিয়া

স্থবির দাশগুপ্ত


ইতালীয় রেনেসাঁ থেকে যে-মানবতাবাদের সুর উঠে এসেছিল তার মূর্ছনা ইংল্যান্ডে এসে পৌঁছল ষোলর শতকে। সেই সুরধুনি যাঁরা তৎকালীন ইংল্যান্ডের জনসমাজে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্তত দু’জনের নাম উল্লেখযোগ্য। থমাস লিনেকার (১৪৬০-১৫২৪) ও থমাস মোর (১৪৭৮-১৫৩৫)। থমাস লিনেকার ছিলেন পণ্ডিতপ্রবর, চিকিৎসাবিদ্যায় নতুন নতুন ধারণার উদ্ভাবক। তাঁরই প্রেরণায় তৈরি হয়েছিল লন্ডনের রয়াল কলেজ অফ ফিজিশিয়ান্স। আর থমাস মোর ছিলেন সমাজ-দার্শনিক, লেখক ও মানবতাবাদী বা এককথায়, আদ্যোপান্ত সমাজ সংস্কারক। সমাজের রীতি-নীতি-আইন প্রণয়নে তাঁর অবদান ছিল ঐতিহাসিক। একটা নতুন, অশ্রুতপূর্ব, আদর্শ সমাজের রূপ-কাঠামো কেমন হবে, সেখানে চিকিৎসার ধরন-ধারণ কেমন হবে, তা নিয়ে তাঁর ভাবনা ধরা পড়েছিল তাঁরই রচনা, ইউটোপিয়া (১৫১৬) বইতে। সে যেন এক ‘সমাজতান্ত্রিক’ চেতনার অস্পষ্ট রূপরেখা।

অবশ্য তাঁর এই রচনায় যে কেবল কল্পনার প্রাবল্যই ছিল তা বলা বাহুল্যমাত্র; তাই কল্পস্বর্গ নামটা ছিল যথাযথ। সেই সুন্দর, সুশীল, প্রাণোচ্ছল সমাজে রোগকাতরতা থাকবে না, প্রতিটি নাগরিকের শৌচাগারও সোনা দিয়ে বাঁধানো থাকবে, এই দৃশ্য নয়নমনোহর বটে, কতটা কার্যকরী তা নিয়ে সকলেরই সংশয় স্বাভাবিক। কল্পনা মানে তো তাই যার যথার্থ অস্তিত্ব নেই। আবার অন্য দৃষ্টিকোণে, কল্পনা মানে তাও যার বাস্তবে রূপান্তরিত হওয়ার কিছু সম্ভাবনা আছে। ষষ্ঠ শতকের ইংল্যান্ডে সত্যিই তেমন সম্ভাবনা ছিল কিনা তা নিয়ে তর্ক থাকবে; কিন্তু জনমানুষের জীবনযাপন নিয়ে যে কল্পস্বর্গ রচনা করা যায়, সম্ভবত তার প্রথম, প্রখর প্রমাণ ধরা পড়ে ওই রচনায়। সমাজের চেহারাচরিত্র নিয়ে, চিকিৎসাবিদ্যার ভবিষ্যৎ রূপরেখা নিয়ে কল্পস্বর্গ রচনার দৃষ্টান্ত এর পরেও আমরা পেয়েছি।

বেঞ্জামিন ওয়ার্ড রিচার্ডসন (১৮২৮-১৮৯৬) ছিলেন প্রখ্যাত ব্রিটিশ চিকিৎসক, লেখক। ১৮৭৬ সালে তিনি লিখলেন ‘হাইজিয়া, এ সিটি অফ হেলথ’। সেই অনিন্দ্যসুন্দর নগরী গড়ে উঠবে ৪০০০ একর জমির উপর, থাকবে এক লক্ষ মানুষ আর কুড়ি হাজার ঘর। সেই ছিমছাম ঘরগুলোর দেওয়াল হবে ধূসর, কেননা ওই রঙটাই মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টিবান্ধব। হাইজিয়া শব্দটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে সেই নগরীর আদব। সেখানকার রাস্তাঘাট থাকবে পরিষ্কার, ঝকঝকে-তকতকে, কেননা সেখানে রাস্তার উপর দিয়ে যানবাহন চলবে না, চলবে সুড়ঙ্গপথে... সুড়ঙ্গরেলের ধারণা হয়তো সেকালেও ছিল! তবে সেই সুড়ঙ্গে কখনও মানুষ বসবাস করবে না, কেননা গুহায় থাকা মানে বর্বর যুগে ফিরে যাওয়া। বেঞ্জামিন সাহেবের রচনায় অন্তত এইটুকু ধরা পড়ে যে, এমন কল্পনা করা সম্ভব।

সম্ভব ছিল, কেননা আগেকার যুগগুলোর তুলনায় ঊনবিংশ শতকে ডাক্তারি পরিষেবা উন্নতই ছিল, নতুন নতুন উদ্ভাবন আর আবিষ্কারে নতুন যুগের সূচনা রচিত হচ্ছিল। অনেকে তখন ভাবতেন, এ হল ডাক্তারি পরিষেবার লৌহযুগ, স্বর্ণযুগে যেতে আমাদের আর দেরি নেই! তাই বেঞ্জামিন সাহেবের কল্পনাপ্রবণ মনে কোনও খাদ ছিল না, মানুষ এভাবেই ভবিষ্যতের কথা ভাবতে ভালবাসে। অবশ্য তার্কিকরা বলতে পারেন, অমন ভাবনার পিছনে যুক্তির ভার তেমন ছিল না... ঊনবিংশ শতকের শেষের দিক থেকে আমাদের আয়ুষ্কাল বেড়েছিল, নবজাতকের মৃত্যুও যে কমেছিল এ সবই ঠিক; কিন্তু তার জন্য জীবাণুবিদ্যা এবং ডাক্তারির অন্যান্য আবিষ্কারগুলোর চেয়ে স্বাস্থ্যবিধির (হাইজিন) অবদান ছিল অনেক বেশি। এইসব তর্কে অবশ্য ডাক্তারিবিদ্যা আর স্বাস্থ্যবিধি রচনার মধ্যে সম্পর্কটা আবছা হয়ে যায়।

তাহলে কি কল্পস্বর্গ রচনা করা ভুল? মানুষ কি উন্নততর সমাজের কথা কল্পনা করবে না? হোক না সে ভুল, তবু মানুষ তো কল্পনায় মুক্তি খোঁজে... এ যে তার স্বভাব। তাই সমাজজীবনের এক-একটা সন্ধিক্ষণে, এক-একটা সংকটকালে মানুষ নতুন করে ভাবতে বাধ্য হয়, নতুন ঘাটে নৌকো বাঁধতে চায়। সেই কাতরতা থেকেই হয়তো রচিত হয়েছিল, ‘মেন লাইক গডস’ (১৯২৩)। প্রথম মহাযুদ্ধের আঘাত আর স্প্যানিশ ফ্লু-এর ধ্বংসলীলার পর লেখক এইচ জি ওয়েলস (১৮৬৬-১৯৪৬) হয়তো ভেবেছিলেন, বিংশ শতাব্দিটা বুঝি বিভ্রান্তিতেই কাটবে; তাই এই শতাব্দিতেই এমন এক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যেখানে যাবতীয় সংক্রামক ব্যাধি সবংশে নির্মূল হয়ে যাবে। সে হবে এমন উন্নত এক সমাজ যেখানে মানুষ হয়ে উঠবে ঈশ্বরের সমকক্ষ, দুজনে কোলাকুলি করবে।

কিন্তু এর পরেই, কল্পস্বর্গের বিপরীতে এক নষ্টকল্প রচনা করলেন অ্যালডাস হাক্সলি (১৮৯৪-১৯৬৩)। আমেরিকায় যখন নিদারুণ আর্থিক সংকট, সারা দুনিয়ার বিচিত্র ভাষা, বিচিত্র সংস্কৃতির দেশগুলো যখন দাঁতে দাঁত চেপে নিজের নিজের ঘর সামলাতে ঘর্মাক্ত, তখন প্রকাশিত হল তাঁর ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’ (১৯৩২)। হাক্সলির আঁকা সেই অনাগত ভবিষ্যতের দুর্ভাবনায় আমরা যারপরনাই ম্রিয়মাণ। তবুও মানুষ আশা হারায়নি। কিন্তু কল্পস্বর্গ রচনার সেই সোনালী দিনগুলো শেষ হয়ে গেল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর। সেকথা জানিয়েছিলেন আরেক বিদূষী চিন্তাবিদ জুডিথ স্ক্লার (১৯২৮-১৯৯২)। একটা নৃশংস যুদ্ধ কীভাবে মানুষের সযত্নলালিত স্বপ্নগুলো নিমেষে খানখান করে দেয়, কীভাবে ‘সভ্যতার’ আলখাল্লা নিমেষে খসে পড়ে, মানুষ এখন তা নিজের চোখে দেখল, নিজের কানে শুনল, বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের তফাৎ ঘুচে গেল।

মানুষ নিজের শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে স্বভাবে দুর্বল; তাই বারবার সে উন্নততর স্বাস্থ্যের কথা ভাবতে চায়, নির্দ্বিধায়, নিঃসঙ্কোচে জীবন কাটাতে চায়। তারই জন্য সে নতুন নতুন স্বাস্থ্য পরিষেবার কাঠামো রচনা করে। দ্বিতীয় যুদ্ধের আগে সে-চেষ্টাও হয়েছিল। যুদ্ধের পরে আরও একবার ইংল্যান্ডের নাগরিকগণ জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবার সুখস্বপ্নে বিভোর হতে চাইলেন। কিন্তু স্বস্তি নেই; এর পর আরেক নষ্টকল্প নিয়ে এলেন জর্জ অরওয়েল (১৯০৩-১৯৫০)। ইংল্যান্ডে তখন একইসঙ্গে চলল জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা আর ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত অরওয়েল-এর ‘নাইনটিন এইটি ফোর’-এর পাঠ; স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্নের সমান্তরাল চলন। সেই স্বপ্নেরও সমাধি রচিত হল রাজনীতির কুটিল কোন্দলে আর আশির দশকে সোভিয়েতের পতনের পর। তার পর থেকে জনমানুষ দিশেহারা বা বলা চলে, দিশাহীন। প্রবলসম্ভাবী বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলোও যেন বিলীয়মান।

কিন্তু প্রকৃতি তো শূন্যস্থান বরদাস্ত করে না। এতকাল যাঁরা কল্পস্বর্গ রচনা করতেন তাঁদের হাত থেকে নিঃশব্দে দায়িত্ব নিয়ে নিল শ্রেষ্ঠীশ্রেনী, আমাদের চোখের সামনে, প্রকাশ্য দিবালোকে তারাই হয়ে উঠল সমাজ সংসারের পরিত্রাতা। তারা ঠিকই বুঝে নিল, জনশিক্ষা আর জনস্বাস্থ্যই জনসমাজের মেরুদণ্ড, সেটাই দখলযোগ্য। উন্নত শিক্ষার রূপ কেমন হবে, উন্নত মানুষের শরীরের আয়োজন কেমন হবে, কোন যাদুকাঠির ছোঁয়ায় ক্যানসার থেকে শুরু করে যাবতীয় সংক্রামক-অসংক্রামক ব্যাধি ভুপৃষ্ঠ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে তার হদিশ আছে কেবল শ্রেষ্ঠীশ্রেণির হাতে। শুরু হল আর এক কল্পস্বর্গের যুগ, অতি আধুনিক, উত্তর আধুনিক যুগ। ইতিমধ্যে প্রযুক্তির ঝর্ণায় আমরা উচ্চকিত হচ্ছি; নতুন নতুন কল্পস্বর্গে শ্রেষ্ঠীর হিসেবে দাঁড়াল সেই নব নব উন্মেষশালিনী প্রযুক্তির উপর - প্রযুক্তিই নতুন সমাজ গড়ে দেবে।

এই ধারণার বিপরীতে দাঁড়িয়ে অনেকে তখন বলেছিলেন, কল্পনা ভাল তবে তার বাড়াবাড়ি ভাল না; জনস্বাস্থ্যের বুনিয়াদি সমস্যাগুলোকে উপেক্ষা করলে যজ্ঞ নষ্ট হয়। কাজাকস্তান সরকার, ‘ইউনিসেফ’ আর ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র মিলিত উদ্যোগে ১৯৭৮ সালে হয়েছিল ‘আলমা-আটা কনফারেন্স’, বুনিয়াদি স্বাস্থ্য পরিষেবার রূপরেখা নিয়ে কথা হয়েছিল। সেটা কল্পস্বর্গ ছিল না, ছিল কঠিন বাস্তবকে মাথায় রেখে যথার্থ পরিকল্পনা। কিন্তু সেই মহৎ চেষ্টা দানা বাঁধবার আগেই বিশ্ববাণিজ্যের অমোঘ নিয়ম আরও রূঢ় বাস্তবের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটিয়ে দিল। স্বাস্থ্য-অস্বাস্থ্য নিয়ে হীন বাণিজ্যই সেই রূঢ় বাস্তব। শুরু হল ব্যাধি নিয়ে উদ্দীপনা, ভাবালুতার যুগ। তিলকে তাল না-করলে ওষুধ শিল্পের উন্নয়ন হয় না; তাই রোগ-ব্যাধির ভাবালু ধারণা প্রচার করে জনসমাজের স্বাস্থ্য রক্ষার ভার নিয়ে নিল আন্তর্জাতিক ওষুধ শিল্প।

আধুনিক কল্পবিজ্ঞান রচয়িতারা, যেমন স্যাতোশি (প্রোজেক্ট) ইটো (১৯৭৪-২০০৯) জানালেন, উন্নত স্বাস্থ্য আর উন্নত আয়ুষ্কালই তো মানুষের চিরন্তন স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন চরিতার্থ করার একমাত্র উপায় অন্য কিছু না, মানুষকে তার যাবতীয় চিন্তাশক্তি নিয়োজিত করতে হবে সুস্বাস্থ্যের উপর। ব্যক্তিসত্তা, নিজস্ব স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা থাকবে না, সামাজিক সত্তাই একমাত্র সত্য; সাবলীলতা থাকবে না, ‘তাসের দেশ’-এই আমাদের মুক্তি। তবেই না রচিত হবে ঐকতান - জনজীবনের একমাত্র, যথার্থ যুক্তি, আর যা যথার্থ তাই একমাত্র সত্য। সমাজের বৈষম্য নিয়ে কথা বলা অবান্তর, শুধু স্বাস্থ্যের সাম্য চাই। শুনে উচ্চবিত্ত, ভদ্রবিত্ত ভাবলেন, বটেই তো, একেই তো বলে বিজ্ঞান। নিম্নবিত্ত মানুষজন ভাবলেন, প্রযুক্তির বন্ধনেই মুক্তি, সে আবার কী! মধ্যবিত্ত সংশয়সংকুল, দোদুল্যমান, ‘আমি কোন পথে যে চলি’!

শ্রেষ্ঠী জানাল, এখন ‘১’ হল বীজমন্ত্র... ১ স্বাস্থ্য, ১ কল্পনা, ১ স্বাস্থ্য পরিকল্পনা, ১ রাষ্ট্র, ১ ধর্ম, ১ দল, ১ জাতি, ১ রাজনীতি, ১ অর্থনীতি। তবেই না আমরা ১ বিশ্বের নাগরিক হয়ে উঠব... ১ বিশ্বের ১ স্বাস্থ্য। সেই এক বিশ্বে ব্যাধির রূপ হবে এক, তার স্বভাব সারা বিশ্বে হবে একমাত্রিক, তাকে ধ্বংস করার নীতি আর কৌশলও হবে একমাত্রিক। কিস্কিন্ধ্যায় যে রোগের যে-চিকিৎসা, অযোধ্যাতেও তাই হবে, কাশ্মীরে বরফ পড়লে কেরলে কেঁপে উঠতে হবে... তবেই না ‘এক প্রাণ, এক মন, একতা’। বিশ্বের শ্রেষ্ঠীসমাজ একযোগে এমনই ভাবনা জারিত করেছে... একদিনে না, ক্রমান্বয়ে, ধীরে ধীরে। আমরা যখন বুঝেছি তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে। সবচেয়ে আগে যাঁদের বুঝবার কথা ছিল তাঁরা রাজনীতির কুসংস্কারে ডুবে থেকেছেন।

তাঁদের সম্পর্কে হুমায়ূন আজাদ বলতেন, ‘বিপ্লবীদের বেশি দিন বাঁচা ঠিক নয়। বেশি দিন বাঁচলেই তারা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে’! সবকিছু চুকেবুকে গেলে তাঁরা হয়তো ভাবতে বসবেন আর মনে মনে বলবেন, জানি না কোন বিপাকে আঙুর হয়ে যায় মদ! কিন্তু বিপাক তো সমাজে চলতেই থাকবে, তাই আমাদের মগজটাকেও সচল রাখতে হবে, শ্রেষ্ঠীদের চেয়েও বেশি। কারণ, স্বাস্থ্যের প্রতি আমরা তো অমনোযোগী হতে চাইনি, বরং শ্রেষ্ঠীরাই স্বাস্থ্যের অলীক ধারণা তৈরি করে দিয়েছে নিজের স্বার্থে। আমরা জানতাম, স্বাস্থ্যের কোনও সংজ্ঞা হয় না, সে এক উপলব্ধি মাত্র, প্রেমের মতো, অনুরাগের মতো, বাৎসল্যের মতো। কিন্তু শ্রেষ্ঠী বলেছে, স্বাস্থ্য হবে কোমরের মাপে, ব্যাধির পরিমাপে, ওষুধ ব্যবসার নিয়ম মেনে। চেয়েছি সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা, তার বদলে পেয়েছি সর্বজনীন স্বাস্থ্য বিমা।

বিমা কোম্পানির স্বার্থে চিকিৎসার নিয়ম-বিধি তৈরি হবে। ভেবেছিলাম, প্রযুক্তি আসবে আমাদের দরকারমতো; এখন দেখছি, প্রযুক্তির স্বার্থে আমাদেরই বরং নতুন করে সাজতে হবে। আমার স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য ওষুধ না, বরং ওষুধশিল্পকে বাঁচাবার জন্য আমাকে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। ত্যাগ মানে পীড়া, আমাকে পীড়িত হতে হবে, তার জন্য পীড়ার সংজ্ঞা বদলে দিতে হবে। সংক্রমণ আর পীড়ার তফাৎ ঘুচে যাবে। আগে আসবে টিকা, তার পর টিকা ব্যবহারের যুক্তি সাজাতে হবে, নইলে টিকাশিল্পের সর্বনাশ। আমরা বিশ্ববৈচিত্র্যের কথা জানতাম, এখন জানলাম একই ভাইরাস সারা বিশ্বে একইভাবে ছড়িয়ে পড়ে, একই তার স্বভাব, একই তার চিকিৎসা, একই তার পরিণতি। আমরা জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবার কথা ভেবেছি, এখন জানছি কর্পোরেট স্বাস্থ্য পরিষেবাই আমাদের নিয়তি।

এ সবই তো নষ্টকল্প, ডিসটোপিয়া... শ্রেষ্ঠী নির্দেশিত কল্পবিজ্ঞান। সেই কল্পবিজ্ঞানে ভর করে আমরা ভাবলাম, ‘লকডাউন’ যথার্থ (শুধু একটু-আধটু ভুলচুক হয়ে গেছে, এই যা!), ছয় ফুটের পারস্পরিক ব্যবধানেই আমাদের গৌরব আর মুখোশে মুখ ঢেকে রাখলে নির্বোধ ভাইরাস বিফল মনোরথ হয়ে যাবে। ভাবলাম, নিয়ম মেনে ঠিকঠাক যুদ্ধ করতে পারলেই ভাইরাস নির্মূল হয়ে যাবে। দেখলাম, আধুনিক ডাক্তারবদ্যিরাও ওয়েলস-এর কল্পবিজ্ঞানেই বাঁধা পড়ে আছেন, তাই ভাবলেন সামনের দুনিয়া নতুনভাবে নতুনরূপে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে বরণ করে নিতে হবে। সে যে কর্পোরেটের সুখস্বপ্নের দুনিয়া সেকথা বললেন না, বরং তার বদলে শুনলাম প্রলাপের ঐকতান... ‘সুশীল’ সমাজ, জঙ্গীবাদী ডাক্তার আর নতজানু ‘মিডিয়া’ এক সুরে গেয়ে ওঠে, চোপ, ‘আপৎকালীন’ অবস্থার আইন-কানুন বরণ করে নিতে হবে! অতিমারি উপলক্ষে এখন সকলেই অতিজ্ঞানী।

অতিজ্ঞানীদের মুখে শুধু আতঙ্কের ছেদচিহ্নহীন বাক্য - আমরা মৃত্যুর জন্য সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে আছি! সমগ্র বিশ্বের আবালবৃদ্ধবনিতার মধ্যে টিকাকরণ সম্পূর্ণ হয়ে গেলেই আমরা সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়ে যাব। এই বাণী শুনতে শুনতে আমাদের খেয়াল থাকে না যে, এক অখণ্ড অবসরে আমাদের এক প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি জানিয়েছেন, ‘ডিজিটাল দুনিয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার সঙ্গে আমাদের ব্যপক যোগাযোগ ঘটে। পাশাপাশি নতুন এই পৃথিবীতে মানবাধিকারের ভরকেন্দ্রেরও পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে’। মধুর বচন বটে। মানবাধিকারের ভরকেন্দ্র এখন কোথায় থাকবে তা অস্পষ্ট; তবে একথা স্পষ্ট যে মানবাধিকার, জনশিক্ষা আর জনস্বাস্থ্য... এগুলোর ধারণাও অতি দ্রুত লয়ে পালটে যাবে। নাগাল্যন্ডে সাম্প্রতিক গণহত্যা, সরকারি স্কুলগুলোর অগস্ত্যযাত্রা, টিকার উন্মত্ত অভিযান আর সরকারি হাসপাতালে বিমার ভীমপ্রয়োগ তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

অথচ মানবাধিকার, জনশিক্ষা আর জনস্বাস্থ্য ছিল আমাদের শেষতম বস্ত্রখণ্ড... নল-দময়ন্তি উপাখ্যানের ছদ্মবেশী পাখিরা তা কেড়ে নিয়ে উড়ে চলে গেল... আমরা এখন উলঙ্গ ছাড়া আর কী! সেই বোধও বুঝি হারিয়েছি। অথচ এই তো ছিল সময় আর সুযোগ, আমরা জনস্বাস্থ্য নিয়ে পুরনো কথাগুলো নতুন করে বলতে পারি - আমরা জনমানুষের অর্থে, তারই স্বার্থে স্বাস্থ্য পরিষেবার সর্বজনীন অধিকার চেয়েছি, তার এক বিন্দু কম বা বেশি কিছু না। আমরা সেই নকশা তৈরি করে শাসকের নাকের ডগায় ছুঁড়ে দিতে পারি। আমরা বলতে পারতাম, জনস্বাস্থ্য দাঁড়িয়ে থাকে যে-বনিয়াদগুলোর উপর তারা হল, সকলের মাথার উপরে ছাদ, শৌচালয়-শৌচাগার, তিন বেলা আহার, পরিস্রুত পানীয় জল আর নারীর হাতে আর্থিক ক্ষমতা। এগুলো না-করার কোনও অজুহাত আর শুনতে চাই না।

তা বুঝি আর করা হল না, আমরা একটিমাত্র ব্যাধির চর্চায় এতটাই মগ্ন থাকলাম, এমনই ‘মগন গহন ঘুমের ঘোরে’ যে, বিফল বৃষ্টি নেমেছে, বুঝিনি। তাই মনে হয়, এতকাল আমরা কোন গর্বে নিজেদের মননশীল ভেবেছি, কার জয়ধ্বনি করলাম, কীসের, কেন? তখন মনে পড়ে আর এক প্রবচন, ‘মানুষ সিংহের সাহসের প্রশংসা করে, কিন্তু শেষমেশ গাধাকেই বরণ করে।’


দোহাই -
● Building Utopia from Disaster: Could The Pandemic Show a Way to Better Healthcare? Agnes Arnold-Forster. BMJ, 2021;375:n2892 Published: 14 December, 2021
http://dx.doi.org/10.1136/bmj.n2892

● M G H Bishop & S Gelbier. British Dental Journal Volume 195, Pages: 251-255 (2003)

● Should We Aim to Create a Perfect Healthy Utopia? Discussions of Ethical Issues Surrounding the World of Project Itoh’s Harmony. Atsushi Asai, Taketoshi Okita, Motoki Ohnishi & Seiji Bito. Science and Engineering Ethics Volume 26, Pages: 3249-3270 (2020)

● Utopian Aspirations in a Dystopian World: “Health for All” and the Universal Health Coverage Agenda - An Introduction. By Ruth J. Prince.
http://somatosphere.net/2020/universal-health-coverage.html

● অতিমারির আতঙ্ক! নতুন পৃথিবীর কথা তুলে আনলেন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি।
https://bangla.hindustantimes.com/nation-and-world/htls-2021-former-cji-said-about-the-new-world-31638450233676.html

● হুমায়ূন আজাদের কিছু নির্বাচিত প্রবচন।
https://m.somewhereinblog.net/mobile/blog/janjabid_08/29005830/