আরেক রকম ● দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২২ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪২৮
প্রবন্ধ
আপাতত বাম ভাবনার পথে চিলি
শুভময় মৈত্র
সাধারণভাবে মনে হয় একনায়কতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের পথে হাঁটাটাই যুক্তিগ্রাহ্য। কিন্তু গণতন্ত্রে পৌঁছলেই যে সব সমস্যার সমাধান হবে তা নয়। আর তার একেবারে পাঠ্যবই থেকে তুলে আনা উদাহরণ চিলি। পিনোচেতের সামরিক শাসনের পর সে দেশ বারবার চেষ্টা করেছে গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে। কিন্তু লেখচিত্রে অনুভূমিক পথে সময়কে রেখে উল্লম্ব অক্ষে রাজনীতি ধরলে বামপন্থার দিকে দু-পা উঠতে গেলে এক-পা নামতে হচ্ছে ডানদিকে। তবে এই সময়ের খবর আবার বামপন্থার পক্ষে। সাম্প্রতিক নির্বাচনে জয়ী হয়ে সামনের মার্চ মাসে রাষ্ট্রপতি হতে চলেছেন গাবরিয়েল বরিশ্, বয়স মাত্র পঁয়ত্রিশ।
১৯৯০-এ পিনোচেতের একনায়কতন্ত্র সমাপনের পর বহুবার গণতন্ত্র দেখেছে চিলি, কিন্তু অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হয়নি মোটেই। মধ্যপন্থার বাঁদিক ডানদিকে পেন্ডুলামের নড়াচড়া চিলির শাসককুলের বৈশিষ্ট্য। এর মধ্যে ২০১৮-তে শুরু হওয়া পিনেরা-র দ্বিতীয় দফার রাজত্ব পুরোপুরি ডানপন্থী। এই জমানায় চিলিতে অর্থনৈতিক অসাম্য এবং সামাজিক বৈষম্যের ছবি স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছে জনগণ। তার বিরুদ্ধে বিপুল আন্দোলনের শুরু ২০১৯-এই। কোভিড অতিমারী না এলে এই আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করত তাতে সন্দেহ নেই। তাই অনেকটা স্বাভাবিক বিবর্তনেই এবার নির্বাচনে জিতে এলেন বাম মনোভাবাপন্ন যুবনেতা গাবরিয়েল বরিশ্। দায়িত্ব নেওয়ার তারিখ আগামী ২০২২-এর ১১ই মার্চ।
দক্ষিণ আমেরিকার মানচিত্রের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে পরিধি বরাবর চিলির অবস্থান। ক্ষেত্রফলে ভারতের চার ভাগের এক ভাগ, জনসংখ্যা কমবেশি দু' কোটি। মাথাপিছু গড় আয় ভারতের তিনগুণ, আর অর্থনৈতিক বৈষম্য এদেশের মতই তীব্র। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি ইনকা শাসনের অবসান এবং স্পেনের দখলদারির শুরু। তারপর আঠারোশো আঠারোতে স্বাধীনতা। গত শতকের ষাট সত্তরের দশকে বিশ্ব রাজনীতিতে সালভাদোর আলেন্দের কথা উঠে এসেছিল বারবার। পেশায় চিকিৎসক এই মার্কসবাদী নেতা ১৯৭০-এর তেসরা নভেম্বর চিলির রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। তবে তাঁর রাজত্ব খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তিন বছরের মধ্যেই বিশাল গোলমাল। ১৯৭৩-এর ১১ই সেপ্টেম্বর সেনা অভ্যুত্থানের কাছে নতি স্বীকার না করে সম্ভবত একে-৪৭ চালিয়ে আত্মহত্যা করেন। বিস্তর অনুসন্ধান এবং গবেষণা বলে (যা চলেছিল ২০১১ পর্যন্ত) রাইফেলের বাঁট মাটিতে ঠেকিয়ে নলটা নিজের চিবুকের তলায় রেখে গুলি চালান তিনি। আর এই অভ্যুত্থানের গোটা বিষয়টিকে বামপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন অনেকে। ক্ষমতা দখল করেন চিলির সেনানায়ক অগাস্তো পিনোচেত। ১৯৯০ পর্যন্ত পদ ধরে রেখেছিলেন তিনি। তবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চাপে ১৯৮৮ সালে হয় গণভোট এবং সেখানেই তাঁর বিদায় নিশ্চিত হয়। শেষমেশ ১৯৯০-তে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন পিনোচেত।
এই দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রনায়কের পতনের পরেও কিছুদিন চিলির অর্থনীতি মোটামুটি চাঙ্গা ছিল। রাজনীতিতে একনায়কতন্ত্র চালালেও মার্কিন সহযোগিতায় দেশের বাজার খুলে দিয়েছিলেন পিনোচেত। সামরিক শাসনের লৌহকপাট ভেঙে যাওয়ার পর নব্বইয়ের দশক থেকেই নিয়মিতভাবে শুরু হয় গণতান্ত্রিক উপায়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। নব্বই থেকে চুরানব্বই, এই চার বছর রাজত্ব করেন ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট নেতা প্যাট্রিসিও আলউইন। তিনিও ছিলেন সালভাদোর আলেন্দের বিরোধী। ফলে পিনোচেতের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ বিরোধিতা ছিল না। পরবর্তীকালে অবশ্য দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন এই নেতা। ১৯৮৮-র গণভোটে অনেকেই মনে করেছিলেন যে পিনোচেত জিতে যাবেন আবার এবং আরও আট বছর ক্ষমতায় থাকবেন। কিন্তু এইসময়ে সারা দেশে অসাধারণ দক্ষতায় পিনোচেত বিরোধী হাওয়া তোলেন রিকার্ডো লাগোস এবং প্যাট্রিসিও আলউইন। দেশের মূল অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন না করলেও, প্যাট্রিসিওর রাজত্বকালে কয়েকটি বিষয়ে অর্থনীতির ধারা ছিল জনমুখী। সমাজের প্রান্তিক মানুষের হাতে সম্পদ পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান ইতিবাচক। শ্রমিক-কৃষকের ন্যুনতম মজুরি এবং জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু সংস্কার সাধন করেছিলেন তিনি।
চিলিতে নির্দিষ্ট সময় অন্তর গণভোট হয় সংবিধান সংশোধন নিয়ে। ১৯৯৪-এর গণভোটে নির্ধারিত হয় পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন ছয় বছরের জন্যে। এবার ক্ষমতা পান ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটদের নতুন নেতা এদুয়ার্ডো ফ্রেই রুইজ-ট্যাগেল। তাঁর বাবা এদুয়ার্ডো ফ্রেই মন্তালভা রাষ্ট্রপতি ছিলেন ১৯৬৪-৭০, সালভাদোর আলেন্দের আগেই। পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার পুত্র এদুয়ার্ডো শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে বেশ ভালো কাজ করেছিলেন। তবে সমগ্র লাতিন আমেরিকার মতোই, তাঁর রাজত্বের শেষের দিকে চিলির অর্থনীতি খারাপ হতে শুরু করে। এরপর ক্ষমতা হস্তান্তর হয় ২০০০-এ। এবার জয়ী হন পার্টি অফ ডেমোক্র্যাসির নেতা রিকার্ডো লাগোস। ১৯৯০-তেই তাঁর রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার সুযোগ ছিল, কিন্তু সেইসময় নিজের জায়গা ছেড়ে দিয়ে সমর্থন করেন প্যাট্রিসিও আলউইনকে। রিকার্ডোর রাজত্বের ধারা ছিল মোটের ওপর বামঘেঁষা। তবে শুরুর দিকে তাঁকে সামলাতে হয় বিপুল বেকারত্বের সমস্যা। বছর তিনের মধ্যেই পরিস্থিতি কিছুটা হলেও সামাল দেন তিনি। তাঁর আমলেই ২০০৫-এর গণভোটে মানুষ মতদান করেন রাষ্ট্রপতির শাসন কমিয়ে চার বছর করার পক্ষে। রাষ্ট্রনেতা একটানা কম সময় ক্ষমতা ভোগ করছেন, সেটা অবশ্যই গণতন্ত্রের পথে ইতিবাচক পদক্ষেপ। এরপর ২০০৬ এর নির্বাচনে জয়ী হন সমাজবাদী নেত্রী মিশেল ব্যাসেলেট। ইনিই চিলির প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট। পিনোচেতের সামরিক শাসনে বেশ কিছুটা সময় দেশের বাইরে নির্বাসনে কাটাতে হয়েছে একাধারে চিকিৎসক এবং প্রতিরক্ষা বিষয়ে দক্ষ এই নেত্রীকে। রাজনীতিতে অগ্রজ লাগোসের রাজত্বে তিনি কাজ করেছিলেন স্বাস্থ্য এবং প্রতিরক্ষা দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে। কিন্তু তাঁর রাজত্বের শেষের দিকে আবার হাওয়া ঘুরতে শুরু করল ডানদিকে। ২০০৯-এর বিশ্বজোড়া মন্দা যে চিলিতেও প্রভাব ফেলেছিল তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সেখান থেকেই জনমনে কিছুটা ক্ষোভের জন্ম। ২০১০ সালে তাঁর রাজত্বের একেবারে শেষের দিকে চিলিতে হয় এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প। পরবর্তী পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষেত্রেও বেশ সমালোচিত হয়েছিলেন এই নেত্রী।
এই অবস্থায় ২০১০-এর নির্বাচনে জয়ী হলেন রক্ষণশীল দক্ষিণপন্থী প্রার্থী সেবাস্তিয়ান পিনেরা। আগেরবার তিনি হেরেছিলেন মিশেলের কাছে। পিনোচেতের সামরিক শাসনের পর পিনেরা-ই হলেন চিলির প্রথম গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত একেবারে দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রপতি। বিপুল ধনী হওয়ার কারণে নির্বাচনে জেতার জন্যে প্রচুর খরচ করেন তিনি। তাঁর আমলের সবথেকে বড়ো খবর ২০১২-য় তেত্রিশজন শ্রমিকের সত্তর দিন খনিগর্ভে আটকে থাকা। তবে তাদের উদ্ধারের ক্ষেত্রে বেশ ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিলেন পিনেরা। যদিও অতি দক্ষিণপন্থী নীতির কারণে বেশ কয়েকবার দেশবাসীর বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয় তাঁকে। রাজত্বের একেবারের শুরুর দিকেই ২০১১-য় তেলের দাম বাড়ানোয় বিপুল প্রতিবাদের ঝড় ওঠে সে দেশে। সে বছরই শুরু হয় বিপুল ছাত্র বিক্ষোভ। যা চলে প্রায় ২০১৩ পর্যন্ত। এবার নির্বাচনে জেতা গাবরিয়েল বরিশ্-এর রাজনৈতিক জীবনের শুরু সেই সময়। ২০১৪-তে মধ্যপন্থীদের সাহায্যে আবার ক্ষমতা ফিরে পেলেন সমাজবাদী মিশেল ব্যাসেলেট, দ্বিতীয়বারের জন্যে। এবারে তাঁর প্রচারের মূল অস্ত্র ছিল বিনামূল্যে উচ্চশিক্ষার প্রতিশ্রুতি। সে কাজে যদিও পুরোটা সফল হতে পারেননি। তার ওপর সমাজবাদী ভাবনায় দেশের বেসরকারি শিল্পক্ষেত্রে করের মাত্রা অনেকটা বাড়িয়ে দেন তিনি। খুব স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসার ক্ষেত্রে বেশ প্রভাব পড়ে এই সিদ্ধান্তে, এবং দেশের বাজার অর্থনীতিতে কিছুটা মন্দা আসে। এর মধ্যে দুর্নীতি সংক্রান্ত কিছু অভিযোগও ওঠে নেত্রীর পুত্র এবং পুত্রবধূর বিরুদ্ধে। জনপ্রিয়তা কমতে থাকে তাঁর। ২০১৮-তে দ্বিতীয়বারের জন্যে ক্ষমতায় ফিরলেন সেবাস্তিয়ান পিনেরা, তবে এবার নির্দল প্রার্থী হিসেবে। সমর্থন জানালো মধ্য-দক্ষিণপন্থী সংগঠন চিলে ভামোস। অর্থাৎ ২০০৬-২০১০-২০১৪-২০১৮ আদতে দু'বার করে বাম-ডানের বদল।
ক্ষমতার দম্ভ দেশনেতাকে বাস্তব থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। আর দক্ষিণপন্থী ভাবনায় দলের মধ্যে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর লোক যায় কমে। দ্বিতীয়বার দখল পেয়ে তাই জনগণের কথা ভুলে গেলেন পিনেরা। চটজলদি দক্ষিণপন্থী সংস্কারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করলেন তিনি। এর মধ্যে সবথেকে মারাত্মক হল রাজধানী সান্তিয়াগোতে মেট্রো রেলের ভাড়া বাড়ানো। এমনিতেই নিম্নবিত্ত মানুষের দিন এনে খাওয়ার খরচ বাড়ছিল বেসরকারিকরণের চক্করে। বাড়ছিল অসাম্য। তার মধ্যে মেট্রোর ভাড়া বৃদ্ধি একেবারে বিক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দিল। ছাত্ররা দখল নিল রেল স্টেশনের, মারপিট শুরু হল পুলিশের সঙ্গে। ২০১৯-এর আঠারোই অক্টোবর শুরু হয় ভাঙচুর, বাস জ্বালানো। তার পরের দিন জারি হয় কার্ফু। জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হয় পিনেরাকে, নামাতে হয় মিলিটারি। সান্তিয়াগোর সীমানা ছাড়িয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে চিলির অন্যান্য শহরেও। লক্ষ মানুষের মিছিলে উদ্বেলিত সারা দেশ। ২০১৯-এর শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলনে নিহত হন অন্তত তিরিশ জন, আহত এবং গ্রেফতার হন যথাক্রমে আড়াই এবং তিন হাজার মানুষ। ২০২০-র শুরুতেও জারি থাকে বিক্ষোভ। চলে পরীক্ষা বয়কট এবং প্রশ্নপত্র পোড়ানোর মাধ্যমে প্রতিবাদ। সে বছরের মার্চ থেকেই বিশ্বজুড়ে কোভিড অতিমারী। তাই স্বাভাবিক কারণেই চিলিতেও বিক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত হয়। কিন্তু আবার অক্টোবরে বিক্ষোভের বর্ষপূর্তিতে আবার মাঠে নামেন সাধারণ মানুষ। পিনেরার রাজত্বে চিলির যে তীব্র দক্ষিণপন্থার পথে হাঁটা, তাকে একেবারেই মানতে পারেননি সেদেশের জনগণ। ২০২০-র শেষে, নভেম্বরের আঠারো তারিখেও বিরাট মিছিল হয় সান্তিয়াগোতে। প্রতিবাদ ছিল পুলিশি জুলুমের বিরুদ্ধে, দাবি উঠেছিল পিনেরার পদত্যাগের। আসলে ২০২০-তে যে সংবিধান সংশোধনের কাজ শুরু হয়েছিল, সেখানে পিনোচেতের সময়ের কিছু একনায়কতন্ত্রী ভাবনা বজায় রাখার চেষ্টা করছিলেন পিনেরা। কিন্তু তার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন চিলির প্রায় আশি শতাংশ ভোটার। এই পরিস্থিতিতেই ২০২১-এর নির্বাচন।
এবারের জয়ী প্রার্থী গাবরিয়েল বরিশ্-কে মোটের ওপর নব্যবাম বলাই ভালো। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে অন্যতম পিনোচেত-পন্থী হোসে অ্যান্তনিয় কাস্ট। প্রথম রাউন্ডে সকলে মনে করেছিলেন গাবরিয়েল এগিয়ে থাকবেন। কিন্তু তা হয়নি। এর একটি কারণ হতে পারে নব্য এবং পুরাতন বামেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। রাজনীতির দিক থেকে আগের দুই বাম রাষ্ট্রনায়ক রিকার্ডো লাগোস এবং মিশেল ব্যাসেলেট-এর সমালোচনায় মুখর ছিলেন গাবরিয়েল। প্রথম পর্বে প্রায় ২৮% ভোট পান হোসে, সেখানে গাবরিয়েল ২৫%। তবে এর পরেই রাজনৈতিক কৌশলে পরিবর্তন আনেন যুব বাম নেতা। সমর্থন আদায় করেন রিকার্ডো এবং মিশেলের। এর সঙ্গে জনমুখী অর্থনীতির প্রচার তাঁকে এগিয়ে দেয় অনেকটা। কম বয়সী হওয়ার কারণে যুবক-যুবতীদের বিপুল সমর্থন পান তিনি, সঙ্গে অন্তর্জাল-ভিত্তিক সামাজিক মাধ্যমে চলে বিপুল প্রচার। ইতিহাস বলে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিলিতে প্রথম পর্বে জয়ী প্রার্থী পরের বারেও জেতেন। এবার তেমন হয়নি। বিপুল ৫৬% ভোট পেয়ে জয়ী হলেন গাবরিয়েল বরিশ্, বিরোধী যেখানে মাত্র ৪৪%। ডিসেম্বর উনিশ, ২০২১-এর এই ফল মনে করিয়ে দেয় ১৯৮৮-র ৫ই অক্টোবর চিলির নির্বাচনের ফলাফল। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সেদিন এই শতাংশেই সমর্থন জানিয়েছিলেন চিলির মানুষ।
আপাতত এই যুব বামপন্থী নেতার পেছনে বিপুল জনসমর্থন। কিন্তু সেখানকার সংসদে তাঁর সমর্থকদের প্রাধান্য খুব পরিষ্কার নয়। ফলে বামপন্থী সংস্কারমুখী যে সমস্ত কাজের প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন, তাঁর রূপায়ণ কতটা করতে পারছেন সেটাই আগামীদিনে দেখার বিষয়। অনেকে মনে করছেন, মার্কিন দেশে যেমন ওবামা একটি জনমুখী ভাবনার পথ নিয়েছিলেন, অনেকটা সেই পথেই বরিশের জয়। অর্থাৎ তীব্র বামপন্থা নয়, বরং উদারবাদী সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট গোছের একটা পরিচয় তাঁকে সাহায্য করেছে এই নির্বাচনে। জেতার পর বেশিরভাগ রাষ্ট্রনায়কের বক্তব্যই হয় অসাধারণ। সান্তিয়াগোর প্রশস্ত রাজপথে লাফ মেরে মঞ্চে উঠে জনগণকে কাঁপিয়ে দিয়েছেন বরিশ্ - "আমরা এমন একটি প্রজন্ম, যারা জনজীবনে এসেছি আমাদের অধিকারকে সম্মান দেওয়ার দাবিতে। এই অধিকার যেন কেউ ব্যবসায়িক ভোগ্যপণ্য হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ না নেন। আমরা কিছুতেই আর মানব না দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য, যার মূল্য দিতে হচ্ছে চিলির নিম্নবিত্ত মানুষদের। সামনের দিনগুলো অবশ্যই সহজ নয়। তবে সামাজিক সংহতি, নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করা এবং সকলের জন্যে একটা সুস্থ বাঁচার জায়গা তৈরি করার মধ্যে দিয়ে সুদৃঢ় উন্নয়ন পৌঁছে দিতে হবে চিলির প্রত্যেক মানুষের কাছে।" ডিসেম্বর ১৯, ২০২১ আর চৌঠা সেপ্টেম্বর ১৯৭০-এ বক্তব্যের ঢঙে মিল অনেক। আজকের বরিশ্ কি সেদিনের আলেন্দে? নেতাদের কথা শুনতে ভালোই লাগে, তবে সত্যিকারের কি কাজ হল তা বোঝা যায় ভবিষ্যৎ সময়ের বিবর্তনে অতীত হলে। সেইজন্যেই অপেক্ষা ইতিহাসের।