আরেক রকম ● দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২২ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪২৮

সমসাময়িক

কর্পোরেশন নির্বাচন ও অশনি সংকেত


সদ্যসমাপ্ত কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনের ফলাফল দেখিয়ে দিল, বিজেপি কতটা হাওয়ার ফানুশে ভর করে বাংলায় ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখেছে। গত নির্বাচনে দখলে রাখা সাতটি ওয়ার্ড থেকে শুরু করে লোকসভা নির্বাচনের হিসেবে কলকাতায় দখলে রাখা তেতাল্লিশটা ওয়ার্ড যেভাবে মাত্র তিনে নেমে এল, তাতে বোঝাই যায় যে টাকা ছড়িয়ে অথবা দলবদলের খেলায় মেতে উঠে, দিল্লি থেকে ওজনদার নেতাদের নিয়ে এসে বাংলার মাটির সঙ্গে যাঁদের কিছুমাত্র সম্পর্ক নেই, এবং তারকা প্রচারকদের ভিড় বাড়িয়ে ভোটের বাজারে সাময়িক চমক দেওয়া গেলেও দীর্ঘস্থায়ী ফল মেলে না। যে মুহূর্তে দেখা গেল যে বিধানসভায় প্রত্যাশিত ফল হল না এবং দখল হল না বাংলার মসনদ, সেই মুহূর্ত থেকেই বিজেপির বিপদ ঘণ্টা বেজে গেছে। দল ছাড়ার হিড়িক, দলের ভেতর চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা, উপদলীয় কোন্দল - এই সমস্তই নব্বই দশকের বাংলা বিজেপি-কে মনে করাচ্ছে। এই অবস্থান থেকে আবার ফিরে আসা কঠিন, এবং এর কারণটাও স্বাভাবিক। বিজেপির সমস্যা দ্বিবিধ। এক, নীতি নির্ধারণে, এবং দুই, স্থানীয় স্তরে সংগঠনে। কর্পোরেশনের মত নির্বাচনে স্থানীয় স্তরের ইস্যুগুলিকে না তুলে ধরে যদি সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি, দুর্নীতি, অনুপ্রবেশের মত বায়বীয় ইস্যুগুলি নিয়েই লড়া হয় - যেটা হয়েছিল লোকসভা নির্বাচনে, তাহলে ফল মেলে না। আর এই প্রথম সমস্যার কারণ হিসেবে দ্বিতীয়টা উঠে আসে। বিজেপির স্থানীয় স্তরে সংগঠন বা জনভিত্তি শূন্যের কাছাকাছি, অন্তত কলকাতায়। লোকসভা নির্বাচনে ভাল ফল মিলেছিল নরেন্দ্র মোদীর নামে। স্থানীয় নির্বাচনে মোদী পার করাবেন না। কিন্তু সেক্ষেত্রে স্থানীয় ইস্যুগুলি কী, তা বুঝতে গেলে ওয়ার্ডভিত্তিক সংগঠন প্রয়োজন। সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি অথবা শুধুমাত্র তৃণমূলের বিরুদ্ধে বড় বড় কথা তখনই বলতে হয় যখন নিজেদের অ্যাজেন্ডা থাকে না। কাজেই আপাতত বড়বাজার-ভিত্তিক অবাঙালীদের দল হিসেবেই থেকে যাবে বিজেপি।

তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থনের ভিত্তি স্বাভাবিকভাবেই বিশাল, এবং তা প্রত্যাশিতও। সবে ছয় মাস আগে বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে, এবং এই সময়টুকুর মধ্যে এমন কোনও বড় ঘটনাও ঘটেনি যার ফলে এই জনসমর্থনে ধস নামে। তৃণমূল স্থানীয় স্তরে জমাট সংগঠন বানিয়েছে, এবং তারা কাজ করেনি একথা শত্রুরাও বলবে না। দুর্নীতি যেমন হয়েছে, অনুদানমূলক কাজকর্ম ও উন্নয়ন কিছুমাত্রায় হয়েছে অবশ্যই। যেটা দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল সব স্তরের মানুষের সমর্থনই পাচ্ছে। বাংলায় এমনিতেই একটা প্রবণতা আছে, স্ট্যাটাস কুয়ো বজায় রাখবার। যে দল ক্ষমতায়, তার পক্ষেই ঝুঁকে থাকেন মানুষ, বড় স্তরের সমস্যা না হলে। সেক্ষেত্রে তৃণমূল মানুষের স্বাভাবিক পছন্দ হিসেবেই পশ্চিমবঙ্গে আরও কিছুকাল সরকারে থাকবে সেটা ধরে নেওয়া যায়। সমস্ত ভুল ও ভ্রান্তি, দুর্নীতি, গুণ্ডামি ও বিজেপিকে জায়গা করে দেবার অভিপ্রায়ের পরেও মানুষের পছন্দ তাকেই, আর তাই বাংলায় অদূর ভবিষ্যতে পট-পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম।

তবে এই নির্বাচন থেকে একমাত্র সদর্থক বার্তা যা উঠে এল, বামেরা কিছুটা হলেও রক্তক্ষরণ ঠেকিয়ে ভোটের নিরিখে উঠে এসেছে দ্বিতীয় স্থানে। বিজেপিকে পেছনে ফেলে বারো শতাংশ ভোট বা দুটি ওয়ার্ড দখলে রাখাই নয়, কলকাতার প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ ওয়ার্ডে তারা দ্বিতীয় স্থানে। বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে স্বল্প ব্যবধানে হেরেছে তারা। এই প্রবণতা দেখাচ্ছে যে বামেরা দীর্ঘমেয়াদি রাস্তায় থাকার সুফল পাচ্ছে। শ্রমজীবী ক্যান্টিন, করোনার সময়ে রেড ভলান্টিয়ারদের কাজ, এবং নির্বাচনী ইস্তাহারে গ্রিন সিটি, তৃতীয় লিঙ্গের পৌর অধিকার, বস্তিতে শ্রমজীবী পাঠশালা ইত্যাদি যুগোপযোগী যে দাবীগুলো তারা করেছে সেগুলো সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবথেকে উন্নত ও এগিয়ে থাকা রাজনৈতিক দাবীসমূহের মধ্যে থাকবে। এই দাবীগুলোকে ধরে যদি নিরবচ্ছিন্নভাবে রাস্তায় থাকা হয়, এর সুফল বামেরা সংগঠনের মাধ্যমে তুলবে। আর স্থানীয় সংগঠন শক্তিশালী হলে ভোট বাড়বে, আজ না হলেও আগামীদিনে।

কিন্তু অশনি সংকেত যেটা, তা হল এই নির্বাচনেও তৃণমূলের ভোট লুঠ, রিগিং ও গুণ্ডামি অব্যাহত। পঁচাত্তর শতাংশ ভোট একটা দল পাচ্ছে, কোনও কোনও ওয়ার্ডে তারা নব্বই শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে, এগুলো প্রহসনের ইঙ্গিত দেয়। এমন নয় যে ছাপ্পা না মারলে তারা জিততো না। হয়ত ভোট কমে পঞ্চান্ন শতাংশ হত, কিন্তু নিরঙ্কুশ আধিপত্য থাকলো তবুও। ভোটের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার বলেছিলেন যে কোনওরকম অশান্তি করা যাবে না, সেগুলো যে অসাড় বাগাড়ম্বর, প্রমাণিত হল আবারও। কিন্তু এখানেই একটা আশঙ্কা কাজ করছে। গত পঞ্চায়েত ভোটে চরম অশান্তি ও ছাপ্পাবাজির পর বাংলার মানুষ যখন বিরক্ত হয়ে বিজেপির দিকে মুখ ফেরালেন, সেই সংকেত অব্যর্থ লুফে নিয়েছিলেন মমতা, কারণ রাজনৈতিকভাবে তিনি ফ্লেক্সিবল। তারপর থেকে নিজেদের ভাবমূর্তি উদ্ধারের প্রয়াস ও সমস্ত অঞ্চলে গুণ্ডামি বন্ধের অন্তত দৃশ্যত কিছুটা প্রচেষ্টা তিনি করেছিলেন। এবার, যদি এটাই হয় যে মমতা বা অভিষেক সত্যিই চেয়েছিলেন যাতে কর্পোরেশন ভোটেও গুণ্ডামি না হয়? যদি সত্যিই এটা হয়, তাহলে তার পরেও যে গুণ্ডামিগুলো হল তার কারণ একটাই হবে সেক্ষেত্রে। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ব্যাপক টাকা ছড়িয়ে, কাটমানি তুলে ও অনুদানের মাধ্যমে যে বেনিফিশিয়ারি গোষ্ঠীগুলো তৃণমূল তৈরি করেছে, তাদের ঝুঁকি এতটাই বেশি যে অস্তিত্বরক্ষার স্বার্থে দলের আদেশ অমান্য করতেও তারা পিছপা হয় না। যদি গুণ্ডামি না হত, তৃণমূল কিছু ওয়ার্ডে হারত। কিন্তু এই মুহূর্তে বেনিফিশিয়ারিদের অসুবিধা এতটাই যে একটা ওয়ার্ডও তারা হারবার ঝুঁকি নিতে পারছে না। অর্থাৎ, তৃণমূলের যে জল্লাদ বাহিনী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বানিয়েছেন, তারা এবার তাঁরই হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, যাদের চাইলেও তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। বাঘের পিঠে চড়ে নদী পার হবার পর আর সেই পিঠ থেকে নামা যায় না, নামলে বাঘ খেয়ে ফেলে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামীর রাজনীতি বিরোধী দলের জন্য তো বটেই, এমনকী তৃণমূলের জন্যেও সুখের হবে না। তারা যখন বিদায় নেবে, সেটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতে না হয়ে রক্তাক্ত হবে, যে রক্তের বেসাতি তারা নিজেরা এতদিন করে এসেছে সেগুলোর প্রত্যাঘাত হবে তখন। এই বিপদ সংকেত নিয়ে তৃণমূল এখন মাথা ঘামাবে না কারণ জয় সব কিছু ভুলিয়ে দেয়, কিন্তু এটাই তাদের পতনেরও কারণ হবে।