আরেক রকম ● দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২২ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪২৮

সমসাময়িক

প্রসঙ্গ আধার সংযুক্তিকরণ


বারো সংখ্যার আধার দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবনে আঁধার ডেকে আনছে। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের জোট সরকার যে নীতি প্রণয়ন করেছিল তাকে কাজে লাগিয়ে ২০১৬তে আধারকে ব্যাঙ্ক, মোবাইল, রেশন, ১০০ দিনের কাজে বাধ্যতামূলক করতে আইন এনেছে সঙ্ঘ পরিবারের সরকার। মোদির নামেই সব চলে। আসলে সরকারের রিমোট কন্ট্রোল আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবারের কাছে। এবং এই সরকার চলছে আদানি আম্বানিসহ কিছু চোরপোরেট ও ইজরায়েলের স্বার্থরক্ষা করে।

এবার নতুন আইন এল, নির্বাচক তথা ভোটার তালিকার সঙ্গে আধার সংযুক্তি।

এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক পদক্ষেপ।

শুধু বিপজ্জনক নয় সর্বনাশা।

আমাদের মনে পড়তে বাধ্য ২০১৭-র ১৭ অক্টোবরের এই সংবাদঃ

সন্তোষীর পরিবার সিমডেগার করিমতী গ্রামের বাসিন্দা। সে গত ২৮ সেপ্টেম্বর মারা গিয়েছে। গ্রামে কোনও কাজ নেই, রোজগারের সুযোগ নেই। জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন অনুযায়ী ভর্তুকিযুক্ত রেশন পাওয়ার কথা। তবে সেটাও সন্তোষীর পরিবার পাননি।

অভিযোগ, গত ছয় মাস ধরেই স্থানীয় রেশন ডিলার সন্তোষীর পরিবারকে রেশন দেওয়া নিয়ে গড়িমসি করেছে। কারণ তার রেশন কার্ডের সঙ্গে আধার কার্ড লিঙ্ক করানো নেই।

প্রসঙ্গত, সুপ্রিম কোর্ট বারবার নিজের রায় ও পর্যবেক্ষণে বলেছে যে, সরকারি সুবিধা পেতে আধার কার্ড বাধ্যতামূলক করা যাবে না। বিশেষ করে খাদ্য সংক্রান্ত সরকারি সুবিধার ক্ষেত্রে।

এ-রকম কত শত সন্তোষী কুমারী মারা যাচ্ছেন কেউ জানেন না। আজকাল হইচই বেশি না হলে খবর হয় না। প্রায় কোনো রাজনৈতিক দল মানুষের না খেতে পেয়ে মরা নিয়ে সেভাবে চিন্তিত নয়।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে আন্দোলন নেই। ওষুধের দাম বাড়া নিয়ে কথা নেই। খড়্গপুর আইআইটি-র অবৈজ্ঞানিক অনৈতিহাসিক মিথ্যা তথ্য দিয়ে দিনপঞ্জি বা ক্যালেন্ডার করছে তা নিয়ে ছাত্র আন্দোলন নেই।

স্কুল ও কলেজে সার্ভিস কমিশনের চাকরি না থাকা নিয়ে ন্যায্য আন্দোলন কিছুটা আছে। কিন্তু বাকি সব নিয়ে নমো নমো একটা বিবৃতি। তাও অনেক সময় উধাও। হরিদ্বারে ধর্মসংসদের নামে চরম অধর্ম ও অপধর্মীয় শ্লোগান উঠল। বিক্ষোভে দেশ ফেটে পড়েনি। খোলাখুলি ২০ কোটি মুসলমানকে গণহত্যার কথা বলা হল। কোনো মামলা নেই। ধর্মসংসদের উদ্গাতা বলছেন, পুলিশ আমাদের লোক। গুজরাট গণহত্যার সময় এই কথাটাই শোনা গিয়েছিলঃ ইয়ে অন্দর কি বাত হ্যায়/ পুলিশ হামারে সাথ হ্যায়।

কে যে কার সাথে অন্দরে আছে, আর কে বাইরে - আজকাল বোঝা মুশকিল।

তাই আধার ভোটার তালিকা সংযুক্তি যে ভয়ঙ্করতম বিপদ তা অনেকেই বুঝতে পারছেন না।

প্রথমত, বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতি পরীক্ষিত সত্য নয়। আধার কর্তৃপক্ষ তা নিশ্চিত করতে পারেননি, একজনের বুড়ো আঙুলের ছাপ, চোখের মণি ইত্যাদি দিয়ে সঠিক মানুষকে খুঁজে বের করা সম্ভব নয়।

দ্বিতীয়ত, হায়দরাবাদে তিন জনের আধার কার্ড নিয়ে আধার কর্তৃপক্ষ বলেছে, এঁরা বুড়ো আঙুলের ছাপ জাল করেছে, চোখের মণিও জাল।

পরে পুলিশ বলেছে, এঁরা ছাড়াও এ-রকম ১২৭ জন আছেন।

পুলিশের কাছে তো আধার তথ্য যাওয়ার কথা নয়। যদিও এখন একটা পানের দোকানও মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়ার সময় আপনার আধার তথ্য জেনে যায়। তার কাছে থেকে যায় আপনার আঙ্গুলের ছাপ।

তৃতীয়ত, গুরুগাঁও অধুনা গুরুগ্রামের একটা খবর ২০১৮-তে বের হয়। ২৫০ টাকায় বুড়ো আঙ্গুলের চীনা ছাপ মিলছে। অনেকেই অফিসে অন্য সহকর্মীদের দিয়ে ছাপ দেওয়ার কাজ করাচ্ছেন।

ভোটের সময় তা হবে না কী করে বলা যাবে?

চতুর্থত, অনেক বয়স্ক মানুষের আঙ্গুলের ছাপ মেলে না। অনেকেই টাকা তুলতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন। ব্যাঙ্কে আধার লিঙ্ক করতে গিয়ে অনেকের অভিজ্ঞতাই সুখকর নয়। কীভাবে যে আধারে ছাপ নেয় ভুক্তভোগীরা জানেন।

পঞ্চমত, নির্বাচক তালিকায় আধার সংযুক্তি আসলে ই-ভোটের দিকে ঠেলা। বিদেশের বেশ কিছু দেশের সঙ্ঘ সমর্থক নাগরিকদের ভোটাধিকার দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তাঁদের ভোট নেবে অথবা তাঁদের হয়ে কেউ ভোট দেবে।

ষষ্ঠত, ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে সঙ্ঘী সরকারের মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেছিলেন, তাঁরা ৪৯,০০০ আধার কেন্দ্র বাতিল করেছেন। কারণ ভুল হয়েছে আধার করায়। পাঁচ বছরে এই ৪৯,০০০ কেন্দ্র দিনে একটা করেও আধার করলে ৮,৯৬,২৫০০ মানুষের আধার ভুল ধরতে হয়।

সপ্তমত, আধার সংযুক্তি আসলে মানুষের অধিকার বঞ্চিত করা। বহু মানুষের নাম রেশন থেকে বাদ গেছে। আধারের খোঁচায়।

অষ্টমত, ইচ্ছেমতো আধার দেখে ভোটারের রাজনৈতিক অবস্থান জেনে তাঁর নাম বাদ দেওয়া হবে না, এমন নিশ্চয়তা কোথায়?

নবমত, ভোটের দিন বিরোধী সমর্থকের আধার লিঙ্ক অকেজো করে রাখা যেতে পারে।

আজকের দিনে, সামাজিক মাধ্যমের যুগে কারো রাজনৈতিক অবস্থান জানা খুবই সহজ।

দশমত, ভোটার তালিকার সঙ্গে আধার সংযুক্তি মানে একটা মোবাইল রাখা বাধ্যতামূলক হয়ে যাচ্ছে। মোবাইল ফোন নম্বর আগে মাসে ১০ টাকা দিয়ে টিকিয়ে রাখা যেতো, এখন মাসে ন্যূনতম ১২৮ রাখা জরুরি। কতজন পারবেন? আর সবার কি মোবাইল আছে? না থাকা সম্ভব?

শেষ কথা, আধার নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। শেষ বারো মাসে ১৮২ দিন দেশে থাকলেই একজন আধার কার্ড পাওয়ার অধিকারী। দেশের নাগরিক না হয়েও একজন ভোট দিতে পারবেন।

অক্ষয়কুমাররাও তো এবার ভোটার হয়ে যাবেন।

এছাড়াও সুপ্রিম কোর্ট ২০১৭-তে এক রায়ে বলেছেন, আধার কার্ড বাধ্যতামূলক নয়। ভোটের সঙ্গে যুক্ত করলে তো আধার বাধ্যতামূলক হয়ে যাবেই।

এবং এতে ব্যক্তির গোপনীয়তা বলে কিছু থাকবে না। ভোটার তালিকায় আধার থাকলে দুষ্কৃতকারীরা সহজেই সব কিছু জেনে নেবে।

১০৪ জন প্রাক্তন আমলা এক সাহসী বিবৃতিতে বলেছেন, ভোটার আধার সংযুক্তির সিদ্ধান্ত ত্রুটিপূর্ণ, আইনের দৃষ্টিতে মন্দ, অসৎ অভিপ্রায়ে এবং অপব্যবহারের প্রবল সম্ভাবনা।

তথ্য সুরক্ষা বিলের খসড়া তৈরি কমিটির অধ্যক্ষ এবং দেশের প্রাক্তন আমলাদের নিয়ে গঠিত সংগঠনের সভাপতি বিচারপতি বি এন কৃষ্ণ বলেছেন, এই সংযুক্তি অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করবে।

বিবৃতিতে অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানার উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে সেখানে আধার তথ্য সুরক্ষার দায়িত্বে আছে একটি বেসরকারি সংস্থা। নকল ভোটার ধরার নামে সেখানে আধার কার্ড তথ্য ব্যবহার করে যা হয়েছে তা বিপদের চেহারা বুঝতে সাহায্য করে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রাক্তন আমলাদের আশঙ্কা, বহু ভোটারের নাম বাদ দেওয়া হবে আধার তথ্য ভুল বলে।

তাঁরা আদালতের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।

আমাদের মত, গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

এছাড়া রাস্তা নেই।

আদালতের লড়াই চলুক। পাশাপাশি রাস্তাই হোক রাস্তা।

পুনশ্চঃ জাল আধার কার্ড হয়েছে কাদের কাদের নামে? এদের মধ্যে আধার কর্তৃপক্ষের এক বড় কর্তাও আছেন। তার নামে সরকারি টাকাও তোলা হয়ে গেছে।

উত্তরপ্রদেশে একটি চক্র ধরা হয়েছিল, যারা চোখের রেটিনা ও বুড়ো আঙ্গুলের ছাপ হ্যাক করেছে আধার সংস্থা থেকে।

আর এটা তো সবাই জানেন, ১৩ কোটি আধার তথ্য হ্যাক হয়েছে।

১৩১ কোটির হবে না কে বলতে পারে?