আরেক রকম ● দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২২ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

দেনার দায়ে জর্জরিত কৃষকঃ বাড়ছে আত্মহনন


খবরের কাগজে প্রায় প্রতিদিনই কৃষকের আত্মহত্যার খবর প্রকাশিত হয়। টিভি চ্যানেলের খবরে এইসব মৃত্যুর খবর প্রচারিত হয় না। এসব খবরে টিভি চ্যানেলের টিআরপি বাড়ে না। তবে সমাজ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এবং শুধুমাত্র নথিভুক্ত আত্মহত্যার খবরই জানা যায়।

কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে ২০২০-তে মোট ১০ হাজার ৬৭৭ জন আত্মহত্যা করেছেন, যা ভারতের মোট আত্মহত্যার সাত শতাংশ। এদের মধ্যে ৫ হাজার ৫৭৯ জন কৃষক এবং ৫ হাজার ৯৮ জন কৃষি শ্রমিক রয়েছেন। ২০২০-তে আত্মহত্যাকারী ৫ হাজার ৫৭৯ কৃষকের মধ্যে ৫ হাজার ৩৩৫ জন পুরুষ ও ২৪৪ জন নারী। একই সময়ে, একই বছর আত্মহত্যাকারী ৫০৯৮ জন কৃষি শ্রমিকের মধ্যে ৪৬২১ জন পুরুষ এবং ৪৭৭ জন নারী।

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি) জানিয়েছে, ভারতে প্রতি বছর ১ লাখ ৫৩ হাজার ৫২ জন আত্মহত্যা করেন। এনসিআরবি জানিয়েছে, ২০১৬-য় ১১ হাজার ৩৭৯টি কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৭-য় ১০ হাজার ৬৫৫ টি, ২০১৮-য় ১০ হাজার ৩৪৯টি এবং ২০১৯-এ ১০ হাজার ২৮১টি কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছিল।

কৃষি ঋণ পরিশোধ করতে না পারার দুশ্চিন্তায় অবসাদগ্রস্ত হয়েই অনেক কৃষিজীবী মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হন। প্রশাসনের তরফে অবিশ্যি সাধারণভাবে মন্তব্য করা হয় যে পারিবারিক বিবাদ আত্মহত্যার মূল কারণ। প্রশাসন কখনও তলিয়ে দেখতে চায় না কেন কোনো কৃষক ঋণ নিতে বাধ্য হন। এবং কেন তা পরিশোধ করা সম্ভব হয় না।

ধারের টাকায় বীজ সার কীটনাশক ইত্যাদি কিনে ফসল উৎপাদন করা এদেশের প্রচলিত রীতি। উৎপাদিত ফসল বাজারে বিক্রি করে সুদসহ ধারের টাকা ফিরিয়ে দেওয়াই দস্তুর। সাধারণ পরিস্থিতিতে এই নিয়মে তেমন কোনো ব্যতিক্রম হয় না। কিন্তু হঠাৎ করে খরা পরিস্থিতির উদ্ভব হলে অথবা বন্যায় জমিজমা ঘরদুয়ার ভেসে গেলে কৃষকের মাথায় হাত। সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার জন্য আবারও ধার করতে হয়। এইভাবে চক্রাকারে বাড়তে থাকে ধারের অঙ্ক। এদেশের কৃষক এই অবস্থাকে কৃষকজীবনের ভবিতব্য মেনে নিয়ে দারিদ্রকে নিত্যসঙ্গী করে কোনোরকমে বেঁচেবর্তে থাকেন। আগে জমিদার, মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ পাওয়া যেত। এখন আইনত কুশিদজীবী নেই। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক, সমবায় সমিতি সর্বোপরি অসংখ্য মাইক্রোফিনান্স সংস্থা চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে।

এ বছর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। নভেম্বর ডিসেম্বর মাসের তুমুল বর্ষণে ভেসে গেছে কয়েক লক্ষ হেক্টর জমির পাকা ফসল। রাজ্য সরকারের হিসেবে আকস্মিক দুর্যোগের ফলে প্রায় ৪ লক্ষ হেক্টর কৃষি জমি নষ্ট হয়েছে। আলু চাষে ১ লক্ষ ৩৬ হাজার ২৮০ হেক্টর জমি নষ্ট হয়েছে। ৬৯ হাজার ৭১৮ হেক্টর জমির সর্ষের সঙ্গে ধানের ক্ষতি হয়েছে ২ লক্ষ ৩৬ হাজার ৮৩৫ হেক্টর জমি। এত বড়ো ক্ষতির সামাল দেওয়া একা কৃষকের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বিপুল এই ক্ষতির পরও ক্ষতিপূরণ নিয়ে নীরব রাজ্য ও কেন্দ্রীয় প্রশাসন।

এই সুযোগে মাঠে নেমে পড়েছে বিভিন্ন ধরনের মাইক্রোফিনান্স সংস্থা। এদের মধ্যে কতগুলি বৈধ আর কতগুলি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক স্বীকৃত নয় তার খবর পাওয়া মুশকিল। তবুও বিপর্যস্ত মানুষ নিতান্ত বাধ্য হয়েই মাইক্রোফিনান্স সংস্থার দ্বারস্থ হয়।

মাইক্রোফিনান্স সংস্থার কর্মপদ্ধতি আপাতঃ দৃষ্টিতে সহজ সরল হলেও বাস্তবে তা এক বিচিত্র গোলকধাঁধা। এখান থেকে একবার ধার নিলে ঋণচক্রের মধ্যে জড়িয়ে পড়তে হয়। ঋণমুক্ত হওয়া কঠিন।

জরুরি প্রয়োজনে কেউ হয়তো দশ হাজার টাকা মাইক্রোফিনান্স সংস্থার কাছ থেকে ধার নিলেন। সুদের হার বার্ষিক ২৫ শতাংশ। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ্ ইন্ডিয়ার নির্দেশ অনুযায়ী বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক থেকে যে হারে ঋণ নিয়ে মাইক্রোফিনান্স সংস্থা ব্যবসা করে তার উপরে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ সুদের হার ধার্য করা যায়। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি মাইক্রোফিনান্স সংস্থাদের ঋণ দেওয়ার সময় ১২ থেকে ১৫ শতাংশ সুদের হার ধার্য করে। তবে অধিকাংশ মাইক্রোফিনান্স সংস্থা খাতকের কাছ থেকে ১৫-র সঙ্গে ১০ যোগ করে ২৫ শতাংশ হারে সুদ নেয়।

সরল সুদের হিসেবে এক বছর পর ধার নেওয়া ১০ হাজার টাকা আর সুদের আড়াই হাজার টাকা ফিরিয়ে দিলেই ঋণ শোধ হওয়ার কথা। কারণ, ঋণের মেয়াদ এক বছর। বিভিন্ন কারণে হয়তো সময় মতো সুদসহ ঋণ পরিশোধ করা হল না। অসুবিধা নেই। মাইক্রোফিনান্স সংস্থা আবার দুয়ারে হাজির। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ধারের টাকা শোধ না হওয়ায় ওই একই মাইক্রোফিনান্স সংস্থা এবার নতুন করে ২৫ শতাংশ সুদে আরও ১০ হাজার টাকা ঋণ দেয়। তবে নতুন ঋণের ১০ হাজার টাকার পুরোটা খাতকের হাতে পৌঁছবে না। প্রথমবারের আসল ও সুদ বাবদ বকেয়া টাকা কেটে রেখে নতুন ঋণের টাকা দেওয়া হয়। অর্থাৎ আগের ঋণ শোধ হল। কিন্তু নতুন ঋণের বোঝা বাড়ল এবং তা পরিমাণে বেড়ে হল ২০ হাজার টাকা। সেই টাকাও শোধ না হওয়ায় দু-বছরের শেষে একই সংস্থা খাতকের জন্য ৫০ হাজার টাকা ঋণ মঞ্জুর করে। তা থেকেও আগের ঋণের সুদ ও আসল বাবদ প্রাপ্য অর্থ কেটে রেখে বাকি টাকা হাতে দেওয়া হয়। এই ভাবে ঋণের অঙ্ক এক লক্ষে পৌঁছলে এগিয়ে আসে আর একটি মাইক্রোফিনান্স সংস্থা। তারা শুরুতেই এক লক্ষ টাকা ঋণ মঞ্জুর করে। সেই টাকা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়তেই আগের সংস্থা তাদের পাওনা কেটে নেয়। ফলে এক লক্ষ টাকা ধারনিয়েও খাতকের হাত কিন্তু একেবারেই ফাঁকা। উল্টে ঘাড়ে এখন ২৫ শতাংশ সুদে এক লক্ষ টাকা ঋণের বোঝা। নতুন সংস্থা ধারের টাকা বিমা করে নেয়। বিমার প্রিমিয়াম এবং ১৮ শতাংশ হারে জিএসটি-ও খাতকের ধারের অঙ্কের সঙ্গে যোগ হয়।

তবুও সবকিছু জেনে শুনেও কেন এত চড়া সুদে বেসরকারি মাইক্রোফিনান্স সংস্থার কাছ থেকে মানুষ টাকা ধার নিচ্ছেন? প্রথমত, সমবায় সংস্থাগুলির হাতে যথেষ্ট টাকা নেই। ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পেতে গেলে কাগজপত্র আর নিয়মের দাপটে জেরবার হতে হয়। অন্যদিকে, জমি-বাড়ি বন্ধক রাখার মতো কঠোর কোনও শর্ত ছাড়াই দ্রুত লোন দেয় মাইক্রোফিনান্স সংস্থা। কিন্তু চড়া সুদের কারণে বেশিরভাগ পরিবারই ধারের টাকা শোধ করতে না পেরে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে।

গ্রামে গরিব চাষি এবং ক্ষেত মজুর ও ছোটো ব্যবসায়ীদের জন্য সরকারি ঋণের যে পর্যাপ্ত জোগান নেই, সরকারি নথিপত্রেই তার প্রমাণ মেলে। ন্যাশলান ব্যাঙ্ক ফর এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড রুরাল ডেপেলপমেন্ট বা নাবার্ডের হিসাব অনুযায়ী ২০২০-২১ অর্থাৎ গত অর্থবর্ষে গ্রাম বাংলার ঋণের চাহিদা ছিল ১ লক্ষ ৯১ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। যা আগের অর্থবর্ষের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। নাবার্ডের তথ্য অনুযায়ী বাংলায় বিগত পাঁচ বছরে কৃষিতে ঋণের চাহিদা পাঁচগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু চাহিদা ও ঋণের অনুপাতের সর্বভারতীয় গড় যেখানে ৪৬ শতাংশ, সেখানে বাংলায় তা ১৯ শতাংশ মাত্র।

রাজ্যে কৃষিঋণের সবচেয়ে বড় জোগানদার হল রাজ্য সরকার পরিচালিত ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক। তাদের ঋণদানের অঙ্ক থেকেও বোঝা যায় কেন মানুষ বেসরকারি মাইক্রোফিনান্স সংস্থার দিকে ছুটছে।

গত ২০শে ডিসেম্বর রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে অবসর নেওয়ার সময় কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি গিরিশচন্দ্র গুপ্ত রাজ্যের মুখ্যসচিবকে লেখা সুপারিশপত্রে ১৯৪০-এর বেঙ্গল মানি লেন্ডিং আইনের বেশ কিছু পরিবর্তন করার কথা বলেছেন। তার মধ্যে অন্যতম হল, মানি লেন্ডিং আইনের মধ্যে মাইক্রোফিনান্স সংস্থাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। তিনি লিখেছেন, কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ, রাজস্থানের মতো কয়েকটি রাজ্য তাদের মানি লেন্ডিং আইনে মাইক্রোফিনান্স সংস্থাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। রাজ্যের আইনে এই নিদান যুক্ত করা গেলে মাইক্রোফিনান্স সংস্থাগুলি যেমন ব্যবসা করতে পারবে, আবার ঋণ গ্রহীতারা ঋণের জালে জড়িয়ে পড়বেন না। ওই আইনে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ সুদ নেওয়া সম্ভব। এছাড়া আগের ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দু’বারের বেশি ঋণ সরাসরি কোনও সংস্থা দিতে পারবে না। সমবায় বিভাগের অনুমোদন লাগবে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টের অংশ তুলে ধরে তিনি আরও জানিয়েছেন যে মাইক্রোফিনান্স সংস্থাগুলি থেকে ঋণ নেওয়া পরিবারগুলির সুরক্ষার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। নন-ব্যাঙ্কিং ফিনান্স কোম্পানির (এনবিএফসি) জন্য আইনি বাঁধন আছে। কিন্তু মাইক্রোফিনান্স সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের অভাব রয়েছে। যদিও ক্ষুদ্র ঋণের ৭০ শতাংশই এখন মাইক্রোফিনান্স সংস্থাগুলিই দিয়ে থাকে বলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরিসংখ্যান বলছে। পাশাপাশি সমবায় সংস্থাগুলি বহুদিন ধরেই চাষের আগে কৃষকদের চাহিদা মতো ঋণ দিতে পারছে না।

১৯৪০-এ বেঙ্গল মানি লেন্ডিং আইন তৈরির সময় আজকের মতো মাইক্রোফিনান্স সংস্থা ছিল না। তবে অসংগঠিত সুদের ব্যবসা ছিল। স্বাধীনতার পর ব্যাঙ্ককে ওই আইনের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব কার্যকর যায়নি। কারণ ব্যাঙ্ক সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের আইন দ্বারা পরিচালিত হয়। রাজ্য সরকার ব্যাঙ্কের উপর ব্যবসা সংক্রান্ত কোনও আইনি বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে না। তবে ক্ষুদ্র ঋণের বিষয়টি রাজ্য সরকারের অধীন। তাই অনেক রাজ্য মাইক্রোফিনান্স সংস্থাগুলিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা আইন করেছে।

এ যেন প্রচলিত উপকথার বহু প্রসবিনী রুটির কাহিনী। প্রতিদিন সেই রুটির অংশবিশেষ কেটে নিলেও পরের দিন সে আবার পুরোনো আকার ফিরে পায়। মাইক্রোফিনান্স সংস্থা থেকে একবার ধার নিলে প্ৰতি বছরই তা যেন নতুন করে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কৃষক দরদী অনেক প্রকল্প আছে। কিন্তু মাইক্রোফিনান্সের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার মতো কোনো প্রকল্পের রূপরেখা আজ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে রচিত হবে তারও কোনো সম্ভাবনা নজরে পড়েনি। তাহলে পশ্চিম বঙ্গের প্রায় সাড়ে দশ লক্ষ কৃষক যাঁরা বিভিন্ন মাইক্রোফিনান্স সংস্থার থেকে ঋণ নিয়েছেন তাঁদের কি আত্মহনন ছাড়া ঋণমুক্ত হওয়ার অন্য কোনো পথ খোলা নেই?