আরেক রকম ● দশম বর্ষ ঊনবিংশ-বিংশ সংখ্যা ● ১-৩১ অক্টোবর, ২০২২ ● ১৬ আশ্বিন - ১৫ কার্তিক, ১৪২৯
প্রবন্ধ
পাঠ পরিক্রমাঃ ‘ইয়ং বেঙ্গল থেকে কমিউনিস্ট বেঙ্গল’
শুভাশিস মুখোপাধ্যায়
এই বাঙলায় কমিউনিস্ট ঘরানার পরিবারের অভাব নেই। সেইসব বিখ্যাত পরিবারগুলির মধ্যেও দক্ষিণ কলকাতার এই বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার নানা দিক থেকে, বিশেষত মনীষার দিক থেকে বিশিষ্টতার দাবি রাখতে পারে। পরিবারের তিন পুত্র, সুব্রত, সুমন্ত এবং শমীক, পরিবারের পুত্রবধু করুণা-র নাম আজ বাঙলার সারস্বত সমাজে অন্দর বা বাহির, দুই মহলেই সম্ভ্রমের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মজীবনীমূলক ইংরেজি ভাষায় সুবৃহৎ গ্রন্থ, প্রাক-সাতচল্লিশ বাম আন্দোলনের অনেক অজানা তথ্যের আকর। শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাংস্কৃতিক জগতের সব বিভাগে স্বচ্ছন্দগামিতা সর্বত্র স্বীকৃত, আর সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় সেই পঞ্চাশের দশক থেকে বাঙলা এবং ইংরেজিতে অনর্গল লিখে চলেছেন। উনিশ শতক থেকে একবিংশ শতকের বাম সংস্কৃতির বিভিন্ন বিভাগে নির্মোহ বিশেষণ হাজির করে তিনি এই সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক হিসেবে নিজেকে আপন দক্ষতাকেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা তাঁর অজস্র প্রবন্ধ হয়তো অচিরেই বিস্মৃতির গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। তাঁর মূল্যবান প্রবন্ধগুলি থেকে নির্বাচিত কয়েকটিকে (মোট ২৬টি) সংকলিত করার উদ্যোগে নিয়েছেন কলকাতার মান্য প্রকাশনা, 'অনুষ্টুপ', যদিও এক্ষেত্রে সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ নির্বাচনে তাঁরা অনুষ্টুপ ব্যতীত আর মাত্র দুটি পত্রিকায় প্রকাশিত নির্বাচিত কিছু প্রবন্ধ বেছে নিয়েছেন (বর্ণনানুক্রমে 'অনীক' ও 'এক্ষণ')।
বর্ণময় চরিত্রের অধিকারী, উত্তাল এক সময় পাড়ি দেওয়া মানুষ সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সেই এদেশের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে জীবন শুরু করে 'স্টেটসম্যান' পত্রিকার সাংবাদিক হয়ে এ বাংলায় বেশ কিছু বছর কাজ করে পরে পত্রিকার দিল্লি সংস্করণে কাজ করার জন্য দিল্লিতে পাড়ি দেন। তারপর শুরু হয় তাঁর দীর্ঘ প্রবাস জীবন, যার ধারাবাহিকতায় তিনি এখন হায়দ্রাবাদ প্রবাসী। বেশ পরিণত বয়সে তিনি নকশালপন্থী রাজনীতির একজন প্রথম সারির কর্মী ও নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। আজকের দিনের জীবিত প্রবীণ বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই তাঁর একদা কমরেড। বাংলার বাইরে দীর্ঘ প্রবাস তাঁকে বাংলার উৎস থেকে ছিন্ন করেনি। বস্তুত তাঁর গবেষণার গতিমুখ উনিশ শতকের বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের উৎস-সন্ধান, পাশাপাশি বাংলার রাজনীতির ও সংস্কৃতি জগতের গতি-প্রবাহের অভিমুখ নিয়ে সুগভীর আলোচনা।
এই প্রবন্ধ সংকলনটিও সেই ধারার অত্যন্ত সফল একটি মূল্যবান গ্রন্থ। গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধই (‘ইয়ং বেঙ্গল’ থেকে ‘কমিউনিস্ট বেঙ্গল’: বাঙালি বুদ্ধিশীল সমাজে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ঐতিহ্যের বিবর্তন) আলোচনার গভীরতার মূল সুরটি বেঁধে দেয়। সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় যে প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজেছেন, সেগুলি সংক্ষেপে এই রকমঃ ‘‘বামপন্থী আন্দোলন কি সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী বৈপ্লবিক পরিবর্তন ও সমাজ সংস্কারের স্বপ্ন সফল করতে পেরেছে? নাকি, সেই অতীতের আপোশপন্থী ধারা অনুসরণ করে এক নয়া-ঔপনিবেশিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কাছে নতিস্বীকার করেছে?’’ 'ইয়ং বেঙ্গল' গোষ্ঠীর ইতিবাচক দিক সম্পর্কে বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুচিন্তিত ও তথ্য-ভিত্তিক অভিমত - ‘‘...Young Bengal-এর ওই তরুণ বিদ্রোহীরা তাঁদের আলোচনাসভা ও প্রচার অভিযানে যেসব সমস্যা তুলে ধরেছিলেন, তা আজকের বাঙ্গালি সমাজেও (অর্থাৎ সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাঁকুড়ার একটি কলেজে এই ভাষণটি দিচ্ছেন) প্রাসঙ্গিক...’’। পরে তাঁর মন্তব্য, ‘‘ওঁদের পত্রপত্রিকাতে... যেসব সম্পাদকীয় ও তর্ক-বিতর্ক প্রকাশিত হত, তার থেকে বার হয়ে আসে দুটো প্রবণতাঃ এক, তৎকালীন বাঙালি সমাজে কিছু প্রগতিশীল সংস্কারের প্রবর্তন, আর দুই, রাজনীতির ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী আত্ম-নির্ধারণ...’’। আবার তাঁদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, ঐতিহাসিক নথি উদ্ধৃত করে যে, ‘‘স্ব-সমাজভুক্ত মেয়েদের শিক্ষাপ্রাপ্তির অধিকার মেনে নিয়েও এঁরা কিন্তু সেই শিক্ষাপদ্ধতি পিতৃতান্ত্রিক আওতাতেই বেঁধে রাখতে চেয়েছিলেন’’। শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্য একটি সুচিন্তিত মত, ‘‘...সমাজ সংস্কারের বিষয়ে Young Bengal-এর radical বা বৈপ্লবিক চিন্তাধারা অনেকাংশেই সীমাবদ্ধ ছিল অতীতের রক্ষণশীল মূল্যবোধের দ্বারা’’। এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য যে, তাঁদের সময়কালে বাংলা ও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে চলা গ্রামীণ কৃষক বিদ্রোহগুলি যে ইংরাজ রাজত্বের মূল স্তম্ভগুলিকে সজোরে কাঁপিয়ে দিচ্ছে, সেই বিদ্রোহগুলি তাঁদের চোখে পড়েনি। ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর একদা একজন বিখ্যাত প্রতিনিধি, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় ১৮৫৭-র বিদ্রোহ অবদমনে ইংরাজের অবর্ণনীয় অত্যাচার সমর্থন করেন এবং উপঢৌকন হিসেবে রায়বেরিলিতে একটি তালুকের মালিকানা পান! সব দিক বিচার করে শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের পুরো মূল্যায়নের প্রধান কথা যে সমাজে এই আলোড়ন সমাজের প্রগতির দিকেই ধাবিত হয়েছিল।
আবেদন-নিবেদনপন্থী ধারা বা সংবিধানপন্থী ধারা (যার প্রতিনিধি ছিল কংগ্রেস, মুসলিম লিগ, কৃষক প্রজা পার্টি প্রভৃতি), সশস্ত্র আন্দোলনের ধারা (বিভিন্ন বিপ্লবী গোষ্ঠী, যেমন বাঘা যতীন, সূর্য সেন প্রমুখের নেতৃত্বে বিভিন্ন গোষ্ঠী ইত্যাদি) ইত্যাদি পেরিয়ে এসে শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় সাম্যবাদী ধারার আলোচনায় উপনীত হয়েছেন। এই পর্যায়ের আলোচনায় তাঁর কয়েকটি পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করা জরুরি। তিনি বিশ্লেষণের শেষে লিখেছেন, ‘‘...বাঘা যতীন বৈদেশিক সাহায্যের উপর (অর্থাৎ জার্মানি থেকে অস্ত্রের আমদানি) অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিলেন। এক্ষেত্রেও দেখতে পাই সেই Young Bengal-এর এক ধরণের পরনির্ভরশীলতার প্রবণতা। Young Bengal তাঁদের আদর্শবাদের প্রেরণা খুঁজেছিলেন পাশ্চাত্যের Enlightenment-এর দর্শনে। পরবর্তী স্বদেশি বিপ্লবীরা যদিও Young Bengal থেকে অনেক বেশি সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ছিলেন, রণকৌশলের ক্ষেত্রে তাঁরা কিন্তু আর এক বৈদেশিক পাশ্চাত্য শক্তির সহযোগিতার উপর ভরসা রেখেছিলেন।... লক্ষণীয় যে বিদেশি শক্তির উপর এই নির্ভরতা বাঙালি প্রগতিবাদী আন্দোলন ও বিপ্লবী সংগ্রামের ইতিহাসে একটা অবিচ্ছিন্ন ধারা হিসেবে দেখা দিয়েছে। রাসবিহারী বোসের জাপান যাত্রা থেকে শুরু করে, মানবেন্দ্র রায়ের রাশিয়াতে বসে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা, সুভাষ বোসের জার্মানি ও পরে জাপানের সাহায্যে 'আজাদ হিন্দ ফৌজ' গঠন ও পরবর্তী যুগে কমিউনিস্ট আন্দোলনে, মতাদর্শ ও রণকৌশলের ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের উপদেশের প্রতি আনুগত্য - এ এক লম্বা ইতিহাস...’’।
সমসাময়িক কালে ফিরে শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। যেমন, ‘‘...১৯৪৮-৪৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সশস্ত্র রাজনীতি, পঞ্চাশের দশকে সে রাজনীতি পরিত্যাগ করে সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ এবং আজ পর্যন্ত তার অনুশীলন - এ ইতিহাস পরিচিত। এর পাশাপাশি ষাটের দশকে এক বিকল্প radical বা প্রগতিশীল ধারা দেখা দিয়েছিল পশ্চিমবাংলায়, যার সূত্রপাত ১৯৬৭-এর নকশালবাড়ি আন্দোলন থেকে। ...ষাট-সত্তর দশকের নকশালবাদী আন্দোলনের সবচেয়ে বড়ো অবদান কমিউনিস্ট আন্দোলনকে মাটির শিকড়ে ফিরিয়ে আনা... গ্রামের কৃষকের সংগ্রামে প্রত্যাবর্তন। ...বাইরে থেকে আমদানি রণকৌশলের উপর নির্ভরশীলতা, যা অতীতের বাঙালি প্রগতিশীল কর্মপদ্ধতিকে প্রায়শই প্রভাবিত করেছে, নকশালবাদী আন্দোলনেও এই প্রবণতা দেখা দিয়েছিল...।’’ প্রবন্ধের শেষে তাঁর সুচিন্তিত অভিমত, ‘‘Young Bengal-এর সাহসিকতা ও দুর্বলতাই যেন আবার পুনরাবৃত্ত হচ্ছে Communist Bengal-এ।"
সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় যে কেবল 'গম্ভীর' বিষয়ই অবতারণা করেছেন তাঁর প্রবন্ধ সংগ্রহে, তা মোটেই নয়। ‘কালেজিয় কবিতাযুদ্ধ - ছাত্রজীবনে কৌতুক পরিহাস সেকাল ও একাল' প্রবন্ধটি একটি উৎকৃষ্ট হাস্যরসের প্রবন্ধ, কিন্তু তা একেবারেই রাজনীতি-বর্জিত তরল কৌতুক নয়। ছাত্র জীবনের সহপাঠী ও বাছাই মাস্টারমশাইদের নিয়ে রসিকতা এই প্রবন্ধের উপজীব্য হলেও সেখানে সমাজের মেজাজ বদলের একটা আভাস মেলে। যেমন, ‘‘গত দেড়শো বছরের বাঙালি জীবনের ইতিহাসে, ছাত্র রাজনীতি - সেই ‘ইয়ং বেঙ্গল’ থেকে শুরু করে নকশাল আন্দোলন নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। কিন্তু এই রাশভারী রাজনৈতিক স্রোতের পাশাপাশি যে আর-একটা লঘু মেজাজের স্রোত-ও ছাত্র জীবনে আবহমান ছিল, এ কথাটা আমরা অনেক সময়ই ভুলে যাই।’’ এই প্রসঙ্গ আলোচনায় তিনি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবেই বিভিন্ন ছাত্রাবাসে 'Ragging' ও অন্যান্য, তাঁর ভাষায় ‘‘উৎকট ও কুৎসিত কৌতুক ক্রীড়ার নামে নির্যাতনের ঘটনা’’ যে সংকটের রূপ নিয়েছে তা জানাতে ভোলেননি। আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন যে ragging ‘‘আজ বিভেদ সৃষ্টিকারী উপদ্রব হিসেবে দেখা দিয়েছে ছাত্রসমাজে। আর এই উপদ্রবকারীর জুলুমবাজী মদত পাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলি থেকে। কলেজে ও ছাত্রাবাসে ragging-এ এদের হাতেখড়ি, তার পরবর্তী স্তর ঐ দলগুলির ভাড়াটে গুন্ডা হয়ে যথেচ্ছাচারে রত হওয়া - কখনও পরীক্ষায় টোকাটুকির দাবিতে, কখনও ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচনে নিজেদের দলের আধিপত্য বজায় রাখতে, কখনও কলেজে ছাত্রভর্তির ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের ওপরে চাপ দিয়ে নিজেদের দলভুক্ত প্রার্থীদের (অপরিহার্য যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও) ভর্তি করানো।’’ ছাত্র রাজনীতি, আন্দোলন আর এসবের পাশাপাশি ‘‘কালেজিয়’’ ব্যাপার-স্যাপারগুলিও চলতো অবিচ্ছিন্ন ধারায়। সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মায়ের এক কাহিনি শুনিয়েছেন। ১৯৩০ সালে কোনও এক আইন অমান্য আন্দোলনের কালে স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্ররা উল্টোদিকের বেথুন কলেজের সামনে গিয়ে সেই কলেজের ছাত্রীদের উদ্দেশে আহ্বান রাখেন, ‘‘বোনেরা, দিদিরা বার হয়ে আসুন...। ...মা-এর এক সহপাঠিনী... স্কটিশের ছাত্রদলের দিকে একবার তাকিয়েই... হুঙ্কার ছাড়লেন - ‘‘আ মরণ! ছোঁড়ার দোল। যদি বার হতেই হয়, তবে তোদের সঙ্গে বার হব কেন রে?’’
শারদীয়া 'এক্ষণ', ১৩৮৯-এ (১৯৮২) সরোজ দত্ত ও 'শশাঙ্ক' নামে এক ক্ষুরধার বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ লেখেন শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় (আলোচ্য গ্রন্থের ৬ সংখ্যক প্রবন্ধ)। আমরা কী করে ভুলে যাব যে সরোজ দত্ত প্যাট্রিশ লুমুম্বা-র ‘‘আফ্রিকার বুকে একটি সকাল’’-এর অনন্যসাধারণ অনুবাদক, কী করেই বা ভুলে যাব 'ডেকাড্যান্স'-এর সমর্থনে লেখা প্রগতি সাহিত্য শিবিরের লেখকদের বিরুদ্ধে সেই অসাধারণ উচ্চারণ, ‘‘ইন্টেলেকচুয়ালী কুসংসর্গ হইতে বামপন্থীদের সতর্ক হইবার দিন আসিয়াছে’’। শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের সরোজ দত্ত ও 'শশাঙ্ক'-রূপী সরোজ দত্ত সম্পর্কে মূল্যায়নে খোলা তলোয়ারের মতো ঋজু এবং একই সঙ্গে নির্মোহ ও অসূয়া-মুক্ত। তাঁর মত, ‘‘ঊনবিংশ শতাব্দীর তথাকথিত ‘রেনেশাঁস’-এর পুনর্মূলায়ন - ব্যাপক জনসাধারণের তৎকালীন প্রয়োজনের সঙ্গে তার কতখানি যোগাযোগ ছিল, এ নিয়ে আজ যে প্রশ্ন উঠছে, জাতীয় নেতৃত্বের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার আন্তরিকতায় যে সন্দেহ উচ্চারিত হচ্ছে - এই নতুন ইতিহাস চিন্তার পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে বহুলাংশে ‘শশাঙ্ক’র রচনাগুলি ও সমকালীন কালাপাহাড়ি কাণ্ডকারখানা, তাদের মাত্রাধিক্য ও কর্কশ অমিতাচার সত্ত্বেও।’’ শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় এই আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন, তাঁর ছিল এই আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, যে টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে তখন আন্দোলনের এই পর্বটি অতিবাহিত হচ্ছিল, তিনি একাধারে তার অংশ, অন্য দিকে ভেতরে ভেতরে তাঁর সমালোচকও। বহু মানুষ, যাঁরা এই আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন তাঁরা আন্দোলনের এই দিকটির বন্ধুত্বপূর্ণ, কিন্তু তীব্র সমালোচনা করেছেন। এই পার্টির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক নেতা, দীর্ঘদিনের পোড় খাওয়া কমিউনিস্ট কর্মী, শ্রী সুশীতল রায়চৌধুরী, এই মূর্তি-ভাঙ্গা আন্দোলন যখন তার শীর্ষবিন্দুতে, তখনই পার্টির মধ্যে দলিলের মাধ্যমে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দিক থেকে এই মূর্তিভাঙ্গার বিরোধিতা করেছিলেন। অল্প কয়েকটি স্থানে, অল্প কয়েকজনের মূর্তি ভাঙা পড়েছিল। সর্বমোট, কাগজের রিপোর্ট অনুসারে (আনন্দবাজার, যুগান্তর, স্টেটসম্যান, অমৃতবাজার ইত্যাদি কলকাতা-কেন্দ্রিক কাগজগুলি) বিদ্যাসাগর পাঁচটি, রামমোহন দুটি (মতান্তরে একটি), গান্ধী তিনটি, রবীন্দ্রনাথ একটি, বিধান রায় একটি (দুর্গাপুরে)। আর যাঁদের বিরুদ্ধে ‘শশাঙ্ক’ তাঁর শানিত আয়ুধ প্রয়োগ করেছিলেন, যেমন সুভাষচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, তাঁদের মূর্তি অক্ষত ছিল। তৎকালীন নব কংগ্রেসের পক্ষে একটি সূক্ষ্ম প্রচার ছিল যে বেঙ্গল কেমিক্যালের কাছে আচার্যের মূর্তিটি নাকি ভেঙে দেওয়া হয়েছে, অনেকেই যা নিয়ে আজও সামাজিক মাধ্যমে ঝড় তোলেন, কিন্তু তা ঘটনা হিসেবে নির্জলা মিথ্যে। তবে কি সমালোচনা-যোগ্য বা নিন্দার্হ কিছুই ঘটেনি? সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্মোহ স্বীকৃতি, ‘‘...অমিতাচার ঘটেছে অজ্ঞতা ও অস্থিরতা থেকে। ‘মূর্তিভাঙ্গার রাজনীতির প্রচারে অস্থির ‘শশাঙ্ক’ প্রায় অন্ধ পরশুরামের মতো দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে তাঁর কুঠার দ্বারা বাছবিচারহীনভাবে অতীতের সমস্ত মনীষীদের নিধনে উদ্গ্রীব। গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথে কোনো তফাৎ দেখেননি।...’’
‘‘...সরোজ দত্ত ...স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভিযানকে তত্ত্ব দিয়ে রাজনৈতিক অনুমোদন দান করেছিলেন। ঔপনিবেশিক শিক্ষা-সংস্কৃতি ব্যবস্থার ধ্বংসের প্রয়োজনীয়তায় একে এক সাংস্কৃতিক বিপ্লবরূপে তিনি উপস্থাপিত করেছিলেন। কিন্তু এই তাত্ত্বিক উপস্থাপনায় ফাঁকি ছিল...’’। এমন ব্যক্তিত্বকে তিনি মূল্যায়ন করেছেন সরোজ দত্তকেই উদ্ধৃত করে, ‘‘এ আমার দীন লজ্জা, এ আমার উগ্র অহংকার/ নাস্তির নিঃসীম শূন্যে জীবনের উদ্ধত কৌতুক’’।
২০০৫ সালে নেপালের মাওবাদী আন্দোলন যখন সারা পৃথিবীর নজর কেড়েছে, সেই আন্দোলন শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়েরও নজর এড়ায়নি। আন্দোলনের বিভিন্ন দিকের সুবিস্তৃত আলোচনার পর তাঁর সিদ্ধান্ত যে, যে সমাজ-বাস্তবতায় এবং ভৌগোলিক সুবিধার ভিত্তিতে সেই সময়ে নেপালে মাওবাদী আন্দোলনের বৃদ্ধি, সেই সমাজ-বাস্তবতা দ্রুত পরিবর্তনশীল, সরকারও কিছু কিছু উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে শ্রমজীবীদের একাংশকে কিছু সুবিধা দিয়ে আন্দোলনে বিভেদ সৃষ্টি করবে, যা আমরা ভারতের একদা নকশালপন্থী অধ্যুষিত বিভিন্ন অঞ্চলে দেখেছি। নতুন অবস্থার প্রেক্ষিতে তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল, ‘‘ভৌগোলিক সংস্থান-নির্ভরশীল রাজনীতিকে ঢেলে সাজাতে হবে ও নতুন রণকৌশলের কথা ভাবতে হবে’’। পেছন ফিরে তাকালে, বর্তমান প্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্তের সারবত্তা আমাদের চমৎকৃত করে।
ধর্মান্ধতা ও মতান্ধ বাম আদর্শ নিয়ে শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় অনেকদিন থেকেই সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করে চলেছেন। এই সংকলনে নয় নয় করে আটটি প্রবন্ধে এই দুই সমস্যার নানা দিক নিয়ে তিনি সুবিস্তৃত আলোচনা করেছেন। ‘বার্লিন’ বনাম ‘তারকেশ্বর’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘‘সাধারণ স্তরে যে-কোনো বর্তমান সংকটের সম্মুখীন হলেই ‘আগের যুগ এ-যুগের থেকে ভালো’ ধরনের যে মনোভাব, সেটাই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ...আমাদের দেশেও রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে ইদানিংকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিদ্রোহ (পাঞ্জাব ও কাশ্মীরে) সংগঠিত হচ্ছে ধর্মীয় মৌলবাদের ছত্রতলে।’’ অনেক আলোচনার পর তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘তারকেশ্বর ও তার বিশ্বব্যাপী নানা প্রতিমূর্তি - তা ভ্যাটিকানই হোক বা মেক্কাই হোক - কি আমাদের ভাগ্যবিধাতা হবে? আশা করি নয়।’’
"ভারতবর্ষের মোদীকরণ ও পশ্চিমবঙ্গের মমতায়ন" নামক প্রবন্ধে তিনি এই দুই প্রক্রিয়ার মর্মবস্তু নিপুণ হাতে বেপর্দা করেছেন। রাজনৈতিক অর্থনীতি ও প্রায়োগিক রাজনীতি, এই দুই দিক বিচার করে তাঁর সিদ্ধান্ত, ’’জাতীয় স্তরে ‘মোদীকরণ’ ও পশ্চিমবঙ্গে ‘মমতায়ন’ (উভয়ে অনেকাংশে অনুরূপ) শুধুমাত্র বামপন্থীদের সামনে এক বিপজ্জনক ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসাবে আসেনি, সারা দেশে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সামনে এক অমঙ্গলের ভবিষ্যৎ পূর্বাভাষ। ঐক্যবদ্ধভাবে সর্বস্তরে এর বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলা আশু প্রয়োজন।’’
‘বাঙলা প্রগতিশীল সাহিত্যঃ দুই যুগের খতিয়ান’ এক অসাধারণ প্রগতি-সাহিত্য-ইতিহাস চর্চা। বাঙলার প্রগতি সাহিত্যের নানা সময়ের নানা দিক জীবন্তভাবে এই লেখায় ফুটে উঠেছে। গোলাম কুদ্দুসের তেভাগা আন্দোলনের স্মৃতিচারণমূলক লেখা দিয়ে শুরু করে শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় পৌঁছন বসাই টুডুতে, যিনি তাঁর নেতাকে বলেন, ‘‘এত ভাল লোক তুমু, তুমুও বাবু হয়্যে বাবুরে মদত দাও...’’। শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে ১৯৪৯-এ বেআইনি কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ভবানী সেন, 'রবীন্দ্র গুপ্ত' ছদ্মনামে সাহিত্য সমালোচনার এক ধারার জন্ম দেন। এইসব লেখায় তিনি ও অন্যান্যরা সব সাহিত্যিকদের এক সারিতে ফেলে ‘‘একই মোটা তুলির ছোপে’’ দেগে দেন ‘বুর্জোয়া-প্রতিক্রিয়াশীল’ বলে। সেই একই প্রবণতা তিনি ‘শশাঙ্ক’র মধ্যে দেখতে পান সত্তর দশকে।
এই সঙ্কলনের শেষ প্রবন্ধটি অধ্যাপিকা মালিনী ভট্টাচার্যের একটি লেখার সমালোচনা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল, ‘রাজনৈতিক কবিতায় ভাবাবেগ’। অধাপিকা ভট্টাচার্যের একট অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল বামপন্থী কবিতায় ‘আঙ্গিক শৈথিল্য’, ‘বিশেষণমূলক ভঙ্গীর অভাব’ প্রকট। শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সমালোচনায় সঙ্গততভাবেই প্রশ্ন তুলেছেন, "দেশে ও বিদেশে, অতীতে ও বর্তমানে, যে-কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন-সমর্থক কবি-সাহিত্যিকদের অধিকাংশেরই এই ‘বৈশিষ্ট্য’ বিদ্যমান।" এই প্রেক্ষিতে তিনি একটি অতি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তুলেছেন। ‘‘আমাদের দেশের শিক্ষিত বামপন্থী পাঠক ও সমালোচক পাবলো নেরুদার 'The Heights of Macchu Picchu' পড়তে গিয়ে Inca সভ্যতার ইতিহাস ঘাঁটেন কবিতায় উল্লিখিত কোনো দুরূহ বিষয়ের অর্থোদ্ধার করতে।... Mayakovoski-র কবিতার উচ্চনিনাদের স্লোগানধর্মী স্তবকগুলি ...কবিতা বিচারের প্রচলিত মানদণ্ডে গ্রহণীয় না হলেও, আমরা মার্জনা করি বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার কর্মোদ্যম ও নতুন সমাজ গঠনের যুগান্তকারী প্রয়াসের কথা স্মরণে রেখে। ...বিদেশি কবিদের বুঝবার জন্য আমরা যতটা বিচার-বিবেচনা করি, যতটা যত্নসহকারে সমসাময়িক ইতিহাস অনুশীলন করি, যতটা কষ্ট করে নানা ঐতিহাসিক তথ্য ঘাঁটাঘাঁটি করি - তার এক সিকি ভাগও কি প্রাপ্য নয় সেই সব অখ্যাত কবিদের ভাগ্যে, যাঁরা আমাদের দেশে, এই যুগেই একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বসে কবিতা লিখছেন?’’
৩৩৫ পৃষ্ঠার বইটিতে যে বিপুল পরিমাণ প্রবন্ধ বিভিন্ন বিষয়ে সংকলিত হয়েছে, আপাতদৃষ্টিতে সেই বিন্যাসকে খানিকটা এলোমেলো মনে হতে পারে। সম্পাদক এই বিষয়ে সচেতন ছিলেন বলেই তিনি তাঁর মুখবন্ধে একটি কৈফিয়ত যোগ করেছেন। সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত সেই পঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকে, কমিউনিস্ট ঘরানার প্রায় প্রতিটি পর্বের সঙ্গে তাঁর ছিল নাড়ীর যোগ, কাজও করেছেন পার্টির বিভিন্ন বিভাগে, কারাবরণ করেছেন কমিউনিস্ট হিসেবে, দান ছেড়ে ময়দান ত্যাগ করেননি। বর্তমানে দেশে যে ক'জন জীবিত প্রবীণ কমিউনিস্টদের আমরা স্মরণ করতে পারবো, সেই তালিকায় খুব ওপরের দিকেই সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্থান মিলবে (তাঁর জন্ম ১৯৩৬ সালে)। তিনি গত ছয় দশকের ওপর অক্লান্তভাবে লিখে চলেছেন। এই সংকলনে তাঁর চিন্তার প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিফলন ঘটেছে।
________________________________________
ইয়ং বেঙ্গল থেকে কমিউনিস্ট বেঙ্গল
প্ৰবন্ধ সংকলন
সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
অনুষ্টুপ প্রকাশনী
জানুয়ারি, ২০২২
মূল্যঃ ৪৮০ টাকা