আরেক রকম ● দশম বর্ষ ঊনবিংশ-বিংশ সংখ্যা ● ১-৩১ অক্টোবর, ২০২২ ● ১৬ আশ্বিন - ১৫ কার্তিক, ১৪২৯

প্রবন্ধ

মাহশা আমিনির স্ফূলিঙ্গ

মালবী গুপ্ত


কোনো কোনো সময় এক জন ব্যক্তির মৃত্যু তাঁর জীবৎকালীন সমস্ত ক্ষমতা বা শক্তিকে ছাপিয়ে যেতে পারে। যে শক্তি থেকে জন্ম নেওয়া বিক্ষোভ-প্রতিবাদের আগুন, তার উৎস স্থল থেকে ছড়িয়ে গিয়ে চরাচর জুড়ে ব্যাপ্ত হতে পারে। এবং সেই আগুনে-প্রতিবাদের বজ্র মুষ্ঠি যে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারে মানব অধিকার হরণের তাবৎ ‘আইনি’ শৃঙ্খল - ইসলামিক প্রজাতান্ত্রিক ইরান যেন সেই সত্যকেই এখন প্রত্যক্ষ করছে।

‘নো টু হিজাব’, ‘ওয়াকিং আনভেইল্ড’, ইরানি মেয়েদের দৃপ্ত কন্ঠের এই বজ্রনির্ঘোষ এখন ইরানের পথে ঘাটে, আকাশ বাতাসে।সেই নির্ঘোষইরানের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে কড়া নাড়ছে। দখল করে নিচ্ছেতাবৎ সমাজ মাধ্যম।কারণ সঠিক ভাবে হিজাব (মাথা ঢাকা রাখার কাপড় বা চাদর) না পরার অপরাধে তেহরানের রাজপথে যে ২২ বছরের কুর্দি তরুণী মাহশা আমিনির ওপর নীতি পুলিশের হামলা, গ্রেফতার ও পুলিশি হেফাজতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে, তার অভিঘাতে গোটা ইরান এখন জ্বলছে।

এই লেখার সময় পর্যন্ত ইরানের ৮০ টিরও বেশি শহর বিক্ষোভের আগুনে পুড়ছে।পুড়ছে, কারণ মৃতা আমিনির পাশে একে একে তরুণী হাদিস নাজাফি, কিশোরী নিকা শাকারামিদের মতো হিজাব বিরোধী আন্দোলনকর্মীদের নাম যোগ হচ্ছে। এবং ইরানের নিরাপত্তা রক্ষীরা ক্রমেই সেই হত্যার তালিকাকে দীর্ঘ করে চলেছে। ইতিমধ্যেই সেখানে দেড়শ’রও বেশি মানুষের প্রাণ গেছে। গ্রেফতার করা হয়েছে সাংবাদিক সহ কয়েক’শ বিক্ষোভকারীকে।

ইরানে সেই প্রতিবাদ বিক্ষোভের কাল এক মাস অতিক্রান্ত।কিন্তু হাজার দমন পীড়নেও সেখানকার পরিস্থিতি ইরান সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।বরং উত্তরোত্তর তীব্রতর হচ্ছে সেই বিক্ষোভ।সমাজের সব স্তরের মানুষ তাতে অংশ নিচ্ছেন। এমনকি ইরানের রাস্তায় নেমে আসা ছাত্রছাত্রীদের কন্ঠ থেকে প্রবল আওয়াজ উঠেছে‘ডেথ টু দ্য ডিক্টেটর’, ‘উইমেন, লাইফ, ফ্রিডম’, ইত্যাদি স্লোগান।যে স্লোগানে ইরানের বাতাস ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে।

সত্য যে, হিজাব পরিধানের বিরুদ্ধে ইরানে আগেও প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু মাহশা আমিনির মৃত্যু তাকে যে মাত্রা দিয়েছে তা এক কথায় অভূতপূর্ব।তেহরানের নীতি পুলিশ ১৩ সেপ্টেম্বর মাহশা আমিনিকে তাদের ভ্যানে তুলে নেয়।প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, গাড়িতে তাঁর মাথা ঠুকে দেওয়া হয়।গাড়ির মধ্যেই প্রবল লাঠি পেটা করা হয় তাঁকে। পরে তিনি কোমায় চলে যান।তিন দিন পর ১৬ সেপ্টেম্বর আমিনির মৃত্যু হয়। ইরানের পুলিশ অবশ্য অন্য অসুখের কারণে আমিনির হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে। কিন্তু তত ক্ষণে হিজাবের কারণেই যে পুলিশি অত্যাচারে, পুলিশি হেফাজতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে, সেই বার্তা প্রায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।

এবং সেই অনলের তীব্রতা এতটাই যে, নারী পুরুষ নির্বিশেষেপ্রশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ইরানেররাস্তায় রাস্তায় নেমে এসেছেন। মেয়েরা পথে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁদের হিজাব। প্রতিবাদে চুল কেটে ছোট করে ফেলছেন। আর সমাজ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে সেই বিক্ষোভ ছবি। এবং হিজাব বিরোধী বিক্ষোভ আন্দোলন ক্রমেই সরকার বিরোধী আন্দোলনের রূপ নিয়ে নিচ্ছে।

কখনো আন্দোলনে যোগদানকারী নাজাফির মতো প্রতিবাদীদের বুলেটে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হচ্ছে। কখনো বা ১৬ বছরের কিশোরী নিকার অপহরণ ও হত্যা করে গোপনে কবর দিয়ে দেওয়ার মতো মর্মান্তিক ঘটনাঘটছে। যার বিরুদ্ধে স্কুলের ছাত্রীরাও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে।

অবশ্য এই প্রথম যে ইরানের মেয়েরা হিজাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছেন, পথে নামছেন এমনটা নয়। এমনও নয় যে, হিজাব ঠিক ঠাক না পরার অপরাধে সেখানকার মেয়েদের ওপর এই প্রথম আঘাত নেমে আসছে।বরং ইরানে বাধ্যতামূলক হিজাব বিরোধী প্রতিবাদে ২০১৪ থেকে ২০১৯, গত কয়েক বছর ধরেই মেয়েরা প্রচার চালিয়েছেন। পথে নেমেছেন। পুরুষরাও সেই প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন।এবং ইরানে নারী অধিকার রক্ষাকর্মী সহ হিজাব প্রতিবাদকারীদের ওপর যে নীতি পুলিশের হামলা, জরিমানা, গ্রেফতার ও তাঁদের হাজতবাস চলেছে, বার বারই সে খবর সংবাদ মাধ্যমে উঠে এসেছে।

এবং গত ১২ জুলাই ইরানের ‘ন্যাশনাল হিজাব অ্যান্ড চেস্টিটি ডে’র প্রতিবাদে কী ভাবে ইরানি মহিলারা মাথার হিজাব খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন।নীতি পুলিশের উদ্যত লাঠি উপেক্ষা করে বহু সাহসিনী হিজাব ছাড়াই গণ পরিবহণে, দোকানে রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছেন - সেই ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সমাজ মাধ্যমে। তবে পুলিশি হেফাজতে মাহশা আমিনির মৃত্যু ইসলামিক প্রজাতান্ত্রিক ইরানের শহরে শহরে, এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামেও বিক্ষোভকে যেভাবে ত্বরান্বিত করেছে, এমনটা আগে কখনও হয়নি।

এবং সে আগুন যে নেভানো কঠিন হয়ে উঠবে, এমনকি ইরান সরকার আদৌ তা নেভাতে পারবে কিনা সেই সন্দেহের অবকাশ থেকে যাচ্ছে। আশ্চর্য যে, গত তিরিশের দশকে শাহ’র নির্দেশে এই ইরানে মেয়েদের নিকাব ও হিজাব পরা নিষিদ্ধ হয়েছিল। কেউ পরলে তা জোর করে খুলে দেওয়া হত। সেই ইরানেই ১৯৭৯-তে ইসলামিক বিপ্লবের পর চালু হওয়া শরিয়া আইন মেনে মেয়েদের ওই একই পোশাক পরা বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে। এবং হিজাব পরার নির্দেশ অমান্য করা হলে প্রকাশ্যে ৭৪ বার বেত মারা, ৬০ দিনের হাজতবাসের শাস্তি ধার্য হয়।এমনকি ইরানি মেয়েদের জন্য বিয়ের আগে সতিত্বের পরীক্ষা দেওয়ার মতো বর্বরোচিত নিদানও দেওয়া হয়।

আসলে কোনো রাষ্ট্রযন্ত্র যখন মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে,গায়ের জোরে কিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যা, তার চলা ফেরা, মেলা মেশা, আচার আচরণের স্বধীনতা কেড়ে নেয় - তার ফল শেষ বিচারে যে কখনোই ভাল হয় না।বরং অনেক সময় তা বুমেরাং হয়ে সেই রাষ্ট্রের পতন ডেকে আনে ইতিহাসে তার বহু নজির ছড়িয়ে আছে। তাই বোধহয় যাঁরা হিজাব পরতে চান, কোথাও তা নিষিদ্ধ হলে তা পরার অধিকারের দাবিতে সেখানে প্রতিবাদ সংঘটিত হয়।আবার কোথাও হিজাব পরা বাধ্যতামূলক হওয়ায় তা না পরার অধিকারের দাবিতে মেয়েরা জীবনকে তুড়ি মেরেও পথে নেমে পড়েন। ঠিক যেমনটা ঘটছে ইরানে।

কারণ যে বিপ্লব-পূর্ব ইরানেএকদা মেয়েরা চলাফেরায়, সাজ পোশাকে, আচার আচরণে বিপুল স্বাধীনতা ভোগ করেছেন।যাঁরা জিনস, মিনিস্কার্ট ’র মতো আধুনিক পশ্চিমি বেশ-ভুষায় অভ্যস্ত ছিলেন। বিপ্লবোত্তর সেই ইরানেই এমন জুতো, পোশাক না পরা, এমন সাজগোজ না করা, যাতে পুরুষের উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে পারে ইত্যাদি, এই ধরনের সরকারি অযুত নিষেধ আরোপিত হতে থাকে।যা অমান্য করলেই শাস্তির খাড়া নেমে আসে।এবং নীতি পুলিশের কড়া নজরদারিতে সেই দমবন্ধ করা পরিস্থিতির মধ্যে চলতে চলতে এক সময় ইরানি মেয়েদেরজীবনে সমস্ত ধৈর্যর বাঁধ যেন ভেঙে যায়।

বস্তুত পদে পদে মেয়েদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া নানা বিধি নিষেধ, যুগ যুগ ধরে ইরানি শাসকদের স্বৈরাচারী আচরণ, দারিদ্র, দুর্নীতি - সব মিলিয়ে সমগ্র ইরানি সমাজ যেনক্রমশইঅগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছিল।তার ওপরহিজাব ছাড়া মেয়েদের জনসমক্ষে বেরনো, স্কুল, কলেজ, কর্মক্ষেত্র ইত্যাদি সর্বত্রইতাদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়।মেয়েদের প্রতি রাষ্ট্রের এই সংঘটিত হিংসা যেভাবে বিগত কয়েক দশক ধরে ইরানি মেয়েদের সমস্ত স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারগুলিচরম নিষ্ঠুরতায় কেড়ে নিতে থাকে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে সমগ্র ইরানি সমাজ যেন আজ তার বিরুদ্ধেই জেহাদ ঘোষণা করেছে।

তাই এত দিন যে যন্ত্রণা, যে অসম্মান, যে অপমানের ধিকি ধিকি আগুন বুকের ভেতর জ্বলছিল, মৃতা মাহশা আমিনি যেন ইরানি সমাজের সেই আগুনকেই বাইরে মুক্তি দিয়েছেন। এবং নিজে তার স্ফূলিঙ্গ হয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছেন।জানতে পারছি, আমিনি স্ফূলিঙ্গ এখন ইরানের কুর্দিশ শহর সানন্দাজে ও অয়েল ইন্ডাস্ট্রির দরজায় দরজায় পৌঁছে যাচ্ছে। বুশেহর ও দামাবন্দ পেট্রোকেমিকেল প্লান্টের ১০০০’রও বেশি কর্মী ষ্ট্রাইকে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। তাঁদের ‘ডেথ টু দ্য ডিক্টেটর’ স্লোগানের নীচে চাপা পড়ে যাচ্ছে নিপত্তারক্ষীদের বুলেটের শব্দ।মনে হচ্ছে,সরকারি যাবতীয় দমন পীড়ন অত্যাচার ও মৃত্যু-ভয় উপেক্ষা করে হিজাব বিরোধী বিক্ষোভ - আন্দোলনে সমস্ত ইরান যেন উত্তাল হয়ে উঠেছে।আর সেই আন্দোলনে বিপুল শক্তি যোগাচ্ছেনমৃতা মাহশা আমিনির স্ফূলিঙ্গ। কে জানে, হয়তো সেই শক্তিতে ভর করেই এক নতুন দিগন্তের দিকে যাত্রা শুরু করছে ইরান।