আরেক রকম ● দশম বর্ষ ঊনবিংশ-বিংশ সংখ্যা ● ১-৩১ অক্টোবর, ২০২২ ● ১৬ আশ্বিন - ১৫ কার্তিক, ১৪২৯

প্রবন্ধ

মা চপ দাও তেলেভাজা দাও ঘুগনি দাও

অর্ধেন্দু সেন


মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা দায়িত্ব রাজ্যের যুবক যুবতীদের চাকরির ব্যবস্থা করা। তার জন্য তিনি আয়োজনের ত্রুটি রাখেননি। বছর বছর 'বিশ্ব বাংলা সম্মেলন'-এ দেশ বিদেশের শিল্পপতিদের সমাবেশ হয়। এই সমাবেশকে বর্ণাঢ্য এবং স্মরণীয় করে তুলতে রাজ্য সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করে। জাঁকজমকের অভাব হয় না। সমাবেশের শেষ লগ্নে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন শিল্পপতিরা কতো লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবেন আর তার ফলে কতো লক্ষ চাকরি হবে। প্রথম বছর তিনি বললেন চুরাশি হাজার কোটি টাকার কথা। বুঝলাম একেই বলে পরিবর্তন। হাজার চুরাশির রাজ্যে আসবে চুরাশি হাজার!

বার্ষিক বিনিয়োগের পরিমাণ ক্রমে বাড়ল। একদিন সেটা দুই লক্ষ কোটি ছাড়িয়ে গেল। তাতে হল উলটো বিপদ। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলল এতো বিনিয়োগ হচ্ছে চাকরি হচ্ছে না কেন? ধরে নেওয়া যায় কলকাতা এবং সংলগ্ন অঞ্চলেই চাকরি হবে বেশি। তবুও জেলায় জেলায় দুই তিন লাখ তো হবে? পঞ্চায়েত সমিতি প্রতি কুড়ি তিরিশ হাজার? কোথাও তো কেউ বলে না সে চাকরি পেয়েছে। দিদির ব্লাইন্ড সাপোর্টারের মনে অন্য প্রশ্ন। এত চাকরি হল অথচ আমি পেলাম না? সেও কিছুটা ক্ষুব্ধ।

দিদিকে তখন বাধ্য হয়েই বলতে হল এই চাকরি নির্ভরতা বাঙালির চরিত্রদোষ। অন্য কোনও রাজ্যে চাকরি নিয়ে এত হাহাকার নেই। যারা চাকরি পায়না তারা ঠিক কোনও ধান্দা জোগাড় করে নেয়। বাড়িতে বসে অন্ন ধ্বংস করে না। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ক্যারাম পেটায় না। আর সর্বোপরি নিজের দোষ সরকারের ঘাড়ে চাপায় না। এতদিন যাদের ভালোবেসেছেন তাদের উপর একটু রেগেই গেলেন দিদি। অপ্রিয় হবার ঝুঁকি নিয়ে তাদের উপদেশ দিলেন তেলেভাজার দোকান দিতে। মনে করিয়ে দিলেন তেলেভাজা বিক্রি করে কোটি টাকা আয় করা যায়। তিনতলা বাড়ি করা যায়। কথাটা উনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেই বলেছিলেন। দলনেত্রী হিসেবে নয়। সরকার কিন্তু সেই কথার কোনও মূল্য দিল না। তেলেভাজার ব্যবসা করতে ইচ্ছুক ছেলেমেয়েদের সাহায্য করতে কোনও সরকারি স্কিম তৈরি হল না। মুখ্যমন্ত্রী নিজে কারও হাতে কোনও ফুটপাথে ছয় ফুট বাই ছয় ফুট জায়গার পাট্টা তুলে দিলেন না। মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শ কতজন গ্রহণ করল তাদের মধ্যে কতজন কতটা প্রতিষ্ঠা পেল সরকার তার হিসেব রেখেছে কিনা সন্দেহ।

তাই একটু অবাক হলাম যখন উনি আবার বললেন স্বনির্ভর হবার কথা। এবার তেলেভাজা নয়। এবার বললেন চা আর ঘুগনির কথা। সেও বাঙ্গালির প্রিয় তাতে সন্দেহ নেই। বললেন এক হাজার টাকায় একটা কেটলি কিনতে। মাকে বলতে ঘুগনি করে দিতে। এত ডিমান্ড হবে যে দিয়ে শেষ করা যাবে না। কথাটা পুজোর মুখে বলাতে অনেকেই মনে করলেন উনি সম্ভবত পুজো প্যান্ডেলেই ঘুগনি বিক্রির কথা ভেবেছেন। প্রতিটি পুজো কমিটিকে নির্দেশ দেওয়া যেত তাদের অনুদানের পুরোটা সেফ ড্রাইভে খরচ না করে পাঁচটা করে কেটলি কিনে দিতে। তা কিন্তু করা হল না। একটা স্কিমের পয়সায় অন্য স্কিমকে উৎসাহ দেওয়াকে সরকারি ভাষায় বলে 'কনভারজেন্স'। এর একটা ভালো সুযোগ ছিল।

মুখ্যমন্ত্রী কি ইলেকট্রিকের কেটলির কথা ভেবেছেন? সরকারিভাবে কোনও ব্যাখ্যা এখনও আসেনি। এখানেও কনভারজেন্সের ব্যাপক সুযোগ কারণ পুজো কমিটি বিদ্যুৎ পাবে বিনি পয়সায়। এলপিজির যা আকাশছোঁয়া দাম হয়েছে তাতে চায়ের ভাঁড় আর লেড়ি বিস্কুট গিয়ে দাঁড়াবে দশ টাকায়। বিক্রি তো কম হবেই। উপরন্তু এলপিজি ব্যবহার করলে আইনত প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে প্রধানমন্ত্রীর ছবি টাঙাতে হবে। সেটা অনেকের পছন্দ নাও হতে পারে।

পরিকল্পনার অভাবে রাজ্যে শিল্পের সম্ভাবনা কিভাবে তৈরি হয়েও নষ্ট হচ্ছে দেখুন। 'সবুজ সাথি'র কথা এখন আর শোনা যায় না। এককালে এটা ছিল মমতার ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প। অমিত মিত্র তখন স্বপ্ন দেখেছিলেন রাজ্যে সাইকেলের কারখানা স্থাপন করার। সত্যিই তো। প্রতি বছর রাজ্য সরকার কয়েক লক্ষ সাইকেল কেনার গ্যারান্টি দিলে বড় বড় ব্র্যান্ড ভিড় করবে রাজ্যে সাইকেল নির্মাণ করতে। সরকারের সমস্যা হবে কাকে বাদ দিয়ে কাকে রাখবে। কার্যত কি হল? কেউ এল না।

অর্পিতার বিভিন্ন ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে যখন কোটি কোটি টাকা পাওয়া যাচ্ছিল একটু আশা জেগেছিল যে নোট গোনার মেশিনের যথেষ্ট চাহিদা হবে। বাংলার মেশিনেই গোনা হবে বাংলার নোট। সে আশা ত্যাগ করতে হল কারণ কোনও এক অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলনে ইডির তৎপরতা এখন স্তিমিত। বছরে দেড় দুই লাখ ইলেকট্রিক কেটলির বাজার তৈরি থাকলে ফিলিপস্, বাজাজ ইত্যাদি কোম্পানির সঙ্গে নিশ্চয়ই কথা বলা যায়। মিত্র মহাশয় অসুস্থ। কে করবে এই কাজ?

বেগতিক দেখে দিদি তাই দুটো প্রকল্পে জোর দিয়েছেন। এক দেউচা পাচামি। দুই তাজপুরের বন্দর। বীরভূম জেলার দেউচা পাচামি এশিয়ার বৃহত্তম কয়লা খনি। যুগ যুগ ধরে এই খনি অহল্যার মতো সুপ্ত ছিল। মমতার স্পর্শে এখন জেগে উঠেছে। তোড়জোড় চলছে খনি চালু করার। কিছু প্রযুক্তিগত সমস্যা আছে বটে। তবে মুখ্যমন্ত্রী তাতে দমে যাবার পাত্রী নন। এই খনি থেকে বছরে চার কোটি টন পর্যন্ত কয়লা তোলা যাবে। মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন খনিতে এক লক্ষ চাকরি হবে। এই অনুপাতে কোল ইন্ডিয়ায় চাকরি হওয়া উচিত ছিল কুড়ি লক্ষ। তা তো হয়নি। কিন্তু চাকরির আধার খনি না খনির আধার চাকরি সে প্রশ্নে গিয়ে কি লাভ! সে তুলনায় তাজপুর বন্দর ছোটো প্রকল্প। প্রত্যক্ষ চাকরি হবে মাত্র তিরিশ হাজার। এই বন্দর প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী ডানকুনির সঙ্গে উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের রেল যোগাযোগের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তার মানে বাংলার উন্নয়ন না হলেও তাজপুরের বন্দর ঠিক চলবে। গৌতম আদানিও বন্দরের দায়িত্ব নিয়েছেন নিশ্চিন্তে।

বকরূপী ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করেছিলেন মনুষ্যের কোন আচরণ সবচেয়ে বিস্ময়কর? যুধিষ্ঠির বলেছিলেন মানুষ অভিজ্ঞতায় জানে নেতা-নেত্রীদের আশ্বাসবচন কতোটা অসার। তবুও তারা মনে করে এবার হয়তো কাজ হবে। নেতা-নেত্রীরাও শিখে যান মানুষকে ভুলিয়ে রাখার বুলি। মোদী তাঁর নির্বাচনী প্রচারে বলেছিলেন বছরে দুই কোটি চাকরি দেবেন। বস্তুত বেকারি ক্রমাগত বেড়ে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। আজকের দিনে পাঁচশো পোস্টের বিজ্ঞাপন দিন আপনি তিন লক্ষ আবেদন পাবেন। অথচ শাসকের বিরুদ্ধে কারও কোনও ক্ষোভ দেখা যাবে না। এও কি এক নয়া উদারপন্থা!

বাংলায় শিল্প নেই তাই চাকরির সুযোগ কম। স্কুলে কলেজে কিন্তু অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকার নিয়োগ হয়েছে। লক্ষ লক্ষ নয় তবে হাজার হাজার। সুযোগ ছিল এই নিয়োগ চালিয়ে যাবার। শাসক দলের সীমাহীন দুর্নীতির জন্য এই প্রক্রিয়া এখন স্তব্ধ। মমতা অনেকদিন হল বলছেন, তিনি যখনই চাকরি দিতে চান বিরোধীরা আদালতে গিয়ে সে প্রচেষ্টা বানচাল করে দেয়। এতদিন বাঙালি সেকথা মেনে নিয়েছে। নোটের পাহাড় দেখার পর কিন্তু কেউ তাঁর কথা মানতে চাইছে না। ঘুগনিমঙ্গল কাব্য রচনার পিছনে সেও একটা বড় কারণ!

মমতা চান নূতন যুগের ভোরে বাঙালি নিজেকে নূতন ভাবে তৈরি করে নেবে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা উকিল হতেই হবে সেদিন আর নেই। মমতার সেরা পঞ্চাশের সংগ্রহে একটি মেয়ের গল্প আছে, যে অঙ্ক পারত না বলে ইশকুলে খারাপ রেজাল্ট করত। স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের সুযোগ নিয়ে সে ফ্যাশান টেকনোলজি শেখে। সে এখন দিব্যি আমেরিকার এক হোটেলে রিসেপশনিস্টের চাকরি করছে। এই দৃষ্টান্ত যদি আমাদের ছেলেমেয়েদের অনুপ্রেরণা না দেয় তাহলে মমতাই বা কী করবেন?

হবে। সবার চাকরি হবে। একটা কথা মাথায় রাখতে হবে। চাকরি পার্মানেন্ট হবে না। প্রাইভেট সেক্টরে কোনোদিনই পার্মানেন্ট ছিল না। সরকারও এখন সে মন্ত্র শিখেছে। মাইনে দিলেই ডিএ দিতে হবে। আন্দোলনের অধিকার দিতে হবে। বন্ধের দিন ছুটি দিতে হবে। ওসব ভুলে যান। দিদিকে দুর্বল ভাববেন না। মোদী আরএসএস তো সঙ্গে ছিলই। এখন স্বয়ং আদানি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।